ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পরজীবী ।। প্রথম পর্ব ।। অভিষেক ঘোষ
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৯৯১
মধু অত্যন্ত প্রতিভাবান ছেলে, সুন্দরপুর আর তার আশেপাশের কয়েকটা গ্রামের অনেকেই তা মনে করে । সে দিনের বেলায় রাজমিস্ত্রীর হেল্পারের কাজ করে । এই উনিশ বছর বয়সেই ওই কাজে সে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে । কিন্তু রাতের বেলায় সে চোর । তার বাবা ব্রজ নস্কর গ্রামে ভ্যান চালাতো, তার ছিল হাতটান । ছিঁচকে চুরির কাজটা সে অভাবে করতো না, করতো স্বভাবে । কিন্তু মধু ওই কাজে রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পায় । রাতে সে একাই বেরোয়, এসব ব্যাপারে সে কাউকে বিশ্বাস করে না । গত তিন বছর ধরে তার এই গোপন প্রতিভা লুকিয়ে রাখতে সফল হলেও সমস্যাটা হয়েছে সম্প্রতি । মধু বিয়ে করেছে মাস চারেক হল । ওদের জাতের সকলের অল্প বয়সেই বিয়ে হয় । তার মা যখন স্বামীর ঘরে এসেছিলো, তখন তার নাকি মোটে বারো বছর বয়স, মধুর মা বেঁচে নেই, তাকে জন্ম দিতে গিয়েই শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু মধুর বউ আলাদাই গোত্রের মেয়ে । তার কাছে কিছু লুকোনো তো দূর অস্ত, মেয়েটা একেবারে মধুর ভিতর অবধি দেখে ফেলে । এরকম বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা মধু-র কখনো হয়নি । উপরি বিপদ মেয়েটার স্বভাব । মালতী ক্লাস ফোর পাস, তারপর আর বাপ-মা পড়ায় নি । মালতীর এখন সতেরো, গায়ে একেবারে কাপড় থাকে না তার, বড্ড খোলামেলা মেয়ে । সতেরো বছর বয়সেই তার এমন ডাগর শরীর যে, তাকে দেখলেই মধু ভিতরে ভিতরে শক্ত হয়ে যায়, তারপর দ্রুত দুর্বল বোধ করে । সুতরাং মালতীর কাছে কিছু লুকোনো অসম্ভব । মধুর টিনের চালের ঘর খাল-পাড়ে । একটা মোটা চট আর কাপড় দিয়ে ঘেরা চৌকো মতো স্নানঘর কাম্ পায়খানা আছে বটে ঘরের পাশে, কিন্তু ঘেরা জায়গায় মালতীর নাকি কিছু হতে চায় না । তাই সে দিনের বেলাতেও প্রায়ই পিছনের কাপড় তুলে খালের ধারে কাদায় বা, ঘাস জমিতে বসে যায় । এই ঘটনা ওই এলাকায় খুবই স্বাভাবিক । কিন্তু লজ্জায় মধু মরে যায় । তার রাগে পাগল পাগল লাগে । যার জন্য বাথরুম বানালো নিজের হাতে, সেই কিনা খোলা জায়গায় ওইভাবে... ভাবতে পারে না মধু । সবচেয়ে বড়ো কথা এই চার মাসে এমন দুমদাম মালতী তাকে কাছে টেনে নিয়েছে যে, মধুর প্রায়ই বড্ড খালি