কানের দুটি ছিদ্র দিয়ে শুরু। রুনার জীবনে প্রথম শাশুড়ীর বাক্যবানের প্রয়োগ ! বিয়ের পর সবাই যখন মন্দ কিছু বলছিল না তখন, শাশুড়ী হঠাৎই সামনে এসে, তার থুতনি ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন, "এমা, এতো দুকানে দুজায়গায় দুল পড়েছে!" "কানের ফুটো টা ও ঠিক করে করিয়ে দিতে পারেনি, তোমার মা?"হতবাক রুনা, মেনে নিলো সেকথা! মনে একটু দুঃখ হল, যতটা না কথা টা শুনে, তার থেকেও বেশী হল কথার মধ্যে দিয়ে ওনার বিদ্বেষ বাষ্প র ছোঁয়ায়!
ছেলের নিজের পছন্দের এই বিয়েতে ইচ্ছে না থাকলেও সায় দিতে হয়েছে নাহলে ছেলে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে!
তার শ্বশুর মশাই আবার উচ্চাকাঙ্খী ব্যক্তি। বিয়েতে কম দেওয়া থোওয়া হয়েছে, এই অভিযোগ টা ওনার ছিল এবং বহুবার ঠারেঠোরে বলেছিলেন যে ওনার এই ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য কত বড়লোক বাড়ীর সন্বন্ধ এসেছিল আর সেসব ঘটনা চক্রে ফিরিয়ে দিয়ে উনি কত বড় ভুল করেছেন!
রুনার বিধবা মা অতি কষ্টে মেয়ের বিয়ের সমস্ত জোগাড় যন্ত্র করেছেন, কোনও রকম ত্রুটির অবকাশ রাখেননি।
মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন যাতে কিছু না বলতে পারে সেজন্য তিনি সর্বদা ত্রস্ত ছিলেন। মায়ের শুকনো মুখ মনে পড়ে রুনার। এখন যেন মনে হয় শিশির কে ভালবাসা এবং বিয়ে করা, কোনও টার দরকার ছিল না। সে তো মায়ের সঙ্গেই বাকী জীবন টা কাটাতে পারত!
রুনা র মা সরকারী স্কুলের টিচার, কম মাইনে হলেও ছোটবেলার থেকেই রুনাকে আদরে আরামে বড় করেছেন। তার মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা হঠাৎই মারা যাওয়ায় , মার জীবন রুনা ছাড়া অন্ধকার। রুনা সংসারের কাজ কর্মের ব্যাপারে তাই অপটু। বিবেচনা র বোধ টা প্রখর, তাই বৌভাতের পর দিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে, শিশির তখনও গভীর ঘুমে। বাইরে এসে শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করে, "মা, কিছু করব?" শাশুড়ী তৎক্ষনাৎ বলে ওঠেন, "হ্যাঁ, সবার জন্য চা কর ।" দেখা গেল আত্মীয় স্বজন মিলিয়ে, চা হবে কুড়ি কাপ। রুনা, কোনও দিন দু কাপের বেশী চা করেনি। কিন্ত রুনা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, তাকে দ্রুত সমস্ত ঘরোয়া কাজকর্ম শিখে ফেলতে হবে এবং শাশুড়ী কে খুশী করতে হবে। সে একটা অথৈ সমুদ্রে পড়ে গেল, কুড়ি কাপ চা করতে গিয়ে। একজন মামীশাশুড়ী স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে এগিয়ে এলেন রুনা কে সাহায্য করতে। অন্য অতিথি আত্মীয় রা টেবিল জুড়ে বসে গুলতানি তে মত্ত। সবাই চা এর অপেক্ষায়! তার পর প্রাতরাশ সেরে যে যার বাড়ী ফিরবেন। হিমশিম খেতে খেতে অবশেষে চা তৈরী হল!
