এক
টেবিলের উপর ঠক করে চায়ের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে ইমন পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াতে লাগলো। দেশলাইটা কোথায় যে রেখেছে? গ্যাস লাইটার ব্যবহার করে না দেশলাই বাক্সের একটা ঐতিহ্য আছে অন্তত তাই মনে হয়। কুড়ি বছর বয়স থেকে সিগারেট ধরেছে, এখন চল্লিশ। কুড়িতেই ব্যবসাটা শুরু করেছিল। প্রথম প্রথম বড়বাজার থেকে মাল কিনে মফস্বলের দোকানের সাপ্লাই দিত। সামান্য পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিল। পুঁজিটা মা-ই হাতে তুলে দিয়েছিল। গ্রামের বাড়ির চারটে তালগাছ আর দুটো শিরিষ গাছ বিক্রি করে হাজার দুই টাকা হয়েছিল। এখন ব্যবসাটা ফলাও হয়ে কলকাতা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ইমন এখন বেশ কয়েকটা কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটর। স্বচ্ছল সংসার। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে সুখী ইমন। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে তার দাম্পত্য গতানুগতিক তবু একটা দৃঢ় বাঁধন আছে। সাত বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে এখন ক্লাস ওয়ান। ইমনের মা ছিলেন শিক্ষিত এবং রুচিসম্পন্ন ইমনের মেয়ের নাম দিয়েছিলেন শাল্মলী তারা ডাকে শালু।
গরম চা টা প্রায় এক ঢোকে শেষ করেছে ইমন। গরম জল পেটে না গেলে কমোডে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। এবার শর্মী ও তার ব্রেকফাস্ট রেডি করে টেবিলে সাজিয়ে ঢাকা দিয়ে মেয়েকে স্কুলে দিতে যাবে। অন্যদিন ইমনই তাড়া দেয়, কিন্তু আজ ইমনের সময় থমকে গেছে। চেয়ারে বসে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে চোখ কুঁচকে চেয়ে আছে দেখছে শালুকে। শালু এখন স্কুলের পোশাকে বেশ গাবলু-গুবলু। মেয়েটাকে দেখলেই চটকাতে ইচ্ছা করে। স্কুলের পোশাকে বেশ স্মার্ট লাগে। হাঁটুর থেকে প্রায় বিঘত খানেক উঁচু বাসন্তী রঙের স্কার্ট এর উপর ধবধবে সাদা শার্ট, তার উপর অফ হোয়াইট ব্লেজার। বেশ ফর্সা রং আর গোলগাল গড়ন হয়েছে মেয়েটার। চঞ্চলতায় চড়ুই পাখি কেও হার মানায়। পিঠে একটা ব্যাগ, বইখাতা এখন আর বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে হয় না ওদের। স্কুলে থাকে শুধু জলের বোতল, টিফিন, রুমাল আরো কি যে আছে তা সে নিজেও জানেনা। শর্মীও বেশ স্বাস্থ্যবতী তবে মানানসই। ডিম্বাকৃতি ফর্সা মুখে লাবণ্য মাখামাখি। মনে কোন প্যাঁচ-পয়জর নেই। দুজনেই এখন ব্যস্ত।শালু প্রায় রেডি। ওর মা একটা সন্দেশ মুখে ফেলে দ্রুত চিবিয়ে নিয়ে দু-ঢোক জল খেয়ে নিচ্ছিল, এবার বের হবে দুজনে। নীচে গাড়ি অপেক্ষা করছে।
