গল্প।। মৃত্যুনীল উপত্যকা ।। সোমা চক্রবর্তী
মৃত্যুনীল উপত্যকা
সোমা চক্রবর্তী
রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। দূর দূর পর্যন্ত এখন শান্ত। খামার বাড়িটার ফাঁকা ছাদের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এতক্ষণে কাস্তের মতো বাঁকানো চাঁদের ফলাটা উঠে এসেছে মাঝ আকাশে। দূরের অন্ধকার পথ থেকে ভেসে আসছে গোঙানির মতো চাপা কুকুরের ডাক। উঠোন পেরিয়েই দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেতের শুরু। যদিও ক্ষেতে এখন ফসলের চিহ্নও নেই। অকেজো একটা ট্র্যাক্টর পড়ে রয়েছে উঠোন আর ক্ষেতের জোড়টায়। আর সেই অকেজো ট্র্যাক্টরটার ধূলোমাখা টিনের শরীরে একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে আফসুন। মাথার ওপর ক্ষয়াটে চাঁদের ফালিটা বড়ো করুণ মনে হচ্ছে ওর। সামান্য জোৎস্নায় ঘোলাটে হয়ে আছে চারপাশটা। কুকুরের গোঙানির আওয়াজ ছাড়া বাকি সব ভীষণ চুপচাপ। যেন হাওয়াও ভয় পাচ্ছে পাতার ওপর শব্দ তুলতে। সারাদিন অবশ্য এইরকম চুপচাপ ছিল না সবকিছু। সারাদিন উন্মত্তের মতো তান্ডব চালিয়েছে ওরা। সমস্ত দেশ ওদের দখলে। রাতারাতি দেশটার নামও ওরা বদলে ফেলেছে। আতঙ্কে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে কাতারে কাতারে মানুষ। সরকারের উঁচু গদিতে যারা ছিল, আগেই খবর পেয়ে সরে পড়েছে। শুধু বুঝতে পারেনি সাধারণ মানুষ। তবু, শুরুতে যারা সুযোগ পেয়েছে, পালিয়েছে। যারা পারেনি, প্রাণের ভয়ে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে এসেছে। আফসুনরাও বেরোতে পারেনি দেশ ছেড়ে। তাই বাবা-মা ওকে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে, আফসুনের বাবার পৈতৃক ভিটায়। সঙ্গে এসেছে আফসুনের পিসি, ওর বাবার একমাত্র বোন। পিসেমশাই ছিল সরকারি আধিকারিক। অফিসে গিয়েছিলো। সেখান থেকেই পাশের দেশে পালিয়ে গেছে প্রাণ বাঁচাতে। পিসিকেও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এখনো পারেনি। দেশের বাড়িতে প্রায় দশবছর আগে শেষবার এসেছিলো আফসুন, যখন দাদি বেঁচে ছিল। তারপর আর আসা হয়নি। আফসুনের বাবা একজন প্রখ্যাত কৌতুক শিল্পী। মা একজন নার্স। আফসুন নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।
কিছুক্ষণ আগে ফিরাসের বাড়ির ফসল রাখার বস্তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে, এখন এই উঠোনে, অকেজো ট্র্যাক্টরটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আফসুন। বিকেলের দিকে ওরা এসেছিলো। খুঁজে খুঁজে ওরা ঠিক বের করেছে আফসুনের বাবা ঈশাদ হারজারিকে। হারজারির শো সারা দেশ জুড়ে মানুষের প্রিয়। ঈশাদ হারজারি মানুষের কাছে ভগবান। যে অন্যায়ের প্রতিবাদ হয় না, যে কথা কেউ বলতে সাহস করে না, ঈশাদ হারজারি সেই কথা তার কৌতুকের মধ্যে দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। মানুষকে ভাবতে শেখায়। মানুষকে কথা বলতে শেখায়। তার শো দেখে মানুষকে বহুবার গর্জে উঠতে দেখেছে আফসুন। জনসাধারণ আসলে খানিকটা জলের মতো। যেদিকে গড়িয়ে দেওয়া যায়, সেদিকেই গড়িয়ে যায়। ঈসাদ হারজারির শো সেই আকৃতিবিহীন জনগনকে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বটা দেখতে শেখায়। তাদেরও যে মেরুদন্ড