গল্প ।। ব্যথা ।। আবদুস সালাম
হেনা বউদি কেন যেন হঠাৎ থমকে কাঠ হয়ে গেছে । সারাদিন মুখভার। একদম প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া মুখে কোন উত্তর নেই । কেউ কোন কথা বললে কষ্ট করে উত্তর দেয়।
পাড়ার মেয়েরা একে একে জিজ্ঞেস করে--- কি হলো গো সাহেবের মার। খুব তো দেখছিল্যাম --"ব্যাটা বহু আসবে বুলি কতো গিদ্যার করছিলো পোখোরের ঘাটে । কষ্ট করে গোটা বাড়ি খ্যান ছাঁইচ্ ও দিলে বহিন । বহু চালের আটার রুটি খেতে ভালবাসে বুলি বুড়ো বাপটোকে বাজার থেকে আলো চাল কিনেই আনেলে। কষ্ট করি বুঢ়্যাকে সবুরের মিল থেকি আটা কুটি নিঁং ও আসা করেলে। ব্যাটা বহু আসবে বুলি মাজা লোটেতে লোটেতে সব কাম করি ব্যাড়েলো । খিলখিল করি কতো জী হাসছিল বহিন"। তা কি হোলো টি এ্যাখুন ?------
(গিদ্যার -আহ্লাদ,পোখোর -পুকুর,ছাঁইচ- নিকানো, মাজা -কোমর,লোটেতে লোটেতে- নড়বড় করতে করতে, এ্যাখুন -এক্ষুনি)
ঈদের সময় ব্যাটা বউ আসতে পারেনি বলে মনে মনে একটা আফসোস পোষা ছিল চাকরি করে বৌমা। ছুটি পাইনি । বৌমা কীখেতে ভালোবাসে কী খেতে ভালবাসে না সবমিলিয়ে বুড়ীর আনন্দ আর যেন ছোট্ট বাড়িটাতে ধরে রাখতে পারছে না। এই বুড়ো বয়সে যেন গোটা সংসার এক করে ছাড়ছে ।দ্বিগুণ শক্তি খুঁজে পেয়েছে মনে মনে ।মনে হচ্ছে সেই কোমর বাঁকা বুড়ি আর নেই। দ্বিগুণ উৎসাহে মেতে উঠেছে। গোস্তের বহু রকম পদ রান্না করবে। মনে মনে সব হিসেব করে রাখছে । গোস্ত ভাজা ,গোস্তপোড়া, গোস্ত ভূনা ,গোস্তের টিকিয়া বানানো ইত্যাদি ইত্যাদি ।বহুদিন পর বেটা বউ বাড়ি আসছে তো। সারাদিন অমানুষিক খাটুনি। তবু বুড়ো বুড়ি যেন সব উদ্যম টুকু গেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ব্যাটা বউ এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে বাড়িতে যখন খাবার টেবিলে এলো তখন রাত দশটা। এমনিতেই গ্রামের বাড়িতে নটা বাজলে একমাত্র কুকুর ছাড়া কেউ জেগে থাকে না। কারো কারো বাড়িতে লেখাপড়া করা ছেলে থাকলে সেই বাড়িতে আলো জ্বলে। নয়তো কারেন্টের বিল বেশি উঠবে বলে সবাই বাল্ব বন্ধ করে রাখে। খুব গরম লাগলে একবার দুবার ফ্যান চালায়।
কোরবানির নামাজ শেষ হলো ।নামাজ শেষে ঈদ মোবারক জানানোর পালা ।এবাড়ি সে বাড়ি ঘুরে একটু আমিত্ব জাহির করা ।পাড়ার দাদি-নানিরা দোয়া করে। আরো বড় হও দাদুভাই । দোয়া করে সবাই । পোতা,পোতা বউএর সাথে একটু আধটু হাসিমস্করা করে।গ্রামে যখন থাকতো মানে , যখন পড়াশোনা করতো তখন তাদের আদব-কায়দা দেখে অজান্তেই সবার প্রিয় হয়ে গিয়ে ছিল । সবাই এখন ও খুব ভালোবাসে । নামকরা একটা বড়ো কোম্পানির একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ।তবু কোন অহংকার নাই। সবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা, সমবয়সীদের ঘাড়ে ঘাড় মিলিয়ে ঈদ মোবারক জানানো।
প্রতিবেশীরা মনে মনে হিংসা ও যে না করে এমন কি নয় ।একই পরিবেশে বাস করে তাদের ছেলেরা গরুর ঘাস কাটছে।কোমরে গামছা বেঁধে ভোর হলেই ছুটছে মাঠে লাঙ্গল নিয়ে। তাদের কাজ হলো বিকেলে চায়ের দোকানে আড্ডা মারা,আর ভোটের সময় এলে নেতাদের পেছনে পেছনে ঘোরা।