মামী শাশুড়ীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় রুনার মন টা ভরে গেল!তাকে শেষ পর্যন্ত আর সবার সামনে অপদস্থ হতে হল না।
শাশুড়ীর কোনও রকম হেলদোল দেখা গেল না।
এরপর শাশুড়ী তার মেয়েদের সঙ্গে পরামর্শ করে বললেন, সকালের জলখাবার হিসেবে, পরোটা,আলুর তরকারী আর বেগুন ভাজা হবে।
এই বাড়ীতে এখনও অবধি কোনও কাজের লোক চোখে পড়ল না! রুনার বাড়ীতে একজন কাজের মাসী দুবেলা আসে আর সব কাজই করে দ্যায়। সেই সরলা মাসী ছোটর থেকে রুনা কে দেখেছে বলে, তাকে খুব ভালবাসে আর তাই কখনও কিছু করতে দ্যায়নি। পরোটা, তরকারী তো তারও ফেভারিট। কিন্ত কেমন করে করতে হয়, সেই বিষয়ে জ্ঞান ভাসাভাসা!
শাশুড়ীর অর্ডার শুনতে পেল, "দাঁড়িয়ে রইলে কেন, তাড়াতাড়ি হাত চালাও, ময়দা টা আগে মেখে ফেল, তারপর আলু আর বেগুন গুলো কেটেকুটে গুছিয়ে নাও। চা এর কাপ গুলো সব টেবিল থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও, আর ধুয়ে মুছে তুলে ফেল, ওগুলো সব ভাল কাপ ডিশ কিন্ত!"
রুনা চারিদিকে তাকিয়ে একটা পরিচিত মুখ খুঁজল, যে তাকে আগের রাতে শরীরী ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে!
এই অকুল পাথারে পড়ে, সেই মনের মানুষ কে পাশে পেতে মন চাইছে, কিন্ত শিশির এখনও ঘর বন্ধ করে গভীর ঘুমে!তার মা, দিদি রাও তার যাতে ঘুমের ব্যাঘাত না হয়, সে ব্যাপারে নজর রাখছে। মোটা মাইনের ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়ের প্রতি তাদের অনেক আশা, নিজের পছন্দের এই মেয়ে টাকে বিয়ে করেছে বলে ,ভাই যাতে বউ এর ন্যাওটা না হয়ে পড়ে, সে জন্য বাড়ীর সবাই সজাগ!
শ্বশুর মশাই বসে বসে পা দোলাচ্ছেন আর তার পুত্রের গুন কীর্তন করে চলেছেন। শিশির যে কীরকম ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, সেটা বোঝাতে চাইছেন আত্মীয়দের! কী অসাধারণ একজন টেবিল টেনিস প্লেয়ার, স্কুলে, কলেজে, বরাবর চ্যাম্পিয়ন!
এসব কথা কানে আসছে, আর পরোটা বানানোর চিন্তায় মাথায় হাত দিতে ইচ্ছে করছে।এগিয়ে এলেন সেই মামীমা, রুনার শুকনো মুখ দেখে উনি ঠিক বুঝেছেন, আর নিজের ননদ কে উনি হাড়ে হাড়ে চেনেন!
বললেন, "তুমি বরং কাপ ডিশ গুলো ধুয়ে তুলে ফেল ,আমি এদিক টা দেখছি।"
ঘরকন্নার কাজে পটু মামীমা ঝটপট ময়দা মেখে ফেলে ওটা ঢাকা দিয়ে রেখে বসে গেলেন সবজি কাটতে! সেটাও নিমেষে হয়ে গেল!