আছে, সেটা মনে করিয়ে দেয়। নিজের ইচ্ছায় মাটির বুকে শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়। মানুষ তাই ঈসাদের মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতে চেয়েছে এতদিন। সেই ঈশাদ হারজারি তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছিলো তার পরিত্যক্ত ভিটেয়। আর মাত্র কিছুক্ষণ আগেই তাকে কুকুরের মতো টেনে পথে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করে গেছে ওরা। খুব কাছেই গোপনে লুকিয়ে বসে কেঁদে উঠতেও পারেনি তার পরিবার।
রাত গভীর হলে, চারিদিকে সবকিছু নিঃঝুম হয়ে গেলে, ফসলের বস্তার মুখ খুলে আফসুন, ওর মা আর পিসিকে বের করে এনেছে ফিরাস। ফিরাস পাশের বাড়িতে থাকে। সেও এখানকার আর সবার মতো চাষী। আফসুনদের ছেড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ওই দেখাশুনা করে। স্নান, খাওয়া আর একটু বিশ্রাম- তারপর দিনের আলো ফোটার আগেই আবার প্রস্তুত হয়ে থাকা। যাতে প্রয়োজন হলেই বস্তায় ঢুকে, মুখ লুকিয়ে সম্মান রক্ষা করার চেষ্টা করা যায়। সবচাইতে বেশী ভয় মেয়েদের- তা সে যে কোনো বয়সেরই হোক। কিন্তু আজ আর কোনো ভয়ডরই নেই আফসুনের মনে। বস্তার মুখটা বাইরে থেকে এমনভাবে বাঁধা ছিল যে, কোনরকম ভাবেই যাতে বোঝা না যায়, তার মধ্যে সন্দেহ করার মতো কিছু থাকতে পারে। ভেতরে নড়াচড়ার জায়গাটুকুও ছিল না। তাই সেটা খুলে বেরোতেই পারেনি আফসুন। তা না হলে, বাবার ওইরকম পরিণতি দেখে ও কি করতো, বলা কঠিন। আফসুনের মা নাসরিন তো অসুস্থ হয়ে পড়ছে বারবার। পিসি যুহা সমানে চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে চলেছে। তাতে সামান্য সময়ের জন্য জ্ঞান আসছে। কিন্তু চোখ মেলে যেই তাকাচ্ছে, আবার মূর্ছা যাচ্ছে। তবু মুখে শব্দ করে কাঁদছে না কেউই।
চোখে জল নেই আফসুনের। শুধু চোখদুটো জ্বালা করে উঠছে। থেকে থেকে একটা ব্যাকুল নিঃশ্বাস অস্থির হয়ে বেরিয়ে আসছে। নীরবে ফুঁপিয়ে উঠছে কখনো কখনো। দিগন্ত জোড়া খালি মাঠে গভীর অন্ধকার ঘন কালো হয়ে জট পাকিয়ে রয়েছে। এই অন্ধকার শুধু আজকের রাতের নয়। এই অন্ধকার দেশের ভবিষ্যৎ। পৃথিবীর কারোর কিছু এসে যাচ্ছে না, এদেশের মাটিতে পড়ে থাকা অসহায় মানুষগুলোর জন্য। কূটনৈতিক চাপান উতোর চলছে দিনের পর দিন। রোজ রোজ হাজার হাজার মেয়েকে নৃসংশ অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে। খবর কিছু বেরোচ্ছে, কিছু কেউ জানতেই পারছে না। অথবা সবাই সব জানে। কিন্তু কেউ কিছু করছে না। লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকদের ধরে ধরে মেরে ফেলছে প্রকাশ্যে। কোথাও যাতে কোনো প্রতিবাদের গলা বেঁচে না থাকে। তারই ফলস্বরূপ, শহর থেকে এতদূরে খুঁজতে খুঁজতে এসে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিয়ে গেছে ঈশাদ হারজারি কন্ঠ, যা কিনা এতদিন ছিল প্রতিবাদেরই আর এক নাম। দেশটাকে ক্রমে একটা অন্ধকূপে পরিণত করবে ওরা। একটা বর্বর, মধ্যযুগীয় প্রদেশ, যেখানে জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির আলোর প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেখানে নারী আবার হারাবে তার সমস্ত অধিকার।
কাঁধের ওপর একটা নরম স্পর্শ অনুভব করতেই ঘুরে দাঁড়ালো আফসুন।
- মতিন!
