আমার জীবনে ভৌতিক অভিজ্ঞতার ঝুলি টা
কিন্তু কম নয়! আমি জীবনে বেশ কিছু ভৌতিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। তার
মধ্যে অনেক ভৌতিক ঘটনার যেমন কূলকিনারা করতে পেরেছি, আবার এমন অনেক ভৌতিক
ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি যার কূলকিনারা আজ পর্যন্ত করতে পারলাম না। মাঝে মাঝে
এইসব ভৌতিক ঘটনা মনকে বড্ড নাড়া দেয়, উতলা করে তোলে। ভূতের সঙ্গে গল্প !
কথাটা শুনে খুব অবাক লাগছে! লাগারই কথা, কারণ এমন ঘটনা তো সচরাচর ঘটে না,
এই ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা আমি অনেককেই বলেছি, কিন্তু সকলেই প্রায় হেসেই
উড়িয়ে দিয়েছে। আজকে আমি এমনই একটা লোমহর্ষক ভৌতিক অভিজ্ঞতার কাহিনী
তোমাদের শোনাব।
আমার জীবনে এই লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটেছিল খুব সম্ভবত
আটের দশকের প্রথমার্ধে। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স বড়জোর ১৫-১৬
হবে, ভাদর মাস, খুব সম্ভবত সকাল দশ-এগারো টা হবে বোধ হয়। শেষ ভাদরের কোন
এক রবিবারে মন্তেশ্বরে দীনেন স্যারের কাছে পড়ে বাড়ি ফিরছি। বলে রাখা
ভালো যে ঘন্টা দেড়েক আগেই প্রবল বর্ষণ হয়েছে, রাস্তাঘাট খুব পিচ্ছিল, তার
ফলে আলপথ ধরেই বাড়ি ফিরছি। কর্দমাক্ত আলপথ, সেই কারণে চলতে একটু অসুবিধা
হচ্ছে। একটু অসতর্ক হলেই পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয়। তখনকার দিনে প্রায়
সকলেই মন্তেশ্বর যাতায়াতে আলপথ-ই বেশি ব্যবহার করতো। কারণ তখন মন্তেশ্বর
-সুটরা রোডটা ছিল সম্পূর্ণ কাঁচা, আর বর্ষাকালে তো বলতেই হবে না, মানুষ
চলাচলের ও অযোগ্য হয়ে উঠতো।
যাই হোক, অতি কষ্টে আগুন পুকুর থেকে জোড়া পুকুরের
পাড়ে উঠেছি, দূর থেকে দেখছি একজন মাঝবয়েসী ভদ্রমহিলা বসে আছে, পড়নের
কাপড় -চোপড় ও ভিজে। মনে মনে ভাবলাম হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, কাছে গিয়ে
দেখলাম আমাদের গ্রামেরই দাসপাড়ার ভুবনের মা, সামনে আলু আনাজ -পত্র সব
ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে জায়গাটা ও অনেকটা দলানো অবস্থায়। মনে মনে ভাবলাম
হয়তো পা স্লিপ করে পড়ে গেছে। শুধু তাই নয়,কানের কাছ থেকে অল্প রক্ত
ঝরছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম-"এখানে এভাবে বসে আছো কেন? বাড়ি চলো? ভুবনের মা
বলল -"না আমি আর বাড়ি যাব না, আমার মালপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছে, ভুবন
আমাকে বকাবকি করবে," আমি বললাম -"না, তুমি চলো তো! কেউ তোমাকে কিছু
বলবেনা!"
আমি আনাজ পত্রগুলো কুড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে
দিলাম, যাইহোক আমার আশ্বাস পেয়ে ভুবনের মা আমার পিছু পিছু আসতে লাগলো।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আলপথ ছেড়ে মেন রোডে এসে উঠেছি, তারপর আপন মনে
হেঁটে চলেছি। সামনে ছোটপুলে পাশের গ্রামের কয়েক জন ছেলে মাছ ধরছিল, উৎসুক
ভাবে কতটা মাছ পেল তা দেখছি। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাই নি, আনমনে বড়পুল ও
পেরিয়ে এসেছি, খুব দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, সামনে গয়লাগড়ের কাছে বেশ
কিছু লোক জড়ো হয়েছে, মনে মনে ভাবলাম হয়তো এই ভাদর মাসে মাঠে জমি নিরান
করার জন্য লোকজন বসে আছে, হয়তো গল্পগুজব করছে।
কিন্তু সামনে এসে আমার সব ভুল ভেঙে গেল। আমি
তো আকাশ থেকে পড়লাম! দেখলাম ভুবনের মা মরে পড়ে আছে! আর দাসপাড়ার অনেকই
তাকে ঘিরে রয়েছে, মনকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কিছুক্ষণ আগে
জোড়া পুকুরে আমি কাকে দেখলাম? ওটাতো নিশ্চিত ভুবনের মা! মন আমার উথাল
পাথাল করছে! বারে বারে জিজ্ঞাস করছে! কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না! দেখি ভুবন
ওর মায়ের মাথার কাছে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে, আমার আরেক বন্ধু সুজয় বলল
,-"আজকে জোড়া পুকুরে পাড়ে বাঁজ পড়ে ভুবনের মা মারা গেছে!" আমি আর আমাতে
নেই, আর ওখানে আমি দাঁড়াতে পারলাম না! ভুবন কে সান্তনা বাক্য দেওয়ার মত
আমার মনের অবস্থা ছিল না! দ্রুত বাড়ি চলে এলাম!
বাড়ি এসে ঘরে বইপত্র রেখে কোনরকমে হাত মুখটা ধুলাম।
স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি। কাউকে কিছু না বলে একমনে উদাস নয়নে
দাঁড়িয়ে আছি। ঘোর কাটল মায়ের ডাকে। মা বললো -"কখনো সেই সকালে খেয়ে
গেছিস, তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে নে!" খাবার খেতে বসেছি, ওমনি মা
বলল-"শুনেছিস বাবা, আজ সকালে জোড়া পুকুরের কাছে বাঁজ পড়ে ভুবনের মা মারা
গেছে?" মায়ের প্রশ্নটাও যেনো অসহ্য লাগলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোনরকমে বললাম -
হ্যাঁ এইমাত্র শুনলাম! মা বলল-"সেই সকাল থেকে তোর জন্য ভীষন চিন্তা
হচ্ছিল!" আমি একটু ঢোক গিলে বললাম-"বৃষ্টির জন্য আসতে দেরি হয়ে গেল!"
খাওয়ার ইচ্ছাটা আগেই মরে গেছিল, মা কিছু ভাববে তাই খেতে বসা। সাত
তাড়াতাড়ি কোনরকমে আধখাওয়া খেয়ে উঠে পড়লাম!
যাইহোক বাড়িতে কাউকে কিছু বললাম না, সারাদিন
ব্যাপারটা মনের মধ্যে চেপে রেখে দিলাম, রাতে ভাল ঘুম হয়নি, পরের দিন টিউশন
পড়তে যেতে যেতে কয়েকজন বন্ধুকে ব্যাপারটা বললাম, সবাইতো হো হো করে হেসে
উড়িয়ে দিল । মনে মনে ভাবলাম-- আমিই হয়তো ভুল দেখেছি! ধীরে ধীরে মন
থেকে ব্যাপারটা উঁড়েই গেল।
আজ চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে, গঙ্গা দিয়ে অনেক জল
গড়িয়ে গেছে। সেদিন হঠাৎ শেষ ভাদরে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে আবার সেই
লোমহর্ষক ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো, লিখে ফেললাম একটা গল্প, পাঠকদের
অনেকেরই কাছে খটনাটা অবাস্তব বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সেদিনের ঘটনাটা
আমার চোখের সামনে ভাসছে, জ্বলজ্বল করছে ! অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই।
মহাকালের সাক্ষী হয়ে হয়তো স্মৃতিতে ধূলিধূসরিত হয়ে থাকবে চিরকাল! তাই
গল্প হলেও সত্যি।।
------------------------------
গ্ৰাম- সাহাপুর
পোঃ- আসানপুর
থানাঃ- মন্তেশ্বর
জেলা- পূর্ব বর্ধমান