খালি লেগেছে ভিতরটা । যেন কেউ পাম্প চালিয়ে তার ভিতরের পুকুরের সবটুকু জল টেনে নিয়েছে । সে বেচারা তারপর বোকার মতো, না ঘুমিয়ে বাকি রাত শুয়ে থেকেছে তার জোড়া-চাটাইতে । নাহ্ মধুর ঘরে কোনো খাট বা, তক্তপোষের বালাই নেই । একটা চোরাই হাতল-ভাঙা স্টিলের চেয়ার আর একটা জল রাখার কুঁজো, ঘরে ঢুকলেই এইটুকু দৃশ্যমান হয় । মালতী তার নিজস্ব মাদুরে শোয়, মধুর জোড়া-চাটাইয়ের গা-ঘেঁষে । মালতী তাকে টেনে নিলে, শক্ত মেঝেতে বলপ্রয়োগে বড্ড অসুবিধা হয় । তখন মধু ভাবে যে কীভাবে একটা খাট চুরি করে আনা যায় ! কিন্তু সমস্যা হলো বেশি বাড়াবাড়ি করলেই লোকের চোখ টাটাবে, সেটা তার পক্ষে মঙ্গলের হবে না । তাছাড়া মালতীর খিদে মেটাতে গিয়ে মধুর প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । সে আজকাল একটা ঘোরের মধ্যে থাকে, আর কারো বাড়ি চুরি করতে ঢুকলেও তার এখন কেবলই চোখ যায় কানের দুল, গলার চেন, মনকাড়া নাকছাবি, শৌখিন চিরুনি বা, পুঁতির মালায় । শাড়ি নিয়ে হবেই বা কী ? মালতী তো কাপড় খুলে ফেলতে পারলেই বাঁচে । এরকম মেয়ে গ্রামে আর একটা দেখে নি মধু, লজ্জার বালাই নেই । ভাগ্যিস সে তার বাপের সঙ্গে থাকে না, থাকলে মালতী এক কেলেঙ্কারি বাঁধাতো ।
মধু গত এক সপ্তাহ ধরে একটা ছক কষছে । যতীন রায়দের বাড়ির দোতলায় যে লালুবাবু থাকেন, বয়সের ফারাক বছর পাঁচেকের হলেও সম্পর্কে উনি যতে রায়ের কাকা হন । লালুবাবু বড়ো চাকরি করেন, তাঁর ঘুমও বেজায় গাঢ় । বুড়োর খ্যামতা আছে মানতেই হয়, নাহলে ওই বয়সে আবার বাবা হবে ! বউমা কিছুকাল হলো গিয়েছেন আঁতুড়ে, এখনও রয়েছেন বাপের বাড়িতেই । যতে বাবুদের পাশের বাড়িটি একতলা, কিন্তু ছাদে টালি বসছে বলে কাজের বরাত পেয়ে মধু দিনের আলোয় ওই ছাদ থেকে সব বুঝে নিয়েছে । তার কাজটা নির্ঝঞ্ঝাটে হয়ে যাবে । শুধু মুশকিল হচ্ছে পাড়ার কুকুরগুলোকে নিয়ে । যে দেওয়াল বেয়ে উঠবে, সেটা দিয়ে নামা বেশ শক্ত হবে । আজ জ্যোৎস্না আছে । কিন্তু পুরোনো দেওয়ালের গায়ে বট-অশ্বত্থের শিকড়গুলো বেয়ে উঠে যাওয়ার সময় যেভাবে হাত-পা রাখা যায়, নামার সময় তা হয় না । হড়কে যেতে হয়, হাতে-পায়ে ছুলে যায় । দেওয়ালটাও ঝুরো, চুন-বালি খসে পড়ে । ঠিক নিচে যে সিমেন্ট বাঁধানো রোয়াকটা রয়েছে, সেখানে দিনের বেলা ছেলেপিলেরা ক্রিকেট খেলে প্লাস্টিক বল নিয়ে । রাতে ওটাই পাড়ার কুকুরগুলোর ঘুমানোর জায়গা । তাহলে উপায় ?
