লিপিকার মন মতো যেন সংসারে কিছুই হচ্ছিল না। অনির্বাণ কোনকিছুতেই ওর পরামর্শ নেয় না,এবং নানাবিধ অভিযোগ লেগেই ছিল। অনির্বাণের ওপর প্রতিশোধ স্পৃহায় লিপিকাও হয়ে উঠছিল সংসার সম্পর্কে উদাসীন। ছেলে তুতুলও যেন ওর এই উপেক্ষা থেকে বাদ পড়ছিল না। নিজের মতো একটা স্বাধীন জীবনের খোঁজে পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেরিয়ে পড়ত লিপিকা। এইভাবে একদিন ওর আলাপ হল প্রলয়ের সঙ্গে। সেই আলাপ ক্রমশ গাঢ় হল। প্রলয় বিবাহ বিচ্ছিন্ন তাই অনির্বাণকে বিচ্ছেদ দিয়ে নতুন সংসার পাততে লিপিকার কোন অসুবিধে হল না। তুতুলকে অনির্বাণ আইনত রেখে নেওয়ায় বিশেষ প্রতিবাদও করল না লিপিকা। প্রথম প্রথম তুতুলকে না পাওয়ার আক্ষেপ থাকলেও পরে নিজের সংসারে মগ্ন লিপিকার কোল আলো করে ও পক্ষের দুই ছেলে এসে যাওয়ায় আর তুতুলের খোঁজ রাখল না। অনির্বাণও নতুন সংসার পাতায় তুতুলের ঠাঁই হল ওর ঠাকুর্দা ও ঠাকুমার কাছে। বাবা'মায়ের স্নেহ বর্জিত হয়ে তুতুলের মনে আক্ষেপ থাকলেও তা কখনও ওর মানবিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। বরঞ্চ একটু বড় হতে হতে ও দাদু ঠাকুমার অনেক ভার হালকা করে দিয়েছিল।উল্টে ওই ওনাদের দেখাশোনা করত। রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ভক্ত দাদুর সঙ্গে বেশী সময়ে কাটানোর জন্য একধরনের সেবার প্রবণতা ওর মধ্যে বেড়ে উঠল। বয়স্কদের সম্মান করা,পাড়াপ্রতিবেশীর বিপদে দাঁড়ানো এসব মিলিয়ে তুতুল মানে শ্রীমন্ত খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে নিজের একটা এনজিও খুলল শ্রীমন্ত। দাদু,ঠাকুমার বয়সকালীন কষ্ট লক্ষ্য করে সহায়,সম্বলহীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য খুলে ফেলেছিল একটা বৃদ্ধাশ্রমও। উপযুক্ত সেবা শুশ্রূষা পেলেও বয়সের কারণে শ্রীমন্তর দাদু,ঠাকুমাও ইহলোকের মায়া ত্যাগ করল। এতসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে শ্রীমন্তর আর নিজের বিয়ে-থা সংসার করা হয়ে উঠল না। তবে ঘরের বাইরে অনেকের জীবনের সঙ্গে ওর জীবন জড়িয়ে রইল। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদেরই ও মা'বাবা বলে সম্বোধন করে এক অদ্ভুত আনন্দ লাভ করে। ওদের দেখাশোনা, ওষুধ পথ্যের কোন অন্যথা হয় না।। এইভাবে আস্তে আস্তে শ্রীমন্তর চুলেও পাক ধরল। ওদিকে লিপিকার ছেলেরা সব উচ্চশিক্ষা পেয়ে বিদেশবাসী হল। দেশের ব্যাঙ্কে রেখে গেছিল বাবা'মায়ের জন্য শিক্ষা নেওয়ার ধার। সেই ধার শুধতে শুধতে ওদের বাবা প্রলয় গত হল। লিপিকা দেখাশোনার লোক আর অর্থের অভাবে ধাক্কা খেতে খেতে পৌঁছালো শ্রীমন্তর বৃদ্ধাশ্রমে। শ্রীমন্তকে দেখে কোথাও কি কোন অনুভূতির সঞ্চার ঘটল লিপিকার,কিংবা শ্রীমন্তর। ঐ কাঁচাপাকা চুলের মাঝবয়সী শ্রীমন্তর মধ্যে তো সেই ছোট্ট তুতুলকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।বয়স,রোগ,অসুখ,দুশ্চিন্তায় লিপিকার চেহারাতেও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবুও শ্রীমন্তর মা ডাকে যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে লিপিকা। প্রবাসী ছেলেদের সম্মানে যাতে কোন আঁচ না লাগে তাই বৃদ্ধাশ্রমে নিজের আসল নামও দেয় নি লিপিকা।এখানে সবাই ওকে রাণু বলে ডাকে। বাসিন্দাদের সকলকে এমন পরিসেবা দেওয়া হয় যে তাদের আর স্বতস্ফুর্ত অভিযোগের জায়গা থাকে না। তবে সেদিন লিপিকার রুমে জল শেষ হয়ে যেতে ও শ্রীমন্তকে বলার জন্য ওর ঘরে গেল।গিয়ে লিপিকা যা দেখল,ইহজন্মে তা দেখবে বলে আশা করে নি। শ্রীমন্ত ওর দাদু-ঠাকুমার ফটোতে ধূপ দিচ্ছে। যাদের লিপিকা ওর প্রথম জীবনের ছবছরের বিবাহ সম্পর্কে চেনে। ছবি দুটো দেখে থ হয়ে গিয়ে লিপিকা বলল-"বাবা,এনারা তোমার কে হন?"শ্রীমন্ত পাল্টা প্রশ্ন করল-"আপনি এঁদের চেনেন?" লিপিকা কোন্ জোরে আর এদের সঙ্গে আত্মীয়তা করবে,তাই মাথা নেড়ে সব সম্পর্ককে অস্বীকার করল। তুতুলের বর্তমান মা ডাকটুকু হারাবার ইচ্ছে হল না লিপিকার।
................................................
ঠিকানা-শিল্পকানন, দুর্গাপুর, পশ্চিমবর্ধমান