ছোটগল্প ।। দুই বসন্ত ।। সৌমেন দেবনাথ
বয়স গেছে, কিন্তু যৌবন যায়নি। আজো আঙুররঙা টসটসে দেহতনু। এখনো অদ্ভুত মাদকতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সর্ব অবয়বে। বড় বেশী আবেদনময়ী মহিলা। কেউ বলবেন না উনি বাইশ-তেইশ বছরের এক কন্যা সন্তানের জননী। আজো লাগে সেই কুড়ি বছরের মত। আটোসাটো শরীরের গাঁথুনী।
আপেলের ন্যায় রাঙা জাহ্নবীর স্বামী মারা গিয়েছেন বছর পনের আগে। সেই থেকে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এতটুকু তার আঁচ পড়েনি শরীরে। যেন সোনার শরীর, শত তাপ আর চাপে উজ্জ্বলতা বাড়ছে। বিকেলের সোনারোদ শরীরে পড়লে শরীরটা হয়ে যায় শিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরি অকল্পনীয় ছবি।
স্বামী মারা যাওয়ার সাথে সাথে গ্রামবাসী জাহ্নবীকে নিয়ে কত বাজে মন্তব্য করেছিলেন। মালবী বৌদি কটাক্ষ করে বলেছিলেন, বর মরেছে ঘরের অভাব হবে না। যেমন সুন্দরী হয়ে জন্মেছে বর যাবে বর পাবে।
স্বামীহারা এক বৌয়ের মনের অবস্থা বোঝার চেয়ে তাঁর ঘাড়ে নানা অপবাদের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামবাসী। কাকলির মা বলেছিলেন, বর মরেছে, দেবরের অভাব আছে নাকি! গ্রামের সব ছেলেই তার দেবর, বর মেরেছে দেবরদের জন্যই। ঘরের বৌ পরের সাথে এত আলাপ করে এই মহিলাকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।
মাটির পুতুলের সৌন্দর্য আছে, রূপ-রং লাবণ্যও আছে, প্রাণের স্পন্দন নেই। জাহ্নবীও মাটির পুতুলের মত প্রাণের স্পন্দনহীন রূপ-লাবণ্যের একজন হয়ে গেলো। সবাই যে কটাক্ষ করতেন, বা শত্রুপনা করতেন তা নয়। কেউ কেউ এসে সান্ত্বনাও দিয়ে যেতেন। সুভদ্রার মা এসে জাহ্নবীকে সান্ত্বনা দিতেন, বলতেন, মেয়েদের জীবন এমনি দিদি। স্বামীহীন জীবন কানাকড়ির চেয়েও মূল্যহীন। স্বামীই সম্বল, স্বামীহীন নিঃসম্বল। মেয়েরা লাউয়ের ডগা। খুঁটি পেলেই আঁকড়ে বাঁচে। মেয়েটাকে কোলে পিঠে মানুষ করো।
জাহ্নবীর চোখ দিয়ে জল ঝরতো। প্রথমে রাকেশকে সহ্যই করতে পারতো না জাহ্নবী। বাবা তাঁর অমতে তাঁকে বিবাহ দিয়েছিলেন, একারণে বাবা ও রাকেশকে ইচ্ছামত বকতেন। অপমান করতেন। প্রতিবেশীরা জাহ্নবীর সম্বন্ধে জেনে গেলে রাকেশ পথে-প্রান্তরে বন্ধুদের দ্বারা টিটকিরির স্বীকার হতেন। পবন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলেছিলেন, কিরে বৌ বকে! কেমন পুরুষ! পুরুষ নামের কলঙ্ক! বৌ বকবে কেন্? বৌ থাকবে জব্দ।
রাকেশ মানুষের কথা শুনেও না শোনার ভান করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় সবচেয়ে বড় শিক্ষক।
মনকে বুঝ দিতেন রাকেশ। জাহ্নবীর মন বোঝার চেষ্টা করতেন। কোল আলো করে স্নেহা আসলো। রাকেশ ভেবেছিলেন, এবার জাহ্নবী ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু তার লক্ষণ তিনি দেখলেন না। মনকে বুঝ দিলেন, ওর চরিত্রই হয়ত এমন, একটু রগচটা। কিন্তু যেদিন তাঁর সম্পর্কের কথা শুনলেন সেদিনই রাকেশ খুব ভেঙে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে রাকেশ মারা যান। যে মানুষটাকে জাহ্নবী সহ্যই করতে পারতেন না, তাঁর মৃত্যুতে জাহ্নবী কি কান্নাকাটিই না করেন! মালবী বৌদি কাটাক্ষ করে বলেছিলেন, দেখো, কী মায়াকান্না! কত অভিনয় জানে এই বাজে মহিলা!
