গল্প।। রুপালি আঁশের রূপকথা ।। এণাক্ষী কয়াল মণ্ডল
'রূপ চাঁদের রূপের ফাঁদে যদি বাবু মন ফাঁসে, ব্যাগ লইয়া চইলা আইসেন মোর পাশে। ব্যাগ লইয়া চইলা আইসেন মোর পাশে।'মাছের বাজারের হাজার হট্টগোলের মাঝে কান চিনে নেয় পরিচিত গলার সুর। এ আমাদের ঠাকুরপুকুর মাছ বাজারের পরেশ মণ্ডল। সবার প্রিয় প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর পরেশ। কথা বলে কম। গান গায় বেশি। যেদিন যেমন মাছের সংগ্রহ ওর কাছে, সেদিন তেমন সেই মাছের সুরেলা বর্ণনা। বর্তমান টেনশনে ভরা জীবনে ক্রেতার কাছে এ উপরি পাওনা। এগিয়ে যাই। আমি শুধু রোববারের খদ্দের। একদিনেই সারা সপ্তাহের বাজার মজুদ করি। জানতে চাই , 'ও পরেশ আজ আর কি জুটিয়ে এনেছ গো আমাদের জন্য?' একগাল হেসে সে জিয়ানো কই মাছ দেখিয়ে গেয়ে ওঠে, ' বাবু খাল বিল থইথই।ডিম ভরা ফ্রেশ কই।' আমি ইচ্ছে করে বলি, 'আর?' সে সুরে গায়, 'পরেশের পারশে খেলে ধন্য জনগণ। বাবুরা খুশি হলেই খুশি মোর মন।' সুরের টানে খদ্দের জমে যায়। ঝপঝপ মাছ খালি হতে থাকে তার স্টক থেকে। পরেশকে আমি আজ বিশ বছর দেখছি। একই রকম প্রাণচঞ্চল আর আমুদে।
প্রথম দিকে ও সাইকেলে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মাছ বিক্রি করত। সাইকেলের কেরিয়ারে বিশাল গামলার জলে জিয়ানো মাছ। আর হ্যাণ্ডেলের দুই রডে ঝোলানো চারটে নাইলন ব্যাগে থাকত নানান মাছ। আর থাকত ওর কথা সুরের জাদু। সকাল বেলার বাতাসে ভেসে আসত ওর গান। আমরা বুঝতাম রকমারি মাছের সাথে পরেশ হাজির। খদ্দেরের পছন্দ অনুযায়ী মাছ মেপে বঁটি সেট করে আঁশ ছাড়িয়ে কেটেকুটে সাইজও করে দিত সে। ওই সময়টাতে ওর সাথে টুকটাক কথা হতো।
সুন্দর বনের ছেলে পরেশ মণ্ডল। ওর নিজের কথায়, 'মাছের সাথে কি আমাদের আজকের সম্পর্ক! আমরা হলুম গিয়ে মাছমারা। বাপ আর সব ভাইয়েরা নৌকা করে মাছ ধরতে যেতুম গহীন সমুদ্দুরে। কুড়ি দিন, তিরিশ দিন কেটে যেত জলে জলে। তারপর ফেরা। বাবু, সুন্দরবন হলো নদীনালার দেশ। আর আমরা হলুম বানভাসি মানুষ। বর্ষাকালে প্রতি বছর বানের জলে ঘর ভাসে। খাবার নাই। পানীয় জল নাই। কলকাতা শহর আমাকে টানত। কত আলো। কত আনন্দ ফুর্তি শহরের বাতাসে। আর কত ইস্কুল কলেজ। শহরে পালিয়ে যেতে চাইত মন। কিন্তু বাবার নদীর প্রতি বড্ড মায়া। তা শুধু কি আর মায়া সম্বল করে বাঁচা যায়! তাই বাবা এজগতের মায়া কাটাতেই বউ ছেলের হাত ধরে এই শহরের বুকে বাসা বাঁধলুম।' দক্ষিণ কলকাতার এই ঠাকুরপুকুর অঞ্চলে বিগত তিরিশ বছর ধরে কর্মসূত্রে আমার বাস। আমিও কলকাতা শহরে বহিরাগত। নদীর ওপারের মেদিনীপুর জেলায় আমার পৈতৃক ভিটা।
