রামেশ্বর আর বুধিয়ার ছোট্ট সংসার ; সে সংসারের নিত্য সঙ্গী অভাব। কিন্তু তার মধ্যেই তাদের একফালি আনন্দ তাদের প্রজাপতির মতো ছটফটে ছয় বছরের মেয়ে মুন্নি । ভাল নাম মুনিয়া। এই ছটফটে ছোট্ট পরীটাকে দেখলেই রামেশ্বরের সব দুঃখ চলে যায় ; শুধু মনের মধ্যে আঁচড়াতে থাকে একটাই কষ্ট মেয়েটাকে সে ঠিক মতো যত্ন করতে পারে না । অভাবের সংসারে যা হয়। বুধিয়া তাকে দিনরাত কথা শুনায় , সে নাকি নামেই পুরুষ মানুষ ; তা না হলে সে কি পারে না একটু বেশী রোজগার করতে ? অন্ততঃ মেয়েটার জন্যে! রামেশ্বর বুধিয়াকে বুঝিয়ে পারে না তার ছোট্ট একফালি দোকান থেকে এর থেকে বেশী রোজগার হয় না।
ওই তো রাস্তার ধারে এক টুকরো দোকান ; যেখানে সে বসে ছোলা , বাদাম ভাজা বিক্রি করে ; কটা লোক কেনে ? তার থেকে একটু বেশী রোজগার করে তারই প্রতিবেশী রাজেশ। সে বেলুন বিক্রি করে - আর সব বেলুনগুলোই সে তৈরি করে মানুষের হৃদয়ের আকারে । কি অদ্ভুত ভাবে রোজ সেগুলো বিক্রি হয় | রামেশ্বর ভাবে হৃদয়ের এতো আদর !!তাহলে মানুষের মধ্যে এতো ভালোবাসার অভাব কেনো ? সামনে পূজো , রামেশ্বরের একটাই চিন্তা মেয়েটাকে যদি একটা সুন্দর জামা কিনে দিতে পারে | সে বাবা হয়ে যদি মেয়ের জন্যে এটুকু করতে না পারে তাহলে তো বুধিয়ার মা , সে তো কথা শোনাবেই।
দুর্গাপুজো পেরিয়ে গেছে রামেশ্বর পারে নি তার মুন্নিকে একটা নতুন জামা কিনে দিতে | বুধিয়া রাগ করে পুজোর কদিন তাকে সাড়া দেয় নি |পুজোর কদিন তার বিক্রি একটু হয়েছে ; কিন্তু মেয়েটার দুদিন জ্বর ছিলো , তাকে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে যেটুকু টাকা রাখছিলো শেষ হয়ে গেছে |সামনে কালীপুজো, রামেশ্বর খুব চেষ্টা করছে যাতে মেয়েটাকে একটা নতুন জামা দিতে পারে |রামেশ্বর থাকে যেখানে বড় বড় বাড়িগুলোতে ভদ্রবাবুরা থাকে সেই পাড়ারই একপ্রান্তে ; সেখানে ছোটো ছোটো তাদের মতো কিছু দরিদ্র পরিবার বসবাস করে ;অনেকেই তাদের বসবাসের জায়গাটাকে বলে ছোটলোকদের বাস| রাজেশও তার প্রতিবেশী ; তারও একটি মেয়ে আছে রামেশ্বরের মেয়ের থেকে দু বছরের বড় | তার মেয়ে আর রাজেশের মেয়ে প্রায় একসঙ্গেই ধুলো মেখে বড় হচ্ছে |ওখানে যে কয়েক ঘর তারা আছে সকলেই মিলেমিশে থাকে |
আজ সকাল থেকেই রামেশ্বরের মনটা ভালো নেই ; তার বউ বুধিয়া কাল রাতে অনেক কথা শুনিয়েছে তাকে | তাই সকাল হতেই সে কিছু না খেয়েই চলে এসেছে ছোটো দোকানে ; এটাই তো তার রুজি রোজগার | ওদিকে রাজেশও এসেছে তার হৃদয় বেলুনের পসরা নিয়ে | ভালোই বিক্রি চলছে রাজেশের | হঠাৎই একটু বেলার দিকে বুধিয়াকে দেখা গেলো হন্তদন্ত হয়ে রামেশ্বরের কাছে এসে হাজির |
রামেশ্বরকে খেতে যাওয়ার জন্যে ডাকতে এসেছে ; কয়েকবার ডাকার পরেও যখন রামেশ্বর সাড়া দিলো না বুধিয়া হাত নেড়ে বলে উঠলো - " যে পুরুষ মানুষ ঠিকমতো বউ মেয়েকে খাওয়াতে পড়াতে পারে না তার ওতো রাগ কিসের শুনি ?" এটুকুই বোধ হয় বাকি ছিল , হঠাৎ বুধিয়ার গালে রামেশ্বর সপাটে চড় মারলো | বুধিয়াও থতমত খেয়ে গেলো ; রাজেশ ও প্রান্ত থেকে দেখে অবাক - আজ পর্যন্ত কোনোদিন রামেশ্বর এরকম কাজ করে নি | তাদের আশেপাশের সবাই জানে সেটা | যারা পাশের বড়ো বাড়িগুলোতে থাকে তাদের দু - একজন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো ; তারাও দাঁড়িয়ে গেছে | বুধিয়ার এতো অপমানে লেগেছে যে সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ; তার দু চোখের জল বাঁধ মানছে না | রাজেশও সব ফেলে এপাশে চলে এসেছে ; মোটামুটি তাদের ঘিরে একটা ছোটোখাটো ভিড় |সবার দৃষ্টি , বাক্যবাণ সব রামেশ্বরের দিকে |আর অপরাধী রামেশ্বর অসহায়ের মতো সমস্ত হজম করছে ; সে যে বড় অসহায় একজন পিতা, বড়োই অসহায় একজন স্বামী - যে স্ত্রীকে সুখে রাখতে পারে না , উৎসবে মেয়েকে জামা কিনে দিতে পারে না |আর সে যে পুরুষমানুষ তাই তো হাজার অপমানেও তাকে কাঁদতে নেই ;কে বুঝবে কোন অসহায় পরিস্থিতি আজ বুধিয়ার গায়ে হাত তুলতে তাকে বাধ্য করেছে ?