-লালু যাসনি, দাঁড়া তোর কী হয়েছে দেখি! আরে তুই খোঁড়াচ্ছিস্ কেন?
ছুটে গিয়ে অয়ন সেই লালুটাকে ধরে ফেলে। ধরতেই লালু ক্যাঁউ, ক্যাঁউ করতে শুরু করে। লালুকে ধরেই অয়ন দেখে লালুর পায়ে কে যেন ঢিল মেরেছে! অয়ন চিৎকার করে উঠে বলল- অ্যাই দ্যাখো মা লালুর পায়ে কতটা কেটে গিয়ে ফুলে উঠেছে। সেই জন্য ও খুব খোঁড়াচ্ছে।
অয়নের মা ছুটে গিয়ে লালুর পা দেখে আঁতকে বলে ওঠে- ইস্ কে করল এইরকম?
অয়ন বলল- মা রাস্তার বাচ্চা মা! ওদের অবস্থা তো এইরকমই হবে। ওদের আর কে আছে বলো! যাক্ তুমি ভাইকাকুর আনা ব্যান্ডেজ তুলো আর পিভোডাইন মলমটা নিয়ে এসো!
অয়নের মা বলে ওঠে- এই তোর ভাইকাকু টিটেনাস এনেছে বাবাকে দেওয়ার জন্য। বাবার দেওয়া হয়ে গিয়েছে একটু বেশি আছে সেটা নিয়ে আসি। তুই ইঞ্জেকশনটা করে দিস্ অন্ততপক্ষে।
অয়ন হতচকিত হয়ে বলে উঠল- মা আমি!
অয়নের মা বলল- হ্যাঁ বাবা কর্ না। কে করবে বল্! তোর ভাইকাকুও তো নেই। সেই কোন্ রাতে আসে! আমি শুনেছি তোর ভাইকাকুর কাছে। হাতের বাহুর ঐ পেশিতে টিপে দিতে হয়। আর সিরিঞ্জে হাওয়া যাতে না ঢোকে সেটা লক্ষ্য রাখতে হয়। ব্যস্ তার পর ফুটিয়ে দিলেই হল।
অয়ন অগত্যার কথা ভেবেই বলে উঠল- ঠিক আছে দাও। তবে তার আগে কিছু খাইয়ে দাও! ও খেয়েছে কিনা কে জানে।
অয়নের মা বাড়ির দিকে ছুটতে বলল- দাঁড়া সঙ্গে রুটি-তরকারিও নিয়ে আসছি।
লালু রুটি-তরকারির কথা শুনে তার জিভ থেকে টস টস করে জল পড়তে শুরু করেছে। কেননা সেই কবে জগদ্ধাত্রীর পুজোর সময় কমিটির একজন কাঙাল ভজন করিয়েছিল, সেখানে সে পাত পেতে খেয়ে ছিল। তার পর আনাচে কানাচে খাবারের দোকানে কেউ ফেলে থেলে দিলে সেখানেই খেয়ে নেয়। উচ্ছিস্ট খাবার খাওয়া ছাড়া তাকে আর কে খাবার দেবে। সেই কবে তার রাস্তায় পড়ে থাকা তার পাগলি মা বুকের দুধ খাইয়ে বছর না গড়াতে গড়াতে চলে গিয়েছে। সেই থেকে রাস্তায় মানুষ। পড়ে ঝরে গেলে কেউ আহারে উহারে করে বটে। কিন্তু কেউ এভাবে শ্রুশ্রূষা করে না। বছর তিনেক বাচ্চা আনাচকানাচে থাকা হেতু কেউ খাবার দোকানের হেঁসেলের কাজেও নেয় না। শতছিদ্র প্যান্ট পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। অয়নের মায়ের আনা রুটি-তরকারি খেয়ে ধুইতে যাবে কি; অয়নের মা বললে- থাক্ থাক্ তুই ওটা তোর কাছে রাখ্।
এই কথা শুনে লালু ফিক করে হেসে ফেলে। অয়ন ধমক দিয়ে ডেটল গোলা কলের জল দিয়ে পা পরিষ্কার করে পিভোডাইন মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। তার পর লালুর অনিচ্ছার সত্ত্বেও লালুকে টিটেনাস করে দেয়। তার পর লালুকে অয়নের মা ধরে বলে ওঠে- চল্ আমাদের বাড়িতে থাকবি।
লালু নাছোড়বান্দা সে থাকবে না। জোর করে নিয়ে আসতে দেখে অয়নের জ্যাঠামশাই ধমক দিয়ে বলে ওঠে- কী করছ বৌমা ছেড়ে দাও! ওকে লাই দিলে মাথায় উঠবে। দেখোনি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে তোমার মমপিসিকে মেরে নিয়ে নিজে সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করে বহাল তবিয়তে সংসার করছে। দাও, ছেড়ে দাও।
লালুকে অয়নের মা হাত ছেড়ে দিতেই ও জ্যাঠামশাইয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে রাস্তার দিকে যেতে যেতে রাস্তার উপর উঠতেই রাস্তায় দ্রুতগতিতে আসা লরি চাপা দিয়ে চলে যায়। অয়ন কটমট করে জ্যাঠামশাইয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে রাস্তার উপর গিয়ে দেখে লালুর থপথপে রক্তে রাস্তা ভিজে। লালু অয়নকে দেখে হাত একটু তুলেই ব্যস্ রাস্তায় হাত পড়ে যায়। লালু আর নেই। অয়ন রাস্তার উপর লালুর পাশে বসে লালুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। অয়নের মা কাঁদতে কাঁদতে অয়নের কাছে ছুটে যেতেই অয়ন কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে- মা লালু আর নেই।
রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। কি হল অয়ন হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে কেমন যেন হয়ে গিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে- তোমরা কেউ শুনছ, লালু আর নেই! বলেই অয়নও অজ্ঞান হয়ে যায়।
---------------------
প্রিয়ব্রত চক্রবর্তী
ঠাকুরানি বেড়িয়া
ক্যানিং
৭৪৩৩৭৬
৬২৯৫০৩৫৬৩২