রহস্যগল্প ।। নরখাদক ।। বানীব্রত গোস্বামী
আমাদের, মানে আমার আর প্রত্যুষের প্রথম সাফল্য এই নরখাদক রহস্য। তবুও তার পরে চন্দননগরের ‘ননীচোরের মোহনবাঁশি’ ও ‘কপালকুণ্ডলা’র খাঁড়া’ কেস্ দুটোর গল্প অনেকে প্রখ্যাত পত্রিকায় পড়েছে। কিন্তু এ’গল্পটা আমার লেখা হয়নি এর নৃশংসতার কারণে। প্রথমত কিভাবে লিখব? আর দ্বিতীয়ত সবাই ব্যাপারটা নিতে পারবে কী না! অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম যতটা সম্ভব প্রকৃত সত্যটাই তুলে ধরার চেষ্টা করব। যারা বাকি দুটো গল্প পড়েনি, তাদের জন্য আমাদের পরিচয়টা আগে একটু দিয়ে দিই। বুঝতে সুবিধে হবে।
আমি, অপূর্ব কর। হিন্দুস্কুলে আঁকা শেখাই। আর গোপন একটা পেশা আছে। সেটা হল লালবাজারের ফ্রিলান্স ক্রিমিনাল, মানে এককথায় কম্পোজিট আর্টিস্ট। বিভিন্ন কেসে প্রত্যুষকে সহযোগিতা করি। কে এই প্রত্যুষ? এক অসম্ভব মেধাবী বিজ্ঞানের ছাত্র। এখন আমার স্কুলেই অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ায়। গোয়েন্দা কাহিনী নিয়ে গবেষণা করছে। চাবুকের মত ব্ল্যাকবেল্ট চেহারা। ছোটবেলা থেকেই বিয়েবাড়িতে গয়না চুরি বা একান্নবর্তী পরিবারে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি চুরির অনেক সমাধানই ও করেছে। তবে গোয়েন্দা তকমা পাবার মত কোন কেস্ না পাওয়ার আফশোস প্রায়ই আমার কাছে করে। আমার গোয়েন্দা বিভাগে কিঞ্চিৎ জানাশোনা আছে। চেষ্টায় থাকি। খরচা করে একটা বন্দুকের লাইসেন্স করাল। পড়ে পড়ে জং ধরছে। ভালো কথা, আমরা কোথায় থাকি সেটাই তো বলা হয়নি। কলেজস্ট্রীটের মির্জাপুরে একটা মেসবাড়িতে একই ঘরে দুজনে থাকি। সন্ধেবেলা দাবা খেলে নিরামিষই কাটছিল দিনগুলো।
বছর দুয়েক আগের ঘটনা। কোলকাতায় সেবার ডিসেম্বরের শুরুতেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। শীত নিয়ে বরাবরই বাঙালির একটা আদিখ্যেতা আছে। এ ব্যাপারে তো বাঙালি আসলে কাঙালী। টিভি চ্যানেলগুলো-ও সন্ধে থেকে বসে গেছে সব রেকর্ড নিয়ে। কোত্থেকে চার পাঁচটা জুটেও যায়, লন্ডন হতে আর কত ডিগ্ৰী বাকি সেই নিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়। আমরাও বসে বসে তেলেভাজা মুড়ি আর চা নিয়ে তার মজা নিচ্ছি। হঠাৎ একটা ব্রেকিং নিউজ! ‘প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে গঙ্গার ধারে মহিলার ছিন্নভিন্ন দেহ উদ্ধার’।
প্রত্যুষের অনুরোধ, “একবার দেখতে যাওয়া যাবে?” পরিচিত পুলিশ অফিসারকে ফোন লাগালাম। আশ্বস্ত করল। জবুথবু ঠান্ডায় বাধ্য হয়ে, প্রত্যুষকে নিয়ে ট্যাক্সি ধরে উপস্থিত। স্পটে যখন পৌঁছলাম, পুলিশে ছয়লাপ। ছোট বড় অনেক অফিসার। অনেক লালবাতি গাড়ি। চেনাশোনার জোরে লাশের অনেকটা কাছে চলে গেলাম। প্রত্যুষ ঝুঁকে পড়ে মোবাইলে ছবি তুলতে লাগল। বডির বর্ণনাটা না লেখার মত, তবু না বললে গল্পটা ভালো লাগবে না। পেট পুরো কাটা, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আছে, দুটো চোখই উপড়ে নেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগের এক হোমড়াচোমড়ার সাথে প্রত্যুষের আলাপ করিয়ে দিলাম। তিনি প্রত্যুষের উৎসাহ দেখে কিছুটা প্রশয় দিলেন। আমাকে