"আজ একটা ভূতের গল্প শোনাও", অনেক দিন পরে বাদলদাকে পেয়ে সোৎসাহে বলে উঠলো পলটু। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে সহমত পোষন করলাম, "হ্যা হ্যা, তাই হোক"।
বাদলদা আমাদের মধ্যমণি। আষাঢ়ে গল্পের বিরাট খনি। ভবঘুরে বাদলদার এক পিসিমা ছাড়া আর কেউ আপনজন নেই। কোথা থেকে, কবে কাটা ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে গোঁত্তা মেরে আমাদের দলে ভিড়লো, সে গল্প অন্য একদিন বলবো।
মালাই দেওয়া চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে বাদলদা বললো, "ভূতের গল্প ? গল্প কেন, একটা সত্য ঘটনাই শোনাই তোদের। এই ঘটনা যখন আমার সাথে ঘটে, তোরা তখন খুবই ছোট। আর তখন তোদের সাথে পরিচয়ও হয়নি। সেটাই শোনাই তাহলে...?"
আমরা, মানে আমি-তুহিন, সুখেন আর পলটু সমস্বরে বললাম, "তাই হোক। তাই হোক।"
আমাদের মধ্যে ফচকে পলটুই সবার আগে বললো, "তুমি তাড়াতাড়ি গপ্পো শুরু করো। সামনে কালী পুজো। পাড়ার ছেলেরা চাঁদা তুলতে এসে গেলে সব ভুন্ডুল না হয়ে যায়!"
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বাদলদা শুরু করলো তার হাড় হিম করা গল্প। এখনই একটা কথা ব'লে রাখা খুবই জরুরি। আমাদের এই দাদাটি গল্প শুরুর আগে বিশেষ ক'রে কয়েকটি কথা এমন কায়দায় বলবে যে আগে থেকেই গল্প শোনার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
হেমন্তের আলতো শীতল সন্ধ্যায় বাদলদা গল্প শুরু করতে যাবে, ঠিক সেই সময়, হঠাৎ
লোডশেডিং হয়ে গেলো। ইনভার্টারের আলো জ্বলতেই "আলোটা নিভিয়ে দে", আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো। রামের ভাই লক্ষণের মতো আদেশ পালন করলাম।
"কাশী থেকে পিসিমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আসার পথে ফুলিয়ায় পিসির গুরুদেবের বাড়ি হয়ে, শান্তিপুরে নিজের বাড়িতে যখন পা রাখলাম, তখন রাত আট কি সাড়ে আট হবে। হঠাৎই কেন জানিনা ঠিক সেই মুহূর্তে রাখালের কথা মনে পড়লো।"
"রাখাল আমার বাল্যবন্ধু", আমরা কিছু বলার আগেই বললো বাদলদা - "খুব ভালো দাবা খেলতো জানিস? আর তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম আমি -"
"দাবা !", "তুমি দাবা খেলতেও পারো ?"গল্পের মাঝে আচমকা প্রশ্ন করে বসলো পলটু।
বাদলদার মুখের এক্সপ্রেসনটা দেখা গেলো না।
ঘরের আলো বন্ধ। জানালা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলোর আভা আসলেও জানালার দিকে পিঠ ক'রে বসায় দাদার মুখের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
আরো আশ্চর্যের বিষয় এর আগে গল্পের মাঝে কেউ কথা বললেই বাদলদা সঙ্গে সঙ্গে মোক্ষম বাক্যবাণ ছুড়ে পুনরায় গল্প শুরু করতো। কিন্তু আজ তার ধারেকাছেও গেলো না। একটু থেমে আবার শুরু করলো। "তো হয়েছিলো কি, যা আমি কোনোদিন পারিনি, কাশী যাওয়ার দিন তিনেক আগে রাখালকে সেদিন পরপর দু'বার দাবা খেলায় হারিয়ে দিয়ে ছিলাম। ক্লাবের ছেলেরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলো। এক ছোকরা তো সেদিন ব'লেই বসলো, কি তাহলে তুমিও আজ হেরে গেলে! তাও আবার বাদলের কাছে? লজ্জায় হোক বা রাগেই - ক্লাব ছেড়ে সেদিন চলে গেছিলো রাখাল।"
