১
অ্যাম্বুলেন্সের লাল আলোটা ক্রমাগত ঘুরে চলেছে আর সাইরেনটা পাগলের মতো বাজছে। অ্যাম্বুলেন্সে অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছেন নির্ঝরের মা প্রণতি মজুমদার। মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরানো। পাশে বসে আছে বিল্টু। পেছনে অন্য একটা গাড়িতে সামনের সিটে ভুরু দুটো যথাসম্ভব কুঁচকে, গম্ভীর মুখে বসে আছে নির্ঝর। ব্যস্ত রাস্তাটা ঠেলে ঠেলে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি যাবার চেষ্টা করছে সেবাপরায়ণ গাড়িটা। ভোর রাত্রে খুব গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রণতি। হয়তো বাথরুমে উঠতে গিয়েছিলেন, পড়ে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যান। নীচের তলায় ওনার দেওরের ছেলে বিল্টু রোজ ভোরবেলা উঠে পড়াশোনা করে। আজও অন্যান্য দিনের মতো পড়তেই বসেছিল বিল্টু। হঠাৎ একটা ভারী কিছু পড়ার মতো শব্দ শুনে ওপরে উঠে এসে ওঁকে পড়ে থাকতে দেখে সে। বাড়ির সবাইকে ডেকে তুলে, অ্যামবুলেন্সে খবরটা দিয়ে ফেলে, নির্ঝরকেও একটা ফোন করে দেয় বিল্টু। আসলে প্রণতি মজুমদার তাঁর শ্বশুর বাড়িতে দোতলায় একা থাকেন। নিজে রান্না করে খান। সংসারের বাকি কাজকর্ম করে দিয়ে যায় লতা নামের একটি মেয়ে। নীচের তলায় ওঁর দেওর পরিবার নিয়ে থাকেন। প্রণতির একমাত্র মেয়ে বিবাহ সূত্রে থাকে ব্যাঙ্গালোরে। একমাত্র ছেলে নির্ঝরও মায়ের কাছে থাকে না। সায়নীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার পর, সংযুক্তাকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। আসলে সায়নীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদটা প্রণতি কিছুতেই মেনে নেননি। তার একটা কারণও আছে। দুজনের মধ্যে বনিবনার অভাবে বিয়েটা ভেঙে গেছে- ঠিক এমনটা নয়। অনেক দিন ধরেই নির্ঝর সায়নীকে লুকিয়ে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। ওর হাবেভাবে সায়নী তো বটেই, প্রণতিও সবকিছু বুঝতে পারছিলেন। মেয়েটা নির্ঝরের অফিসেই চাকরি করে। যখন অবস্থা আয়ত্বের বাইরে চলে গেল, একদিন শ্বশুর বাড়ী থেকে চলে গেল সায়নী। নির্ঝর অবশ্য আজও বলে বেড়ায় যে, সায়নী চলে গিয়েছিলো বলেই সে অন্য সম্পর্কে যেতে পেরেছে। সে নির্ঝর যাই বলুক, প্রণতি কিছুতেই বিষয়টা মেনে নেননি। মা-ছেলের সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছিলো, তা বেড়ে উঠে ভাঙনে পরিণত হয়েছে। নির্ঝর সংযুক্তাকে বিয়ে করার পর নিজের বাড়িতে আসা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিলো। বাবলুর জন্মের পর থেকে আবার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। প্রণতি বাবলুকে তো মেনে নিলেন, কিন্তু আজও সংযুক্তার সঙ্গে কথা বলেন না। ওরা বাড়িতে আসলে নির্ঝরের সঙ্গেও দরকার ছাড়া কথা বলেন না। ফলে আসা-যাওয়া ততোটা স্বাভাবিক আর হয়নি। ওদিকে, সায়নীর সঙ্গে প্রণতি যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সায়নীর অনুৎসাহে সেটা হয়নি।
এখন দেওরের ছেলে বিল্টুই প্রণতির বল-ভরসা। বিল্টু কলেজে পড়ে। টুকটাক জিনিস কিনে আনা, লাইব্রেরী থেকে বই বদলে আনা, ডাক্তারের কাছে নাম লিখিয়ে দেওয়া, ব্যাঙ্কে কিম্বা ডাক্তারের কাছে যাবার জন্য রিক্সা ডেকে দেওয়া- এইসব কিছু বিল্টু খুব খুশী হয়ে করে দেয়। বিল্টু প্রায় বন্ধুর মতো প্রণতির কাছে। বিল্টুর আবার একটা প্রেম আছে। জেঠিমা সে সব কথা জানে। বিল্টুর সঙ্গে প্রণতির কথা হয়েছে যে, বিল্টুর এই প্রেমের বিষয়ে জেঠিমা বাবা-মায়ের মত করিয়ে দেবে। বদলে, জেঠিমার কাছে কথা দিতে হয়েছে যে, একবার বিয়ে করলে, মেয়েটাকে কখনো ঠকাবে না বিল্টু।
অ্যাম্বুলেন্সটা মাঝে মাঝে নজরের বাইরে চলে যাচ্ছে। নির্ঝরের গাড়িটা আটকে পড়ছে রাস্তার জ্যামে বা ট্র্যাফিক সিগন্যাল গুলোতে। "দিদিকে খবরটা দিতে হবে" মনে মনে ভাবলো নির্ঝর। ঠিক সেই সময় গাড়ির সিটে পড়ে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। নির্ঝর তাকিয়ে দেখলো, ফোনের স্ক্রীনে ফুটে উঠেছে "my love"। মানে সংযুক্তা ফোন করছে। ফোনটা টেনে নিয়ে ড্রাইভারকে নির্ঝর বললো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যাম্বুলেন্সটাকে খুঁজে অনুসরণ করতে। তারপর উত্তর দিলো,
- বল সোনা।
- ওদিকের কি খবর?
- হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। রাস্তায় আছি।
- আর কেউ আছে না একা তোমাকেই যেতে হচ্ছে?
- আর কে থাকবে? বিল্টু অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে আছে।
- অফিস যাবে?
- মনে হচ্ছে আজ আর যাওয়া হবে না।
- আমি?
- তুমি আর কি করবে? যাও অফিসে।
- কি ভাবে যাবো?
- আমি হসপিটালে পৌঁছে গাড়িটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি অফিসে পৌঁছে এখানে পাঠিয়ে দিও।
- এই, রাতে ফিরবে তো? বাবলু কিন্তু তোমাকে না দেখলে ভীষন কাঁদবে।
- আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ। ফিরে যাবো। তুমি চিন্তা করো না। চামেলী এসেছে?
- এলো তো একটু আগে।
- ঠিক আছে। তুমি বেরোবে তো, তৈরী হয়ে নাও।
- এই, শোনো না, তোমার দিদি জানে?
- না। হসপিটালে যাই। দেখি কি বলে! তারপর সব জানাবো।
- আসবে তো? নাকি সবকিছু তোমাকে একাই সামলাতে হবে?
- কেন আসবে না? তুমি এতো ভেবো না। রাখছি।
সংযুক্তার ফোনটা কাটতে না কাটতে আবার বেজে উঠলো ফোনটা। এবার দিদি।
- দিদি বল।
- মা এখন কেমন আছে, ভাই?
ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো ঝর্ণা। নির্ঝর বুঝলো, ওকে যেমন জানিয়েছে, তেমনই দিদিকেও বিল্টুই খবর দিয়েছে। আজকাল ওর জন্য আর কেউ অপেক্ষা করে না। এই তো, অ্যামবুলেন্সে ফোন করে দিয়ে তারপর বিল্টু ওকে ফোন করেছিলো। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ও বললো, - এই তো, হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। রাস্তায়...
- আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব, আসছি। আজকের ফ্লাইটে পারলে আজই। বিল্টুকে অনেক বার ফোন করলাম, ধরলো না। তাই...
দিদি ফোনটা কেটে দেবার পর নির্ঝর ভাবলো, বিল্টুকে না পেয়েই তাহলে ওকে ফোন করেছে দিদি। আর তখনই নিদারুণ একটা অভিমান ওর মনে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও এটাও জানে, এ অভিমান অকারণ, নিরর্থক। একদিন ও নিজেই ইচ্ছে করে সকলের থেকে দূরে চলে গিয়েছিলো। যেতে চেয়েছিলো। গাড়ির সামনের কাঁচ দিয়ে হসপিটালের বড়ো বাড়িটা চোখে পড়লো নির্ঝরের। অ্যাম্বুলেন্স নিশ্চয়ই এতক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে। ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলো,
- বিপুল, আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাও। বৌদিকে অফিসে ছেড়ে ফিরে এসো।
- আচ্ছা, দাদা।
ইমারজেন্সিতে প্রণতির পরীক্ষা শুরু হয়েছে। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। জ্ঞান নেই। অসাড় ভাবে পড়ে রয়েছে প্রণতির দেহটা। প্রাথমিক ভাবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট মনে হয়েছে ডাক্তারের। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্ঝর দেখলো, একটু দূরে বিল্টু ফোনে কথা বলছে। হয় কাকা-কাকিমা, না হলে দিদি, কাউকে সব বলছে। নির্ঝরের কাউকে কিছু বলার নেই। সংযুক্তা এখন অফিসের পথে। বিল্টুর সঙ্গে একসময় নির্ঝরের খুব বন্ধুত্ব ছিল। এখন আর দেখা হলেও দরকারী কথার বেশী কথা হয় না। হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নির্ঝরের হঠাৎ অনেক দিন পর সায়নীর কথা মনে পড়ে গেলো। কেন যেন মনে হলো, আজ সায়নী থাকলে, কখনো অফিসে চলে যেতো না। নির্ঝরের সঙ্গে থেকে যেতো। আর সত্যিই নির্ঝরের একা লাগতো না। মনে হলো, সায়নী কখনো গাড়িটা পাঠিয়ে দিতে বলতো না। বরঞ্চ বলতো, "গাড়িটা থাক তোমার কাছে। কখন কি দরকার হয়। আমি এমনি চলে যাবো"। মনে পড়লো, সায়নী থাকলে বিপদের সময় জোর দিয়ে সবাইকে বলতো, "সব ঠিক হয়ে যাবে"। আর ওর বলার মধ্যে এমন একটা কিছু থাকতো, যে সবাই বিশ্বাস করতো যে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবেই। আবার খুব একা লাগলো নির্ঝরের। কিন্তু ও তো একা নয়! ওর তো সুখী পরিবার। যেমন চেয়েছিলো, ঠিক সেই রকম জীবন। টাকা দিয়ে যা পাওয়া যায়, সেই সবকিছুই আজ ওর হাতের মুঠোয়। সাজানো ফ্ল্যাট, দামী গাড়ি, বিলাসের যত উপকরণ, যেসব কিছুর প্রতি ওর লোভ ছিল, যেসব কিছুর প্রতি ওর চরম আসক্তি আছে, সেই সব আজ ওর চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। টাকার ব্যাপারে সায়নীর মতো ছুঁতমার্গ নেই সংযুক্তার। কোথা থেকে সেটা আসছে- এই নিয়ে মাথাব্যথা নেই। শুধু ভোগ, ভোগ আর ভোগ। তাহলে এই একাকীত্ব কিসের? ভাবতে থাকে নির্ঝর।
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নির্ঝর বুঝতে পারলো, অবস্থা যথেষ্ট কঠিন। অসহায় আবেগে ও বললো,
- চিকিৎসার যেন কোনো ত্রুটি না হয়, ডক্টর। যে কোনও ব্যবস্থা করতে হয়, করুন। আমার মা'কে বাঁচান।
- দেখছি।
নামী হসপিটালের ব্যস্ত ডাক্তার গম্ভীর মুখে চলে গেলেন। কোনো আশার আলো দিয়ে গেলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়তে ইচ্ছে হলো নির্ঝরের। কাঁধে একটা হাত রাখলো কে যেন। ফিরে তাকিয়ে দেখলো, বিল্টু। আর সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো নির্ঝর। ওকে ধরে ফেললো বিল্টু।
২
অফিস থেকে ফিরে স্নান করতে অনেকটা সময় নেয় সায়নী। পাতলা টাওয়েলটা দিয়ে ভিজে চুলগুলো খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বেরোতেই চায়ের কাপ হাতে ঘরে এলো মা।
- ফোনটা অনেকবার বেজে গেছে। দেখ একবার।
- তুমি ধরলে না কেন, মা?
- আমি তো রান্নাঘরে ছিলাম। আসতে আসতেই কেটে যেতো।
বিছানার ওপর শুয়ে পড়ে ফোনটা টেনে নিলো সায়নী। চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে খাটের একপাশে বসলো মা। সায়নী দেখলো, চারটে মিসড কল মিতার। মিতা সায়নীর ছোটবেলার বন্ধু। এক পাড়া, এক স্কুল, তবে এক কলেজ নয়। স্কুল থেকে বেরিয়ে মিতা নার্সিং পড়তে গেলো। এখন ও নার্স আর সায়নী বেসরকারী সংস্থায় কাজ করে। মিতার নম্বরে ফোন করলো সায়নী। মাত্র একবার বাজতেই ফোনটা ধরলো মিতা। বললো,
- কোথায় ছিলি?
- স্নান করছিলাম। বল্ কি হয়েছে?
- তোর শাশুড়ি... মানে নির্ঝরের মা... আজ সকালে আমাদের হসপিটালে ভর্তি হয়েছে।
- সে কি? কি হয়েছে?
- হার্ট অ্যাটাক। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
- ডাক্তার কি বলছে?
- খুব একটা আশার কথা বলছে না। আমার আজ নাইট। এসে দেখেই তোকে ফোন করেছিলাম।
হঠাৎ আর কোনো কথা বলতে পারলো না সায়নী। একেবারে চুপ করে গেলো। ওর অবস্থা দেখে ওর মা ফোনটা নিয়ে মিতার সঙ্গে কথা বলে, সব কথা জেনে নিয়ে রেখে দিল ফোনটা।
সারারাত ধরে প্রবল বৃষ্টি হয়ে সকালে একটু থেমেছে। কালো মেঘে ঢাকা দিনটা যেন গুম হয়ে আছে। দোতলার জানালা দিয়ে সায়নী দেখলো রাস্তা গুলো ডুবে গেছে জলে। তবু ও সাতটার মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। এখান থেকে হসপিটালে যেতে আধঘন্টা লাগবে। সাড়ে সাতটার মধ্যেই পৌঁছে যাবে। রাত আটটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত মিতার নাইট ডিউটি। মিতার সাহায্যে একবার প্রণতিকে দেখে, অফিসে চলে যাবে সায়নী। সারারাত একটুও ঘুমোয়নি ও। যে সব দিনগুলোকে ভোলার জন্য এতোদিন ধরে চেষ্টা করে চলেছিলো ক্রমাগত, সেই সব দিনগুলো যেন কোনো বারণ না মেনে, বন্ধ আগল ঠেলে সার দিয়ে এসে দাঁড়ালো সায়নীর চোখের সামনে, সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো! ওই তো সায়নীর ভেজা চুল নিজের ধবধবে সাদা টাওয়েল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছেন প্রণতি। সায়নীকে রান্না শিখিয়ে দিচ্ছেন। ওই তো মোড়ের মাথা থেকে ফুচকা কিনে এনে ছাদে বসে খাচ্ছে দুজনে। একসাথে পূজোর বাজার করতে যাচ্ছে। আর গল্প? দুজনে একসাথে থাকলেই চলে গল্প। বেশীরভাগ সময় প্রণতি বলেন, সায়নী থাকে শ্রোতার ভূমিকায়। বেশীরভাগ সময় প্রণতি নিজের ফেলে আসা দিনগুলোর ছবি আঁকেন বসে বসে। ছেলেবেলা, কলেজ, প্রথম প্রেম, প্রথমবার বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখা, বিরহ, বিচ্ছেদ, বিয়ে, সংসার, ছেলে, মেয়ে, স্বামী, শশুর বাড়ির লোক- যেদিন, যখন যে কথা মনে পড়ে, সায়নীকে বলে ফেলেন প্রণতি। "জানিস, তোর শ্বশুর দূর্গাপূজার সময় নিজে পছন্দ করে একটা শাড়ি আমাকে কিনে দেবেনই। আর সেটা পরেই আমাকে অষ্টমীর অঞ্জলী দিতে হবে"। কিম্বা বলতেন, "ছুটির দিনে একটা কিছু রান্না করবেনই উনি। আমার পছন্দের জিনিস। সেটা আবার বাড়ির কেউ জানবে না"। বলেই, লাজুক হেসে বলতেন, "ওই যে তোরা বলিস না, 'সিক্রেট', এটাও ওইরকম"। কি মনে পড়ায় বলতেন, "হ্যাঁ রে, তোদের কোনো সিক্রেট নেই?" সায়নী হেসে বলতো, "না, মা"। প্রণতি বলতেন, "সত্যিই নেই, নাকি আমাকে বলবি না?" সায়নী হাসি দিয়ে এড়িয়ে যেতো। সত্যিই ততোদিনে ওর আর নির্ঝরের কোনো সিক্রেট অবশিষ্ট ছিল না। নির্ঝরের সিক্রেট তখন অন্য কোথাও, অন্য মানুষের সঙ্গে। একদিন প্রণতি দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর সায়নীকে বললেন,
- আজ তোকে এমন একটা কথা বলবো, যেটা শুধু তোর আর আমার সিক্রেট হয়ে থাকবে চিরকাল। এই কথা আর কেউ জানে না। ঝর্ণা বা নির্ঝর না, এমনকি তোদের বাবাও না। বুঝলি?
- কিন্তু আমাকেই কেন বলবে, মা?
- বলবো, কারণ তুই বুঝবি।
বলেছিলেন প্রণতি নিজের একটা মধুর সিক্রেট। কলেজে পড়ার সময় প্রণতির যে ভালোবাসা পরিণতি না পেয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিলো, তার নাম অলোক। অলোক কলেজের শেষ পরীক্ষাটা দিয়েই বিদেশে চলে গিয়েছিলো। কথা ছিল কয়েক বছর পর ফিরে এসে দুজনে বিয়ে করবে। কিন্তু একবছর যেতে না যেতেই প্রণতি খবর পেলেন, অলোক বিদেশে গিয়ে এক মেমসাহেবকে বিয়ে করেছে। যারা বলেছিলো, তাদের কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। প্রথমটায় খুব ভেঙে পড়েছিলেন প্রণতি। তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে শান্ত করে নিলেন। তাঁরও বিয়ে হয়ে গেলো। সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত প্রণতির মনে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসলো অলোক। নির্ঝরের যখন প্রায় দশ বছর বয়স, একদিন দুপুরবেলা একটা ফোন এলো। পুরনো বন্ধুদের কাছ থেকে নম্বর জোগাড় করে অলোক ফোন করেছে। অনেক দিন পর বিদেশ থেকে ফিরেছে। একবার দেখা করতে চায়। এক সপ্তাহ ধরে টানাপোড়েন চলে প্রণতির মনে। একটা মন চায় যেতে। যতো প্রশ্ন, যতো অভিযোগ সব কিছুর এ জীবনের মতো সমাধান খুঁজতে। আর একটা মন ভয় পায়। প্রবল অভিমানকে 'নিরাসক্তি' বলে মানতে চায়। শেষ পর্যন্ত প্রথম মনেরই জয় হলো। দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রণতি। হয়তো প্রসাধনে সেদিন অকারণেই একটু বেশী যত্ন ছিল। হয়তো বিনা কারণেই মন উতলা হচ্ছিলো। গিয়ে কেমন দেখবেন অলোককে? আগের মতো? নাকি এতদিন বিদেশে থেকে একদম বিদেশীদের মতো?
একটা নামী রেস্তোরাঁয় টেবিল ঠিক করে রেখেছিলো অলোক। প্রণতি গিয়ে দেখলেন, গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবীতে অলোককে কেমন ঋষির মতো দেখাচ্ছে। কে বলবে এতোদিন বিদেশে ছিল? চুলটা একটু পাতলা হয়ে গেছে বয়সের সঙ্গে। অথচ মুখের হাসিটা সেদিনও একইরকম। অলোকের তখনো মনে রয়েছে, প্রণতি পাইনাপেল জুস খেতে ভালোবাসেন। বললো,
- ওটাই অর্ডার করি?
- তোমার এখনও মনে আছে?
- কেন মনে থাকবে না?
- কিন্তু এখন আর ওটা আমার প্রিয় নয়। আর খাই না।
- কেন?
প্রণতি হেসেছিলেন। বলেছিলেন,
- এমনি।
দুটো কফি দিয়ে গেলো ওয়েটার। অলোক একটাই কথা বলার জন্য ডেকেছিলো প্রণতিকে। সেটাই বললো,
- আমার জন্য অপেক্ষা করলে না কেন?
- মানে?
- দেশে ফিরে শুনলাম, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি মধ্যপ্রদেশে ছিলে তখন। কি এমন হলো যে, তুমি এইরকম একটা কাজ করলে? আমি যতদূর তোমাকে চিনি, তুমি তো এরকম নও! তাহলে কি হয়েছিলো?
- আমি তো শুনেছিলাম, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। কোন এক মেমসাহেবকে তুমি নাকি বিয়ে করেছো?
- কি বলছো বলতো? আমাকে জানো না তুমি?
- জানতাম, চিনতাম। কিন্তু সেই সময় অনেকদিন তুমি আমার একটা চিঠিরও উত্তর দাও নি। কোনরকম যোগাযোগ করোনি।
- আমি বাড়ি বদল করছিলাম। সেই দিনই রাস্তায় গাড়িতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। তাই নতুন ঠিকানা আর তোমাকে পাঠানো হয়নি। অনেক দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কয়েক মাস পর সুস্থ হয়েই দেশে আসি। তখন শুনলাম তোমার বিয়ের কথা।
রেস্তোরাঁর ভেতরে, চলমান আলোর আঁকিবুকি আর মৃদু বাজনার এক মায়াময় পরিবেশে, একদিকে সুখের আবেশে আর একদিকে অব্যক্ত যন্ত্রণায় সেদিন উদ্বেল হয়ে উঠেছিলেন প্রণতি। অলোক আজও তাঁরই জন্য অপেক্ষা করে আছে। আজও তাঁকেই ভালোবাসে। তিনি যা শুনেছিলেন, সব ভুল। সবটাই ভুল। অনেক.. অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে অলোক বলেছিলো,
- তুমি আর আসতে পারো না, না?
- অলোক?
- তুমি সুখী?
প্রণতি সহসা উত্তর দিতে পারেন না। এতোদিন তিনি জানতেন, তিনি সুখী। তাঁর বর্তমান স্বামী তাঁকে খুব ভালোবাসেন। তিনিও ভালোবাসেন তাঁর স্বামীকে। ফুটফুটে দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁদের সাজানো সংসার। উৎসবে, কর্তব্যে তাঁর দিনগুলো ভরপুর। তবু আজ এই আবছা আলোয় ভরা ঘরটার মধ্যে বসে তাঁর মন কেন তবে এমন হু হু করে উঠলো? কেন তবে মনে হলো, তাঁর জীবনের অসম্পূর্ণতা অনেকখানি। কারণ, তাঁর অলোককে পাওয়া হয়নি। এ দোষ তো তাঁর নয়, তাঁর স্বামীর নয়, এমনকি অলোকেরও নয়। সেদিন অলোককে বলে এসেছিলেন, জীবিত অবস্থায় ওঁরা কেউ আর পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না। প্রণতি ভয় পেয়েছিলেন, সামান্য সুযোগে তাঁদের পুরনো ভালোবাসা আগুন হয়ে জ্বলে না ওঠে। জ্বালিয়ে না দেয় আশেপাশের সবকিছু। এতো ভালোবাসাও অবশিষ্ট ছিল তাঁর মনে? এতো অভিমান আর অভিযোগের পাহাড়ের আড়ালে? এতোদিনে এতোটুকুও মলিন হয় নি?
হতবাক হয়ে কথাগুলো শুধু শুনেছিলো সায়নী। কোনো কথা বলতে পারেনি। প্রণতির একটু সময় দরকার- সেটা বুঝতে পেরে, তখনকার মতো আস্তে আস্তে সেখান থেকে উঠে চলে গিয়েছিলো।
৩
মায়ের শিয়রের কাছে তাজা রজনীগন্ধার গুচ্ছটা দেখে মনটা কেমন করে উঠলো নির্ঝরের। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মা। মুখে অক্সিজেন মাস্ক তখনো পরানো। জ্ঞান নেই। মায়ের হাসিটা খুব সুন্দর- হঠাৎ মনে পড়লো নির্ঝরের। মায়ের দিকে তাকিয়ে ও দাঁড়িয়েই রইল। নার্স এসে তাড়া দিতে, তাড়াতাড়ি বাইরে এসে ভিসিটিং কার্ডটা ঝর্ণাকে দিয়ে দিলো। দুপুরের মধ্যেই এসে গেছে ঝর্ণা। এখন ভিসিটিং আওয়ার। কাছাকাছির মধ্যে যেসব আত্মীয় স্বজন থাকে, অনেকেই খবর পেয়ে দেখতে এসেছে প্রণতিকে। নির্ঝর দেখলো, একটু দূরে বিল্টু দাঁড়িয়ে আছে, বাইরের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে। নির্ঝর গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালো।
- বিল্টু, কিছু খেয়েছিস?
- হ্যাঁ। বাড়ি গেছিলাম তো।
- চা বা কফি কিছু খাবি?
- নাঃ।
বলে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো বিল্টু। নির্ঝর বুঝতে পারছে, ওপর ওপর কথা বললেও, সবাই ওকে একটু এড়িয়ে চলছে। অথচ, ওর নিজের পরিবারের লোকজন এরা। হঠাৎ সায়নীর ওপর রাগ হয়ে গেলো নির্ঝরের। বিচ্ছেদ কি কারো হয় না? কি এমন দোষ করেছে নির্ঝর? যাকে পছন্দ, তাকে বিয়ে করেছে। আচ্ছা, সায়নীকেও তো সে-ই পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো! সাদা রজনীগন্ধার গুচ্ছটা চোখে ভেসে উঠলো নির্ঝরের। স্মৃতিতে ভেসে উঠলো একটা ছবি- একটা পঁচিশে বৈশাখের সন্ধ্যা। ঘরোয়া ভাবে ছাদে পালন হচ্ছে রবীন্দ্র জয়ন্তী। একজন অল্পবয়সী মেয়ে আর একজন প্রৌঢ়া একসাথে গাইছে, ".... আমার মতন সুখী কে আছে, আয় সখী আয় আমার কাছে.. সুখী হৃদয়ের সুখের গান, শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ... প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল.. একদিন নয় হাসিবি তোরা... একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা...."। চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো নির্ঝরের। এই সুখ, এই হাসি আজ কি আছে নির্ঝরের জীবনে? পয়সা দিয়ে কি কেনা যায় মায়ের মুখের সেই হাসি? নির্ঝরের মনে পড়ে গেলো, কতোদিন মা ওইরকম ভাবে হাসেনি। এতোদিন নির্ঝর নিজে অভিমান জমিয়ে রেখেছিলো মায়ের ওপর। আজ মায়ের অভিমানের দিকটা দেখতে পাচ্ছে নির্ঝর। মা নিজের অভিমানের কথা কাউকে বলতো না। কিন্তু, কাউকেই কি বলতো না?
- এই, এখানে কি করছো?
সংযুক্তা অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে এসেছে নির্ঝরকে নিয়ে যাবে বলে। নির্ঝর নিরস ভাবে বললো,
- কিছু না।
- মা'কে দেখেছো? এখন কেমন আছে?
- একই রকম। তুমি গেছিলে?
- নাঃ। একজন করে সমানে যাচ্ছে আর বেরোচ্ছে। বাড়ি ফিরবে তো?
- দেখি। যদি রাতে কাউকে থাকতে বলে..
- এই, প্লীজ। সারাদিন তো ছিলে। রাতে অন্য কাউকে বলো না থাকতে।
এবার একটু বিরক্ত হলো নির্ঝর। বললো,
- কাকে বলবো? আমার মা, আমি অন্য কাউকে বলবো?
সংযুক্তা আর কিছু বললো না। ওরা আই সি ইউ -এর সামনে এসে দেখলো, ঝর্ণা আর বিল্টু ছাড়া আর কেউ নেই। সংযুক্তা ভেতরে গেলো। বিল্টু নির্ঝরকে বললো,
- ডাক্তার ছ'টার পর আসবে। তুমি থাকবে তো সেই পর্যন্ত? কথা বলতে হবে তো।
- হ্যাঁ, থাকবো।
সব দিক থেকে বিরক্তি ছেঁকে ফেলেছে নির্ঝরকে। এই যে সবাই এমন একটা ভাব করছে যেন নির্ঝরের ওপর কোনো আস্থা রাখাই চলে না। এতো ছোট যে বিল্টু, তারও প্রত্যেকটা কথায় একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ। তার ওপর সংযুক্তা কেবল বাড়ি যাওয়ার তাড়া দিচ্ছে। পাঁচটায় ভিসিটিং আওয়ার শেষ। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হলে আরও একঘন্টা থাকতে হবে। সংযুক্তা কি থাকতে চাইবে?
ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা হলে বিল্টু নির্ঝরকে বললো,
- আজ রাতে আমি থেকে যাচ্ছি। তুমি কাল সকাল সকাল চলে এসো।
-ঠিক আছে। আমি আটটায় এসে আবার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবো। রাতে কোনো অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করিস।
ঝর্ণাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি যখন নির্ঝরের ফ্ল্যাটের দিকে চলতে শুরু করলো, পেছনের সিটে সংযুক্তা একেবারে নির্ঝরের কোলের ওপর ঢলে পড়লো। নির্ঝরও, অনেকক্ষণ পর পরিচিত জীবনের ছন্দে ফিরতে পেরে যেন অনেকটা স্বচ্ছন্দ বোধ করলো।
৪
পুরনো রজনীগন্ধার গুচ্ছটা সরিয়ে নিয়ে, টাটকা ফুলগুলো প্লাস্টিকের ফুলদানিটায় সাজিয়ে রাখলো সায়নী। কাঁপা গলায় ডাকলো, "মা?" গত তিনদিন ধরে রোজ সকালে এভাবেই হসপিটালে আসছে সায়নী। রোজই আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে থাকতে দেখছে প্রণতিকে। রোজ পুরনো দিনের মতো 'মা' বলে ডাকছে। হয়তো ভাবছে, এই ডাক, এই ফুলের গন্ধ যদি পুরনো দিনের কথা মনে পরিয়ে দেয় ওঁকে! যদি ওঁর অবচেতনে পৌঁছে যায় সায়নীর ভাবনা। মিতা সতর্ক ডাক দিল,
- চলে আয়, সায়নী।
- মিতা দেখ, ওঁর চোখের পাতা দুটো কেঁপে উঠলো না?
মিতা এসে ভালো করে দেখলো। কিন্তু কিছু বুঝতে পারলো না। ও সায়নীর হাত ধরে টানলো।
- চল্ এবার।
ফিরে আসছিল দুজনেই। হঠাৎ অস্ফুটে একটা শব্দ করে উঠলেন প্রণতি। জড়ানো গলায় যেন কিছু বলছেন। সায়নীকে বাইরে যেতে বলে মিতা দৌড়লো ডাক্তারের কাছে। চলে আসতে গিয়ে আরও একবার ফিরে তাকালো সায়নী। ঘোলাটে চোখ দুটো খুলে কাকে যেন খুঁজছেন প্রণতি। যে কোনো মুহূর্তে ডাক্তার এসে পড়বে। সায়নী তাই আই সি ইউ এর বাইরে এসে অপেক্ষা করছিলো মিতার জন্য। হঠাৎ দেখলো, সামনের লিফটের দরজা খুলে নির্ঝর বেরিয়ে আসছে। কব্জির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় আটটা বাজে। এই সময়ই তো নির্ঝর আসে রোজ। সিঁড়িটা দিয়ে হুড়মুড় করে নীচের দিকে ছুটলো সায়নী। বাইরে, একেবারে বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে ওর- উত্তেজনায়, ভয়ে। কতদিন পর নির্ঝরকে দেখলো? এক বছর না দুবছর? ঠিক মনে পড়লো না। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলো না সায়নী। চোখ দুটো জলে ভরে গেছে। চোখের জলে ভিজে গেছে মুখটা।
- বৌদি?
চমকে ফিরে তাকালো সায়নী। মুখটা মুছে নিলো ভালো করে।
- বিল্টু?
- কি হয়েছে, বৌদি?
- কিছু না।
- রোজই তোমাকে দেখি। তুমি একজন নার্সের সঙ্গে ভেতরে যাও।
- তুমি রোজ আমাকে দেখো?
- আমি রোজ রাতে থাকি যে! সারাদিন ছোড়দা থাকে। রাতে আমি।
- ডাক্তার কি বলছে?
- কিছুই বলছে না। আশা করার মতো কিছু তো নয়ই।
দুজনেই চুপ করে থাকে। একসময় বিল্টু বললো,
- তুমি কোথায় যাবে এখন?
- অফিস যাবো। তার আগে মিতার সঙ্গে দেখা করবো।
- মিতা মানে ওই নার্স মহিলা?
- হ্যাঁ। আমার ছোট বেলার বন্ধু।
- আচ্ছা বৌদি, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
- বলো।
- তুমি রোজ সকালবেলা লুকিয়ে আসো কেন? এমনি সময় আসলে কেউ তো বারণ করতো না।
- না। তা করতো না।
- তাহলে?
সায়নী বিল্টুর কথার উত্তর দিতে পারে না চট করে। কেন ও সকালে আসে? ও কি চায় না, কেউ ওকে দেখুক? নাকি ও একেবারে একা প্রণতির সঙ্গে দেখা করতে চায়? নাকি ও নির্ঝরের সামনা সামনি পড়তে চায় না আর? নাকি সবগুলো মিলিয়ে এমন একটা অস্বস্তি, যার থেকে পরিত্রাণ পেতেই ও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে আসে প্রণতিকে? উত্তর না পেয়ে বিল্টু অন্য প্রসঙ্গে যায়।
- বৌদি, একদিন এসো না আমাদের বাড়ি?
- তোমাদের বাড়ি?
- হ্যাঁ। বাবা-মা, জেঠিমা সবাই খুব খুশী হবে তুমি এলে।
অন্যমনস্ক ভাবে সায়নী উত্তর দিলো,
- দেখি!
বিল্টু আরও অনেক কথা বললো সায়নীকে। নির্ঝর আর সংযুক্তার সঙ্গে প্রণতির সম্পর্কের কথা। প্রণতির একা থাকার কথা। মরনোত্তর দেহ দান করেছেন প্রণতি। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নমিনি করেছেন বিল্টুর বাবাকে। বলে রেখেছেন, তাঁর কিছু হয়ে গেলে যে যা খরচ করবে তাঁর চিকিৎসার জন্য, সব যেন সেই টাকা থেকে শোধ করে দেওয়া হয়। কারো কাছে কোনো ঋণ রাখতে চান না তিনি। শুনতে শুনতে সায়নীর দু'চোখ ছাপিয়ে আবার বন্যা হয়ে গেলো। এই সবকিছুর বেশ খানিকটা যে সায়নীর জন্যই, সেটা ওর চেয়ে বেশী কে জানে! প্রণতি যোগাযোগ করতে চাইতেন সায়নীর সঙ্গে। মাঝে মাঝেই ফোন করতেন। অসহ্য যন্ত্রণায় তখন সায়নী অবসন্ন। প্রণতিকে 'নির্ঝরের মা' ছাড়া অন্য কিছু ভাবার মতো মনের অবস্থা তখন ওর ছিল না। নির্ঝর সংক্রান্ত যে কোনো বিষয় তখন ও এড়িয়ে চলতে চাইতো। তাই প্রণতির সঙ্গে সহজ সম্পর্কটা বজায় রাখতে পারে নি সায়নী। সেই কথা মনে করে এখন ওর সমস্ত চেতনা ব্যথায় অবশ হয়ে গেলো। একবার যদি বাড়ি ফিরে আসেন তিনি, এবার থেকে সায়নী যাবে তাঁর কাছে। একটা অন্য, সম্পূর্ণ নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলবে। তাঁর আর সায়নীর আর একটা সিক্রেট হবে সেটা- ভাবলো সায়নী। তখনই দেখতে পেলো, হসপিটালের গেট পার হয়ে মিতা বেরিয়ে আসছে। কাছে এসে বললো, "মনে হয় এ যাত্রায় রক্ষা হলো।"
বিল্টু আর মিতা যে যার বাড়ির দিকে চলে গেলো। একা বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে, অফিসগামী বাসের অপেক্ষা করতে করতে, গালে লেগে থাকা চোখের জলের দাগ রুমাল দিয়ে মুছে নিতে চেষ্টা করছিলো সায়নী। ভাবছিলো, জলের দাগ ওপর থেকে হয়তো দেখা যায় না, কিন্তু মোছা যায় কি!
-----------------------
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
সোমা চক্রবর্তী।
Kalikapur, Taki road
(near Shanti Bhawan wedding hall)
PO. Barasat , 24 Pgs (N), WB.