নীচু স্বরে বললেন যে, যদি সমাধানের চেষ্টা করে ক্ষতি নেই, পুলিশের তরফ থেকে সবরকম সহযোগিতা পাওয়া যাবে, অসুবিধে হবে না। কপালজোরে আমাদের প্রথম কেস্ জুটল। যাওয়ার সময় প্রত্যুষের কাঁধে হাত দিয়ে একটা ঝাঁকুনি দিলেন, “বেস্ট অফ্ লাক, ইয়ং ম্যান”। আমি আর প্রত্যুষ ফেরার গাড়ি ধরলাম। এত বড় শহর! কোটি কোটি মানুষ! কাকে সন্দেহ করব? এ তো খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা। সবার আগে জানতে হবে মেয়েটির পরিচয়।
।।২।।
পরদিন জানা গেল মেয়েটির পরিচয়। মিসিং ডায়রি থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। মেয়েটি এক বারসিঙ্গার। ধর্মতলা অঞ্চলের। বার থেকেই ডায়রি করা হয়েছিল। ফোনও তুলছিল না, ফ্ল্যাটেও নেই, কাজেও যায় নি। তার থেকেই ওদের সন্দেহ হয়। পার্ক স্ট্রীটে একা একটি ফ্ল্যাটে থাকত। ফ্ল্যাটটা পুলিশ সিল করেছে। কিছু লোকের ফোন নাম্বার পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলে আমাকে জানাবে। এখন অপেক্ষা পোস্টমর্টেম আর অটোপ্সি রিপোর্টের। প্রত্যুষ গুম মেরে রয়েছে।
--“তুমি জানলে কী করে?”
--“মাটিতে চটির ছাপ ছিল। আর গাড়িতে বডিটা নিয়ে এসে ফেলে দিয়ে গেছে। ওখানে মার্ডার করে নি। তবে আজ আর একবার ওখানে যাব।”
--“ঠিক আছে, বিকেলে যাওয়া যাবে।”
স্কুল থেকে ফিরে আমি আর প্রত্যুষ স্পটে গেলাম। নতুন করে কিছু পাওয়া গেল না। তবে গুটখার কিছু দাগ দেখা গেল। ফরেনসিকে যোগাযোগ করলাম। ওরা জানাল, যে বডি ফেলে গেছে, গুটখা সে-ই খায়। প্রত্যুষ মনে মনে একটা ঝাপসা অবয়ব আঁকতে লাগল। কিন্তু অঙ্ক মিলবে কী করে!
পরদিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখে আমাদের মাথা ঘুরে গেল। শরীরের মধ্যে কোন প্রয়োজনীয় অরগ্যান নেই। হার্ট, লাঙস্, কিডনি, লিভার সব গায়েব। সাথে চোখ দুটোও নেই। এতো সাংঘাতিক কান্ড! আমি প্রত্যুষকে আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম, “এটা পরিষ্কার, যে একটা অঙ্গ প্রতিস্থাপন পাচার চক্র এর মধ্যে জড়িত। তবে দলে একজন ডাক্তার আছে।”
প্রত্যুষের মুখ কঠিন। চিন্তাশীল। সহজে কোন কথা মেনে নেবার পাত্র নয়। গলা নামিয়ে গম্ভীর হয়ে একটা প্রশ্ন করল, “যারা এরকম একটা নৃশংস খুন করে সব অঙ্গ কেটে নিতে পারে, তারা কী চোর-পুলিশ খেলবে বলে বডিটা ঐভাবে ফেলে গেল? আর একটু গভীরে ভাবতে হবে।” আমি আর কথা বাড়ালাম না। বুঝলাম এসব আমার কম্ম নয়। তার চেয়ে লেখা নিয়েই থাকি। টিভিতেও ঐ ঘটনাটা সমানে কচলাচ্ছে। ওদের যা কাজ। সব নিয়েই ব্যবসা। মৃত্যু ওদের কাছে প্রোডাক্ট। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে যত পারো বেচো।
পরদিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলাম। শ্বাসরোধ করে খুন। খুনের পরেই পেট কাটা এবং চোখ খোবলানো হয়েছে। এবার অপেক্ষা ফরেনসিকের। প্রত্যুষকে জিগেস করলাম, “কী বুঝছ? একটু আলোকপাত কর।”
--- “একটা জিনিস পরিষ্কার হচ্ছে, কোন প্রতিহিংসা বা প্রেমঘটিত খুন এটা নয়। ধর্ষণেরও কোন ব্যাপার নেই। তাহলে কি অঙ্গগুলো নেওয়াই একমাত্র কারণ? কিন্তু তারা তো বডিটা লোপাট করে দেবে। সব জড়িয়ে যাচ্ছে অপু!”