মধু ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছিল, এদিকে রাত বারোটা বাজতে যায় । ঘুমন্ত মালতীর লোমশ ডান পা-খানা এসময় তার পেটের উপর এসে পড়ে । মধু কিছুক্ষণ মরার মতো পড়ে থাকে । তারপর যখন মালতীর নাক ডাকার মৃদু ঘরঘর শব্দ শুনতে পায়, আস্তে করে পা-টা তুলে পাশে রেখে দেয় । তার বাঁ-হাতটা বউয়ের নরম বুকের নিচে এতক্ষণ চেপে থাকায়, ঝিম ধরে রয়েছে । কিন্তু আর দেরি করলে হবে না । ঘরের দরজায় বাইরে থেকে শিকল তুলে, কোমরে কষে গামছা বেঁধে, মধু খালপাড় ধরে হাঁটা দেয় । দিনের বেলায় খালের কিনারে অগভীর কাদাজলে, কতো বক আর পানকৌড়ি দেখা যায় ! এখন চাঁদের আলো কাদাজলে লুটোপুটি খাচ্ছে, দূরে সবুজে-সাদায় মাখামাখি হয়ে বাতাসে দুলছে ধানক্ষেত । মধুর ওসব দেখার সময় নেই । সে কিছুতেই তার অমন প্রতিভা নষ্ট হতে দিতে পারে না । তাকে আজ চুরিটা করতেই হবে । এখনও অনেকটা দূর যেতে হবে, তাই পা চালায় মধু । বামুন পাড়া পেরিয়ে তবে যতে রায়ের বাড়ি । বছর চারেক আগে মধুর বাবা ব্রজ, বজ্জাত নিমাই স্যাকরার পাল্লায় পড়ে ওই যতে রায়দের গৃহদেবতার মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা চুরি করেছিলো, দেখতে দেখতে কতগুলো দিন কেটে গেলো !
মধু পাড়া-বেপাড়ার কুকুরগুলোর ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকে, কারণ ওরা একবার দলবদ্ধ হয়ে ডাকতে শুরু করলে সমস্ত কাজ পন্ড করে দেয় । তাকে যে এখন প্রায় আধ ঘণ্টা রাস্তায় হাঁটতে হবে, এই পুরো রাস্তাটাই সে বেছে বেছে ঝোপঝাড়-আঘাটা দিয়ে যাবে । তাতে সময় হয়তো একটু বেশি লাগবে, কিন্তু কুকুরগুলোর ব্যাগড়া থেকে বাঁচা যাবে । এই কুকুরগুলো আবার ভারি সুখী । শীতকালে গেরস্তের দাওয়ায় ব্যাটাদের আরাম করে রোদ পোয়াতে দেখলে, এটা আরো ভালো করে বোঝা যায় । এমনিতে পরিচ্ছন্ন দাওয়া, তকতকে মাটির বা সিমেন্টের রোয়াক, আটচালা বা, নিদেনপক্ষে গৃহস্থের বেড়ার কোণ দেখে তারা ঘুমোতে শোয় । মোতার সময় বেছে বেছে তুলসী মঞ্চগুলোই খুঁজে নেয় ! সুতরাং তুমি যদি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকো এ রাতের বেলা, তবে তাদের নজরে পড়বেই পড়বে । আর একটা ঘেউ ঘেউ করলো তো গোটা গ্রামে একেবারে সেটা ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়বে । তখন প্রত্যেক গৃহস্থ সতর্ক হয়ে যাবে ।