কাকলির মা বলেছিলেন, স্বামীকে অসহ্য করলে স্বামীর মন-মানসিকতা ভালো থাকে? মানসিক পীড়ায় স্নেহার বাবা মারা গেছেন। নাও স্নেহার মা, যাকে সহ্য হতো না সে বিদায় নিয়েছে। তোমার হাড় জুড়ালো তো!
রুহিনীর পিসি বলেছিলেন, অতি সুন্দরী তো, রাকেশে মন ভরেনি। নে, এবার নায়ক ধরে বিয়ে করিস।
মালবী বৌদি তীর্যক চেয়ে বলেছিলেন, বাসি ভাত খাবার জন্য কাক বসে আছে! বিয়ে?
কাকলির মা বলেছিলেন, পুরুষ মানুষ চেনো না বৌদি, সুন্দর দেখলে সরে না। ভেবো না জাহ্নবী পড়ে থাকবে!
রুহিনীর পিসি বলেছিলেন, এবার বুঝবি বাস্তবতা কী?
এরপর পনের ষোল বছর চলে গেছে। জাহ্নবী মেয়েকে মানুষ করে তুলেছেন। একা থাকলেই কাঁদেন। মেয়ে প্রশ্ন করলেই কাঁদেন। স্বামীহীন নারীর জীবন আসলেই কঠিন। স্বামীহীন পথ চলা নারীর কত কঠিন উনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, পাচ্ছেন। মা মেয়ে একত্রে ঘর থেকে বের হলে মানুষজন মেয়ের দিকে না তাকিয়ে মায়ের দিকেই বেশী তাকান। আর ভাবেন, নিরেট মহিলা। কোনো অপূর্ণতা উনার মাঝে নেই। জীবনের মাস্তুল বেয়ে দিনগুলো হুহু করে পার হয়ে গেলেও যৌবন তাঁর দেহ থেকে আজো বিদায় নিতে চায় না। যেদিক দিয়ে হেঁটে যান পিছন দিয়ে নদীতে ঢেউ উঠে, গাছে গাছে ঝড় বয়। এখন কত সংযত থাকেন, পোশাক-পরিচ্ছদে নেই আড়ম্বতা। তবুও মানুষের নজর আটকে যায় তাঁর দেহ-প্রকোষ্টে। যথেষ্ট সংযত হয়ে পথে ঘাটে বের হন। আর ভাবেন মনে মনে, স্বামী থাকলে তাঁর হাত ধরে তাঁকে সম্বল করে পথে উঠতে পারতেন। সম্বলটি ভেঙে গিয়েছে। আজ তাঁকে সম্বল করে তাঁর মেয়ে পথে উঠে। মেয়ে মাকে সম্বল করে যেখানে মা নিজেই বেশী সহায়হীনা। আয়ত গভীর চোখ। চোখে যে মায়ার মেলা তা আর মেলে ধরেন না। চশমা পরেন। মাঝে মধ্যে মেয়ের সাফল্য শুনলে একটু ঠোঁটে হাসেন। কী অদ্ভুত রূপ সৃজন হয় তখন। ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির জ্যোৎস্না দেখে স্নেহা বলে, মা, তুমি পৃথিবীর সেরা মা।
জাহ্নবী থেমে যায়, রূপের প্রশংসা শুনে শুনে তিনি বিষিয়ে গিয়েছেন। নিজের রূপকে যত আড়াল করতে চান তত তাঁর রূপ প্রকাশ পেয়ে যায়, মেলে যায় রূপ ততোধিক। নিজের রূপের প্রতি তাই বিতৃষ্ণা জাগে আজ তাঁর।
আজ কলেজ থেকে ফিরে স্নেহা মায়ের উপর খুব চটেছে। মাকে বললো, মা, কাকলির মা কাকলিকে বলেছেন, তুমি নাকি আমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী?
জাহ্নবী বললেন, এসব কী বলছিস মা!
স্নেহা আরো বললো, আমার বাবাকে একদিনও শান্তি দাওনি নাকি, কেনো? আমাকে কেনো পিতৃহারা করেছো?
