রম্যরচনা।।আপনি কিছু জানেন না।। অংশুদেব মণ্ডল
একটা সিনেমা দেখেছিলাম, বৃদ্ধ মাস্টার মশাইকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, "আপনি কিছু জানেন না। " চোখের সামনে যা কিছু ঘটুক না কেন, "আপনি কিছু দেখেন নি "। এই দেখেননি আর জানেন না-র সঙ্গে যদি শোনেন -নি যোগ করা যায়? আপনি অস্তিত্বহীন।
ভারতীয় দর্শনে পড়েছি, এই জগতে পঞ্চ- ইন্দ্রিয় পথে আমরা যা দেখছি সবই মিথ্যা, সবই মায়া। স্বাধীন ভারতের তিয়াত্তর বছরে শুনতে হচ্ছে আপনি অস্তিত্বহীন। জ্ঞান থাকতে জানি না, কান থাকতে শুনিনি, চোখ থাকতে দেখিনি। তাহলে আমি কী?
কেন গুরুদেব বলেছেন, অমৃতস্য পুত্র। মেয়েদের বলেন পুত্রী। শালা ঠিক পটিয়ে পাটিয়ে আগে মেয়েদের কাঁচা মাথা খাবে, সুযোগ বুঝে ধান্দাবাজদের - নেতা,মন্ত্রী,আমলা, ব্যবসায়ী লাইন দিয়ে আছে। তোমার কোনো চিন্তা করতে হবে না, গুরুদেব আছেন না। তো মার হয়ে তিনি সব সামলে নেবেন। তোমার পটি পেয়েছে ? গুরুদেবকে বলো , ঠিক বাস থামিয়ে দেবেন। তোমার সন্তান হচ্ছে না? কোনো চিন্তা নেই গুরুদেব আছেন। কথায় কথায় গুরুদেব। টাকের ওপর হেড মাস্টারের ছড়ি । হাসি হাসি মুখে তিনি বলছেন, অত অস্থির কেন? সব আমার ওপর ছেড়ে দে। তুই নিমিত্ত মাত্র। সব তিনি করাচ্ছেন, তাঁর প্রয়োজনে। কেবল তুই ধর্মের পথে থাক, ধর্মের জন্য সব কিছু কর।
কি করব? বোকা ছেলে। মেয়েদের বলবে, সোনা মেয়ে আমার। যাইহোক কি করতে হবে। দান, খয়রাত! আহা পথে ঘাটে ছড়িয়ে লাভ আছে? কে তাদের দেবে? আল্লাহ, ভগবান, গড্! তার প্রতিনিধি হলেন গুরুদেব। তাঁকে দিবি! তাঁর আশ্রম বা খানকাহের নামে ডোনেট করবি ! প্রভুর নাম প্রচার করবি! মন্দির করবি! গুরু দীক্ষা নিবি , গুরু ভাই, বোনদের সঙ্গে ভজন করবি, ব্যবসা করবি, গুরু ভাইদের সুযোগ করে দিবি, গুরু বোন - ছিঃ ,থাক ওসব কথা।আরে গুরুর আদেশে পার্লামেন্ট কেন হোয়াইট হাউস , ইন্টারনেট পর্যন্ত চলে। আ-হাঃ, ন্যায় অন্যায় বলে কিছু নেই ! সবই স্যারের অধীন, সরি গুরু...দেব । সব তাঁর ওপর ছেড়ে দে। তুই কিছু জানিস না, শুনিস নি, দেখিস নি।
কি খিটকেল দেখুন,আগুনের পাশে ঘি রাখবে, ঘি গললে তোমার দোষ। পেটে ক্ষিদে নিয়ে গুরুদেবের জন্য মন্ডা মিঠাই মাথায় করে বয়ে নিয়ে চলো। এঁটো হাতটা পর্যন্ত ঠেকানো চলবে না। পরীক্ষা, ঈশ্বর আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। কি পরীক্ষা? না ,তুমি জলে নামবে তবু পা ভেজাবে না।
আরে বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে নাকি সব গুরুদেবের পায়ে ঢেলে দাও! তাহলে আমার মূল্য কি রইল? অহং নাশ? লাভ কি? এ জীবনের কোনো মূল্য নেই? সব পরজন্মের জন্য!