মধু যে জায়গাটা দিয়ে খালপাড় থেকে উপরের রাস্তায় ওঠে, সেইখানে এখন রাশিকৃত লোহার রড, ইট, বালি, সিমেন্ট রাখা । শোনা যাচ্ছে তাদের গ্রামে নাকি রেললাইনের কাজ শুরু হবে । হলফ করে বলা যায়, একবার রেললাইন হয়ে গেলে সুন্দরপুর আর এরকম সুন্দর, ফাঁকা ফাঁকা থাকবে না । রাজ্যের সুযোগ-সন্ধানী মানুষ এসে জুটবে । তখন মধুকে নতুন কোনো কাজ খুঁজে নিতেও হতে পারে... ভাবে মধু । সে বাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে । অবশ্য সে অনেক চোরাগলি জানে, শর্টকাট চেনে বলে সময় কম লেগেছে । এখন একেবারে নিস্তব্ধ চারিদিক । হাতে গোনা পাঁচটা পাকা দোকান - অনন্তর চায়ের দোকানে তেরপলটা হাওয়ায় মাঝে মাঝে উড়ছে, রায়মোহনের মিষ্টির দোকানের রকে একটা লোক মাদুর পেতে অঘোরে ঘুমোচ্ছে, আর একটু এগোলেই দুটো শাড়ির দোকান পাশাপাশি; এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো দোকানটা নিয়ে একটা গোলমাল শুরু হয়েছে, এককালের জমিদার বাড়ির বর্তমান কর্তা কৃষ্ণকান্তবাবুর জমি ওইটা, পুরো টাকা অনাদায়ে দোকান-সহ জমি তিনি ফিরৎ চাইছেন । আর একটা বড়ো মুদির দোকান, লোকে বলে দাদুর দোকান । দাদু মানে গুনোদাদু, লোকটা বড়ো ভালো । ওদিকে আরো দুটো দোকান আছে - মাটির চালার । একটা মুদির, আরেকটা দশকর্মার । এছাড়া প্রতি সপ্তাহে শনি-মঙ্গলবার করে হাট বসে । এর বেশি চাহিদা নেই গ্রামের লোকের । গোয়ালে গরু-মোষ-ছাগল-ভেড়া না থাকলেও হাঁস-মুরগি প্রায় সকলেরই আছে । সেই সঙ্গে ঘরের লাগোয়া একটু সবজি বাগান আর ভাগের পুকুরের মাছ । মধুর অবশ্য এসব কিছুই নেই । তবে তার ঘরে জাল আছে একখানা । খালে জাল ফেলতে শিখেছিল সে বাপের কাছে । খুব ভালো না পারলেও চলে যায়, বিশেষত বর্ষায় – খালে তখন জল থাকে ।
নানান কথা ভাবতে ভাবতেই মধু যতে রায়ের বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে । চারিদিকে শুনশান, কোথাও সামান্য আলোটুকুও থাকেনা অন্যদিন । কিন্তু আজ জ্যোৎস্না রাত । একটা বাইকের শব্দ হলো না ? সেইসঙ্গে অস্পষ্ট একটা চিৎকার ? মধু ঠিক বুঝতে পারে না ! নাহ্ এসব ভাবতে বসলে তার চলবে না ! আশপাশের কয়েকটা গ্রামসহ সুন্দরপুরে মাত্র একজনেরই একটা বাইক আছে, সেটা রাধাকান্ত ঘোষের । যুবক অত্যন্ত বেপরোয়া, দুর্বিনীত গোছের । মধুর মত লোকজন তাকে সমঝে চলে । তাদের জমিদারী যে চলে যেতে বসেছে, রাধাকান্তর মতো ছেলেপিলেরা তা মানতে চায় না । হিরো ভাবে নিজেকে । আরামে, বিলাসে বড় হয়েছে । যা চেয়েছে, সবই পেয়েছে । এখন আর চাইলেই পাচ্ছে না । তাই গোটা জগতের উপর তার ভয়ংকর রাগ । মধুর মতো ছোটোলোকেরা তার সাথে কথা বলতে গেলে, গায়ে হাত উঠে যেতে পারে । সবসময় মেজাজ গরম । যাকে যখন পারে অপমান করে বসে । বড়ো ছোটো তো মানেই না, ঝি-বউ-ও মানে না । অবশ্য কৃষ্ণবাবুও তাই ছিলো । খেলার মাঠে ছোটো থেকেই সঙ্গী সাথীদের পিটিয়ে বড়ো হয়েছে রাধাকান্ত । ওই বাইক নিয়ে কত যে হাঁস-মুরগি চাপা দিয়েছে মেঠো পথে, তার নেই ঠিক ! মধু তাই বাইকের শব্দটাকে আর পাত্তা দেয় না ।
