ভ্রমণালেখ্য ।। পাহাড়ি সুন্দরী ঝান্ডি ।। শংকর লাল সরকার
পাহাড়ি সুন্দরী ঝাণ্ডি
শংকর লাল সরকার
মালবাজারকে কেন্দ্র করে ঘুরে নেওয়া যায় ডুয়ার্সের আনাচে কানাচে। শুধু ডুয়ার্সই বা বলি কেন দার্জিলিং জেলার দুটো সেরা বিউটিস্পট লাভা-লোলেগাঁও এর দূরত্বও এখান থেকে বেশী নয়। আগে বেশ কয়েকবার গিয়েছি লাভা শহরে। তাই ঠিক করেছিলাম লাভা শহর ঘুরে রাত্রে থাকব কোন এক স্বল্পচেনা পাহাড়ি গ্রামে।
মালবাজার থেকে রওনা হয়ে গুরুবাথান হয়ে ছুটে চললাম লাভার দিকে। দুপাশে বুক সমান ঢেউ তুলে সবুজ চা বাগান, কাছে দুরে পাহাড়ের হালকা উদ্ভাস। পাহাড়, সবুজ চা বাগান আর তারই মধ্যে মধ্যে রঙবেরঙের পোশাক পরে চা পাতা তোলার দৃশ্য- মিলেমিশে তৈরী করছে সুন্দর সুন্দর সব কম্পোজিশান। দেখে দেখেও আশ মেটে না। মাঝেমধ্যেই পথের উপর চলে আসছে ঘন মেঘ। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ দুম করে শুরু হয়ে গেল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। আকাশ থেকে অবিশ্রান্ত ধারায় ঝরে পড়ছে, আবার পথের উপর দিয়েও বয়ে যাচ্ছে জলের স্রোত। কাছের একটা পাহাড়ের মাথায় ঘন ধোঁয়ার মতো মেঘ জমা হচ্ছে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস।
সিলে নদীর উপরের ছোট ব্রিজটার উপরে উঠার ঠিক আগেই দেখলাম বিশাল বড়ো একটা পাথরের উপর লাল রঙের ছোট্ট একটা মন্দির, অঝোর বৃষ্টিধারায় একলা ভিজছে। যতই লাভার দিকে এগিয়ে চলেছি পথের পাশের রঙিন তরশোকগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে আমরা বৌদ্ধপ্রধান এলাকায় রয়েছি। পথের পাশের প্রতিটি বাড়িতে রঙবেরঙের ফুল। একটা বাঁক ঘুরতেই দেখলাম সামনে বেশ কয়েকটা উঁচু উঁচু বাড়ি। বুঝলাম পৌছে গেছি লাভা। উন্নয়নের ইঁট কাঠ পাথরে হারিয়ে গেল প্রকৃতি। একগাদা হোটেল রেস্টুরেন্ট, দোকানপাঠ আমাদের স্বাগত জানাল। শহরের প্রবেশ পথের মুখেই বিরাট বৌদ্ধগুম্ফা। গুম্ফার উজ্জ্বল রঙের কারুকার্য চোখ টানে। ভিতরে পরপর সাতটা কারুকার্য সমন্বিত চোর্তেন। ফুলের বাগান। তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হল গুম্ফার চারপাশের দৃশ্য। দূরের পাহাড় জঙ্গলের সেই দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
পাহাড় আর জঙ্গলঘেরা ২১৯৫ মিটার উচ্চতার এক অপরূপ শৈল শহর লাভা। মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্বের শেরপা ভিউ পয়েন্ট থেকে উপভোগ করা যায় হিমবন্ত হিমালয়ের সৌন্দর্য। দূরে দৃশ্যমান সমতল মালবাজার। একযাত্রায় দেখে নেওয়া যায় ন্যাওড়া ভ্যালি ন্যাশানাল পার্ক। কালিম্পংএর পথে কিছুদূর এগিয়ে বামদিকের রাস্তা দিয়ে চললাম হিমালয়ের বুকে আর এক বিউটিস্পট লোলেগাঁও। লাভা থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরত্বে লোলেগাঁও অর্থাৎ আনন্দের গ্র্রাম। পর্যটক মহলে লোলেগাঁও নামে পরিচিত হলেও এখানকার স্থানীয় নাম কাফের! অদূরে ধ্যানমৌনী তুষারধবল কাঞ্চনজঙ্ঘা, ঘন নীল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ে ঢাকা ছবির মতো গ্রাম। না ভুলই বললাম, ছবিও কী এত সুন্দর হয়!