জাহ্নবী কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। স্নেহা না শুনে নিজ ঘরে চলে গেলো। জাহ্নবী মেয়ের পিছন পিছন মেয়ের ঘরে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর দাদু আমাকে তোর বাবার সাথে জোর করে বিয়ে দেন।
মাকে থামিয়ে স্নেহা বললো, তুমি প্রেম করতে!
জাহ্নবী চুপ হয়ে গেলেন। বড় ঘরের মেয়ে ছিলেন জাহ্নবী। ছোটবেলাতেই বোঝা গিয়েছিলো জাহ্নবী একদিন মিস ডায়ানাকেও সৌন্দর্যে হার মানাবেন। ক্লিও-প্রেট্রাও তাঁর রূপের কবলে পড়ে সেরা সুন্দরীর মুকুটটা নিজ হাতেই জাহ্নবীকে তুলে দেবেন। ধারণাটা সত্যের চেয়েও আরো সত্যে পরিণত হয়। অভাবের তাপ লাগেনি শরীরে, সংকটের মুখে পড়েনি এক মুহূর্তের জন্য, এমনি পরিবেশে বেড়ে উঠেন তিনি।
জোড়া ভ্রু'র মাঝে তারা ফুলের খসে পড়া পাপড়ির মত সরু টিপ থাকতো। চোয়ালের ধার জুড়ে ক্ষুদ্রকায় সোনালী পশম বিকেলের হালকা আলোয় চিকমিক করতো রেশমের মত। স্বর্ণের এক ফালি চেন কচি বুকের উপর বাঁক খেতো। দুলতো দামী দুল কানের পাতায়। সৈকতের বালির মত নাকে নোলক ঝিকমিক করতো যা আজ তিনি ইচ্ছাপূর্বক এবং বাধ্যতামূলক ভাবে দেহ থেকে সরিয়ে ফেলেছেন। বিবাহের পূর্বে জাহ্নবীর বাড়ির আশেপাশে অনেক যুবকের জটলা জমতো। সকলে তাঁকে এক নজর দেখবেন বলে এপাশ দিয়ে ওপাশ দিয়ে ঘুরতেন। কেউ একটু কথা বলার জন্য ফিটফাট হয়ে আসতেন। চোখে চোখ পড়লে নিঃশেষ হয়ে যেতেন কেউ কেউ। রূপের আগুন এমনি; অতিশয় সুন্দর হাসির ফোঁয়ারা ছিটিয়ে সবাইকে পিছনে তৃষ্ণার মাত্রা বাড়িয়ে চলে যেতেন অন্দর মহলে। আড়ালে গেলে আস্ফালন যেত দ্বিগুণ বেড়ে। দীঘির মাঝে এ এমনি একটি পদ্ম ছুঁতে পাওয়া ছিলো তো অকল্পনীয়। এক পলক দেখতে পাওয়া সৌভাগ্যের ছিলো। বড় খেয়ালি ছিলেন জাহ্নবী। খেলার ছলে একটু দেখা দিয়ে যেতেন। কেউ যদি সেটুকু দেখতে পেতেন, তবে তিনি বলতেন, দূরেই থাকো, কাছে এলে আবার হারিয়ে যাবে। আশায় থাকা ভালো, আশা ফুরায় না।
এমন একটি অনিন্দ্য সুন্দর শোভনীয় কিংবা কমনীয় মেয়েকে বৌ হিসেবে পাওয়া যে কারোরই স্বাধ জাগতে পারে, কিন্তু তাঁর যোগ্য স্বামী তিনি কী হতে পারবেন তা ভাবাও সচেতন বিবেকের কাজ। তাই বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণের পূর্বে কেউ এত ভাবতেন যে, কেনো জীবনকে আরো সুন্দর করে সাজাননি, জীবনটা সজ্জিত হলে ভবিষ্যৎ রজ্জিত হলে এমন মেয়েকে ঘরে তোলা মামুলি ছিলো। এত ভাবতে গিয়ে কেউ আর এগুতে পারতেন না। কেউ কেউ বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু জাহ্নবীর বাবা গ্রাহ্য করেননি। তাতে কী দুই নয়ন মেলে আঁখির তুষ্টি পূরণ করে তো তাঁকে স্বচক্ষে সম্মুখ হতে একটু হলেও দেখা গিয়েছিলো। এই যেন ঢের প্রাপ্তি।
নতুন নতুন প্রস্তাব আসা শুরু করলে প্রস্তাব গ্রহণের পূর্বেই ঘোটককে বাড়িতে ঢুকতে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। জাহ্নবীর বাবা ভাবলেন, আমি নিজে ছেলে দেখে তার হাতে মেয়েকে তুলে দেবো।
সবাই যাকে এত কাছে পেতে চান, একান্ত আপন ডোরে বাঁধতে চান, তাঁরও তো চাওয়া থাকতে পারে। জাহ্নবী প্রবীর নামের তাঁর এক সহপাঠীকে ভালোবাসতেন। অন্যান্যরা দেখে হা-হুতাশ করতেন, ঐ মেয়ে প্রবীরের মত একটা দুষ্টু ছেলেকে কিভাবে ভালোবাসতে পারেন? একেই কি বলে সুন্দরীর পছন্দ?