পরনে দেশীয় পোশাক, মতিনকে দেখে দেহাতি চাষাভুষো মনে হচ্ছে। মতিন এদেশের মস্ত বড় সঙ্গীত শিল্পী। লোকগান গায়। এদেশের পথে, প্রান্তরে, ক্ষেতে আর কলকারখানায় খেটে খাওয়া মানুষেরা যে গান গায়, মতিন তাদের গান গায়। গায় পাথর ভাঙার গান। এছাড়া নিজের লেখা কবিতাতে সুর দিয়ে গায় মতিন। জীবনের গান, বেঁচে থাকার গান, বিপ্লবের গান। কতোবার মতিন এসেছে আফসুনের বাবার শো'তে। কি দিন ছিল সেসব! ঈশাদ হারজারি আর মতিন খানের একসঙ্গে উপস্থিতি কতোবার উত্তাল করেছে এ দেশের জনতাকে। কতোবার বড়ো বড়ো অডিটোরিয়াম ভেসে গেছে সুরে। হাজার হাজার মানুষ গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠেছে মতিন খানের গানের সুরে সুর মিলিয়ে। সেই মতিন একদিন এলো ওদের বাড়িতে। আলাপ হলো আফসুনের সঙ্গে। তরতাজা, প্রাণবন্ত তরুণটি সহজেই জায়গা করে নিল সদ্য যৌবনে পা রাখা প্রতিবাদী মেয়েটির হৃদয়ে। পথ ছিল ওদের একই। স্বপ্নও ছিল ওদের এক। গভীর থেকে গভীরতর হলো প্রেম। আফসুনের ছুটির সময় মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে হাজির হতো মতিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্তরে, পাছে কেউ চিনে ফেললে ভিড় জমে যায়! রঙীন স্বপ্নের মতো কাটতে লাগলো দিন। স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হলো ওরা। হঠাৎ এলো সেই দিনটা। অসময়ে ছুটি হয়ে গেলো আফসুনের। ছুটতে ছুটতে ঘরে ফিরে এলো সে। মা আর কাজে বেরোতে পারলো না। বাবা দেশ ছেড়ে চলে যাবার চেষ্টা করতে লাগলো। না হলে যে প্রাণ আর সম্মান দুই-ই যাবে। গভীর রাতে মতিন এসে দেখা করে গেছিল শেষ বারের মতো। কথা হয়েছিলো, দেশ ছেড়ে যেতে পারলে আবার পরস্পর যোগাযোগ করে নেবে। পৃথিবী এখন বড্ড ছোট। ঠিক যেন হাতের মুঠির মতো। আর দেখা হয়নি। আফসুন জানতো না, মতিন দেশ ছাড়তে পেরেছে কিনা। মতিনও জানতো না ওদের কথা।
এখন মতিনের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদছে আফসুন। কত কি যে মিশে আছে সেই কান্নায়, তার আর হিসেব কে রাখে! দেশ এখন বর্বর হানাদারদের কবলে। ঈসাদকে মেরেছে ওরা। মতিনকেও ছাড়বে না। সমস্ত প্রতিবাদের কন্ঠরোধ করে তবে ওদের স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়বে! অন্যায় ভয় পায় কবিকে, বর্বরতা ভয় পায় লেখক, শিল্পীদের। কারণ, সেখান থেকেই বিপ্লবের জন্ম হয়। সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো ছেলেমেয়েরা। এক লহমায় যারা লেলিহান শিখা হয়ে উঠতে পারে। জ্বালিয়ে দিতে পারে পুতিগন্ধময় সবকিছু!