সুরঞ্জন ইমনের একমাত্র বিজনেস পার্টনার। মাসখানেক আগে হঠাৎ একদিন সকালে ফোন করেছিল। যদি সম্ভব হয় তবে যেন ইমন গাড়ি নিয়ে টালিগঞ্জে তার বাড়ি তখনই চলে আসে। কিছু বুঝতে না পেরে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছলো তখন বেলা প্রায় এগারোটা। সুরঞ্জনদের বাড়ি আগেও অনেকবার এসেছে আড্ডাও মেরেছে হৈ-হুল্লোড় করেছে কিন্তু সেই মুহূর্তে বাড়িটা যেন একেবারেই থম মেরে গেছে। ইমন সুরঞ্জনদের বাড়ি পৌঁছে দেখল সুরঞ্জন তার দাদা রবিরঞ্জনকে একটা আ্যম্বুলেন্সে তুলছে। ইমনকে দেখে যেন কিছুটা সাহস পেলো সুরঞ্জন। পরিবারের বাকিদেরকে ইমন এর কাছে সঁপে দিয়ে দাদাকে নিয়ে নার্সিং হোমে চলে গেল সুরঞ্জন।
হতভম্ব ইমন কী করবে কিছু বুঝতে পারছিল না। কী ঘটনা তাও সে জানে না। সুরঞ্জনের স্ত্রী পল্লবী বলেছিল ঘটনাটা। প্রতিটা শব্দ যেন কসাইয়ের চপারের মত ক্ষত বিক্ষত করছিল ইমনকে। কান্নায় ভেঙে পড়া পল্লবী বলেছিল রিমিতার কথা। সুরঞ্জন এর দাদার মেয়ে রিমিতা কলকাতার নামকরা বেসরকারি স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। পল্লবীর কথায়- "রোজকার মতো স্কুল থেকে ফেরার সময় গতকালও স্কুল বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে এসেছিল রিমিতা, কিন্তু বাড়ি পৌঁছায়নি। আজ সকালে বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটা গ্যারেজের মধ্যে রিমিতাকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। শরীরে কোন পোষাক ছিল না মেয়েটার, সমস্ত শরীর আঁচড় কামড়ে ক্ষতবিক্ষত। লজ্জাস্থানে চাপ-চাপ রক্ত।" -- কথাগুলো বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল পল্লবী।
রিমিতা এখন বাড়িতেই আছে। জীবন্মৃত হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। পুলিশ এখনও কাউকে ধরা তো দূরে থাক কোন এফ.আই.আর পর্যন্ত করেনি। একটা জেনারেল ডায়রি করে ছেড়ে দিয়েছে।
শর্মী এসবের কিছুই জানে না। তাকে ইচ্ছা করেই জানায়নি ইমন। কী বা জানাত? এই ঘটনাটার পর থেকে তো ইমন নিজেই ভিতরে ভিতরে একেবারে ভেঙে-চুরে তছনছ হয়ে গেছে। এর আগে খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে যা চরম ঘেন্নার সঙ্গে দেখেছে, আজ সেই ঘটনাটাই একেবারে কাছের মানুষের পরিবারে ঘটতে দেখে ইমনের সমস্ত বোধশক্তি, বিচার-বুদ্ধি কেমন একটা ঘোলাটে হয়ে গেছে। যতক্ষণ শালু আর শর্মী বাইরে থাকে অথবা সে নিজে ওদের সঙ্গে থাকে না ততক্ষণ একটা ভয়ঙ্কর টেনশন ইমনকে শেষ করে দিতে চায়, কোন কিছুতেই তখন মনোযোগ দিতে পারে না সে। ইদানিং মাঝে মাঝেই ইমন কাজ ছেড়ে, অফিস ছেড়ে হঠাৎ করে পৌঁছে যায় শালুর স্কুলে। সেখানে আগে খোঁজ নেয় শালু ঠিকঠাক আছে কি না, তারপর আবার অফিসে ফিরে আসে। কিন্তু শর্মীকেও একা বাড়িতে রেখে বাইরে থাকতে পারে না ইমন। গত একমাসে প্রায় বারো দিন ইমন তার অফিসেই যায়নি। ওদিকে সুরঞ্জন আর ম্যানেজার বিজয় সামলাচ্ছে।
আজো ইমনের একেবারেই ইচ্ছা করছে না বেরোতে। একটা ভয়ঙ্কর আশঙ্কায় কেমন যেন তটস্থ হয়ে আছে সে। ইমনের এই পরিবর্তন শর্মীর চোখ এড়ায় নি। আজ শর্মী জিজ্ঞাসা করলো,
-- কি গো? তোমার কি শরীর খারাপ? উঠছো না যে? বেরোবে না?