লাভা লোলেগাঁও ছেড়ে আমরা চললাম ঝাণ্ডির উদ্দেশ্যে। দুপাশে পাইন গাছের সারি। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে সূর্যালোকের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এগিয়ে চলেছি। মূল রাস্তা থেকে বাঁদিকে আচমকা বিবাগি হয়ে উঠে যাওয়া রাস্তায় বিরাট একটা গেটের উপর আড়াআড়িভাবে লেখা রয়েছে 'ঝাণ্ডি ইকো হাট'। হিমালয়ের বুকে স্বল্পচেনা সদ্য আবিস্কৃত এক বিউটিস্পট। অপরূপ ফুলের বাগান। পাহাড়ের ধাপে ধাপে সুন্দর সুন্দর রঙবেরঙের নানা আকার আর সাইজের কাঠের কুঠির। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঝাণ্ডির কটেজগুলি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। নির্জনে কটা দিন কাটাবার একেবারে আদর্শ জায়গা। আবার জনা কুড়ি বাইশজনের দল নিয়ে এসেও দুদিন হইচই হুল্লোড় করে কাটানো যায়। সঙ্গী বলতে চারদিকের পাহাড়, সবুজ জঙ্গল আর মেঘেরা। অনেক জানা অজানা পাখি আর রঙবেরঙের প্রজাপতি।
আমাদের ড্রাইভার রঞ্জিত বলল ঝাণ্ডি ইকো হাট নামের ট্যুরিস্ট রিসর্টটি যেখানে অবস্থিত সেটি আসলে ঝাণ্ডি নয়। ঝাণ্ডি নামের গ্রামটি এখান থেকে আরও পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত। দার্জিলিং জেলার গরুবাথানে অবস্থিত ঝাণ্ডি ইকো হাট, যেখানে তৈরী করা হয়েছে সে জায়গাটার স্থানীয় নাম আপার লুঙসেল।
পাহাড়ের ধাপেধাপে নিদৃষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ছড়ানো ছিটানো তেরটি কাঠের হাট। কিছুটা দূরত্ব রেখে একটা বেশ বড়ো ডাইনংহল। হাটের ভিতরের ওম থেকে বেরহতেই কনকনে ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কেঁপে উঠলাম। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে লেপের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। জানলার কাঁচে সবে একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটছে। ঘুম ভেঙে গেল পাখির কলকাকলিতে। জানলার কাচের মধ্যে দিয়ে দেখলাম নূতন দিন শুরু হচ্ছে। ঘরের ভিতর দিকে চোখ পড়তে অবাক। কত অজস্র রকমের পোকা- প্রজাপতি- মথ। বিচিত্র তাদের পাখার গঠন, অদ্ভুত তাদের ডানার কারুকার্য। আর বর্ণ বৈচিত্র্য!
শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়। বেশ কিছু মথ প্রজাপতিকে বন্দী করলাম ক্যামেরার মেগা পিক্সেলে। একটা মথকে দেখলাম প্রায় চড়াই পাখির মতো বড়ো।ঝাণ্ডি ইকো হাটের থেকে একটা রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ের আরও অনেকটা উপরে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সামসাদ ভিউপয়েন্টে। কিছুদূর অব্দি সিমেন্টে বাঁধানো রাস্তা আছে, তারপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে চলা রাস্তা। পায়ের নীচে ঝরে পড়া পাতা পুরু হয়ে জমে আছে। বেশ বোঝা যায় এপথে মানুষের নিয়মিত পা পড়েনা। ধীরে ধীরে চড়াই ভেঙে উপরে উঠতে লাগলাম। পথের পাশে প্রচুর কলসপত্রী উদ্ভিদ। ফনা তোলা সাপের মতো। ফনার ঠিক নীচে ছোট্ট কলস। চারদিকে যা পোকামাকড় এই গাছের বাড়বাড়ন্ত তো হবেই।
চড়াই পথে ধীরে ধীরে উপরে উঠছি, কখনওবা কিছুটা সমতল রাস্তা। চারপাশে নিবিড় জঙ্গল। প্রতিটি পদক্ষেপে নূতন নুতন চমক। উজ্জ্বল অপরূপ বর্ণবৈচিত্র্য সৃষ্টি করে উড়ে বেড়াচ্ছে রঙবেরঙের প্রজাপতি। কখনওবা নাম না জানা নানা পাখির কলকাকলি। সরু পায়ে চলা সুড়িপথের দুপাশে ঘন জঙ্গল। বিশাল বড়ো বড়ো বনস্পতিরা একে অন্যের সঙ্গে আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা করে বেড়ে উঠেছে। গাছের গুঁড়ি শাখাপ্রশাখায় শেওলার পুরু আস্তরণ। ডাল থেকে ঝুলছে শ্যাওলা। সূর্যের আলো মাটি অবধি পৌছায় না। আলো আধাঁরির খেলায় সকাল আটটার সময়েও যেন এক রহস্যময়তা বিরাজ করছে। মাঝে মধ্যেই মেঘ জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে। দৃশ্যমানতাকে ঢেকে দিয়ে চারপাশে সৃষ্টি করছে এক অপার্থিব নিস্তব্ধতার পরিবেশ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর স্যাঁতসেতে পরিবেশের জন্য আর বেশীদূর অগ্রসর হলাম না। ফিরে চললাম উৎরাই পথে। কিছুদূর নামতেই চারপাশ পরিস্কার হয়ে গেল। গলানো সোনার মতো রোদে প্রকৃতি ঝলমল করে উঠল। আমরা ফিরে এসে কুঠিরের সামনে বসলাম প্রকৃতিকে আরো কিছুক্ষন নিবিড় করে উপভোগ করার জন্য।
ব্লু জে পাখি নীল রঙের চমক সৃষ্টি করে ইতিউতি উড়াউড়ি করছে। চড়াই পাখির মতো গড়ন কিন্তু হালকা নীল রঙ। বেশ কয়েকজোড়া রয়েছে দেখলাম। কসাই পাখিও রয়েছে, হলদে শ্যামলা রঙের উজ্জ্বল রঙ। অপূর্ব সুরেলা গলার সুরের ছন্দে আমাদের মোহিত করে দেয়। ঝাণ্ডিতে আমাদের থাকার মেয়াদ শেষ হয়েছে আবার ফিরতে হবে মালবাজার। দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার।
***