ঝুল বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে সোজা উপরের দিকে তাকিয়ে ভালো করে সে আগে দেখে নেয়, কোনো আলো টালো জ্বলছে কিনা । না জ্বলছে না । তার মানে সবাই ঘুমাচ্ছে । লোডশেডিং না তো ? কারণ চাঁদের আলো ছাড়া কোনো আলোই নেই । এইরে ! লালুবাবু যদি পাখার বাতাসের অভাবে জেগে থাকেন ? মোটামুটি সাড়ে দশটার মধ্যে এরা রাতের খাবার খেয়ে নেয়, সে খোঁজ মধু রাখে । ঘুমিয়ে পড়ারই কথা । বাড়ির দেয়ালের গায়ে মোটা হয়ে নেমে আসা শিকড়ের উপর সন্তর্পনে মধু পা রাখে । খাঁজগুলো খুঁজে নেয় দৃঢ় হাতে, তারপর চটপট উপরে উঠতে থাকে । ঠিক তিন-পা উঠেছে, দেওয়ালের খাঁজে কী একটা দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে । তারপর সরু ছোটো টর্চটা মেরে দেখে, একটা ছোটো প্যাঁচা দেওয়ালের খোঁদলে ঢুকে বসে আছে ! এদিকে ভয়ে ‘রাম-রাম’ বলে উঠেছিলো মধু । এরপর তিরিশ সেকেন্ডেরও কম সময়ে সে ঝুলবারান্দায় পৌঁছে যায় । এখান থেকে বাঁদিকে গিয়ে, ডান হাতে দোতলার ঘরের দরজা । সেটা শুধু ভেজানো থাকে, কখনোই বন্ধ করা থাকে না । সে দরজার কাছে গিয়ে হাতটা ছোঁয়াতেই দরজাটা খুলে যায় । তার চোখ অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পায় ঘরের কোথায় কী আছে । বাইরের চাঁদের আলো মৃদু হলেও জানালা দিয়ে ভিতরে এসে পড়ছিল । জানালার একটা পাল্লা বন্ধ, আরেকটা পাল্লা খোলা । বন্ধ পাল্লাটার উপরে এমনভাবে গাছের ডালের ছায়া এসে পড়েছে, হঠাৎ দেখলে ভুত-প্রেত ভেবে চমকে যেতে হয় । মধু তখন সেসব খেয়ালও করে না । সে লালুবাবুর মানিব্যাগটা ঝোলায় নেয়, গামছায় বেঁধে নেয় একটা লকেট, দুটো মোটা বেল্ট হুক থেকে খুলে নিয়ে একটার উপর আর একটা নিজের কোমরে পরে নেয় । একটা কাঁসার থালা, দুটো স্টিলের বাটি, দুটো গ্লাস, একটা ফুলদানি আর একটা হাত ঘড়ি চটপট তুলে নিয়ে চলে আসে ফের সেই ঝুল-বারান্দায় । আশ্চর্যের ব্যাপার কুকুরগুলো ডাকছে কোথাও দূরে, নিচে রোয়াকে আজ একটাও কুকুর নেই । ব্যাপারটা কী, মধু বুঝতে পারে না ! সে শিকড়ের খাঁজে পা রাখতে যাবে, একটা কুকুর ছুটে নিচে চলে আসে কেঁউ কেঁউ করতে করতে, যেন কেউ তাকে কষিয়ে লাথি মেরেছে । ঠিক এই সময় কারেন্ট চলে আসে, ল্যাম্প পোস্টে আলো জ্বলে ওঠে ।
