দ্বিতীয় পর্ব......
তৃতীয় দিন
সোখা থেকে জংরি = ১০ কিমি
ফেডং উচ্চতা = ১২০৮৩ ফুট
জংরি ক্যাম্পসাইড উচ্চতা = ১৩০২৪ ফুট
জংরি টপ উচ্চতা = ১৩১২৩ ফুট
১৮.১০.২১ তারিখ, আজ আমাদের গন্তব্য সোখা থেকে ফেডং হয়ে জংরি। প্রথম থেকেই শুনে আসছি আসল যুদ্ধ আজ। তাই আজ সবাই খুব সিরিয়াস। খুব সকাল সকাল আমরা উঠে পড়লাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে একেবারে স্যাক নিয়ে কিচেন রুমে চলে গেলাম। নিয়মমতো আমাকে আগেই ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিল। বাকিরা ব্রেকফাস্ট করছে। আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। প্যাকেট লাঞ্চ তখনো তৈরি হয়নি তাই আমারটা আজ ফুর্বা নিয়ে আসবে। সামান্য এগিয়ে পথের পাশে সোখা মনেস্ট্রী। পাশেই সোখা লেক। আয়তনে ছোট হলেও সব মিলিয়ে অপূর্ব মনোরম দৃশ্য। সোখা ছেড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলাম। উপর থেকে মনেস্ট্রী, লেক সহ সোখা অপূর্ব দেখতে লাগছে। কিছুদুর যাওয়ার পর পাহাড়ের গাছপালার চরিত্র বদলাতে লাগলো। ঢালু রাস্তা ক্রমে বড় বড় পাথরের চাঁই সহ সিঁড়িরাস্তাতে পরিণত হলো। রাস্তার পাশে এখন রডোডেনড্রন এর জঙ্গল। ফুল না আসলেও রডোডেনড্রন এর জঙ্গল তার মায়াময় সৌন্দর্য আকৃষ্ট করার দাবি রাখে। ঘন্টা খানেক যাওয়ার পর বৃষ্টি শুরু হল। পঞ্চু চাপিয়ে নিলাম। বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ি পথে অতিকষ্টে উঠতে থাকলাম। জঙ্গলের মধ্যে নাম না জানা পাখির অবিরাম ডাক, ঝিঁঝিঁপোকার চিৎকার আর মেঘাচ্ছন্ন রাস্তা একা আমাকে ভুতুড়ে পরিবেশের উপলব্ধি করালো। যাই হোক এভাবে দু'ঘণ্টা চলার পর কাঠের পাটাতন ফেলা জল কাদা মিশ্রিত রাস্তা শুরু হলো। রডোডেনড্রন এর জঙ্গল আমার সঙ্গী। আরো দেড় ঘন্টা যাওয়ার পর আমার সঙ্গীরা একে একে আমাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে থাকলো। এরপর শুরু হলো বড় বড় পাথরের চাঁই দিয়ে প্রকৃতির নিজের হাতে তৈরি রাস্তা।
নিজের শ্বাস প্রশ্বাসে যেন মনে হচ্ছে হাজার জন আমার সঙ্গে রয়েছে। আরো দেড় থেকে দুই ঘন্টা পরে কষ্টসাধ্য পথ পেরিয়ে এল ফেডং। একটি ছোট্ট সমতল এলাকা। আমার সঙ্গী পদযাত্রীরা তখন প্যাকেট লাঞ্চ সারছে। আমি তাদের সঙ্গ নিলাম। ফেডং থেকে রাস্তা দুই ভাগে ভাগ হয়েছে। একটি সোজা যাচ্ছে জংরি আর ডান দিকের রাস্তাটি জঙ্গলের পথ ধরে গেছে ককচুরং। যেখান দিয়ে আমরা ফিরবো। এখানে আধা ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার পাহাড়ে চড়ার পালা। সামনে পাহাড়টি খাড়াই থাকলেও রাস্তা বেশ ভালো মনে হলো কিন্তু এক ঘন্টা যাওয়ার পর আমাদের ভুল ভাঙলো। দেখলাম পাহাড়ে ওঠার রাস্তা প্রায় নেই, পুরো রাস্তাটায় ধস নেমেছে। সেই ধসের উপর দিয়ে প্রায় ৭০ ডিগ্রি ঢালে উঠতে হচ্ছে পাহাড় বেয়ে। সবার গতি খুবই শ্লথ কারণ এখানে পা পিছলে বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই জীবন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এভাবে দেড় থেকে দুই ঘন্টা হাঁটার পর একটি আপাত সমতল জায়গা এলো। নাম দেওড়ালী দাড়া। ওখানে বসে আমরা যেন জীবন ফিরে পেলাম। চারিদিকে এখন মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে কিছু আগেই। রডোডেনড্রন এর জঙ্গল যে এত সুন্দর হতে পারে তা দেওড়ালী দাড়া তে না এলে জানতে পারতাম না। চারিদিকে পাহাড়ের সারি তার মাঝ দিয়ে রাস্তা। আশেপাশে প্রচুর চামরী গাই তাদের উদর পূরণে ব্যস্ত। একটি শুকনো প্রায় জলাশয় সব মিলিয়ে গত দু আড়াই ঘন্টার প্রাণান্তকর কষ্টের পরে জায়গাটি স্বর্গলোক মনে হচ্ছে। কিন্তু তা ক্ষনিকের, কারণ প্রত্যেকেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেছে, শুধুই নিজের মনকে প্রশ্ন আর কত দেরি। আর শরীর নিচ্ছে না। এভাবে চলার পর দু-তিনটি ঝরনা পেরিয়ে দূরে দেখা গেল জংরি ক্যাম্পসাইট।