ফরেনসিক আসতে এখনও দুদিন দেরি। আরও কিছু তথ্য জানার জন্য আমাকে অটোপ্সির ওখানে ফোন করতে বলল। অটোপ্সির ওখান থেকে অতিরিক্ত যেটা জানতে পারলাম, শ্বাসরূদ্ধ হওয়ার সময় মেয়েটির হাতে খুনীর একটি পাকা চুল মাথার বা বুকের চলে আসে। তার মানে খুনী মধ্যবয়স্ক। আর অজ্ঞান করার প্রায় ঘন্টাতিনেক পরে খুন করা হয়। অর্থাৎ অজ্ঞান করা হয়েছিল অপহরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু অঙ্গগুলো কাটা হল কী উদ্দেশ্যে? সেটাই এখন মূল রহস্য। অটোপ্সি রিপোর্টের অপেক্ষা…।
সেই রিপোর্ট হাতে আসার আগেই আর এক ভয়ঙ্কর খবর এসে হাজির হল। বাইপাসের ধারে মেট্র্যোপলিটনের কাছে ভোরবেলা এক মহিলার দেহ উদ্ধার। খবর পাওয়ার সাথে সাথেই আমরা ছুটলাম সেখানে। জানিনা কী দৃশ্য অপেক্ষা করছে!
।।৩।।
কাছাকাছি গিয়ে যেটা বুঝলাম, এই বারের ব্যাপারটা অনেক সিরিয়াস। পুলিশ মহলকে যথেষ্ট চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। সকলেই একটু নড়েচড়ে বসেছে। লাশের কাছাকাছি যেতে বেশ বেগ পেতে হল। গিয়ে যা দেখলাম, সেটা লিখতে গেলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়। ভিখিরি গোছের এক মহিলা। পরনে ছেঁড়া কাপড়। আলুথালু। সারা শরীর অবিকৃত। শুধু চুল সমেত মাথার খুলির উপরিভাগ নেই। ভেতরটা ফাঁকা। রক্ত লেগে আছে। মস্তিক হাওয়া। নিপুণ হাতে ব্রেনটি যেন খুলে নেওয়া হয়েছে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মেরুদন্ডের ভেতর থেকে সুষুম্নার শেষ অংশটা দেখে বোঝা যাচ্ছে নিঁখুত হাতের কাজ। ডাক্তার ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। অনেকগুলো প্রশ্ন আমাদের মনে এসে ভিড় করছে। কে এই মহিলা? কেনই বা খুন? আর ব্রেন তো এখনও চিকিৎসাবিদ্যায় সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা যায় না। তাহলে ব্রেন লোপাট কেন? কে এই আততায়ী? কী তার উদ্দেশ্য? এই একগাদা প্রশ্ন মাথার মধ্যে কিলবিল করে মাথাটা গুলিয়ে দিচ্ছে। দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে ক্যাপ্টেন ভেড়ির ধারে সুন্দর বাঁধানো জায়গাটায় পায়চারি করছি।
হঠাৎ অটোপ্সি ল্যাবরেটরি থেকে ফোন। আমার বলাই ছিল, দরকারি কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে। ওরা বলল, যে ঐ বার সিঙ্গারের প্রতিটি অঙ্গ নিঁখুত ভাবে অপারেট করা। ওরা একশো শতাংশ নিশ্চিত এটা কোন ডাক্তারের কাজ। আমি প্রত্যুষকে বললাম, “তুমি এর পরেও বলবে, এটা অঙ্গ পাচার-চক্রের কাজ নয়!”