কি আর দোষ দেবেন গুরুদেবদের ।যে সংসারের জন্য প্রাণপাত করলেন,দাঁড় করালেন মর্যাদার আসনে। সেখানেই সকলে প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর,আপনি কিছুই জানেন না। কিছু বলতে যান,কেউ না কেউ বলবে - যাও ,ভেতরে যাও।আপনি দেখেছেন! তারা বলবে,না ,তুমি কিছু দেখনি। আরে ছেলে -মেয়েদের যথাসাধ্য দাঁড় করিয়ে দেবার পরও কপালে সম্মানটুকু জোটে না। ওরা কোন দৈব কলে জেনে যায়, আপনি কিছু জানেন না!
অবশ্য এর পিছনে থাকে আর একটা হাত। অজ্ঞাত কারণে সেই সামন্ততান্ত্রিক যুগ থেকে গৃহিণীরা নিজেদের সাংসারিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ছেলে-মেয়েদের তেল মেরে আসছেন। এখন ছোটবেলা থেকেই তাদের ওপর পূর্ণ আধিপত্য। আর আপনি আস্তে আস্তে সুকৌশলে আউট হয়ে যাচ্ছেন। খুব জটিল কাজগুলো ছাড়া আপনাকে সামনে আনা হবে না। আপনি যদিও এটাই চান, চাপ কমাতে। এটা সব গৃহিণীরা বুঝে ফেলেছে। পুরুষদের স্বভাব দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলা। সেটা যে কাঁধ পেতে নেবে, আখেরে গাছের প্রথম ফলটা সে তো ভোগ করবেই।
আগে তবু পুরো খেলাটা খেলে এক্সট্রা টাইম সাইড লাইনে বসতে হত। এখন খেলা শুরুর আগে থেকে সাইড লাইনে। যেহেতু বেশির ভাগ বিয়ে নিজেদের পছন্দ মতো। তাই শাশুড়ি মা ,কোচিং আগেই শুরু করে দেন। তারপর অন্যান্য ট্রেনার তো থাকবেই। সবাই জানে বিয়ের পর ক্যাপ্টেন কে হবে। কিছুদিন আপনি ক্যাপ্টেন হয়ে দেখবেন ফুলশয্যার রাত থেকে আসছে লাস্ট টাইম সাজেসান । শুনে চললে একটু বেশি দিন পদটা থাকবে। তারপর আপনি সাইড লাইনের দিকে সরছেন । একটা সময় আসবে, আপনি কিছু জানলেন না, শুনলেন না, দেখলেন না কিন্তু ঘটে গেছে। হয়তো অফিস থেকে এসে দেখলেন, মেয়ের কপালে রগরগে সিঁদুর। উনি হাসিমুখে বেরিয়ে এসে বললেন, "জামাইয়ের মুখ দেখবে কিছু এনেছো? " কিম্বা একটা টুকটুকে বৌ, বাচ্ছা মেয়ে ঘোমটা টেনে এসে প্রণাম করছে। কিম্বা শুয়ে আছেন, পুলিশ এসে বলল, থানায় চলুন, ওয়ারেন্ট আছে। আপনি একটা ল্যাম্প জ্বালেন কারেন্টের বিল ওঠার ভয়ে, বিল এলো পঁচিশ হাজার টাকা। অফিসে গেলেন, গিয়ে দেখলেন সাসপেন্ড হয়ে গেছেন !ওই যেমন কলেজের খাতায় ইতিহাসে প্রেজেন্ট দিয়ে গেলেন, এডমিটে দেখলেন রাষ্ট্র বিজ্ঞান। ওই অনেকটা টাকা জমিয়ে গেলেন, মেসেজ এলো টাকা তোলা হয়ে গেছে। ওই বিয়ে না করে ছেলের বাপ হওয়া আর কী।
মশাই আপনি সব মেনে নিতে পারেন, কিন্তু মানতে পারবেন না - নিজের হাতে গড়া সংসারে আপনি কেউ নন।
------------------------
৩১ অক্টোবর ২০২১
অংশুদেব মন্ডল
গ্রাম +পোস্ট - চম্পাহাটি, বারুইপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পিন - ৭৪৩৩৩০
মোবাইল -৯৮৩৬২২৪৩৪০