Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। ওজন বাটখারা ।। সংঘমিত্রা সরকার কবিরাজ

ওজন বাটখারা
সংঘমিত্রা সরকাকবিরাজ

 
আইসিউ কেবিনের বাইরে সারারাত ধরে বসে থাকতে থাকতে পারমিতার মাথার ভেতরটা যেন মনের সাথে সাথে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলো। সেও যেন ভেতরের মানুষটার মতোই এক অর্ধচেতন অবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছিলো। ঘুম  তার চোখ থেকে গত পাঁচ দিন হলো একপ্রকার বিদায়ই নিয়েছে। সুনির্মলের হার্ট অ্যাটাক তাকেও স্থবির করে দিয়েছে। এরকমভাবে আনন্দমুখর উৎসবের বাড়িতে হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাত হবে কেউ আশা করেনি। বিশ্ব অর্থনীতি যে আজকের গ্লোবালাইজেশনের যুগে এক সুতোয় বাঁধা সে কথা এতদিন খবরের কাগজ বা বইয়ের পাতাতেই পরে জেনেছে। দেশ-বিদেশের ঘটনার সাথে সামাজিকভাবে অনেক ভালো মন্দ জড়িয়ে থাকে। তার প্রভাব সামাজিক গণ্ডি অতিক্রম করে ব্যক্তিজীবনেও কখনো-সখনো উঁকি দিয়ে যায়। তবে  তাতে দৈনন্দিন ঘটনাক্রমের কোন ব্যতিক্রম হয় না সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারে। কথায় আছে জাহাজের খোঁজে আদার ব্যাপারীর কাজ কি ? আবার হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে সাময়িক অসুবিধা হয় বৈকি ।তাই হয়তো কোন দেশে যুদ্ধ হলে অন্য দেশে তেলের দাম বাড়ে ।মূল্যবৃদ্ধির দোলন মধ্যবিত্তের টানাটানির সংসারে আর একটু টান ধরায়। তবে ওইটুকুই । মানুষ দুদিন পরে আবার টেনেটুনে মাপে মাপে জীবনকে ঠিক বসিয়ে নেই। তাই গত এক বছর ধরে লাগাতার কৃষি আইন ,কৃষক আন্দোলন, ধরপাকড় -বক্তৃতা আইন অমান্য , এসব টিভিতে খবর কাগজে দেখছিল- পড়ছিল ওই অবধি। সচেতন নাগরিকের মতো কোথাও কোনো আলোচনা হলে তার সহানুভূতিসম্পন্ন মতামত জানাচ্ছিলো। কখনো-সখনো সুনির্মলের সাথে এর স্বপক্ষে বিপক্ষে মতামত নিয়ে একচোট হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাতে দৈনন্দিন জীবনের জোয়ার ভাটা তে কোন ছেদ পড়েনি। আর এইতো সেদিনের  খেরীর ঘটনা টা নিয়ে উত্তাল হলো মিডিয়া ।এরকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে তারাও বেশ টলে গিয়েছিল। মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। এতগুলো অসহায় মৃত্যু, কৃষক পরিবারগুলোর   নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে যাওয়া পারমিতা কে খুব কষ্ট দিয়েছিল। আজ সেই মৃত্যুই তার নিজের দরজায় কড়া নাড়ছে। কোথায় খেরী? আর কোথায় পশ্চিমবঙ্গ। একই ঘটনা তার দুই রকম প্রভাব ফেলে মৃত্যু নামক একই রায় ঘোষণা করেছে ।

খেরীর ঘটনার পর কৃষক আন্দোলন আরও বেশি করে জোরালো এবং কেন্দ্রীভূত হল তারপর আবার উত্তর ভারতের পাঁচটি রাজ্যে ভোটের দামামা বেজে গেছে।  সরকার হয়তো কৃষকদের ভালোই চেয়েছিল, চেয়েছিল সংস্কার ।আবার হয়তো কৃষকেরা সেই ভালো চাওয়ার মাঝে সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল। যাইহোক যা  হচ্ছিলো সেসব ঘটনা ততটা গভীরভাবে তার মধ্যবিত্ত আটপৌরে গৃহবধূর জীবনে সেরকম  প্রভাব ফেলতে পারেনি।  তার টিভি সিরিয়াল দেখা ,মেয়ের আসন্ন বিয়ের প্রস্তুতি ,ঘরোয়া কাজকর্ম  কোথাও কোনো হেরফের হয়নি।তার রান্নাঘরে তালাও পরে নি। হেরফের হলো সেই দিন যেদিন সরকার কৃষক আইন বিল প্রত্যাহার করে নিলো। শেয়ারবাজারে নামল বিপুল  ধস।বিদেশি কোম্পানিগুলো কোনো অশনিসংকেত দেখে শেয়ারবাজার থেকে নিজেদের শেয়ার তুলে নিতে শুরু করলো। একটা বিদেশী কোম্পানির বেশ কিছু শেয়ার কেনা ছিল সুনির্মলের ।এই সপ্তাহের প্রথমেই সেগুলো বিক্রি করে মেয়ের বিয়ের গয়না কেনার কথা ছিল। সামনের সপ্তাহে মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিলো ।এখন যে কী হবে সে সবের কে জানে ? এক লাফে অতগুলো টাকা মাইনাসে চলে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত সুনির্মল এর পোড় খাওয়া দুর্বল হৃদয় নিতে পারেনি ।সোনার দাম এখন অগ্নিমূল্য।  সোনার গয়না কেনা এখন মধ্যবিত্ত বাবা-মায়ের কাছে শরীরের এক একটা হার বিক্রির সামিল।  অনেক দিন থেকেই মেয়ের বিয়ের কথা ভেবে একটু একটু করে সঞ্চয় করছিলেন  সুনির্মল। কিন্তু সামান্য কেরানীর মাইনেতে পাল্টাতে থাকা মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে নিজের ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সকে আর দৌড় করাতে পারছিলেন না। একটু একটু করে ভিতরে ভিতরে অতিরিক্ত চিন্তা তাকে শারীরিকভাবে অনেকদিন ধরেই  অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছিল । কোটরে ঢুকে যাওয়া স্তিমিত চোখ, গাল ভেঙে যাওয়া জীর্ণ মুখ ,ক্লান্তিতে নুয়ে পড়া রুগ্ন শিরদাঁড়া ,কোনরকমে একটা কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের চেহারা  হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি তালপাতার  সেপাই এর মতো ।যার মনে সুখ- স্বাচ্ছন্দবোধ , ভবিষ্যতের দিশা ,বলে কিছু ছিল না । কোন রকমে প্রাণশিখাটি টিমটিম করে জ্বলছিলো। কিন্তু উত্তর ভারতের কৃষক আন্দোলনের ঝড়ের দাপটে পূর্ব ভারতের এক কেরানির প্রাণবায়ু  আজ নিভু নিভু । পৃথক রাজ্য ,পৃথক কোনো সামাজিক শ্রেণীবিভাগ নয় ; অর্থনীতির বিচিত্র হিসেবে কেরানী কৃষক সকলে সমান দাড়িপাল্লায় সমান ওজনের বাটখারা মাত্র।
 
-----------------------------
 
 

 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
সংঘমিত্রা সরকার কবিরাজ
বীরভূম

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.