কালোর মধ্যে দেখতে হলেও প্রবীরকে দেখতে মোটেও মন্দ লাগতো না। সৌকুমার্য ছিলো চেহারার মাঝে। চেহারায় সৌন্দর্যের আতিশয্য না থাকলেও এমন চেহারার ছেলেকে মেয়েরা অপছন্দ করতেও পারেন না। মেধাবী। সব বিষয়ে যেন কম বেশী জানেনই।
জাহ্নবীর সাথে প্রবীরের যেদিন থেকে মন বিনিময় হয়ে গেলো সেদিন থেকেই অকারণে জাহ্নবীর নিরাপত্তা বেড়ে গেলো। কেউ কুনজরে তাকাতে সাহস পেতেন না, বাজে মন্তব্য করতেও কেউ সাহস পেতেন না। কারণ প্রবীর রগচটা ছিলেন, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না, অন্যকে শাসন কিংবা শিক্ষা দিতেও হাত কাঁপতো না। এমন পুরুষোচিত প্রবীরকে জাহ্নবী খুব পছন্দ করতেন।
কিন্তু বাবার পছন্দকে অগ্রাহ্য করার সাহস হয়ে উঠেনি জাহ্নবীর। রাকেশের ঘরে বধু হয়ে এসে উঠেন।
স্নেহার আজ মন খুব খারাপ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কান্না করলো। বাবার ছবিটা বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেলো। জাহ্নবী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, মা, ভাত এনেছি। দুটো খেয়ে নে।
স্নেহা উঠলো না। জাহ্নবী বললেন, তোর বাবাকে আমি মারবো কেনো? প্রথম প্রথম তোর বাবার সাথে আমার ঝগড়া হতো। মানুষ সেটুকুই দেখেছেন। তোর বাবাকে যদি আমি না-ই ভালোবাতাম, তবে সকল সমালোচনার জবাব দিয়ে এই বৈধব্য সাজ এতকাল বহন করছি কেনো?
স্নেহা মাকে বললো, তোমার জীবনের ছোট্ট একটা ভুল তোমার জীবনকে অঙ্গার করে দিয়েছে। মা, এমন ভুল যেন আমি না করি।
জাহ্নবী ভাত তুলে তুলে স্নেহাকে খাওয়ায়ে দিলেন। কখন যে চোখে দুই ফোঁটা জল চলে এলো বুঝতেও পারেননি।
অনেক দিন পর, জাহ্নবী ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে যেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। প্রবীরকে দেখে জাহ্নবীর শরীরে শিহরণ গোল্লাছুট খেলে গেলো। চোখে তাঁর অমল হাসি জেগে উঠলো। চোখে চোখে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়ে গেলো। কৈশোরের দিনগুলো নিমেষেই সামনে ভেসে উঠলো। নিজের চোখের দেখাকে কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না। শতকালের সাধনাকে সামনে দেখে প্রবীর কি করবেন বুঝতে পারলেন না! বিভেদ বা বিচ্ছেদ হলেও অবসান তো হয়নি। মনের অলিন্দে পোনা মাছের মত তো জাহ্নবী অনবরত কলবল করতেন। ম্যানেজারকে বলে প্রবীর জাহ্নবীকে নিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলেন। প্রবীর বললেন, এত নিষ্প্রাণ হয়ে গেছো কেনো? ডালহীন লতার মত নেতিয়ে পড়েছো কেনো? ক্লান্তি তো তোমাকে স্পর্শ করতে পারতো না!
