একটি পাহাড়ি পদযাত্রাঃ গোয়েচা লা
অভিজিৎ নস্কর
প্রথমদিনঃ প্রস্তুতি
সাচেন উচ্চতা = ৭২০০ ফুট
ইয়াকসাম উচ্চতা = ৫৮৪০ ফুট।
১৪.১০.২১ তারিখ নবমীর রাতে শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে আমাদের যাত্রা শুরু। আমরা
অর্থাৎ আমি অভিজিৎ, বাচ্চুদা, তোতোনদা, বরুণদা, পলাশদা, তরুণ মাস্টার,
গৌরীশংকর, বাপ্পাদিত্য, সৈকত, প্রদীপ, পবিত্র, লিটন এবং তনয়। পরদিন সকালে
ঠিক সময় শিলিগুড়ি নামলেও ঐদিন অর্থাৎ ১৫.১০.২১ বিজয়া দশমীতে নেপালিদের
টিকা উৎসব থাকায় ড্রাইভাররা সব ছুটিতে। ফলে আমাদের এজেন্সি এডভান্স নিয়েও
গাড়ি ক্যান্সেল করে দেওয়ার কথা বলে। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায়
সেই এজেন্সি থেকে আবার গাড়ির ব্যবস্থা করে একেবারে লাঞ্চ করে যাত্রা শুরু
করি ইয়াকসামের পথে। পাশে তিস্তা পেরিয়ে জোরথাং ব্রিজ । এর পরেই নিজেদের ভুলে
শর্টকাট না নিয়ে চলে গেলাম পেলিং এ। যাইহোক পুরনো শহর পেলিং, ওখান থেকে
কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন পেলাম। মনটা ভাল হয়ে গেল। সন্ধ্যা সাতটায় ঢুকলাম
ইয়াকসামে। পরদিন সকালেই আমরা গোচালার উদ্দেশ্যে রওনা দেব। তাই সকলেই
তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
তারিখ ১৬.১০.২১, যেহেতু আমাদের পোর্টাররা ঘোড়া এবং ইয়াক নিয়ে দেরি করে এসেছিল তাই প্যাকিং লাঞ্চ নিয়ে আমাদের ইয়াকসাম থেকে বেরোতে বেরোতে দশটা বেজে গেল। আমাদের সাথে চলেছে আমাদের গাইড ফুর্বা। ২৫ বছরের ছটফটে একটি ছেলে। ক্রমে ইয়াকসাম ফেলে আমরা জঙ্গলের পথে প্রবেশ করলাম। গোচালার পথ হল আদিম পথ। জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূরে ঝর্ণার শব্দ।
আজ আমাদের গন্তব্য সাচেন। ইয়াকসাম থেকে সাচেনের দুরত্ব ৮ কিমি। তিনটি পাহাড়ি ব্রিজ অতিক্রম করতে হবে অর্থাৎ তিনবার পাহাড়ের ঢালে উঠতে হবে আবার নামতে হবে। ঘন্টা দুয়েক পর আমরা প্রথম ব্রীজ এসে পৌছালাম। অপূর্ব মনোরম দৃশ্য। এতক্ষণের ক্লান্তি এক নিমেষে কোথায় হারিয়ে গেল। আমি যেহেতু বাকিদের থেকে একটু মন্থর তাই এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম সামনের পাহাড়ি পথ বেয়ে। প্রথম এক ঘন্টা যাওয়ার পর আমার একটু শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। গরম জল সাথে রসুনের কোয়া চিবিয়ে ক্ষনিক বিশ্রাম নিয়ে একটু কর্পূর এর গন্ধ নাকে নিয়ে আবার চলা শুরু করলাম। একঘন্টা যাওয়ার পর একটি জায়গায় আমরা সবাই লাঞ্চ সেরে নিলাম। রাস্তা খুব সংকীর্ণ। মাঝেমধ্যেই একেবারে পাহাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ঘোড়া বা ইয়াকদের যাওয়ার রাস্তা