"তো সেই রাখালের খোঁজে সটান ক্লাবে চলে এলাম। সেদিন যেন পাড়াটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। ক্লাবে এসে দেখি রাখাল ছাড়া আর কেউ নেই। আমাকে দেখে কেন জানিনা ও ব'লে উঠলো এয়েছিস ? আরে তোর জন্যেই তো ব'সে আছি। নে আয় তো একহাত খেলা যাক। আমাকে আবার এক্ষুনি বেরোতে হবে, তার আগে তোর সাথে.... প্রায় একপ্রকার জোর করেই আমাকে খেলতে বসালো।"
"দাবার বোর্ড খোলাই ছিলো। এমনকি ঘুঁটি গুলোও সাজানো। ও কোনোদিন কালো ঘুঁটি নিত না। সেদিন কিন্তু কালো ঘুঁটি নিজের দিকে নিয়ে খেলতে শুরু করলো। প্রথম চালটাও ওই দিলো। পারতপক্ষে যেটা এর আগে কোনোদিন করেনি।"
আমারা সবাই মনযোগ সহকারে শুনছি। এর মধ্যেই সুখেনের চোখ দুটো বড় সাইজের রসগোল্লার আকার নিয়েছে। আড়চোখে তাকিয়ে একবার দেখলাম। পলটু তার কোদাল-ছাপ দাঁত দিয়ে নোখ চিবুচ্ছে।
"আমার যে সেদিন কী হয়েছিল কে জানে! রাখাল যা বলছে আমি তাই করছি। রাখালের পর এবার আমার চাল। দিলাম। বিন্দুমাত্র দেরি না করেই ফিরতি চাল এলো। যেটা এর আগে হয়নি কখনও। প্রথম দিকে এত দ্রুত খেলা তো এর আগে দেখিনি।"
আমার চাল দিতে দেরি হওয়ায় রাখাল ব'লে উঠলো, কি বাছাধন চালো তোমার চাল। এত সময় নিলে হবে ? আমি ভাবছি, কিন্তু ভাবনার ঘোর কাটলো এবার রাখালের হাড়হিম বক্তব্যে, বেশ টেনে টেনে কথাগুলো বলছে সে -
সেদিন তো খুব ভালো খেলছিলিস। আজ কী হলো ? নে দেরি করছিস কেন ? এবার আমার খুব কাছে এসে, ডান কাঁধে হাত রেখে বললো-তোকে বললাম না, আজ আমার একটু তাড়া আছে ?"
"ওর হাতের ছোঁয়া এত হিমশীতল লাগলো কেন ? আর কন্ঠস্বরে কিসের অস্বাভাবিকতা ! তারপর হঠাৎ বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আমার গলা শুকোতে শুরু করলো। গা হাত পা এবার আমার ঠান্ডা হচ্ছে নাকি ! এ কী দেখছি আমি, ঘুঁটি গুলো আপনাআপনি স্থান বদল করছে ! কী হচ্ছে এসব, রাখালের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিতেই দেখি ওর রক্তলোলুপ বিস্ফারিত দু'চোখ ! আর আরো হাড়হিম অট্টহাসির কন্ঠস্বর - কী রে, কী মনে হচ্ছে ? পারবি আজ, আমাকে হারাতে ?"
একটু থেমে বাদলদা বললো, "এরপর কী হয়েছিল তা আর আমার মনে নেই। ততক্ষনে আমি জ্ঞান হারিয়েছি। অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আমি আসছিনা দেখে ভাগ্যিস পিসিমা খুঁজতে বেরিয়ে ছিলো। ক্লাব থেকে সেই রাতে পাড়ার ছেলেরা জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরায়।
"এখানে কী করছিলি ?", "অজ্ঞান হলি কী করে?", "কী হয়েছিল ?" পর পর এত গুলো প্রশ্নের জবাবে শুধু "রাখাল" শব্দটি উচ্চারিত হলো আমার মুখ দিয়ে।
"বুঝেছি", ভুবনকাকা পাশে এসে আমার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বললো, "রাখাল আর আমাদের মধ্যে নেই। আজ সকালে পেপার বিলি করবার সময় পেছন থেকে নিয়ন্ত্রন হারানো একটা ট্রাকের ধাক্কায় মারা যায়। আমরা সকলে এইমাত্র তার দাহকাজ সমাপ্ত ক'রে ফিরলাম।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
--------------------------
সুব্রত দাস
কেশবপল্লী, ৩১/১, গোবিন্দ সেন রোড,
পোঃ রামঘাট, সূচকঃ ৭৪৩১৬৬, গরিফা,
উওর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ
চলভাষ ও হোয়াটসঅ্যাপঃ ৯৩৩০৬২৭৪৩৯,
-----------------------------------------------------------------