জাহ্নবী বললেন, এই পৃথিবীর সবাই আমার রূপের প্রশংসা করেছেন, আমিও রূপের দেমাগ দেখিয়েছি। আমার জ্বর হতে পারে, মানুষ মানতেই পারেন না। আমার মন খারাপ থাকতে পারে, মানুষ বিশ্বাসই করেন না। আমার কষ্ট থাকতে পারে মানুষ, মেনে নিতেই পারেন না। আমি কী রক্তে মাংসে গড়া মানুষ নই?
প্রবীর আশ্চর্য হয়ে বললেন, আমার কথার প্রতিউত্তরে তুমি এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে ঠিক বুঝলাম না!
জাহ্নবী বললেন, যার মুখ থেকে হাসি ফুরাতো না তার জীবনে হাসি রাজত্ব করতে পারেনি। যে খুব ভালো একটা ঘরের স্বপ্ন দেখতো সে ঘর পেলেও স্বপ্নের সাথে বাস করতে পারেনি। এত দুরন্ত ছিলাম, জীবন জুড়ে তার কোনো দুরন্তপনা নেই। জীবনে কখনো নিজের কাজও নিজে করিনি, অথচ গোটা জীবনটার ভার আমার একার কাঁধে চড়ে বসলো! কত সঙ্গপ্রিয় ছিলাম আমি, অথচ কত বছর আমি কতটা একা!
প্রবীর খুব উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কী হয়েছে তোমার, তুমি এমন করে কথা বলছো কেনো?
জাহ্নবী বললেন, প্রবীর, আমার বসন্ত চিরতরে শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার জীবন যৌবন খুন হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুগঙ্গা আমার সব কেড়ে নিয়েছে। সংসারের চৌকাঠে পা না রাখতেই আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। না হয় কথা কাটাকাটি হতো, তাই বলে এভাবে একা করে দিয়ে চলে যাবে? আমি কী তাকে শুধু কষ্টই দিয়েছি? আমি কী তার কাঁধে মাথা রেখে স্বপ্ন গাঁথিনি? তার চোখে চেয়ে জীবনের নকশিকাঁথা বুনিনি?
প্রবীর কথাগুলো শুনে বজ্রাহত হলেন। বললেন, এতকাল পরে দেখা হলো তোমার এই কথা শুনবো বলে? কেনো আবার দেখা হলো? তুমি সুখের রাজ্যে আছো রানী হয়ে আমি তো এই ছবিই দেখেছি।
জাহ্নবী বললেন, বুঝেছো, আমার মেয়েও আমাকে অপরাধী করে।
প্রবীর জাহ্নবীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন। চোখের মণিজোড়া নীল পাথরের মতো টকটক করছে। সদ্য তৈরি ঘিয়ের মত উজ্জ্বল চেহারা আজো আছে, অথচ তার মাঝ থেকে কত কিছুই হারিয়ে গিয়েছে যা তাঁকে তাও মলিন করতে পারেনি।
প্রবীরের রক্ত কণিকায় উষ্ণতার স্রোত বেড়ে গেলো। জাহ্নবী মায়াবী কণ্ঠে বললেন, প্রবীর, তোমার খবর বলো।
প্রবীর বললেন, তোমার বিবাহ হওয়ার কথা শুনে আমিও আর অপেক্ষা করিনি। সদ্য স্নানরত পৌরাণিক নায়িকার মত বৌ পেয়েছি। আমায় খুব যত্ন করে মিনাক্ষী। আমার ছেলে আদর, বিবিএ করছে। তোমার মেয়ে কিসে পড়ছে?