-- দেখছি।
এটুকু বলে ইমন উঠে এসে শালুকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করে বলে,
-- সাবধানে থাকবে, খবরদার কেউ ডাকলে বা কিছু খেতে দিলে বা কোন কিছুই দিলে একদম নেবে না, আর তার কাছে যাবেও না। ছুটি হলে মার সঙ্গেই চলে আসবে বাড়িতে। বুঝলে?
তারপর শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-- ওকে নিয়ে ফেরার সময় কোন দোকানে বা অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, একেবারে টানা বাড়ি চলে আসবে বুঝলে?
ইমন কথাগুলো শেষ করতে না করতেই নীচে পুল কারের হর্ণ তারস্বরে ডেকে উঠলো। শর্মী শালুর হাতটা ধরে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে একটা ফ্লাইং কিস ইমনের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল। দরজাটা বন্ধ হতে হতে ইমনের কানে ভেসে এল শালুর মিষ্টি গলা,
-- টা টা পাপা।
ইমন অসহায়ের মত আবার চেয়ারে এসে বসলো। এখন তার হাতে অঢেল সময় কিন্তু ইতিমধ্যেই একটা অদ্ভুত বিপন্নতা আর আতঙ্ক কুরে কুরে খেতে শুরু করে দিয়েছে ইমনকে। সে চুপচাপ কপালের শিরা দুটোকে দু-হাতে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে রইল।
দুই
গত কয়েক মাসের সংবাদপত্র থেকে কয়েকটা খবর কেটে সেগুলোকে একটা ট্রান্সপারেন্ট কভার ফাইলে রেখে দিতে গিয়েও আর একবার সেগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেয় ইমন। ছ-মাসের কাগজ থেকে প্রায় সতেরোটা পেপারকাটিং করেছে ইমন। প্রতিটা খবরই হয় রেপ নয়তো সেক্সুয়াল অ্যাবিউস সম্পর্কিত। কয়েকটা ক্ষেত্রে রেপ ভিকটিমকে খুন পর্যন্ত করা হয়েছে। ইমন খবর গুলো পড়ে মেঝেতেই বসে থাকলো। হঠাৎ করে একটা ভয় ইমনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে লাগলো। চরম উদ্বেগে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সে, প্রায় ছ-টা বাজে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি, তাই সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে। শালু আঁকতে গেছে, শর্মী গেছে শালুর সঙ্গে। প্রতি শনিবারই যায়, কিন্তু আজকে ইমনের মনে হচ্ছে শর্মী আজ শালুকে নিয়ে না বেরোলেই পারতো। কেন মনে হচ্ছে সেটা ইমন জানে না, তবে এই চিন্তাটা আস্তে আস্তে ইমনের কপালের শিরা উপশিরা থেকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ইমন অস্থির হয়ে উঠতে লাগলো। শর্মীকে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও আজ কেন গেল? কি হতো যদি একদিন শালু আঁকতে না যেত? জীবনটা আগে নাকি আঁকা? ওই যে ছেলেগুলো সব দিন সন্ধ্যা থেকে গুপির চা-গুমটিতে বসে গুলতানি করে, ওরা কি ভালো? ইমন জানে ওরা পারে না এমন কাজ নেই। পলিটিক্যাল পাওয়ার আছে ওদের পকেটে। শুধু ওরা কেন আশপাশের কোন লোকটাকেই বা আজ বিশ্বাস করা যায়? সব চেনা, অচেনা মুখের দিকে তাকিয়ে ইমনের মনে হয় এরা সবাই ভিতরে ভিতরে কোন না কোন ষড়যন্ত্র করছে, এদের মধ্যে যে কেউ যখন তখন শালুকে বা শর্মীর সর্বনাশ করতে পারে। আর যখনি এগুলো মনে হয় ইমনের, সে কেমন একটা ভয় আর অসহায়তার চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকে।