প্রত্যুষ সিগারেটে টান দিয়ে বলে উঠল, “দুটো কেস একই আততায়ীর কী না, সেটা আগে জানতে হবে। তবে এখানে পায়ের ছাপও নেই, গুটকাও নেই। কিন্তু বডি ফেলে যাওয়ার ধরণটা একই রকম। দেখা যাক!”
ঘটনাটা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। কাগজ, টিভি চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। সন্ধের পরেই এখন রাস্তা সুনশান হয়ে যায়। ভয়ে কেউই খুব দরকার না থাকলে ফাঁকা রাস্তায় বেরোয় না। যাদের গাড়ি আছে, তাদের ব্যাপার আলাদা। “এই বিশাল জনসমূদ্রে ঐ ধূর্ত মাছ ধরা যাবে কী করে?” প্রত্যুষকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।
গভীর চিন্তামুখে প্রত্যুষ বলে উঠল, “কাল একবার লালবাজার যেতে পারবে। পুলিশের একটা সহযোগিতা লাগবে।”
--"দেখছি কী করা যায়।”
পরেরদিন পুলিশের বড় কর্তার সাথে একটা এ্যপয়েন্টমেন্ট করলাম। বেলা বারোটায় আমরা লালবাজার পৌঁছলাম। প্রত্যুষ আজ খুব চিন্তামগ্ন। পুলিশের বড় কর্তার সাথে দেখা করার পর প্রত্যুষ একটা অনুরোধ করল, অদ্ভুত অনুরোধ। কোলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সমস্ত সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের গত এক মাসের সব ডেথ্ সার্টিফিকেটের কপি, তাদের বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বর। এছাড়া গত একমাসে কোলকাতার সব শ্মশানের সৎকারের কাগজ। আমি অবাক হয়ে গেলাম। প্রত্যুষকে বললাম, “এতে কী সত্যিই কোন লাভ হবে?”
খুবই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ও জবাব দিল, “এছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার এ’র থেকে ভালো রাস্তা আর কিছু নেই।”
পুলিশের বড়কর্তা মানুষটি বড়ই সহানুভূতিশীল। তিনি উৎসাহ দিয়ে বললেন, “আমাকে তিন-চারদিন সময় দিন। আমি আপনার তথ্যগুলো জোগাড় করছি। আপনি সবরকম সাহায্য পাবেন আমাদের কাছ থেকে। তিরিশ বছর মানুষ ঘাঁটছি। আমার মানুষ চিনতে ভুল হয় না। আমার স্থির বিশ্বাস আপনি সফল হবেন।”
প্রায় চারদিন কেটে গেল। মনের খচখচানি টা যাচ্ছে না। হঠাৎ লালবাজার থেকে ফোন।
যাইহোক প্রত্যুষের সাথে কাগজগুলো নিয়ে বসলাম। প্রথম কেস। একটু খাটতে তো হবেই। রাত জেগে শুরু হল আমাদের হাসপাতাল আর শ্মশানের কাগজ মেলানো। অবশেষে মাত্র পাঁচটি নাম পাওয়া গেল। সবকটার নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার নোট করা হল। এই পাঁচটি বডি সৎকারের কোন হদিশ পাওয়া গেল না। আমি প্রত্যুষকে প্রশ্ন করলাম, “এর সাথে এই খুনের সম্পর্ক কী?”
--"ঐ চা’র সাথে বিস্কুটের যা সম্পর্ক। দুটো কড়া চা বলে দাও। সঙ্গে বিস্কুট। আজ যেন প্রত্যুষকে অনেকটা চিন্তামুক্ত লাগছে। আমার মনে একটাই সন্দেহ। প্রত্যুষ কি কেসটা সমাধান করতে পারবে? ও কি সত্যিই ভবিষ্যতে সফল গোয়েন্দা হবে?”
পরেরদিন পাঁচটি ফোন নাম্বারেই ফোন করা হল। জানা গেল, চারটি বডি তাদের দেশের বাড়ির নিকটবর্তী শ্মশানে সৎকার করা হয়েছে। আর একটি বাড়ি থেকে খোঁজ করাতে, বলা হল রং নাম্বার। এবার প্রত্যুষ বিচলিত হয়ে পড়ল। আমাকে বলল, “আর এক মিনিটও সময় নষ্ট করা যাবে না। তুমি এখনই পুলিশে খবর দাও সাদা পোশাকে ঐ ঠিকানার কাছাকাছি চলে আসতে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “মানে?”
--"মানে বোঝাবার সময় এখন নেই। যা করতে হবে তাড়াতাড়ি। না হলেই সব ফস্কে যাবে। পাখি ফুড়ুৎ।”
যে বাড়ি থেকে একটি পুরুষ-কন্ঠ বলেছিল রং নাম্বার। সেই ঠিকানায়, পেশেন্টের নাম ছিল অনসূয়া চৌধুরী। আর বাড়ির লোক হিসেবে নাম ছিল ছেলের। মনোজিত চৌধুরী। বেকবাগান থানার অন্তর্গত সেবাসদন নার্সিংহোমে দিন কুড়ি আগে উনি মারা যান। নার্সিংহোমে ফোন করে জানা গেল অনসূয়া দেবী মারা যাওয়ার পর গভীর রাতে ওনার ছেলে একা এসেছিল বডি নিতে। সঙ্গে কেউ ছিল না। প্রত্যুষের আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগলো।
আমরা বেলা দশটা নাগাদ পৌঁছলাম কড়েয়া রোডের নির্দিষ্ট বাড়িটায়। শান্তিনিবাস। ট্যাক্সি থেকে নামতেই বুঝে গেলাম নানা ছদ্মবেশে বেশ কিছু পুলিশকর্মী বাড়িটার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বড় কালো লোহার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দোতালা বাড়ি। বেশ পুরোনো। সামনে এক চিলতে বাগান। বাড়ির বাইরে অযত্নের ছাপ প্রকট। সামনের দোকানে জিগেস করে জানা গেল অনেকদিন কাউকেই এ’বাড়ি থেকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি। মনে হয় বাড়িতে কেউ নেই। প্রত্যুষ আবার মোবাইল বার করে নার্সিংহোম থেকে পাওয়া নাম্বারটায় ফোন করল। আবার সেই একই পুরুষকন্ঠ। সেই একই উত্তর ‘রং নাম্বার'।
দূরে বই-খাতার দোকান থেকে একটা খাম কিনে নিয়ে এল। আমাকে একটু দূরে দাঁড়াতে বলল। তারপর খামটা হাতে নিয়ে দরজায় দুবার ধাক্কা দিল। খানিকক্ষণ চারদিক নিস্তব্ধ। মিনিট দুয়েক পর দোতালার বারান্দায় এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। একমাথা কাঁচা-পাকা চুল। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। বয়স বছর পঞ্চাশ। বারান্দা থেকেই প্রশ্ন করলেন, “কে…?”
প্রত্যুষ বলে উঠল, “কুরিয়ার, আপনার নামে একটা পার্সেল আছে।”
--"আমার নামে?”