জাহ্নবী বললেন, ইংরেজিতে অনার্স করছে।
প্রবীর বললেন, খুব ভালো। চলো, তোমার সাথে বাসায় যাবো। মেয়েটাকে দেখবো। তোমার বাসাটাও চেনা হবে।
জাহ্নবী বললেন, প্রবীর, তুমি সমাজকে যেভাবে জানো আমি জানি না সেভাবে। সমাজের সাথে যুদ্ধ করে আমি বেঁচে আছি। সমাজের বিরুদ্ধস্রোত তুমি জানো না। মানুষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমি বেঁচে আছি। সমাজের কটাক্ষ উচ্চারণ প্রতিনিয়ত ভক্ষণ করে আমি পথ চলি। তুমি আমার সাথে আমার বাড়ি যাবে না। তুমি আমার বেঁচে থাকাটুকু বাঁচিয়ে রাখো।
প্রবীর বললেন, মানুষ সভ্য হবার চেয়ে বর্বর হচ্ছে বেশী। আত্মচর্চার চেয়ে মানুষ পরচর্চা পরনিন্দা বেশী করে। নিজ ঘরের খোঁজ রাখে না পরের ঘরের থালা বাটি উল্টায়। মানুষ অদ্ভুত, মানুষের আচরণ আরো অদ্ভুত। এসব যারা করে তারা পঁচা মনের, খুব হিংসুটে আর নীচ প্রকৃতির, অসুখী। যার মুখে যত নোংরা কথা, মনে রাখবে তার মন আরো বেশী নোংরা। তুমি কানে নেবে না। মনে রাখবে না। মনে রেখো, জল যতই নোংরা হোক, হাঁসের পালক ধরে রাখে না। নোংরা জল হাঁসকে মলিন করতে পারে না।
হ্যাঁ-ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে জাহ্নবী বললেন, আজ তো ব্যাংক থেকে টাকা নেয়া হলো না। কাল মেয়েকে সাথে করে আসবো। তখন আমার মেয়েকে দেখো।
আবার শুরু হলো নতুন করে পথ চলা। পরদিন স্নেহাকে সাথে করে ব্যাংক থেকে টাকা উঠালেন জাহ্নবী। স্নেহাকে দেখে প্রবীর আশীর্বাদ করে দিলেন। স্নেহার সুমিষ্ট বাচনভঙ্গি, জ্ঞানের গভীরতা আর শালীনতার ভেতর আভিজাত্যের ছাপ দেখে বিমুগ্ধ হলেন প্রবীর। জাহ্নবী বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। স্নেহা উৎসুকের সাথে বললো, ব্যাংকের ঐ স্যারকে মনে হয় চেনো, মা!
জাহ্নবী বললেন, আমরা একসাথে পড়তাম। আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলো।
স্নেহা চুপ হয়ে গেলো। উচ্ছলতা হঠাৎ কমে গেলো। রাতে প্রবীর ফোন করে বললেন, জাহ্নবী, আমাদের কপালে বিবাহ লেখা ছিলো না, আমাদের দুইজনের পথ দুটো হয়ে গিয়েছিলো। আমরা পারিনি, কিন্তু আমাদের সন্তানরা পারবে। ওদের দুই হাত যদি আমি এক করে দিই, তোমার আপত্তি থাকবে?
জাহ্নবীর চোখে মুখে ঝিলিক জাগলো। কলসের গলার মত খাঁজ কাটা কোমরের দুলুনিতে খোলা চুল শীষ ফোঁটা ধানের মত দোলা খেলো। দীর্ঘদিন যার ঠোঁটে মৃদু হাসিটিও আসেনি তাঁর ঠোঁটে বাঁধ ভাঙা খুশির জোয়ার। অবারিত আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো মনে। বললেন, তুমি আমার মনের কথাটিই বলেছো। তোমার স্পর্শে থাকতে পারিনি, কিন্তু তোমার সাহচর্য আর হারাবো না।
মায়ের হঠাৎ খুশী খুশী ভাব স্নেহাকে ভাবাতে বাধ্য করলো। সুযোগ থাকলে সে কোথাও পালিয়ে বাঁচতো।
পরদিন জাহ্নবী মেয়েকে মিষ্টি করে বোঝাতে সক্ষম হলেন। আদরের সাথে দেখা করতে ক্যাম্পাসে গেলো স্নেহা। স্নেহা মনে মনে প্রচণ্ড রেগে আছে, আদরের থেকে অপ্রত্যাশিত আলাপ পেলেই নিকৃষ্ট আচরণটাই সে করবে। স্নেহার সাথে প্রাথমিক সাক্ষাৎ হলো। আদর বললো, বাবা তো ঠিকই বলেছে, তুমি একটা দারুণ মেয়ে।
স্নেহা প্রশংসায় কর্ণপাত না করে বললো, ক্যাম্পাস, আড্ডা, ঘুম। বাইরে আর কী করেন?
আদর বললো, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে আছি। নির্দিষ্ট সময় অন্তর রক্তদান করি, রক্তদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করি। ছিন্নমূল পথশিশুদের সহয়তায় একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত আছি। আর্ত-মানবতার সেবায় শীতকালে শীতার্তদের মাঝে সংগৃহীত শীতবস্ত্র বিতরণ করি। সাহিত্য সংগঠনে যুক্ত আছি। ডিবেট করি। সাংস্কৃতির সব ধারাতে একটু একটু পদচারণা আছে।
স্নেহা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মনে মনে ভাবলো, সব ছেলেই মেয়েদের সাথে এমন মিষ্টি মিষ্টি আলাপ করে কৃতিত্ব দেখায়। মুখে বললো, রেজাল্ট কেমন করছেন?
