জন্মাষ্টমীর সকালে নীহারিকা তাদের জাগ্রত রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরছে, সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার মাঝে মাঝে দুই এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। একলা মনে পথ চলতে চলতে তার মনে হয় কেউ যেন তাকে অনেক দূর থেকে ডাকছে - রিকা একটু দাঁড়াও প্লিজ।
নীহারিকা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো কেউ নেই। তারপর নিজের মনের ভুল ভেবে আবার নিজের মনে হাঁটতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর আবারও কানে ভেসে আসে - দাঁড়াও একটু রিকা আমি রমেশ। রমেশের কথা শুনে নীহারিকা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে গটগট করে হেঁটে বাড়ি ফিরে এসে টেবিলের ওপর পুজোর থালাটা রেখে,নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা সজোরে বন্ধ করে দেয় এবং খাটের ওপর বসে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে।
তার এই আচরণ মায়ের মনে যেন কোনো একটা প্রভাব ফেলে। তিনি লক্ষ্য করেন মেয়েটা যেন কোন কারনে ভালো নেই। তাই তিনি ঘরের দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বলেন - এই রুমি দরজা খোল, দরজা খোল, তাড়াতাড়ি খোল। নীহারিকা কোন রকমের দরজা খুলে থপ করে আবার খাটে বসে পরে। মন খারাপ দেখে মেয়ে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম সুরে প্রশ্ন করেন - কি হয়েছে রুমি? সকাল থেকেই তো ভালই ছিলি কিন্তু আবার কি হলো? নীহারিকা তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে - মা রমেশ।
রমেশের কথা শুনে তার মা চমকে ওঠেন, তখনও তাদের চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ প্রত্যক্ষ করা যায়। মা ভয়ে ভয়ে বলেন - আবার রমেশ, সে এখানে কি করছে, কোথা থেকে এলো? নীহারিকা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে - সব আমারই ভুল মা। আমি আজ সব শেষ করে দিতে চাই বলেই, সে উঠে দাঁড়ায়। তার মা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন - চুপ কর রুমি সব পুরনো কথা বাদ দিয়ে নতুন করে জীবনটাকে শুরু করো মা। তুই রমেশকে ভুলে যা। ওটা একটা দুর্ঘটনা ছিলো। আয় তোর খাবার বেড়ে দি খেয়ে নে, বলে তিনি চলে যান।
নীহারিকার মনে পড়ে সেই ভয়ংকর অতীত, সে তখন সবে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। নতুন স্কুল নতুন বন্ধুবান্ধব তো খুব ভাল লাগছে তার, বেশ কয়েকদিন ধরেই সে লক্ষ্য করে কেউ যেন তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে, উঠতি বয়স। এই বয়সে এমনটা হয়েই থাকে।
এমন এক জন্মাষ্টমীর সকালে সে পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো এমন সময় সেই ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতে একগুচ্ছ লাল গোলাপ পরনে লাল পাঞ্জাবী; হাঁটু মুড়ে বসে গোলাগুলি দুই হাতে বাড়িয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বলে - ডু ইউ লাভ মি রিকা? নীহারিকা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, সে সাত পাঁচ কিছু না ভেবেই বলে - হুঁ।
গোলাপ গুলি নিয়ে ছুটে চলে আসে বাড়িতে। মাকে সব কথা বলে সে, মা প্রচন্ড রেগে ঠাস্ ঠাস্ করে চড় মেরে ফুলগুলি তার হাত থেকে নিয়ে মাটিতে ফেলে দেন এবং বলেন - ও তুমি এখন বংশের মুখে চুনকালি দিতে শিখে গেছো? এই শিক্ষা দিয়েছি তোমায়? কোন রুচিবোধ নেই তোমার? এভাবেই নীহারিকা জীবনের সুখ-দুঃখ হাসি কান্না যেন খেলা করে যায় বেশ কয়েকটি মাস। সে এবার একাদশ শ্রেণির পাঠ শেষ করে দ্বাদশ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে।
সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো নীহারিকার শরীর ভয়ে শিউরে ওঠে, অবশেষে এলো সেই দুর্বিষহ দিনটা। যেদিন রমেশ তার হাত দুটো ধরে অনুরোধ জানায়, আমার খুব বিপদ আমার বন্ধু পার্থ শিলিগুড়িতে থাকে খুব অসুস্থ হয়তো বাঁচবো না। এক্ষুনি হাজার দশেক টাকার প্রয়োজন তুমি কি পারবে টাকাটা জোগাড় করে দিতে আমি পরে দিয়ে দেব। সেই রাত্রে নীহারিকা তার বাবার আলমারি থেকে হাজার ছয়েক টাকা চুরি করে রমেশের সাথে শিলিগুড়ি চলে যায়। তার বাবা সব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এসব কিছু লক্ষ্য করেন এবং মেয়ের ক্ষতি হবে ভেবে আইনি সাহায্য নিয়ে শিলিগুড়িতে পৌঁছোয়।
রমেশকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এভাবে ভরে গেল নীহারিকার জীবনে আরো দুইটি বছর। এতগুলো দিন সে ভালোই ছিলো; ছিলো না ভয় - ছিলো না রমেশের মতো অমানুষ। কিন্তু তার জীবনে আবার রমেশের মতো একজন অমানুষের প্রবেশ হয়েছে, ভাবলেই নীহারিকা ভয়ে চমকে ওঠে।
-----------------------
অঙ্কিতা পাল
ভাঙড়,
দক্ষিণ 24 পরগনা ।