- কেঁদো না। আর কেঁদো না, আফসুন।
এই কথায় থামার বদলে কান্না দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। মতিন বলে,
- কাঁদলে হবে না। তাতেই তোমার বাবার মতো মানুষের অপমান। তোমার বাবা তো বিপ্লবী, শহীদ। তাঁর জন্য কি চোখের জল ফেলতে আছে?
এবার শক্ত হতে চেষ্টা করে আফসুন। পারে না। এতদিনের ভয়, উৎকন্ঠা আজ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মতিন বলে,
- সীমান্ত পেরিয়ে অন্যদেশে যেতেই হবে আফসুন। মনে রেখো, এ এমন এক অবস্থা, কার সঙ্গে কি হলো, ভাবলে চলবে না। আমিও যদি না যেতে পারি, তুমি এগিয়ে যেতে চেষ্টা করবে। প্রত্যেককে তার ব্যাটনটা নিয়ে এগিয়ে যেতেই হবে।
- কি বলছো তুমি?
- ঠিক বলছি। আমরা সবাই বাঁচার চেষ্টা করবো। হয়তো সবাই পারবো না। যে পারবে, তাকে এগিয়ে যেতে হবে। এতদিন আমাদের বিপ্লব ছিল কথায়, গানে, কল্পনায়। এখন তাকে বাস্তবতা দেওয়ার সময় এসেছে। কথা দাও আমাকে, যে পরিস্থিতিই আসুক, শেষ পর্যন্ত তুমি বাঁচার চেষ্টা করবে। কেউ থাকুক বা না থাকুক। কারণ, আমরা বেঁচে থাকলে বিপ্লব বেঁচে থাকবে। কথা দাও। সব সময় মনে রাখবে, দ্য শো মাস্ট গো অন।
- কিন্তু যদি হঠাৎ আমাকে অসম্মান করে ওরা... সেই অসম্মান নিয়েও কি করে বাঁচবো আমি?
- আফসুন! কেউ কাউকে অসম্মান করতে পারে না। তুমি যে অসম্মানের কথা বলছো, সেটা শুধুমাত্র শরীরের লাঞ্ছনা। আত্মার অসম্মান নয়। যখনি ওরা কোনো নারীকে ছুঁয়েছে ওদের পচাগলা স্পর্শ দিয়ে, সেই নারী শহীদ হয়েছে, অসম্মানিত নয়। যখন দেশমাতা নিজেই বিপন্ন, তখন তাঁর কোলে আশ্রয় নেওয়া মেয়েরা কি কখনো নিরাপদে থাকতে পারে? এ কথা তো তুমি নিশ্চয়ই মানবে যে, শুধু নারী দেহটাই তুমি নও, একজন নারী নয়। দেহ ছাড়াও তোমার মন, চিন্তা, তোমার কর্ম এইসব কিছু নিয়ে তো তুমি। একদল বর্বরের কি সাধ্য তোমাকে অসম্মান করার? আর একথা আমি শুধু তোমাকে বলছি না। বলছি আমাদের দেশের সব নারীদের। সব মা, বোন, মেয়ে আর প্রেমিকা অথবা স্ত্রীদের। বলো আফসুন, বলো তুমি মনে রাখবে এ কথা? কথা দাও তুমি!