তাই আমার মতো যারা কলকাতা শহরে বহিরাগত, তাদের সাথে কেমন যেন এক অন্তরঙ্গতা বোধ করি। তবে এ শহর বড়ো অতিথি পরায়ণ। দুহাতে বুকে টেনে নেয় বহিরাগতদের। তাই অবসর গ্রহণের পরেও আর ফেরা হয়ে ওঠেনি দেশে। কলকাতার মাটিতেই আমার শিকড় চেলে গেছে।
(২)
দেখতে দেখতে বর্ষা এসে গেল। মাছের বাজারে সবার কাছেই রুপালি ইলিশের পসরা। এগিয়ে যাই পরশের কাছে। সে সুর করে হাঁকছে , 'বাবু টাটকা টাটকা ইলিশ, সস্তা চাইলে বালিশ।' রসিকতা করে বলি, তা তোমার কাছে টাটকার সাথে ওই বালিশও আছে না কি গো পরেশ? 'সে হেসে জবাব দেয়, 'বাবু ওসব পচা বালিশ ইলিশ, হলে পরে কাল করবেন কষে নালিশ। পরেশের কাছে শুধু টাটকা তাজা ইলিশ ভাজা। এর খদ্দের রাজা গজা।' ইলিশের মরসুম এলেই সেই ঘটনাটা মনে পড়ে যায়।
আগে যখন পাড়ায় ঘুরে মাছ বিক্রি করত পরেশ। একদিন বঁটি পেতে আঁশ ছুলে ইলিশের পেট ফাঁক করেছে। সবুজ রঙা পিত্ত সহ পেটের ভিতর থেকে মাছের তেল আর পটকার দলাটা বের করে সে জানতে চায়, 'বাবু এগুলো ফেলে দেব, না লাগবে?'
বলি, 'নাড়িভুঁড়ি লাগবে না। কিন্তু ইলিশের তেলটাই যে আসল। ফেলবে কেন?'সে যত্ন করে পরিষ্কার করে প্যাকেটে রাখে কাটা মাছের সাথে। তারপর মাছের নাড়িভুঁড়ি গুলো অন্য একটা নাড়িভুঁড়ি আর চোবড়াকাঁটা সুদ্ধু প্যাকেটে ভরে নেয় নিজের জন্য।
তারপর আপন মনে বলে, 'ছেলে দুটো ইলিশের গন্ধ বড় ভালোবাসে। ওদের মা এইগুলো তেলে ভেজে দিলে একথালা করে ভাত উঠে যাবে সুগন্ধে। সবে ইলিশ উঠছে, এখন এতেই খুশি ওরা।'
মনটা খুবই বিষণ্ণ হয়ে গেছিল। আমার গিন্নির আবার মমতার প্রাণ। এক রবিবার পরেশকে বলেছিল, 'একটু বেলায়, এই বারোটা নাগাদ তোমার বড় ছেলেটাকে একটু পাঠিয়ে দিও তো পরেশ।'
আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের পিছনের বস্তিটাতে একটা ঘর নিয়ে থাকত ওরা। সেদিন একটা টিফিন বাটিতে গিন্নির রান্না পিস চারেক ইলিশ ভাপা রওনা দিয়েছিল পরেশের বস্তির এক চিলতে ঘরে।
সে টিফিন বক্স কিন্তু ফাঁকা ফেরৎ আসেনি। সরিষা বাটা দিয়ে কচুর লতির অপূর্ব পদ সহ ফেরৎ এসেছিল।
কিভাবে যেন দুই অসম পরিবারের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। হয়ত বা দুটো পরিবারই শিকড় ওপড়ানো ছিল বলে এই কল্লোলিনী কলকাতা মহানগরীর বুকে পরস্পরের কাছে একটু আন্তরিকতার ওম খুঁজে পেয়েছিল। প্রতিদিন পরেশ সারাটা মাছ বাজারের মাছের ছলা আঁশ পাখনা সহ আবর্জনা যত্ন সহকারে তুলে আনত। মাছ ব্যাপারীরা তো বিনি পয়সায় বিনি পরিশ্রমে সাফসুরতেই খুশি ছিল।