আদর হেসে বললো, ভালো রেজাল্ট মানেই ভালো মানুষ তা নয়। যারা যত ভালো রেজাল্ট করে তারা তত অহংকারী আর রিজার্ভ। মানুষ ও সমাজের জন্য কিছু করার প্রয়াস তাদের কম দেখি। মানবতার সেবায় ব্রত মানুষই ভালো মানুষ। অধ্যয়ণ করে ভালো রেজাল্ট করা যায়, ত্যাগাদর্শ না থাকলে মহৎ হওয়া যায় না। আমাদের সমাজে মেধাবীদের অভাব নেই। কিন্তু মেধা প্রয়োগ করে না।
স্নেহা তীর্যক চেয়ে বললো, আর বন্ধু সার্কেল?
আদর বললো, আমি একক কোনো বন্ধুতে বিশ্বাসী নই। আমার অনেক বন্ধু। খুব স্ফূর্তি করি। ছুটি পেলেই ঘুরতে চলে যাই দল গুছিয়ে। মা, মাটি, মানুষ নিয়ে নিয়মিত পত্রিকায় কলাম লিখি।
স্নেহা আসল কথাতে ফিরলো, আপনার বাবা নাকি আমার মায়ের খুব ভালো বন্ধু?
আদর হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিমায় বললো, বাবার কাছে আপনার মায়ের কথা শুনেছি। একসাথে পড়তেন। উনারা কত ভালো, বন্ধুদের ভুলতে পারেন না, আর আমরা দুই দিনের মাঝেই বন্ধুদের ভুলে যাই।
বেশী পাত্তা দেয়া ঠিক হবে না বলে হঠাৎ করে স্নেহা বাড়ি চলে এলো। মা বললেন, আদর ছেলেটা কেমন? ভালো তো নিশ্চয়!
আদরের প্রতি মায়ের পজিটিভ কৌতূহল স্নেহার চোখে খুব বাঁধলো। বেশক্ষণ ভেবে স্নেহা বললো, ভালো! অন্য ছেলেদের মত না। তাঁর চিন্তা চেতনা শুদ্ধ। জীবনমুখী ভাবনা মুগ্ধ করার মত।
মেয়ের মুখ থেকে কথাগুলো শুনে জাহ্নবী খুব খুশী হলেন। প্রবীরকে ফোন করে বললেন, ছেলেকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছো?
প্রবীর বললেন, হ্যাঁ। ওরা পরস্পর পরস্পরের সাথে আরো মিশুক। পরস্পর পরস্পরকে আরো চিনুক। নিজেরা নিজেদের যত সম্ভব কাছের করে নিক।
জাহ্নবী বললেন, তোমার স্ত্রী কিছু মনে করবেন না তো?
প্রবীর বললেন, আমার স্ত্রী অনেক ভালো। বড় ভালো মেয়ে। তোমাকে হারানোর বেদনা সে ভুলিয়ে দিয়েছে। বড় মনের একটা মেয়ে ও।
জাহ্নবীর মুখে হাসি জাগলো। মায়ের মুখের হাসি কতকাল স্নেহা দেখেনি। সাম্প্রতিক সময়ের মায়ের মুখের হাসি তার সহ্য হতো না। কিন্তু আজকে কেনো যেন মাকে বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হলো। মায়ের বুকে মুখ লুকাতে ইচ্ছে হলে।
আদর ফোনে স্নেহাকে জানালো, আজ ক্যারিয়ার বিষয়ক একটা ওয়ার্কশপ আছে, তুমি কি যাবে আমার সাথে?