অনেক রাত করে সবাই ঘুমিয়েছে ।এদিকে হেনা বউদির ইচ্ছে ছেলে বউকে চালের আটার সাদা সাদা রুটি আর কোরবানির মাংস খাওয়ানো ।ছেলে বৌ চলে যাবে ।আবার কখন আসবে কে জানে। ভোরে আল্লাহ হু আকবর বলে মৌলভী সাহেব ঢুকে পড়ে ঘুমের দেশে । আজানের সুমধুর আওয়াজ আকাশ বাতাস কে তোলপাড় করে । ঘুম জড়ানো চোখে উঠে নামাজ পড়ে এক পারা কোরআন শরীফ পড়ে তবেই প্রতিদিন চা জলখাবার খায় । কোন তাড়া থাকে না।
নামাজ পড়ে আজ আর বসা হয়নি কোরআন শরীফ পড়তে । তাড়াতাড়ি লেগে গেছে রুটি বানানোর কাজে। চালের আটার (চাল গুঁড়ো)রুটি বানানোর ঝামেলা অনেক। প্রথমে গরম জলে আটাকে আংশিক সেদ্ধ করে নিয়ে নামিয়ে নিতে হয়। খুব যাতে বেশি সেদ্ধ না হয়ে যায় সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। এরপর তাকে সেনে সেনে বানাতে হয় আটার তাল। তাকে ছোট ছোট করে কেটে গোল গোল করে বানাতে হয় লেয়। এরপর বেলে নিতে হয় । অনেকক্ষণ বেলে রাখা রুটি আবার রাখা যায় না । রুটির ফুলন ঠিক মতো হয়না, ফেটে যায় ,ভেঙ্গে যায় । বিশেষ শৈল্পিকতা টুকু নষ্ট হয় । অগত্যা বুড়ি আজ বুড়োটাকে ও কাজে লাগিয়েছে । বুড়োর আবার কোমরে ব্যথা। কষ্ট করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুটিগুলো তাকে সেঁকে নিতে হলো । মনে মনে আনন্দ হচ্ছিল দারুন । আমরা মুখ্যসুখ্য মানুষ । বৌমা কতো লেখা পড়া জানা । এম এ, বি এ কতো পাশকে জানে-- । আবার চাকরি ও করে।
ছেলে বৌমা গরম গরম রুটি আর কোরবানির মাংসের ঝোল খাবে । আজ দেখে মন ভরে যাবে স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে ।
রুটি সেঁকা প্রায় শেষের পথে । দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বৌমা। ঘর থেকে বেরিয়ে হেঁসেলের দিকে চোখ। বুড়ো শ্বশুর কোমরে হাত দিয়ে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে সেঁকছে রুটি। দুজনেই ঘেমে সেমে এক শা হয়ে গেছে। বৌমা শোফায় বসে বসে দেখছে বুড়ো শাশুড়ি আর বুড়ো শ্বশুরের নাজেহাল অবস্থা। কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।ব্রাশ করে এসে বসে পড়েছে খাবার টেবিলে।
কোমরের কঁকানি সহ্য করে ও হাসি মুখে বলে ফেলেছে এতোক্ষণে তোমার ওঠার সময় হলো বৌমা। আমরা ভাবলাম আজ বৌমার হাতের রুটি খাবো।দেখবো আমার বৌমা কেমন সংসারী হয়েছে।
বৌমা হঠাৎ রুদ্র মূর্তি ধারণ করে বললো আমি কি আপনার রুটি সেঁকতে এসেছি না কি?
জানেন সারা রাত আমার একটুও ঘুম হয়নি। বাড়িতে এ সি নেই।ঘড় ঘড় করছে ফ্যান। বাজখাঁই আওয়াজ। এখানে কি ঘুমানো যায়। চৌকিতে গদি নেই। পিঠে লাগছে। সারা রাত ছটফট করেছি শুধু । এদিকে আপনার ছেলে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। যেন তাজমহলের কোন ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে । বললাম আমি আসবো না । কিছুতেই ছাড়বে না। আপনার মেয়ে হলে বলতে পারতেন রুটি সেঁকতে। কথায় আছে না বৌমা বৌমাই হয় কোনো দিন মেয়ে হয়না। আপনি আমাকে একথা বলতে পারলেন!
হেনা বউদির মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। রুটি বানানোর সব সরঞ্জাম রইলো পড়ে। মুখে কোন কথা নেই। শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো চাকরি করা বউ এর রূপ----। চোখের কোণ থেকে বেরিয়ে এলো কয়েক ফোঁটা লোনা জল।
---------------------------------------
###২০/০৮/২০২১