আফসুন বুঝতে পারছে মতিন কি বলতে চাইছে। চট করে কথা দিতে পারে না সে। আজ যখন ওর বাবার সাথে ওই নারকীয় ঘটনা ঘটেছিলো, তখনি ওর মনে হচ্ছিল ছুটে বেরিয়ে আসে! যা হবার একসাথে হোক। কিন্তু বস্তাটা বাইরে থেকে বেঁধে রেখেছিলো ফিরাস। যা ইচ্ছে করা তাই হয়নি আফসুনের। অবশ্য তখন যা ইচ্ছা করলে, এখন আর মতিনের সঙ্গে দেখা হতো না। মতিন ঠিকই বলছে হয়তো। সবসময় এগিয়ে যাবার কথা ভাবতে হয়। কিন্তু এখন এতো কঠিন করে কিছু ভাববার মতো অবস্থায় নেই ও। নিস্তেজের মতো মতিনের বুকে মাথা রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে রাখে আফসুন। ক্ষয়াটে চাঁদটা গড়াতে গড়াতে মাঝ আকাশ পেরিয়ে গেছে। একটু পরেই ভোর হবে। আবার দিনভর লুকিয়ে থাকতে হবে ওদের। মতিনের খবর ওরা পেলে ওর দশা আফসুনের বাবার মতোই হবে, এতে কোনো সন্দেহই নেই। আফসুন আর ওর মা, অথবা পিসি- কেউই বাদ যাবে না।
**
মরুভূমির মধ্যে দিয়ে একটা ট্র্যাক্টর ছুটে যাচ্ছে বিমানবন্দরের দিকে। ইঞ্জিনের চাপা শব্দ আর ধূলোর ঝড় ছাড়া চরাচরের মধ্যে জীবিত কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। চারজন মানুষ নিঃশব্দে বসে রয়েছে চলন্ত গাড়িটায়। গাড়িটা ফিরাস খানের। সেই চালাচ্ছে গাড়িটা। বাকি তিনজনের মধ্যে একজন তার স্ত্রী শিরীন। বাকি দুজন তার মা আর শাশুড়ি। চিকিৎসা করাতে অন্য দেশে আত্মীয়ের বাসায় পাঠাচ্ছে ফিরাস তার মা'কে। মায়ের দেখাশোনা করার জন্য সঙ্গে পাঠাচ্ছে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আর তার মা'কে। পরিস্থিতি একটু ঠিক হলেই ফিরে আসবে সবাই। বুরখায় সর্বাঙ্গ ঢেকে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে তিনটে প্রাণী। খালি ক্ষেত, ফাঁকা জমি, রুক্ষ মাঠ ধু ধু করছে। একটা ছাগল পর্যন্ত চড়ছে না কোথাও। একটাও পাখি উড়ছে না আকাশে। অথচ সকাল দশটাও বাজেনি এখন। আজ দু'সপ্তাহ পর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর খুলে দেওয়া হয়েছে। দুসপ্তাহ ধরে নানা কূটনৈতিক চাপানউতোর চলেছে। তারপর স্থির হয়েছে, বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে স্বেচ্ছায় যারা এদেশ থেকে চলে যেতে চাইবে, যেতে পারবে। যেতে দিতে হবে তাদের। আজ সাংবাদিক, টিভি সবাই থাকবে বিমানবন্দরে। আজ যেতে না পারলে আদৌ আর কোনোদিন যাওয়া হবে কিনা, ঠিক নেই। প্রতিদিন ওদের হিংসা লীলার নিত্যনতুন খবর পাওয়া যাচ্ছে। আতঙ্কে মানুষ আর নিজের মধ্যে নেই। ফিরাস গাড়িটার গতি একটু কমিয়ে পেছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- কেউ কিছু খাবে?
কেউই উত্তর দিলো না। গলাটা পরিস্কার করে সে আবার জিজ্ঞেস করলো,
- জল খাবে?