মধু একটা পাতলা ফতুয়া আর লুঙ্গি পরে আছে । লুঙ্গিখানা হাঁটু অব্দি গুটোনো এখন । বামুন পাড়ার শিবুবাবুর বাড়ি হেল্পারের কাজ করার সময় সে ফতুয়াখানা পেয়েছিল, কেচে কেচে আরো জ্যালজ্যালে হয়ে গেছে, তার ওপর দিয়ে কোমরে গামছাটা পেঁচানো, তার উপরে বেল্ট । কাঁধ থেকে চোরাই মালে বোঝাই ঝোলাটা ঝুলছে । এই অবস্থায় একটু অসাবধান হলেই মধুর বারোটা বেজে যাবে । সে নিচে নামতে ভরসা পায় না । কিন্তু তাহলে উপায় ? খুব ছোটোবেলার একটা স্মৃতি মনে পড়ে যায় মধুর । বছর দশেক আগে একবার এই নিচের রোয়াকে সে ডাং-গুলি খেলার সময় মারামারি করেছিলো খেলার সঙ্গীদের সাথে । তখন সে গুলিগুলো কোঁচড়ে বেঁধে নিয়ে লাফিয়ে ওই গাছের শিকড়গুলো ধরে ঝুল-বারান্দার ওই পারে চলে গিয়েছিল । ওদিকে একটা খুব সরু গলি আছে, ওখান দিয়ে নালার জল যায়, মেথর ঢোকার গলি, ময়লা জায়গাটা । কিন্তু তাতে অসুবিধা নেই, সমস্যাটা হল ওখানে সে নামতে পারবে তো ? লাফালে অনেকটা নিচে পড়বে সে । ছেলেবেলায় কোনোক্রমে পেরেছিলো, মার খাওয়ার ভয়েই । এবারও ধরা পড়লে সেই সম্ভাবনাই কপালে নাচছে, নিশ্চিত হয়ে মধু একটা লম্বা শ্বাস টেনে ফের উপরে উঠতে থাকে । ঝুল বারান্দায় পা রাখতেই গাছের আড়ালের জন্য চাঁদের আলো কিছুটা যেন আটকে যায় । মধু হাতের ভরে ওপারে যায় । কিন্তু এবারে সোজা নিচের দিকে তাকিয়ে সে হতবাক হয়ে যায় । ওখানে ওগুলো কী ? মানে ওরা কারা ? দু-দুটো মানুষ ! জ্যান্ত না মরা ! ওখানে কী করে এল ?
মধু এবার সত্যিই ভয় পেয়ে যায় । সে এখন কাকে ডাকবে আর কীই বা করবে ? মেয়েটা প্রায় উলঙ্গ, উপরের জামা ছেঁড়া, নিচে কিছুই নেই বলতে গেলে ! সেই সঙ্গে রক্ত আর আঘাতের দাগ ! তার মানে... মধু আরো ভয় পেয়ে যায় । কাছেই এক যুবকের দেহ জল-কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে । প্যান্টটা হাঁটু অব্দি গোটানো । চেনা চেনা লাগছে না ? খুব ছোটো আর সরু যে টর্চটা আছে মধুর ফতুয়ার বুক পকেটে, একান্ত দরকার না হলে সে ওটা ব্যবহার করে না । এখন ওটার আলোটা লোকটার মুখে ফেলতেই সে চমকে ওঠে । এ কি ! এ যে রাধাবাবু ! কৃষ্ণকান্ত মিত্তিরের বড়ো ছেলে । মধুর হাত-পা কাঁপতে থাকে । সে রাধাবাবুর বাঁ হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে টিপে দেখে । খুব ধীরে নাড়ি চলছে । মেয়েটা নিশ্চিত মরে গেছে । রাধাবাবুর মুখে, কানের পিছনে, মাথার পিছনে ঘাড়ের কাছে ক্ষতচিহ্ন, ধস্তাধস্তি ভালোই হয়েছে বোঝা যাচ্ছে জামা-প্যান্টের হাল