বুধিয়া যে তাকে ক্রমাগত আঘাত করছিলো , তার অসহায়তাকে কোনোমতেই বুঝতে চাইছিলো না |একমাত্র ঈশ্বর সাক্ষী যে সে বুধিয়াকে মারতে চায় নি |রাজেশ অনেক বুঝিয়ে বুধিয়াকে বাড়ি পাঠালো ; তারপর যারা রামেশ্বরকে বাক্যবানে বিদ্ধ করছিলো তাদের সরালো | সেও তো পিতা , রামেশ্বরের সঙ্গে তার ওঠা বসা তাই সে ব্যাপারটা জানে যে রামেশ্বর ভীষণ অসহায় | পুজোতে রাজেশ নিজের মেয়ের জন্যে জামা কিনেছে কিন্তু মুন্নির জামা হয় নি জানতো ;দিতে গিয়েও মনে হয়েছে যদি ওরা কিছু ভাবে , তাই আর ও কিছুই করে নি |রাজেশ রামেশ্বরের পাশে বসলো ;এক পিতা যেন আরেক পিতার কষ্টটা পাশে বসে ভাগ করে নিতে লাগলো নিঃশব্দে |ভদ্রবেশী প্রতিবেশীরা আঙ্গুল তুলতে পারে , অসহায়তাকে বাড়িয়ে দিতে পারে, কিন্তু কষ্ট কমাতে পারে না |রাজেশ উঠে প্রথমে নিজের জিনিসপত্র গুটিয়ে নেয় , তারপর রামেশ্বরের জিনিসপত্র গুটিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় |রামেশ্বর সেই যে মুখ বন্ধ করেছে আর সাড়া দেয় নি |রামেশ্বরকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সেও বাড়ি চলে যায় |
তার দুদিন পর সন্ধ্যেবেলা রাজেশ তার বেলুনের পসরা গুটিয়ে বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে রামেশ্বরের বাড়িতে এসে হাজির হয় |মুন্নি তো রাজেশের মেয়েকে পেয়েই খুশিতে মেতে গেছে ; রাজেশের মেয়ে মুন্নির হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলে - " নে মুন্নি এটা তোর "| মুন্নি ভীষণ কৌতূহলে প্যাকেট খুলে দেখে একটা সুন্দর জামা |ততক্ষনে রামেশ্বর , বুধিয়াও সামনে চলে এসেছে ; রামেশ্বর আর বুধিয়া তো দেখেই নারাজ রাজেশের উপর |রাজেশ তাদের বুঝিয়ে পারছে না যে তার মেয়ে আর মুন্নি তার কাছে একই ; সেই এতদিন ভুল করেছে - শুধু নিজের মেয়ের জন্যে জামা কিনে , তার যে দুটো মেয়ে এটা আর কোনোদিন সে ভুলবে না |অনেক বোঝানোর পর বুধিয়া আর রামেশ্বর শান্ত হয় | আর দেখে তাদের ছোট্ট পরী নতুন জামা পেয়ে কি খুশি |রামেশ্বরের আনন্দের মাঝেও এক বুক চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ; এক অসহায় পিতার দীর্ঘশ্বাস - রাজেশ বোঝে তাই গিয়ে রামেশ্বরের পিঠে একটা হাত রাখে | সেই স্পর্শ বুঝিয়ে দেয় অনেক না বলা সান্ত্বনা।
রামেশ্বর আজ বোঝে রাজেশের হৃদয় বেলুন বিক্রির অর্থ |সত্যিই রাজেশ হৃদয় বিক্রি করে -সত্যিকারের হৃদয় ;যারা কিনে নেয় সেই বেলুন তারা তার অর্থ যেমন বোঝে না তেমন তার দাম দিতেও জানে না ; যারা হৃদয় বেলুন কেনে তারা ভাবে ভালোবাসা ভীষণ সহজ ; তাই যদি হতো তাহলে তার অসহায়তা অন্যরাও বুঝতো , বোঝে নি কেউ একমাত্র হৃদয় বেলুন বিক্রেতা রাজেশ ছাড়া | হ্যা , সমাজের কাছে তো রাজেশ শুধুমাত্রই একজন হৃদয় বেলুন বিক্রেতা , এটাই তো রাজেশদের পরিচয় |
সাজানো গোছানো সমাজের আড়ালে এরকম কত রাজেশ , রামেশ্বর আর বুধিয়ারা যে রয়েছে তার হিসেব আমরা কেউ রাখি না। আমরা যে সুসজ্জিত ভদ্র শিক্ষিত সমাজ -ওদের সঙ্গে কি আমাদের তুলনা চলে ? আমরা আঙ্গুল তুলতে জানি , অসহায়কে আরও অসহায়তার দিকে ঠেলে দিতে জানি - কিন্তু একটু ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে শেখায় নি আমাদের শিক্ষা।
---------------------------
কলমে : অনিতা কর
তারিখ : 23/10/21