ফিরাসের মা অস্ফুটে কি একটা বললো। 'না' কিম্বা 'হ্যা৺ ' কিছুই বোঝা গেলো না। বাকি দুজন কিছুই বললো না। গাড়িটা সম্পূর্ণ থামিয়ে জলের বোতলটা পেছনে বাড়িয়ে দিলো ফিরাস। তারপর অকারণেই গলাটা আবার পরিস্কার করে নিয়ে বললো,
- ইয়ে.. মানে... যদি কিছু দরকার থাকে, সেরে নিলেই ভালো। এয়ারপোর্টে পৌঁছে আর কোথাও যাবার দরকার নেই। আর একটু পরেই আমরা শহরে ঢুকে পড়বো।
ইঙ্গিতটা বুঝে ফিরাসের মা আর শাশুড়ি নেমে গেলো গাড়ি থেকে। শিরীন একই ভাবে বসে রইল। যেন জগতের কোনো কিছুতেই কোনো প্রয়োজন নেই তার। কতক্ষণ আর? মিনিট দশেক হবে। অথচ মনে হচ্ছে যেন এক দশক ধরে এখানে বসে আছে ওরা। গাড়িটা ধীর গতিতে চলতে শুরু করলো আবার। খুব সাবধানে ওদের নিয়ে যাচ্ছে ফিরাস। যাতে কোথা থেকেও এতটুকু সন্দেহ না করে কেউ। শহরের উপকণ্ঠে এসে দেখা গেলো, অনেক লোক শহরে ঢুকছে। কেউ হেঁটে, কেউ গাড়িতে। বোঝা যাচ্ছে যে, সবারই গন্তব্য বিমানবন্দর। এতক্ষণ বেশী জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলো না ফিরাস। এখন আর চালানোর উপায়ও নেই। ওদের গাড়িটার আশপাশ দিয়ে বহু লোক একই দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চারপাশের হৈচৈ, কথাবার্তার মধ্যে বহু দূর থেকে একটা সুর অস্পষ্ট ভাবে ভেসে আসছিলো ওদের কানে। একটু একটু করে সুরটা এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অনেকটা দূরে কেউ একজন দেশীয় ভাষায় একটা গান গাইছে। বিষন্ন সুরটা বাতাস কেটে ভেসে আসছে। এদেশের বিখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী মতিন খানের লেখা গান। মাত্র দুসপ্তাহ আগে দেশের বাড়িতে লুকিয়ে থাকার সময় ওদের হাতে মতিন খানের মৃত্যু হয়েছে। না চাইতেও একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বেরিয়ে এলো ফিরাসের। মতিন তার মাসতুতো ভাই। একেবারে পিঠোপিঠি ছিল দুজনে। এখানে একথা কোনো ভাবেই প্রকাশ করা চলবে না। তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। তবু একেবারে চুপ করে থাকতে পারলো না ফিরাস। বলে ফেললো,
- শিল্পীদের মেরে ফেললেও, তাদের শিল্পকে নষ্ট করে ফেলা সহজ নয়!
তিনটে বুরখা পরা অবয়ব একটু ফুঁপিয়ে উঠলো মাত্র। তারপর আবার পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে।
বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে প্রচন্ড ভিড়। ফিরাস এখন যাবে না। তাই সে আর এগোলো না। কাগজপত্র হাতে নিয়ে ঠেলাঠেলি করে এগোতে লাগলো তিনজন নারী। যে ভাবেই হোক, আজ ওদের একটা বিমানে উঠতেই হবে। হঠাৎ শিরীনের পা নরম একটা কিসে ঠোক্কর লাগলো। নীচু হয়ে দেখতে গিয়ে দেখে, কি সর্বনাশ। একটা প্রায় সদ্যোজাত বাচ্চা, মেয়ে। এ এখানে কিভাবে এলো? পায়ের চাপেই তো শেষ হয়ে যাবে। হাত বাড়িয়ে তুলে নিলো বাচ্চাটাকে শিরীন। এদিক ওদিক দেখতে চাইলো, এমন কাউকে দেখতে পায় কিনা, যার বাচ্চা হারিয়ে গেছে। কাউকেই সেরকম মনে হলো না। এদিকে মা ওর হাত ধরে টানছে। একটু দেরী হলেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। চলতে শুরু করলো শিরীন। ঢুকে পড়লো বিমানবন্দর এলাকায়। একবার তবু পেছনে তাকিয়ে দেখলো শেষবার। একটা ওরই বয়সী মেয়ে, এক পলকের জন্য বুরখাটা তুলে ওর দিকে তাকিয়েই নামিয়ে দিলো মুখের পর্দাটা। শিরীনের মনে হলো, ওর কৃতজ্ঞতা আর মিনতি ভরা চোখদুটো যেন শিরীনকে বলে গেলো, "নিয়ে যাও। বাঁচাও ওকে।" শিরীন নিশ্চিত যে, সেই বাচ্চাটার মা।
- একে কোথায় পেলি?
চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো শিরীনের মা।
- এখানে পড়ে ছিল।
- তুই কি করবি? জমা দিয়ে দে।
- না।
চাপা অথচ স্পষ্ট করে বললো শিরীন। আর একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো। বুরখা পরা মূর্তিটা আর নেই। কিন্তু ফিরাস তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কেন যে এলো না ফিরাস! মায়েরা তো ওকে কতো করে বুঝিয়েছিলো। ফিরাস মানেনি। বলেছিলো,
- তোমাদের যে কারণে যাওয়া দরকার, আমার তো ঠিক সেটা নয়। আমি এখানেই থাকবো। বেঁচে থাকলে নতুন করে দেশটাকে তৈরী করার স্বপ্ন দেখবো। মতিনের লেখা গানগুলো গাইবো। সবাই চলে গেলে দেশের ভেতরের সব আলোই যে নিভে যাবে! আসেনি ফিরাস। আসবেও না। বেঁচে থাকলে আবার কোনো দিন এই দেশের মাটিতেই দেখা হবে ওর সঙ্গে। শিরীন যে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো, সেটা দেখেছে ফিরাস। বুড়ো আঙুলটা উঁচু করে দেখালো শিরীনকে। বুরখা তোলার উপায় নেই। মাথাটা একবার নেড়ে, সামনের দিকে পা বাড়ালো শিরীন।
বিমানবন্দরের লোক কাগজপত্র পরীক্ষা করছে। আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। তিনজনের মধ্যে দুজনের হয়ে গেছে। শুধু শিরীন বাকি। দুরুদুরু বুকে কাগজের গোছাটা বাড়িয়ে দিলো শিরীন।
- নাম?
- শিরীন... শিরীন হোসেইনী।
- বিবাহিত?
- হ্যা৺।
- স্বামীর নাম?
- ফিরাস খান।
- সঙ্গে কেউ আছে?
- মা আর শাশুড়ি মা।
- আর?
- আর কেউ নেই। না... মানে... এই... আর আমার মেয়ে।
ঢোক গিলে বললো শিরীন। বলার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটাকে জোর করে জড়িয়ে ধরলো বুকে। পলক না ফেলে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল অফিসার। রোজ রোজ একই যুদ্ধ দেখছে সে এই ক'দিন ধরে। মনুষ্যত্বের সঙ্গে পশুত্বের অবিরাম লড়াই। সুযোগ মতো চেষ্টা করেছে, মনুষ্যত্বকে জিতিয়ে দিতে। কিন্তু সেসব তো সাময়িক। সত্যিকারের মনুষ্যত্বের চিরস্থায়ী জয় কবে হবে কে জানে!
- কি হয়েছে অফিসার? সমস্যা?
হেড়ে গলায় একজন বলে উঠলো পেছন থেকে। বলতে বলতেই সামনে এগিয়ে এসে বন্দুকটা রাখলো ছোট কাঠের টেবিলটার ওপরে। শিরীনের ইচ্ছা করছিলো, বন্দুকটা টেনে নিয়ে সবকটা গুলি ভরে দিতে জানোয়ারটার বুকে। এইরকম একটা বন্দুক দিয়েই তো....