সত্যিই সুন্দর। কষ্ট করলে যে অনেক কিছু লাভ হয় দূর থেকে জংরির দৃশ্য দেখে তাই মনে হল। আরও আধা ঘন্টা যাওয়ার পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জংরি পৌছালাম। গিয়ে শুনলাম প্রচন্ড বৃষ্টিতে টেন্ট খাটানো যাচ্ছে না। তাই আমরা রান্নাঘরের লাগোয়া বড় ডাইনিং রুমে রাত কাটানোর জন্য আশ্রয় নিলাম। যাওয়ার সাথে সাথে বড় এক বাটি নুডুলস সুপ শরীরকে উজ্জীবিত করল। কিছুক্ষণ পরে মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হল। সে বৃষ্টি কল্পনার অতীত। পাহাড়ে এরকম বৃষ্টি আমরা আগে দেখিনি। ক্রমে রাত নামলো সাথে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। প্রচন্ড ঠান্ডা যেন শরীরের প্রত্যেকটি হাড়কে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ডাইনিং রুমে সবাই মিলেজুলে বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। বিছানায় বসেই ডিনার করলাম। তারপর সবাই একটু পার্টি মুডে নাচ-গান করা হলো, চলল জমাটি আড্ডা কারণ আগামীকাল আমাদের রেস্ট ডে। তাই আজ বেশি রাত পর্যন্ত জাগা যেতেই পারে।
চতুর্থ ও পঞ্চম দিন
জংরি থেকে থাংসিং ভ্যালি = ১২ কিমি
ককচুরং উচ্চতা = ১২১৫২ ফুট
থাংসিং ভ্যালি উচ্চতা = ১২৯৪৬ ফুট
১৯.১০.২১ তারিখ, আজ আমাদের রেস্ট ডে তবে প্রোগ্রাম ছিল ভোর চারটের সময় বেরিয়ে পড়ে জংরি টপ এ উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘার সানরাইজ দেখা। এত তাড়াতাড়ি ওঠা এই কারণেই জংরি টপ এখান থেকে খুব বেশি উঁচু না হলেও ওখানে এত অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যায় যে আমাদের যেতে অনেক সময় লাগবে কিন্তু বিধিবাম। সেইযে কাল বিকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তার কোন বিরাম নেই। সারারাত অঝোর ধারা, সকালেও একই রকম। ভাগ্যিস আজ আমাদের বেরোনোর প্রোগ্রাম ছিল না। যাই হোক এখানে জংরিতেোও টয়লেট এরিয়া প্রায় একশো মিটার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে শুনতে পেলাম, পাশেই যারা কাল রাতের টেন্ট পিচ করেছিল তাদের টেন্ট জলে পুরো ভেসে গেছে। তারা গভীর রাতে যাহোককরে একটি কিচেন রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে রয়েছে। ওই টিমের বেশিরভাগই গড়িয়া এবং বাঘাযতীন এলাকার।
সারাদিন অলস ভাবে বা আড্ডা দিয়ে রাতে শুতে গেলাম এই ভেবে যে যদি কাল সকালে জংরি টপ থেকে সানরাইজ টা দেখা যায়। পরের দিন ২০.১০.২১ তারিখ, ভোর চারটেয় আমরা রেডি কিন্তু বৃষ্টি কমার কোন নাম নিচ্ছে না। আমরা বসে গল্প করে কাটালাম কয় ঘন্টা। সকাল সাতটার দিকে বৃষ্টি থামলো। তাড়াতাড়ি করে সামনের পাহাড়টায় উঠে গেলাম। এখন চারিদিক পুরোপুরি পরিষ্কার। বেশকিছু ছবি নিলাম। আমাদের দলের কয়েকজন জংরি টপের দিকে রওনা হলো। বেশিক্ষণ লাগবেনা হয়তো আধাঘন্টা। কিন্তু হায় ১০-১৫ মিনিট পরে আবার বৃষ্টি শুরু হয় হওয়ায় তারা প্রায় ভিজতে ভিজতে ডাইনিং রুমে এসে ঢুকলো। ঠিক এই সময় আমাদের কো-অর্ডিনেটর পুরণ জি এসে জানালো পুরো ট্রেক রুটে কেউই গতকাল কোথাও বেরোতে