ইমন আর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সাড়ে ছটা বাজে। ভুরুটা কুঁচকে ওঠে ইমনের। এত তাড়াতাড়ি কি করে বেজে গেল সাড়ে ছটা? না এই ঘড়িটাও তার সঙ্গে ঠিক কাজ করছে না, এভাবে তাকে আরও বেশী করে ভয়ের মধ্যে ঠেসে ধরছে। আরে সাড়ে ছটা বাজলে তো শর্মী শালুকে নিয়ে ফিরেই আসতো। ঘড়িটাই তাহলে ভুল দেখাচ্ছে। হা হা করে হেসে উঠলো ইমন। মুঠো করে নিজের মাথার চুল গুলো খামচে ধরে লাফিয়ে উঠে ছুটে গেল ঘড়িটার দিকে। তারপর অদ্ভুত হেসে মুখ ভেংচে আবার হেসে উঠলো অট্টহাসি। কয়েক মুহুর্ত পর হঠাৎ করেই হাসি থামিয়ে ইমন একটা লাঠি তুলে নিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার উপর দুম দাম করে মারতে লাগলো। ভয়ংকর চিৎকারে কেঁপে উঠতে লাগলো চারদিক।
হঠাৎ তখনি কে বা কারা এসে জাপটে ধরলো ইমনকে। চেঁচিয়ে উঠলো ইমন -" এই কে? কে ধরলি আমাকে? ছাড়, ছাড় বলছি! তোরা সবাই সমান! কেউ ভালো নয়। ঘড়িটাও নয়। তোদের সবাইকে ওই ঘড়িটার মত করে মারবো, মেরে শেষ করে দেবো একেবারে। ভয়ঙ্কর রাগে ফুঁসতে লাগলো ইমন। সর্বশক্তি দিয়ে হাত পা ছুঁড়ে লোকগুলোর বাঁধন থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইলো ইমন। ঠিক তখনই কেউ একজন একটা সুঁচের মত কিছু তার হাতে ফুটিয়ে দিল। আস্তে আস্তে তার চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। প্রচন্ড ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল ইমন।
-- এরকমটাই চলছে মিসেস দেবনাথ। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, কিন্তু ... একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ডঃ জাকির আলমের মুখ থেকে।
নিজেকে আর সামলাতে পারলো না শর্মী। এই কয়েক মাসে জীবনটা ছারখার হয়ে গেছে তার। ইমন প্রথম দিকে একটু অন্যরকম ব্যবহার করছিল, শালুকে একেবারে চোখের বাইরে যেতে দিচ্ছিল না, এমনকি তাকেও বাড়ি থেকে বেরোতে দিতে চাইছিলো না। আস্তে আস্তে এই ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে উঠতে লাগলো। বাইরের কেউ, বিশেষত ছেলে বা কোন লোককে একেবারে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকতে দিতে চাইছিল না ইমন। তবে যেদিন পাড়ার জনা কয়েক ছেলে বাড়ি এল, একটা অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ করতে, সেদিন যখন ইমন জলের ওয়ারিং এর জন্য আনা বাড়তি পিভিসি পাইপের টুকরো দিয়ে তাদের বেদম মারলো, সেদিন শর্মী বুঝেছিল, ইমন আর স্বাভাবিক নেই।
এই শহরে একমাত্র ভরসা যোগ্য সুরঞ্জনকে সঙ্গে নিয়ে গত কয়েক মাস এই মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে আসছে শর্মী। আপতত এটাই ইমনের ঠিকানা।
শর্মীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়া শরীরটা ডঃ জাকির আলমের টেবিলের উপর ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। সুরঞ্জন চুপচাপ বসে থাকে, শর্মীকে সান্ত্বনা দেবার মত শব্দ তার জানা নেই।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
============================== ==
অনিন্দ্য পাল
জাফরপুর
চম্পাহাটিি
সোনারপুর
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত