ছোটগল্প ।। শিকার ।। শংকর লাল সরকার
কোচবিহার রাজপ্রাসাদের গেটের সামনে মেয়েটাকে দেখে সত্যি বলতে কী অয়ন চোখ সরাতে পারছিল না। গত তিনমাস ধরে ফেসবুকে যে মেয়েটির সঙ্গে নিয়মিত মেসেজ বিনিময় করে এসেছে এই সে! কিছু সুন্দরী মেয়ে আছে যাদের রূপ জ্যোৎস্নালোকিত নিঝুম রাতের মতো। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন নেশা ধরে যায়।
ওমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?
মেসেজটা পেয়ে এক পলকের জন্য চোখাচুখি হল। অবশ হয়ে গেল অয়ন, এত সুন্দর! মাথার চুলগুলি হাওয়ায় কপালে গালে লুটোপুটি খাচ্ছে। সরু করে কাজলপরা দুটি চোখ। ধবধবে সাদা কপালের মাঝখানে একটা ছোট চৌকোনা নীল টিপ। দুপা এগিয়ে শালিনীর মুখোমুখি হল অয়ন। হেসে বলল লাল রঙের অন্ধকারে এত রূপ লুকিয়ে ছিল!
দুজনে পাশাপাশি হেটে যাচ্ছিল। অয়নের নাকে আসছিল শালিনীর শরীরের মিষ্টি গন্ধ। ওর মনে পড়ল শালিনীর সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিনের কথা। শালিনীর প্রোফাইলে নিজের ছবির বদলে ছিল কালচে লাল রঙ। ওই শালিনীকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। ফেসবুকের অ্যাড ফ্রেন্ড অপসনে শালিনীর নামটা কিকরে যে এসেছিল তা ও বলতে পারেনা। দুজনের মধ্যে কোন মিউচিুয়াল ফ্রেন্ডও ছিলনা। যাইহোক রিকোয়েস্ট পাঠাবার দুদিন বাদেই রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্টেড হল।
অয়ন মেসেঞ্জারে লিখেছিল লাল রঙের আড়ালে যে সুন্দর মুখ লুকিয়ে আছে তাকে কী দেখতে পাবনা।
আমাকে দেখতে যে সুন্দর আপনি জানলেন কি করে?
অনুভূতি দিয়ে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে একটা জিনিষ আছে মানেন তো।
লাল রঙ দেখেই তো ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন!
এটা সত্যি যে প্রোফাইলের ওই কালচে লাল রঙ দেখে কৌতুহলী হয়ে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বন্ধুত্ব হবার পর লাল পর্দাটা আর ভালো লাগছে না।
লাল রঙের অন্ধকারে ঢাকা মানুষকে দেখার এত আগ্রহ কেন?
মুখ না দেখে চ্যাটিং করতে কিরকম অস্বস্তি হয়।
প্রোফাইলে কিন্তু সব আসল মুখের ছবি থাকে না, কিছু মুখোশও আছে।
একটা কথা কী জানতে পারি, প্রোফাইলে লাল রঙ কেন?
ঐ কালচে লাল হল আমার মনের রঙ?
আপনার মনের লাল রঙে এত অন্ধকার থাকতেই পারে না।
কী করে বুঝলেন?
কেন আপনার কথায়?
কী আছে আমার কথায়?
মোম জোৎস্নার নরম রূপালী আলো।
এতকথার পরও শালিনীর মুখের ছবি আসেনি। একদিন অফিস থেকে ফিরে বিছানায় শুয়ে অয়ন মোবাইল খুটখাট করছিল। ফেসবুকে ঢুকে দেখল শালিনী লাইভ। কী মনে করে মেসেজ পাঠাল এখন কী করছেন?
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বিপ বিপ করে শালিনীর মেসেজ এল এই মাত্র স্নান সারলাম।
এত বৃষ্টি হচ্ছে এখন স্নান করলেন?
কেন? বিশ্বাস হলো না বুঝি? শালিনী নিজের তোয়ালে জড়ানো শরীরের সেলফি তুলে অয়নকে পাঠিয়ে দিল। কেমন দেখলেন লাল পর্দার আড়ালে থাকা মানুষটিকে?
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অয়ন মেসেজ পাঠাল, আপনি এই বুড়ো মানুষটার মাথাটা খাবেন দেখছি।
বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় অয়ন শালিনীর পাঠানো ছবিটা দেখছিল। গোলাপি রঙের ঝাড়নে মাথার চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। কপাল ছুয়ে গাল পর্যন্ত নেমে আসা দলছুট কয়েকটা চুলের ডগায় মুক্তোর মত জমে থাকা জলবিন্দু। দুষ্টুমিভরা দুচোখে নিষিদ্ধ ইশারা। ভরাট বুকে শুধুমাত্র একটা টকটকে লাল তোয়ালে জড়ানো। তোয়ালের সীমান্তে মোম নরম সাদা শরীরে ক্লিভেজের বিপজ্জনক খাঁজ। আর কোন মেসেজ আদান প্রদান হলনা।
সেরাত্রে কিন্তু অয়ন বারেবারেই শালিনীর ছবিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। অনেক রাত পর্যন্ত শালিনীর স্নানে ভেজা শরীরের গন্ধ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিল।
চলুন রাজপ্রাসাদের ভিতরের সংগ্রহ গুলো দেখি।
শালিনীর কথায় অয়ন বাস্তবে ফিরে এল, বলল আমার যা দেখার তা তো দেখা হয়েই গেল। আর কি দেখব? ভার্চুয়াল দুনিয়া ছেড়ে স্বয়ং আফ্রোদিতি আমার পাশে পাশে হাটছে।
এসব কথা বলে মাথা খাবেন না। এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আর কত মেয়েকে মজিয়েছেন বলুন তো?
চেষ্টার কোন ত্রুটি করি নি কিন্তু তেমন কিছু আর ঘটল কই!
মিথ্যা কথা! সব পুরুষই এই রকমের মিথ্যুক।
এরকম কতজন মিথ্যুক পুরুষের কাছাকাছি এসেছ বল তো? এই রে আবার তুমি বলে ফেললাম, কিছু মনে করলেন নাতো।
তুমিই ভালো। আপনি আজ্ঞে করলে সম্পর্কের মধ্যে একটা কৃত্রিম জড়তার ভাব থাকে। শরীরে ঢেউ তুলে শালিনী হাসিমুখে তাকাল অয়নের দিকে। শালিনীর হাসিমুখের দিকে অয়ন চেয়ে রইল।
ওমন হা করে তাকিয়ে কী দেখছ? এবার শালিনী তুমি বলল।
দেখছি তোমাকে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবার সময়ে ভাবতেও পারিনি লাল রঙের অন্ধকারে এরকম একজন ডাকসাইডে সুন্দরী লুকিয়ে আছে।
এরকমই কথায় কথায় সারাটা বিকাল কেটে গেল। একটা ফুরফুরে মেজাজকে সঙ্গী করে ঘরে ফিরল অয়ন। ঘর বলতে মড়াপোড়া চৌপথির কাছে এককামরার ভাড়া বাড়িতে। কোচবিহার পোস্টিং হবার পর থেকে এটা ওর দূরবাসের আস্তানা।
স্নানের পর বাথরুমের আয়নার সামনে দাড়িয়ে বেয়াল্লিশ বছরের পুরানো পুরুষ শরীরটা খুটিয়ে দেখছিল। এখনপর্যন্ত নির্মেদ সুঠাম চেহারা ধরে রাখতে পেরেছে। ঘন কালো রোমে ঢাকা বুক। চওড়া কাঁধ। কাঁধের দুপাশ থেকে নেমে আসা হাতদুটো পেশিবহুল না হলেও সুঠাম। চুল আচড়াল। মাথার কালো চুল আর মোটা গোঁফে দুএকটা রুপালি ঝিলিক। কানের পাশে দুটো তিনটে করে চুল সাদা হয়েছে। এই বেয়াল্লিশেই বয়স গুটিগুটি করে এসে জায়গা নিতে শুরু করেছে। এমন সময়ে কানে এল সেই ঘড়ঘড়ে কণ্ঠস্বর। শালিনীকে নিয়ে কী ভাবছ?
কী ভাবছি মানে? কিছু ভাবছিনা। তুমি এখন যাও, একা একাই চেঁচিয়ে উঠল অয়ন।
খিক্ খিক। করে একটা হাসির আওয়াজ হল। শ্লেষ্মা জড়ানো সেই ঘড়ঘড়ে স্বর বলল না মানে নেহার সঙ্গে যা ঘটিয়েছ শালিনীর সঙ্গেও তাই করবে কিনা তাই জানতে চাইছি।
একমগ জল বাথরুমের আয়নায় ছুড়ে দিল। চেঁচিয়ে বলে তুই দূর হ! পিছন ফিরে দ্রুত বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে অয়ন।
রাত সাড়ে দশটার সময়ে অয়ন নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছিল। এমন সময়ে শালিনীর মেসেজ ঢুকল। আজকে সারাদিন কেমন কাটল?
যতটা ভালো কাটবে ভেবেছিলাম সেরকম না!
কারণ?
যাকে ভালো করে জানার জন্য গেলাম তাকে কাছে পেলাম কই?
আর কত কাছে পেতে চাও?
যতটা কাছে এলে পরে একে অপরের নিশ্বাস ছুঁতে পারা যায়।
তুমি না সত্যই বড়ো বেশি অসভ্য!
ছবি পাঠিয়ে মাথা খাবার সময়ে মনে ছিল না।
ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল শালিনী। ফের সেই দুঃস্বপ্ন। দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর। দোতলা ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বেরিয়ে এল। ভিজে বাতাসের শীতল স্পর্শ ওকে আরাম দিচ্ছিল। সময় পিছিয়ে গেল চার বছর। একটা অন্ধকার গলির ভিতর দিয়ে ও প্রাণপণে ছুটছে, পিছন পিছন ছুটে আসছে তিনটে নররাক্ষস। খোলা নর্দমা, আবর্জনার স্তুপ, ভাঙা পাঁচিলে পেচ্ছাপের গন্ধ কোন কিছুকে পাত্তা না দিয়ে শালিনী দৌড়চ্ছিল। পুরানো শিবমন্দির, জুয়ার ঠেক কোনদিকে ছুটছিল শালিনী। আচমকা কিছুতে একটা হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ল। তারপর চারদিক অন্ধকার। নীচের রাস্তা দিয়ে যাওয়া একটা রাতচরা মোটরসাইকেলের গুড়গুড় আওয়াজ শালিনীর চেতনায় আলোড়ন তোলে। যতই ভুলে থাকতে চায় ততই যেন সেই কালরাত্রি ওর স্বপ্নে হানা দেয়। সেই ঘটনার পর প্রায় বছর দুয়েক ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছিল শালিনীকে। ডাক্তার চিকিৎসা করে ওর শরীরটাকে বাঁচিয়ে তুলেছিল কিন্তু মনটাকে বাঁচাতে পারেনি। আর মনের মৃত্যু হলে মানুষ হয়ে যায় পশু। নির্মম, জিঘাংসু মারাত্মক পশু। কারন মনের মৃত্যু হলেও থেকে যায় বুদ্ধিবৃত্তি। যে বুদ্ধিবৃত্তি পশুর নেই। যতকিছু পাশবিক নারকীয় জঘন্য কাজ সে তখন করতে পারে।
বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন সকলের কাছ থেকে শালিনীকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। কারুর কাছে মুখ দেখানোর উপায় ছিল না। চেনা মানুষদের চোখে করুণা আর অবিশ্বাস মেশানো অচেনা দৃষ্টি সহ্য করতে পারছিল না। যেন সব দোষ ওর। এক হাতে কী তালি বাজে! কেন ও অত রাত্রে একা বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল? নরপশু গুলো ওর পিছনে লাগল কেন? ওর দিক থেকে কোনরকম ইঙ্গিত ছিল না তো! কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ সব প্রশ্ন। সকলের আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল শালিনী। পড়াশুনা নিজের কেরিয়ারে ইতি টেনে, নিজের আজন্ম পরিচিত চেনা শহর ছেড়ে অনেক দূরে অজ্ঞাতবাসে আসতে বাধ্য হল। সব পুরুষদের প্রতি এক তীব্র বিতৃষ্ণায় চোয়াল শক্ত হয় শালিনীর।
কোচবিহার থেকে ভোরবেলায় গাড়ি করে বেরিয়ে চিলাপাতা জঙ্গলের অপরূপ শোভা দেখতে দেখতে চলেছিল ওরা। আজ ওরা রাত কাটাবে জয়ন্তীতে। শালিনী একটা গোলাপি রঙের চূড়িদার পরেছে। দুহাত জড়ো করে কোলের উপরে রাখা। অয়ন একবার ওর হাত ছুঁল। বাঁহাতের কব্জীর ঠিক নীচে ছোট্ট একটা ট্যাটু। আঙুল দিয়ে শালিনীর ট্যাটুটা ছুয়ে অয়ন বলল বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এরকম টাটু আঁকানোর প্রবণতা বিশেষ দেখা যায় না।
কেন খারাপ লাগছে?
ফনা তোলা সাপের ছবিটা হাতের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে নাকি মোমের মত নরম ফর্সা হাতটার জন্যই ছবিটাকে এত ভালো লাগছে বলতে পারব না।
অয়নের অলক্ষ্যে শালিনীর মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
সামনে বিরাট চওড়া জয়ন্তী নদীর খাত ওপাশে প্রাচীরের মত দাড়িয়ে রয়েছে নীলচে সবুজ ভুটান পাহাড়। পায়ের নীচে তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলধারা। নদীর বুকে ভাঙাচোরা এক রেলসেতু।
দুটো বড়ো পাথরের মধ্যে অনেকটা ফাঁক। পার হয়ে অয়ন ঘুরে তাকাল শালিনীর দিকে। সামান্য হাত বাড়াল শালিনী। অয়নের বুকের বদ্ধ জলাশয়ে যেন কেউ ঢিল ফেলল। নেহার কথা মনে এল অয়নের। শালিনীর সেই বাড়ান হাতের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। শালিনী আলতো করে ধরল সেই হাত। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত, কিন্তু তার মধ্যেই যেন অনন্ত সময় কেটে গেল। পাখির শরীরের মত স্পর্শ শালিনীর হাতের, উষ্ণ নরম। কয়েক সেকেণ্ড অয়নের হাতের আঙুল ধরেছিল শালিনী। তারপর ছেড়ে দিল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এসেছিল জঙ্গলের কাছাকাছি। গাছেরা ঘেঁষাঘেষি করে দাড়িয়ে আকাশকে ছেয়ে ফেলেছে। সবুজ সামিয়ানার ফাঁকফোকর দিয়ে নেমে আসা সোনালি রোদ রাস্তায়, ওদের শরীরে নানারকমের নকশা বুনেছে ।
চারপাশের বিরাট বড়ো বড়ো বনস্পতিরা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বেড়ে উঠেছে। গাছের গুড়ি শাখাপ্রশাখায় শেওলার পুরু আস্তরণ। গাছের ডাল থেকে ঝুলছে শ্যাওলা। আলো আঁধারির খেলায় যেন এক নেশা ধরানো রহস্যময়তা।
শালিনী, অয়নকে বলল আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছ ওমন করে?
দেখছি তোমার থুতনীর কালো তিলটাকে, শীরজবাসিনী তুর্কি রমনী সাকীর গালে এইরকম একটা তুচ্ছ কালো তিল দেখে হাফিজ তখনই তার বদলে সমরখন্দ আর বুখারা দিয়ে ফকির হতে চেয়েছিলেন। শায়রী পড়বার সময়ে এই কথার অর্থ বুঝতে পারিনি আজ ডুয়ার্সের পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে তোমাকে দেখে অনুভব করলাম তার মানে।
তুমি আমার মাথাটা আর কত রকম ভাবে খাবে বল তো!
শালিনী তাকাল অয়নের দিকে। শালিনীর দৃষ্টি ওর চোখে গেঁথে গেল।
একটা মিষ্টি গন্ধ পেল। নেহা কাছে এলেও এরকম একটা গন্ধ পেত সে। মনে মনে ভাবল শালিনীর প্রতি কী সত্যি সত্যি দুর্বল হয়ে পড়ছে। নেহার মত শালিনীকেও ভালোবেসে ফেলছে। প্রচণ্ড আগ্রাসী ভালোবাসা। শুধু মন নয়, শালিনীর সমস্ত সত্ত্বাকে – ওর রক্ত, মাংস, হাড়, মজ্জা সবকিছু দখল করার এক প্রচণ্ড আবেগ টের পায় অয়ন।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথে অনেকটা উঠে এসে আয়েস করে অয়ন একটা সিগারেট ধরাল।
ওকে হতচকিত করে শালিনী বলল, দাওতো একটা টানদি। শালিনীর কথায় সে মুখ তুলে তাকাল। তুমি স্মোক কর নাকি।
হ্যা মানে মাঝে মধ্যে।
সুন্দরী মেয়েরা স্মোক করলে রূপ আরও খোলতাই হয়। শালিনী মনে মনে খুশি হলেও মুখে কোন অভিব্যক্তি দেখাল না। আচ্ছা অয়নদা একটা কথা..
আবার অয়নদা কেন? শুধু অয়নই তো ভালো।
ঠিক আছে, অয়ন .. অয়ন হল তো । হ্যা যা বলছিলাম। ফেসবুক প্রোফাইলে তোমার স্ট্যাটাস দেয়া আছে সিঙ্গল। বয়সের হিসাবে এই স্ট্যাটাস কী বেমানান নয়!
তুমি কী জানতে চাইছ বুঝেছি, তোমার অনুমান ঠিক। অয়ন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। নেহার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক ছিল। তবে সে সম্পর্ক বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি। কয়েক মুহূর্ত কেমন বিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। একট কথাও মনে আসে না। সামনের গামার গাছটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। সদ্য ধরানো সিগারেটটা নিঃশব্দে ক্ষয়ে যাচ্ছে। নীল একটা ধোঁয়ার সুতো পাক খেয়ে উপরে উঠছে। মাঝে মাঝে টুকরো বাতাসের ঝাপটায় ধোঁয়ার সুতো হারিয়ে যায়। আবার দেখা যায় নতুন করে পাক খেয়ে উপরে উঠছে। নীল বিষধর সাপের মতো।
হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে শালিনী ওর মুখোমুখি দাড়ায়। নিস্পলক ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ওর দিকে। এবার অয়ন মুখে তোলে ওর চোখদুটো কাঁচের মতো চকচক করে উঠে।
শালিনী ওর আরও কাছে সরে আসে। ডান হাতটা আস্তে করে ওর কাঁধে রাখে। সম্পূর্ণ নতুন স্বরে বলে দুঃখিত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইনি।
নানা সেরকম কোন ব্যাপার নয়। তুমি আবার রাগ করলে না কি!
রাগ করবো কেন?
আসলে ওটা আমার জীবনের একটা ফেলে আসা অধ্যায়। ওই সময়টাকে আমি মনেপ্রাণে ভুলতে চাইছি।
শালিনী ওর পাশ ঘেঁসে দাড়াল। কথা বলতে বলতে শালিনীর বাহাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে নিল অয়ন। শালিনীর কব্জীর উপরে আঁকা সাপের ছবিটার উপরে আঙুল বোলাতে লাগল।
মন খারাপ লাগছে?
শালিনী তাকাল ওর দিকে। সেই গভীর দৃষ্টিতে অবগাহন করে শালিনীর কব্জির উপরে আঙুলের চাপ বাড়াল। শালিনী ওর হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল না।
শালিনী-
দুজনের নীরব চোখের চাহনীতে মিশতে লাগল অজস্র কথা। বেলা শেষের রাঙা আলোয় উদাস জয়ন্তী। পাখিদের ডাকে মন কেমন করা সুর।
ভূটান পাহাড়ের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। বন্যপ্রাণ আর রাতচরা পাখিদের ডাকে মুখর বনভুমি। মোম জোছনায় শরীর ভিজিয়ে জয়ন্তী নদী গল্প করতে বসেছে পাহাড় আর অরণ্যের সঙ্গে। নদীর উপরে ভাঙা রেলসেতুটার দুটো পিলার সেই হাহা শূন্যতার মধ্যে উদাসীনতায় নীরব। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে শালিনীর নগ্ন বাহু আর ঘাড়ের একপাশে। অয়ন আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওর দিকে। অন্ধকারে খাটের পায়ায় পা আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল। শালিনী খিলখিল করে হেসে উঠল। আলো আঁধারিতে অয়ন দেখল শালিনীর চোখেমুখে রহস্যময় একটা হাসির ছটা।
বিছানায় শালিনী ওর হাতের কব্জিতে আঁকা সাপের মতই আশ্চর্য রকমের চঞ্চল। শালিনী আস্তে আস্তে ওকে নিজের দিকে টেনে নিতে থাকে। অয়নের সমস্ত সংযম নিঃশেষে হারিয়ে যায়।
বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল অয়ন। একটানা বুনো পোকার আওয়াজ। পাশে ঘুমন্ত শালিনী। ওর মুখে এসে পড়েছে চাঁদের আলো। কালো ঢেউ খেলানো এলোচুল চাঁদের আলোর সঙ্গে মিশে গিয়ে বালিসের উপরে এঁকেছে বিচিত্র নকশা। শালিনীর দিকে একবার তাকিয়ে আবার বাইরের দিকে ওর ঠাণ্ডা দৃষ্টিটুকু ফিরিয়ে নেয় সে। নিজেকে ওর বড়ো ছোট, বড়ো নোংরা আর ক্লেদাক্ত বলে মনে হয়। নেহার কথা খুব মনে পড়ছে। নেহাকে ভালোবেসে লিভইন করেছিল। কিন্তু বছরখানেক পর থেকেই ওদের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। দুজনেই অফিসে বেশি করে সময় কাটাতে লাগল। অয়নের তো বাড়ি ফিরতেই ইচ্ছা হত না। নেহা ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছিল ওর কাছে। সে জানতে পেরেছিল নেহা ওদের অফিসের অমিতাভর সঙ্গে একটা অন্যরকম সম্পর্কে জড়িয়েছে।