পারিনি। সোখার অবস্থা খুব খারাপ। টেন্ট পিচ করা যাচ্ছে না ফলে আসার এবং ফেরার ট্রেকিং গ্রুপগুলি এই প্রচন্ড বৃষ্টিতে সেখানে শেল্টার নিতে বাধ্য হয়েছে। ঘোড়ার আস্তাবলগুলো পর্যন্ত মানুষের ভিড়ে একাকার। আমাদের সাথে আরও একটি সাতজনের টিম এসেছিল তাদের মধ্যে দুজন অসুস্থ হওয়ায় পূরণ জি তাদের নিয়ে আজ সোখা নেমে যাবে। ওদিকে গড়িয়া বাঘাযতীনের যে দল গতকাল এসেছিল শুনলাম তারা প্রায় অসুস্থ, কারোর প্রচন্ড ব্রীদিং প্রবলেম হচ্ছে, কারো শরীর খুব খারাপ তাই এখান থেকেই তারা ফিরে যাচ্ছে। শুনে খুব খারাপ লাগলো। আটটার দিকে বৃষ্টি থামলো। ঠিক করে নিলাম বৃষ্টি পড়লেও আমরা আজ থাংসিং ভ্যালি নামবো। সেইমতো তাড়াতাড়ি তৈরি হয় রওনা হয়ে পড়লাম। এখন চারিদিকে মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যপট। আমরা জংরিকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম। প্রায় পাঁচশো ফুট চড়াই উঠে একটি শৈলশিরা পেলাম। সেই বরাবর আমরা হাটতে থাকলাম। রাস্তা এখানে অনেক ভালো। উঁচু-নিচু বন্ধুর পথ, রঙিন পাহাড়, চঞ্চল ঝরনা পেরিয়ে হাঁটলাম ২ ঘন্টা। এবার নামার পালা। বড় বড় বোল্ডার দিয়ে তৈরি রাস্তা। এক একটি ধাপ দুই ফুট থেকে তিন ফুট। অতি সাবধানে সেই পথ অতিক্রম করে হালকা বৃষ্টিকে সঙ্গে করে পৌঁছলাম ককচুরং। সেখানে আমাদের চা বিস্কিট সহযোগে শরীরকে গরম নেওয়া হলো। অতঃপর ১৫ মিনিট রেস্ট নিয়ে এগিয়ে চললাম, এগোতেই পড়ল প্রেকচু নদী। অপূর্ব সুন্দর তার ছন্দ, দৃশ্য বয়ে চলা। সেই নদীর পাড় ধরে বন্ধুর পথ অতিক্রম করে ব্রিজ পড়লো। এই ব্রীজের কথা আগেই শুনে আসছি। পোর্টাররা বলছিল গতকাল নাকি নদীর স্রোত, এই ব্রিজের উপর দিকে বয়ে যাচ্ছিল তাই এই ব্রীজ পারাপার করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু আজ মোটামুটি জলস্তর নিচে। চারিদিকে আবহাওয়া একটু পরিষ্কার হয়েছে। দূরের শৈলশিরা প্রায় স্পষ্ট। ব্রিজ পেরিয়ে থাংসিং ভ্যালি উঠে যাওয়ার রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে অপূর্ব সুন্দর বন্ধুর পথ ধরে এগিয়ে চললাম। ঘন্টা দেড়েক যাওয়ার পর প্রেকচু নদীর একটি ধারা উপস্থিত হল। পাহাড়ে এখানে গতকাল পুরোপুরি ধ্বস নেমেছে। সেই রাস্তা ধরে খুব সাবধানে এগিয়ে চললাম। ভয়ানক রাস্তা একটু অসাবধান হলেই আছড়ে পড়তে হবে নদী খাতে।
অনেক জায়গায় পাথর খুবই আলগা। সাবধানে ভালোলাগাকে সঙ্গে করে কাঞ্চনজঙ্ঘার টানে আরো ঘন্টা আড়াই যাওয়ার পর দূরে দেখা গেল থাংসিং ভ্যালি। শরীর আর দিচ্ছে না, তবু মন বলছে আরো দেখি, আরো সৌন্দর্যের দিকে ছুটে যাই। থাংসিং ভ্যালি পৌঁছে দেখলাম সেখানে অবস্থা শোচনীয়। প্রচন্ড বৃষ্টিতে চারিদিকে কর্দমাক্ত। আমরা সেখানে গিয়ে একটি হাটে দুটি ঘর ফাঁকা পেয়ে ঢুকে পড়লাম। গরম গরম স্যুপ খেয়ে শরীর যেই চাঙ্গা হল সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আবহাওয়া যখন পরিষ্কার হয়েছে তখন কাল নয়, আজই রাতে রওনা দেওয়া হবে গোচালার উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা সাতটায় ডিনার করে শুয়ে ঘুম কিছুতেই আসছে চাইছিল না। বাইরে এসে দেখলাম আকাশ পুরো পরিষ্কার।
তারা ঝলমল আকাশে একপাশে পান্ডিম ঝকঝক করছে তার পাশে আরেকটি পিক রয়েছে তার নাম তেনজিংখাং। কিছুক্ষণ সেই নৈসর্গিক দৃশ্য মন ভরে দেখে, একেবারে রাতে বেরোনোর জন্য গরম পোশাক পড়ে তৈরি হয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
-----------
চলবে......