করে দিতে হচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পরেই এল দ্বিতীয় ব্রিজ। বাকি ১২ জনের মধ্যে কেউ না কেউ সবসময়ই আমার সাথে চলছিল। আরো দুই ঘন্টা যাওয়ার পর তৃতীয় ব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে আমরা আবার পাহাড়ের ঢালে উঠতে থাকলাম। পদযাত্রার প্রথম দিন তাই হাঁটতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। তার উপর মেঘ সূর্যের লুকোচুরিতে মেঘের জয় হল। পাহাড় এখন মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টি প্রায় আসন্ন। মাঝেমধ্যেই ভারী মেঘ আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা সকলেই পঞ্চু পরে নিলাম। অবশেষে বিকেল চারটের সময় আমরা সাচেন পৌছালাম। পুরোপুরি জঙ্গল।
কিছুক্ষণ ফ্রী হ্যান্ড এক্সারসাইজ করার পর টেন্টগুলো খাটিয়ে নেয়া হলো। খাওয়ার ব্যবস্থা এবং টয়লেটের ব্যবস্থা প্রায় ২০০ মিটার পাহাড়ের ঢাল নেমে। যদিও আমাদের সন্ধ্যায় চা, মাশরুমের স্যুপ বা ডিনার আমাদের টেন্টে দিয়ে গেল কিন্তু ২০০ মিটার পাহাড়ীপথ নেমে টয়লেটের ব্যবস্থা বাকি গ্রুপগুলোর মত আমরাও মেনে নিলাম না। তাই সবাই টয়লেট পেপার নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে হালকা হওয়া গেল। ডিনারের আগেই বৃষ্টি নেমেছিল তাই আমরা প্রচন্ড ঠান্ডাকে কুর্নিশ জানিয়ে তাড়াতাড়ি টেন্টে ঢুকে স্লিপিং ব্যাগের চেইন টেনে দিলাম।
দ্বিতীয় দিন
সাচেন থেকে সোখা = ৭ কিমি
বাকিম উচ্চতা = ৮৬৫৪ ফুট
সোখা উচ্চতা = ৯৭০১ ফুট
১৭.১০.২১
তারিখ, আজ আমাদের যাত্রাপথ সাচেন থেকে বাকিম হয়ে সোখা। পুরো পথটাই
চড়াই-উৎরাই। আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন আমি স্লো হাইকার। তাই ব্রেকফাস্ট
সেরে ৭ টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম সকলের আগে। একটি কথা বলার ছিল সাচেন যেমন
জঙ্গল জীবনের একটি অভিজ্ঞতা দেয়, তেমনি এখানে পাহাড়ি জোঁক এর খুব আধিক্য।
সারারাত তাঁবুর বাইরে বৃষ্টির শব্দ, শুকনো ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ এবং জোঁকের
ভয়ে সবাইয়ের ঘুম খুবই কম হয়েছে কিন্তু সকালে উঠে সবাই ফ্রেশ। যাইহোক
আমি অনন্ত সৌন্দর্যের মাঝে একা ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম অজানা সৌন্দর্যের
টানে। কিছুদূর যাওয়ার পরেই একটি পাহাড়ে চড়াইপথ পেলাম। প্রচন্ড কর্দমাক্ত
রাস্তা। এতোটুকু ধৈর্যশীল না থাকলে পা পিছলে একেবারে খাদে। খুব আস্তে
আস্তে পাহাড়টি উঠলাম। এখানে পাথরের ভাগ কম। জঙ্গলের প্রকৃতি একইরকম। দুই
থেকে আড়াই ঘন্টা যাওয়ার পর আবার নিচে নামার পথে একটি ভিউ পয়েন্ট দেখে