- কিছু না। সব ঠিক আছে।
বললো মধ্যবয়সী অফিসার লোকটা। তারপর শিরীনের দিকে ফিরে বললো,
- আপনি এগিয়ে যান। পেছনে অনেক লোক।
****
একটা বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে একটা অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় প্রতি রবিবার রাত আটটার সময়। অনুষ্ঠানের নাম "কেয়ার অফ মৃত্যুনীল উপত্যকা"। গত পাঁচ বছর ধরে এই কৌতুক শোটি সারা পৃথিবীতে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। একসময়ের বিশিষ্ট কৌতুক শিল্পী ঈসাদ হারজারির মেয়ে আফসুন হারজারি সঞ্চালনা করেন এই অনুষ্ঠানটি। দেশের অস্থির অভ্যন্তরীন পরিস্থিতিতে, উগ্রপন্থীদের হাতে সতের বছর আগে নিহত হয়েছিলেন ঈসাদ হারজারি। থেমে গিয়েছিলো তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। সেদিন নিতান্ত নিরূপায় হয়ে মুখ লুকিয়ে, পরিচয় গোপন করে পালিয়ে আসতে হয়েছিলো তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে। আফসুনের পিসেমশাই পাশের দেশে বসে গোপনে জাল পরিচয়পত্র তৈরীর জন্য সাহায্য করেছিলো। সেই পরিচয়ের ভরসায় আফসুন, ওর মা আর পিসি দেশের বাইরে আসতে পেরেছিলো। পিসি সেদেশেই থেকে যায়, পিসেমশাই এর সঙ্গে। আফসুন আর ওর মা নাসরিন চলে আসে ইউরোপে। পড়াশোনা সম্পূর্ণ করতে করতেই আফসুন মনে মনে ঠিক করে নেয়, বাবার জীবিকাকেই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেবে। আজ আবার তার শো এর মাধ্যমে বার্তা পৌঁছাচ্ছে তার দেশের মানুষের কাছে। আবার আশা পুঞ্জীভূত হচ্ছে সেদেশে। ওদেশে ছাত্রসমাজ, যুবসমাজও থেমে নেই। বিপ্লবের পথে তারা অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সঙ্গে রয়েছে আফসুন হারজারির শো। গোপনে অর্থ সাহায্য করেও আফসুন এই সংগঠনকে সাহায্য করছে।
আফসুনের শোতে আজ প্রথমবার অতিথি হয়ে আসছে ষোলো বছরের মারুফা খান। আফসুনের দেশেরই প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী নিহত মতিন খানের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার সাথে সাথে গান গায় মারুফা। সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে তার বাবার লেখা গানগুলো গাইতে। লোকগানের শিল্পী হতে চায় মারুফা। চায় দেশের মানুষের জন্য গান লিখতে, গান গাইতে।
রেডিও স্টেশনের বাইরে ভিড় উপচে পড়ছে। অনুষ্ঠান শেষ হলে একবার মারুফাকে দেখতে চায় সবাই। রাত আটটা। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আফসুন অনুরোধ করলো মারুফাকে, তার পছন্দমতো কোনো গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে।
- মৃত্যুর ঠিক দু'দিন আগে, গ্রামের বাড়িতে লুকিয়ে থাকার সময় আমার বাবা যে কথা আমার মা'কে বলেছিলেন, আর বলতে চেয়েছিলেন দেশের সমস্ত মেয়েদের, সেই কথাগুলো নিয়েই বাবা লিখেছিলেন তাঁর শেষ গান। এই গানে সুর করে যেতে পারেননি আমার বাবা। সেই গানে সুর করেছি আমি। এটাই আমার জীবনের প্রথম করা গানের সুর।
এটা দিন বদলের গান
প্রিয়তমা আমার-
এটা ভরসা রাখার গান
সূর্য উঠবেই আবার।
তুমি মৃত্যু যদি দেখো,
অবিচলিত থেকো,
তুমি পাশবতা দেখেও
অধীর হোয়ো নাকো।
জেনো পাশবতা কোনদিন
দীর্ঘস্থায়ী নয়।
জেনো ভয়ঙ্কর এই রাত
ফুরোবেই নিশ্চয়।
তোমার দু'চোখ ঘিরে ভয়,
তোমার যন্ত্রণা মেশা রাত,
ফুরোবেই একদিন,
হবে আশার সুপ্রভাত।
মারুফার হাত ধরে রেডিও স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে, গাড়িতে ওঠার আগে আফসুন আনমনেই আকাশের দিকে তাকালো একবার। বৃষ্টি থেমে গেছে তখন। আকাশে কাস্তের মতো বাঁকানো চাঁদের ফলাটা জলের পর্দার ভেতর থেকে ওর দিকেই কি চেয়ে আছে!
---------------------------
সোমা চক্রবর্তী।
কালিকাপুর, বারাসাত,উত্তর ২৪ পরগণা।
পিন- ৭০০১২৪.
Wonderful
উত্তরমুছুন