--"হ্যাঁ, এসে নিয়ে যান।”
--"লেটার বক্সে দিয়ে যান।”
--"না, একটা সই করতে হবে।”
-- “দাঁড়ান, আসছি।”
প্রত্যুষ ইশারায় পুলিশকর্মীদের সজাগ করল। আমি ভাবছি শুধু অনুমানের ওপর একজনকে অপদস্থ করাটা কী উচিৎ হবে। যদি নিশানা ভুল হয়, তখন পুলিশমহলে আমার যথেষ্ঠ সম্মানহানি হবে। আর এই লোকটিও কতটা কেউকেটা, সে-তো আর জানা নেই। এইসব ভাবতে ভাবতেই নীচর কালো লোহার দরজাটা একটু ফাঁক হল। লোকটা মুখ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে, প্রত্যুষ দরজাটা এক ঠ্যালা দিয়ে লোকটার হাতটা খপ্ করে ধরে নিল। লোকটা বাধা দেবার আগেই দুজন পুলিশের লোক লোকটাকে চেপে ধরে ফেলল। এবার লোকটি চোস্ত ইংরেজিতে প্রতিবাদ করছে। আমি প্রত্যুষ আর দুজন পুলিশ অফিসার ঢুকে পড়লাম বাড়ির মধ্যে।
গেট দিয়ে ঢুকে একটা ছোট অযত্নের বাগান। তারপাশে ধুলোপড়া একটা গাড়ি। একতলার সবক’টি ঘর বন্ধ। নোংরা অপরিচ্ছন্ন বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি। সিঁড়িতে আবর্জনা ভর্তি। আমরা উঠে গেলাম দোতালায়। দোতালায় উঠতেই একটা বোঁটকা গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠলো। প্রথম ঘরটায় একটা ময়লা বিছানা। ছেঁড়া মশারির দুটো কোণা খাটানো। প্রচুর পোড়া সিগারেট পড়ে আছে। দীর্ঘদিন জানলা বন্ধ থাকার ফলে, একটা চাপা ভ্যাপসা গন্ধ। পাশের ঘরটায় ঢুকলাম। একটা ফ্রিজ। পাশে ডাইনিং টেবিল। ফ্রিজটা খুলতেই আমরা চমকে গেলাম। ডিপ্ ফ্রিজে একটা রক্তাক্ত মানুষের মস্তিস্ক। প্রত্যুষ দৌড়ে গেল শেষের বন্ধ ঘরটার দিকে। তালা দেওয়া। লাথি দিয়ে দরজাটা ভেঙে দিল। ভেতরে একটা বড় আইসক্রিম রাখার ফ্রিজ। তার ভেতর ঢোকানো রয়েছে এক বয়স্ক মহিলার মৃতদেহ। জলের মত পরিস্কার হতে লাগলো ঘটনাগুলো। গ্ৰেপ্তার করা হল মনোজিত বাবুকে। তবে ওনার অসংলগ্ন কথাবার্তায় আমাদের সন্দেহ বাড়তে লাগলো। পরেরদিন আমাদের দুজনকে লালবাজারে ডেকে পাঠালো। আমরা ভয়ে ভয়ে গেলাম। গিয়ে অবশ্য অনেক প্রশংসাই পেলাম। জানতে পারলাম, মনোজিত একজন মানসিক রোগী। এ’রোগ তার বহুদিনের। ডাক্তারী পড়তে পড়তে তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। জেরায় সব-ই স্বীকার করেছে। মায়ের মৃত্যুর পর বডি রাতের অন্ধকারে গোপনে নিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকিয়ে নেয়। তারপর একটি কমার্শিয়াল ফ্রিজ কেনে এবং বডি ঢুকিয়ে রাখে। মৃত্যুর কারণ ‘মাল্টি-অরগ্যান ফেলিওর’। মনোজিত বিশ্বাস করে, সব অরগ্যান, এমনকি মস্তিস্ক পাল্টে, তারপর বিদ্যুৎ শক্তির মাধ্যমে চার্জ দিয়ে নাকি বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। ঠিক সেই কারণেই দুটি হত্যা। এখন হোমে পাঠানো হয়েছে মনোজিতকে। প্রত্যুষের নামের আগে গোয়েন্দা তকমা বসল। আমি পাকাপাকি ভাবে সহকারী হলাম। কাগজে খবরটা ফলাও করে বেরিয়েছে। প্রত্যুষের ছবিটা খুব পরিষ্কার, পিছনে আমার একটা ঝাপসা ছবি। সেটাই বা কম কী! জীবন অন্য দিকে মোড় নিয়ে, এক অন্য খাতে বইতে শুরু করল।
-----------------------------------
-- বাণীব্রত গোস্বামী
Name-Banibrata Goswami
Address-9/6 East Mall Road. Kolkata-700080
Mobile-9831068493,