সেই আধো আলো অন্ধকারের মধ্যে অতীতের স্মৃতি যেন বিষধর সাপের মতো ওকে জড়িয়ে ধরতে লাগল। ব্যথার এক তীব্র যন্ত্রনা অস্তগামী সূর্যর ম্লান লাল আভার মতো ওর সমস্ত হৃদয় আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কোন বিষ জ্বালা নেই, দহনের তীব্রতা নেই। নেই কোন অসহ্য যন্ত্রনার চিৎকার দাপাদাপি, কিন্তু সারা শরীর যেন বিষে জরজর। তীব্র বিতৃষ্ণা আর ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাল ঘুমন্ত শালিনীর দিকে। শালিনীর মুখটা কখন যেন নেহার মুখের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। অনেক কষ্টে নিজের হাতদুটোকে সংযত করল সে। এখনই নয়, শিকারকে আর একটু খেলানো যাক। তারপর না হয় নেহার মত শালিনীরও জায়গা হবে কোন সেপ্টিক ট্যাঙ্কের ভিতর। মানুষ মারা তো খুবই সহজ। বিশেষ করে সে যখন খুনির অভিসন্ধি সম্পর্ক অসচেতন। কিন্তু আসল সমস্যা মৃতদেহ নিয়ে। কানের কাছে শ্লেষ্মা জড়ানো ঘড়ঘড়ে স্বরটা শুনতে পায় সে, মৃতদেহ থেকেই জানা যায় খুনের কথা আর তার থেকেই ধরা পড়ে খুনী! গলার স্বরটা শুনলেই একটা বিতৃষ্ণায় ওর মনটা ভরে যায়। শয়তানের মতো ওই সত্ত্বাটা ওকে নিয়ে যতসব পাপ কাজ করিয়ে নিতে চায়। ওর উপস্থিতি কী হ্যালুসিনেসান নাকি ও দিনে দিনে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের শিকার হয়ে পড়ছে।
জয়ন্তী থেকে ফিরে আসবার পরদিন অয়ন ওর হোয়াটসঅ্যাপে শালিনীর মেসেজ পেল। আমি দুঃখিত এটাই আমার তোমাকে শেষ মেসেজ এরপর সিমকার্ডটা আমি ফেলে দেব। নতুন সিম থেকে হয়তো অন্য কাউকে মেসেজ পাঠাতে হবে। তোমার ব্যাগের সামনের চেনে একটা কম্পিউটারে টাইপ করা চিঠি আছে। পড়ে দেখ।
মেসেজ পেয়েই অয়ন তড়িঘড়ি চিঠিটা বের করল। চিঠিটা হাতে নিয়ে প্রচণ্ড ভয়ে ও বিবর্ণ হয়ে গেল। প্রচন্ড একটা আতঙ্কের শিহরণ ওর শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে গেল।
অয়ন, আমার জীবনে বছর চারেক আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। দুর্ঘটনা ছাড়া আর কি বা বলব। তিনটে নরপশু একা পেয়ে আমার শরীরটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছিল। আমার চেনাজানা পৃথিবীটাকে একদিনেই নরক বানিয়ে দিয়েছিল। সেই দিন থেকে প্রতিটা পুরুষকেই আমি মনে করি হিংস্র ধর্ষক। প্রতিশোধ স্পৃহায় আমি পাগল হয়ে যাই। আমার সৌভাগ্য সেই তিন নরপশুর মধ্যে কোন একজন আমাকে একটা দারুণ উপহার দিয়েছিল। সেটা আজ আমার অস্ত্র। সে অস্ত্রে আমি পুরুষমানুষ শিকার করি। শিকারকে নিশ্চিত যন্ত্রণাময় মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এর থেকে আর ভালো কিছু হয়না। দূর থেকে উপভোগ করি আমার শিকারের মৃত্যু যন্ত্রনা। এবার আসল কথাটা বলি, আমার রক্তে রয়েছে ভয়ংকর এডস রোগের ভাইরাস। আমি ওদের কোলাহল আর উল্লাস শুনতে পাই। প্রতিটা শিকারের পরে ওদের উল্লাস যেন আরও বেড়ে যায়। অয়ন তোমার রক্তটা পরীক্ষা করিয়ে নিও।
ইতি শালিনী।
*****