স্নেহা আদরের ফোন পাওয়ার সাথে সাথে যে বিরক্ত হয়েছিলো, এমন প্রস্তাব পেয়ে রাজি হয়ে গেলো। ওরা ওয়ার্কশপে যোগ দিলো। অন্যদিন ফোনে আদর বললো, তুমি তো ইংরেজিতে অনার্স করছো। স্পোকেন-এ দখল নিতে তোমার কোর্স করার দরকার আছে। প্রয়োজনে আমার সাথে স্পিকিং করতে পারো।
আজকের প্রস্তাবটাও স্নেহার ভালো লাগলো। আদরের সাথে দেখা হতেই বললো, আপনি কিন্তু বলেছিলেন একক বন্ধুতে আপনি বিশ্বাসী নন। অথচ নানা কায়দায় আপনি আমার সঙ্গ নিচ্ছেন।
আদর খুব সিরিয়াস হলো কথাটি শুনে। বললো, বাবা তোমার সাথে দেখা করতে পাঠান। তোমার সাথে দেখা না করলে তিনি কষ্ট পান। তোমার সাথে দেখা করতে হলে তোমাকে নানা অজুহাতে ডাকতে হয়। তুমি আমাকে অপরাধী করতে পারো না।
স্নেহা বললো, আমিও আপনার ডাকে আসি কারণ আপনার সাথে দেখা করলে আমার মায়ের মুখে হাসি ফোঁটে। আমার মা জনম দুখী। আপনার বাবা, আমার মা যা চাই, আমি তা কল্পনাও করি না। আমি বাবার মুখটা পর্যন্ত মনে করতে পারি না, বাবার আদর কেমন জানি না। তার জন্য কাউকে আমি দায়ী করতেও পারি না। আপনি আপনার বাবাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেবেন আমার অমতের ব্যাপারটা। আমি চাই-ও না আমার বিষয়ে আপনার ন্যূনতম আগ্রহ থাক।
জাহ্নবী আর প্রবীর উভয়ই জেনে গেলেন মেয়ে ছেলের মতামত। পরের দিন উনারা দেখা করলেন। দুইজনেরই মুখ অন্ধকার। কেউ কথা বলছেন না। প্রথমে প্রবীরই মুখ খুললেন, বললেন, বিবাহের কথা আদর শুনতেই চায় না। বড় হবে, অনেক বড়। মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করবে!
জাহ্নবী বললেন, আমার মেয়ে কখনো রাগে না, কিন্তু গতকাল খুব রাগ দেখিয়েছে। অ্যাম্বিশন, সাকসেস, ক্যারিয়ার, প্রতিষ্ঠা নিয়ে ব্যস্ত। বৃত্তি নিয়ে বিদেশ যাবে। জ্ঞানী হবে।
প্রবীর বললেন, আমরা যেতাম পার্কে, নিরিবিলি কোনো প্রান্তরে, রেস্তোরাঁয়। ওরা যায় পাবলিক লাইব্রেরিতে, সেমিনারে, সিম্পোজিয়ামে, ওয়ার্কশপে, সাইবার ক্যাফেতে। এরা সময় আমাদের মত প্রেমালাপ করে নষ্ট করে না। এদের সময়ের অনেক মূল্য।
জাহ্নবী বললেন, কিন্তু ওরা অনুরাগটা পাবে কোথায়? যন্ত্র যুগে যান্ত্রিক হয়ে প্রেম কী ওরা ভুলে যাচ্ছে। মেয়ে বললো, এখন প্রেমসর্বস্ব জীবন নয়। প্রতিষ্ঠা চায়। প্রতিষ্ঠা দিয়ে করবে কী? অনুরাগহীন সম্পর্ক টুক করে লাগলে যে ভেঙে যায়।
প্রবীর বললেন, জাহ্নবী, আমাদের স্বপ্ন পূর্ণ হয় না। থাকুক ওরা ওদের উদ্দেশ্য নিয়ে। কী লজ্জায় না পড়েছি দুইজন ওদের সামনে গিয়ে! আমরা ভেবেছি, ওরা নিজেদের মাঝে সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে। কে জানতো ওদের কথার মাঝে হালকা চড়ক! চলুক ওরা ওদের মত, ওদের পথে। আমরা তো আর হারাবো না। আমাদের অনুভূতির আদান-প্রদান হবে জাহ্নবী, কিন্তু অতৃপ্তি নিয়ে থাকতে হবে। আর জীবন মানেই অতৃপ্তি।
জাহ্নবী বললেন, এভাবে দুইজন জীবনের অলিগলি পথ পাড়ি দিতে দিতে দুটি নিষ্প্রাণ জীবনের ইঁদুর দৌঁড় দেখতে দেখতে না হয় দীর্ঘশ্বাসই ফেলবো। এর বেশী তো কিছুই নয়।
আঁচলটা মাথার ছাতা করে জাহ্নবী হাটতে লাগলেন। প্রবীরের কাছে একটা ছাতা থাকা সত্ত্বেও জাহ্নবীকে ছাতার তলে নিতে পারলেন না। দোকানে গেলেন ছাতা কেনার জন্য।