থমকে দাঁড়ালাম। অসম্ভব সৌন্দর্য। মনে হল যারা আসেনি তারা কতো কিছু পেল না।
এরপর আধাঘন্টা নেমে বাকিম ব্রিজ। ব্রিজে এসে পাদুটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
প্রত্যেকটি সৌন্দর্য আগের সৌন্দর্যকে টেক্কা মেরে যাচ্ছে। মনের সুখে গান
গাইলাম। সেই গান হারিয়ে গেল পাগল ঝরনাধারার বুকে।
গ্রুপের বাকিরা ধীরে
ধীরে আসছে। আমিও তাই এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। মাঝেমধ্যেই বিপরীত দিক থেকে
যারা গোচালা হয়ে ফিরছেন তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া উপরের আবহাওয়া
কেমন। প্রায় প্রত্যেকেই একটি কথা বলছেন যে তাদের দলের সবাই শেষ পর্যন্ত
যেতে পারেননি। তাই আমাদের চেষ্টা থাকবে আমরা ১৩ জনই যাতে শেষ পর্যন্ত
সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি। অপরূপ শৈলশিরা আর মেঘের লুকোচুরি খেলা, গায়ে
স্নিগ্ধ রোদের চুম্বন নিয়ে আমরা পৌঁছালাম বাকিম ক্যাম্প সাইডে। এখানে চা
বিস্কিট খেয়ে রোদে খানিক নিজেদেরকে গরম করে নিয়ে ঘন্টাখানেক বিরতির পর
আবার যাত্রা শুরু করলাম সোখার উদ্দেশ্যে। বেরোতেই দেখলাম ইয়াক এর একটি বড়
দল নিচে নামছে।
আমরা তাদেরকে পথ করে দিয়ে এগিয়ে চললাম আরো খাড়াই পথ
ধরে। জঙ্গলের রূপ একটু একটু করে বদলাচ্ছে। বড় বড় পাইন গাছ আর গোছানো
পরিপাটি সরু রাস্তা। যেন কেউ ঢেলে সাজিয়ে রেখেছে আমাদের জন্য। ধীরে ধীরে
আমরা এগোতে থাকলাম। আরো দুই থেকে আড়াই ঘন্টা চলার পর আবার আমাদের ধাওয়া
করলো মেঘের দল। চারিদিকে ঘন মেঘ, হালকা ঝিরঝির বৃষ্টি। ইচ্ছা করছিল না
পঞ্চু চাপাতে। দূরে দেখলাম সোখা। একটু জোরে পা চালিয়ে আরও আধা ঘন্টা পর
চলে এলাম গন্তব্যে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে ভালোই। এখনো আমাদের টেন্ট খাটানো
হয়নি। তাই কিচেন রুমে আমরা গরম গরম স্যুপ সহযোগে শরীরকে ধাতস্থ করলাম। বসে
সবাই মিলে লাঞ্চ সহযোগে খানিক গল্প। প্রায় আধা ঘন্টা পরে একটু দূরে
ক্যাম্প সাইডে টেন্টগুলো খাটিয়ে সবাই গিয়ে টেন্টে বসলাম। বাইরে বৃষ্টি
থেমেছে তাই বেরিয়ে মেঘেদের আনাগোনা, সাথে দূরে একটুকরো পান্ডিম দর্শন
অপূর্ব এক আনন্দ অনুভূতি বয়ে গেল সবার শরীরে। এখন অন্ধকার। গরম গরম চা
সহযোগে টেন্টের মধ্যেই হেডটর্চ জ্বেলে সবাই গল্প করতে থাকলাম। সাতটা নাগাদ
ডিনার খাওয়ার জন্য ডাক পড়লো। আবার সবাই ডিনার টেবিলে পরের দিনের কিছু
জরুরি আলোচনা সেরে ফিরে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে পড়লাম। (চলবে)
-------------------------------------------
অভিজিৎ নস্কর
সোনারপুর।
সত্যিই পড়ে খুব ভালো লাগলো। পুরানো কথা মনে পড়ে গেল।
উত্তরমুছুন