কেউ কেউ জানতে চাইত, 'রোজ এসব নিয়ে কি করো?' পরেশ এক গাল হেসে বলত , 'আজ্ঞে গাছের সার হবে।'আসলে খিদিরপুরের ওদিকে একটা সার কারখানার সাথে যোগাযোগ করেছিল পরেশ। তারা দৈনিক নগদ পয়সায় কিনে নিতো মাছ বাজারের বর্জ্য। একটু একটু করে পুঁজি গড়ে পরেশ মাছ বাজারের একটুকরো স্টলের হকদার হতে পেরেছিল। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মাছ বিক্রির দিন গত হয়েছিল তার। এর মধ্যে আমার দুই ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিদেশে পাকাপাকি ভাবে থেকে গেল। ওরা অবশ্য আমাদেরকে সাথে রাখতেই চেয়েছিল। আমি চাইলেও আমার গিন্নি রাজি ছিল না। তার মতে, 'তোমার কাজের জন্য এক সময় দেশগাঁ ছেড়ে এই শহরে এলাম । এখন ছেলেদের জন্য কি আমাকে সত্যি সত্যি দেশছাড়া হতে হবে না কি! এখন এটাই আমার ভিটে। শেষ বয়সে আর ভিটে ছাড়া হতে পারব না বলে দিলাম।'
(৩)
বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের তের নম্বর ওয়ার্ডে এক বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছি। স্টেজে বসে দেখছি আমাদের পরেশও ধোপ দুরস্ত পাজামা পাঞ্জাবি পরে হাজির। ভালো লাগল। অনুষ্ঠান চলছে। নাচ গান বক্তৃতার মাধ্যমে সময় গড়াচ্ছে। এমন সময় বিশেষ পুরস্কারের প্রাপকের নাম ঘোষণায় চমকে উঠি। পায়ে পায়ে স্টেজে উঠে আসে পঞ্চাশোর্ধ পরেশ। আমাদের পরেশ মণ্ডল।
সাউণ্ড বক্সে তখন ঘোষণা চলছে, 'আপনারা জানেন আমাদের ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের মাছের বাজারগুলোর চারপাশ আগে মাছের বাজারের বর্জ্যের দুর্গন্ধে ভরে থাকত। ভ্যাটগুলোতে ফেললেও সময়মতো সেগুলি সাফাই না হলে পারিপার্শিক এলাকায় দুর্গন্ধে টেকাই দায় হতো। কিন্তু আমাদের শ্রী পরেশ মণ্ডলের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় আজ বিগত পাঁচ বছর ঠাকুরপুকুর সংলগ্ন পাঁচ ছয়টি মাছ বাজার আজ সেসব দুর্দিনকে পেছনে ফেলে এসেছে।
নিয়মিত মাছের বাজারের আবর্জনা সাফাইয়ের পুরো দায়ভার পরেশবাবু নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বিগত পাঁচ বছর ধরে পরিবেশ বান্ধবের ভূমিকা পালন করে চলেছেন নিরলস ভাবে। তাই এই বছরের বিশেষ পরিবেশ বান্ধবের পুরস্কার আমরা তুলে দিচ্ছি পরেশ বাবুর হাতে।'
রুপালি আঁশের রূপকথার জনক শ্রী পরেশ মণ্ডল তখন পৌরপিতার হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার শেষে নীরবে চোখের কোণ মুছছে পাঞ্জাবির হাতায়।
-----------------------------