কাপ ডিশ ধুয়ে মুছে তোলা হয়ে গেছে। এবার মামীমার কাছে পরোটা বেলার প্রথম পাঠ শিখল সে! কেমন করে গোল লেচি কে ভাঁজ করে তিন কোনা করে বেলতে হয়, তা শেখালেন! পরম মমতা আর ধৈর্য ধরে একজন আনাড়ি মেয়েকে রান্নার কাজ শেখাতে লাগলেন।
রুনা তাই সারাজীবনের মত এই মহিলার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইল! বেলার কাজ টা সবচেয়ে কঠিন, রুনার তাই খুব সময় লাগছিল!মামীমা র ততক্ষনে এক দিকের গ্যাসে আলুর তরকারী তৈরী হয়ে গ্যাছে। মামীমা তাড়াতাড়ি রুনার বেলা খারাপ পরোটা গুলো কোনও রকমে ম্যানেজ দিয়ে ভেজে ফেললেন। বেগুন ভাজা র কাজ টা রুনা করে ফেলতে পারে ! ননদ রা আড্ডা য় ব্যস্ত, শাশুড়ীর সবার ওপর ছড়ি ঘোরানো চলছে।অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে রুনা সবাই কে খাবার পরিবেশন করতে লাগল! হাত দিয়ে পরোটা তুলে ভাল ভাবে পরীক্ষার পর শাশুড়ী বললেন, "এটা একটা পরোটা হয়েছে? কে করেছে, তুমি "? মামীমা সাথে সাথে দৌড়ে এসে বললেন, "না না ,দিদি, পরোটা আমিই করেছি, আজকে তাড়াহুড়োতে ভাল হয়নি। " শাশুড়ীর রক্ত চক্ষু দুজনের ওপর দিয়ে ঘুরে গেল। এমন সময় ওনার আদরের ছেলে ঘুম থেকে উঠে এল। মা আর দিদিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাকে নিয়ে। তার এই বিয়েতে কত পরিশ্রম হয়েছে, সেই আলোচনায় , পরোটা র বিচার ধামাচাপা পড়ল।
আজ যখন নিজেও সে পঞ্চাশের কোঠায়, তখন এসব কথা নতুন করে মনে পড়ে।সেই ভাল মানুষ মামীমার শরীর অসুস্থ, জুবুথুবু হয়ে গেছেন। ওনার থেকে দশ বছরের বড় ওনার ননদ দিব্যি বহাল তবিয়তে আছেন। এক চোখা ভগবানের বিচারে,একটি অল্প বয়সী সরল মেয়ের চোখে অজস্র চোখের জল ফেলানোর কোনও শাস্তি হয়নি তার। তাই ভগবান নামক ভদ্রলোকের অস্তিত্ব সম্পর্কে গভীর ভাবে দ্বিধা গ্রস্ত হয়ে পড়েছে, রুনা।
আজ যখন তাকে কানের লতি কেটে যাওয়ায় ,সার্জারী করাতে যেতে হয় আর নতুন করে আবার কান বেঁধাতে হয়, তখন মহিলা ডাক্তারের সঙ্গে গল্পচ্ছলে পুরোন ঘটনা র কথা
বলে। কসমেটোলজিস্ট ডাক্তার শর্মিলা গুহ খুব মজার মানুষ, উনি কানের ফুটো নিয়ে, পুরনো গল্প টি শুনে বলেন, "দাঁড়ান, এবার এমন ফুটো করে দেব যে আপনার জাঁদরেল শাশুড়ী কিছুই বলতে পারবেন না, ও,টি র মধ্যে যত নার্স আছে সবার সামনে আপনার কান বেঁধাব !"
বলে ,নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা করে হেসে উঠলেন। রুনা বলল, " না, দিদি, কানের লতি দুফাঁক হওয়ার ঘটনাটাই তো ওনাকে জানাব না, কাজেই নতুন ফুটো টা বুঝতেই পারবেনা!"
রুনার যে বদ্ধমূল ধারনা, তার, যে কোনও রকম খারাপ খবরে শাশুড়ী, ননদেরা মনে মনে আনন্দই পাবে! বহু বছর বিদেশ বাস করে ভাই তার বউ নিয়ে অবশেষে দেশে ফিরেছে। কিন্ত তাদের সমস্ত আশায় ভাই জল ঢেলে দিয়েছে, অতিরিক্ত মেশামেশি টা ওরা স্পষ্টতই এড়িয়ে চলছে। ভাই যে, মা বা দিদিদের নিয়ে নাচানাচি করছে না আর, সেকথাও বুঝেছে! পুরো, বউ এর আন্ডারে এখন! সেই ভাল মানুষ রুনা ও এখন পোড় খাওয়া সংসারী! দুর্বল, ভীতু, রুনা বদলে গেছে এখন!
জীবন কেটে যায়, পুরনো দুঃখের স্মৃতি ফিকে হয়ে আসে। তবে ক্ষত র দাগ রয়ে যায়।ক্ষমাই হওয়া উচিত জীবনের মন্ত্র! অশিক্ষিত ভেবে শাশুড়ীর প্রতি ক্ষমাই অনুভব করতে চায়, কিন্ত আজও এই বয়সেও ওনার হুল ফোটানো কথা গুলো বুকে বিঁধে যায়।
----------------------------------
অক্টোবর ২৩, ২০২১