দেখে । ভেবলে গিয়ে মধু শুধু চেয়ে থাকে । তারপর তার হঠাৎ কেমন লোভ হয় । সে মেয়েটার রক্তাক্ত শরীরের দিকে এগিয়ে যায় । এই নির্জনে সে যদি একটু সুযোগটা কাজে লাগায়, খুব কি অপরাধ হবে ? মালতী জানতে পারলে ? এক মুহূর্ত দ্বিধা করে মধু । তারপর তার প্রবৃত্তি জয়ী হয় । সে পায়ে পায়ে অন্ধকার শরীরটার দিকে এগিয়ে যায় । মাথার চুল মুখে পড়ে মুখটা ঢেকে দিয়েছে । অস্পষ্ট একটা রেখার হদিশ পেয়ে মধু মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয়, এরকম পুরুষ্টু, নিটোল মেয়েছেলে সে এরকম ন্যাংটো অবস্থায় কখনও দেখে নি । মালতী এর ধারে-কাছেও যায় না । মালতী তো এর কাছে বাচ্চা মেয়ে । মধু সবে চুল সরিয়ে মেয়েটার বাঁ বুকে একটা হাত রেখেছে, অমনি একটা জোরালো আলো এসে গলির উলটো মুখ থেকে তেরচা ভাবে মেয়েটার মুখ আর মধুর পেটের কাছটা আলোকিত করে দেয় । মধু কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাইকের স্টার্ট নেওয়ার প্রচন্ড আওয়াজে রাতের নৈঃশব্দ্য খানখান হয়ে যায় । মধু তার হাতটা টেনে সরিয়ে নেওয়ার আগেই, প্রায় মড়ার মতো পড়ে থাকা মেয়েটা কান ফাটানো আর্তনাদ করে ওঠে । মধু ভারসাম্য হারিয়ে পিছনে পড়ে যায়, কোমরের কাছে কিছু একটা লাগে । তারপর দেখে তার ঝোলাটা পিঠের নিচে পড়েছে, কিছু একটা গিঁথে গেছে চকিতে । মধু উঠে দৌড়াতে থাকে, গলির মুখ দিয়ে বামুন পাড়ার দিকে বেরোতে যাবে, সজোরে ধাক্কা খায় একটা ভুঁড়িওলা দেহের সঙ্গে । পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নিয়ে মধু ভুঁড়ির মালিকের দিকে তাকায় আর চিনতে পারে । এ আর কেউ নয়, নন্দদা, লোকে বলে আর্টিস্ট । মধু মাঝে মাঝে বলে, 'আটিস দাদা' ! লোকটা বেহেড মদ্যপ বটে, কিন্তু সত্যিকারের আঁকিয়ে । এখন মাল টেনে এত রাতে কোথায় যাচ্ছিল কে জানে !
"এই স-সালা ! কো-কোথায় যাচ্ছিস বে সোগো ? থাম্... থাম্ বলচি.. এই তুই মধু না ? ও হরি, মধুই তো ?"- বলেই একটা চকাস করে চুমু খায় নন্দদা, মধুর গালে ।
"নন্দদা যে ! তা কোথায় যাওয়া হচ্ছিল ?"
"ছিঁড়তে ।" - একগাল হেসে বলে নন্দ ।
"বলছি… এখানে তো এক অলুক্ষুণে কাণ্ড হয়ে গেছে ।"
"কেন রে ? কী হয়ে..ছে ?" - বড়ো বড়ো চোখ করে জানতে চায় নন্দ । তার পরেই গলির ভিতরে তার সোজা চোখ পড়ে, কিছু একটা দেখে টলতে টলতে এগোয় আর বলতে থাকে, "মার্ডার, মার্ডার হয়ে গে..ছে ! আমি আঁকবো... মার্ডারের ছবি আঁকবো !"
---------------- চলবে------
লেখক- অভিষেক ঘোষ
142/A Swinhoe Lane,
kasba, kolkata- 42