ধারাবাহিক উপন্যাস।। পরজীবী - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ।। অভিষেক ঘোষ
পরজীবী
অভিষেক ঘোষ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
২০০৩
বাজি ধরে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে বলে কায়স্থ পাড়ার অনেক ছেলেরাই বেলা দশটার মধ্যে হাজির হয়েছে গ্রামের দক্ষিণ সীমানায়, ধানক্ষেতে । সুন্দরপুরের মিত্তিরদের বাড়ির আশ্রিতর সংখ্যা নেহাৎ কম নয়, তাদেরই কয়েকটি ছেলেপিলে সেখানে ক্রিকেট খেলছিল তখন । লালুবাবুদের বাড়ির পাশের রোয়াকে গত কয়েকদিন ধরে জোরদার প্র্যাকটিস হয়েছে তাদের, লিডার ছিলো লালুবাবুর ছেলে মন্টু । পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে, সকাল থাকতেই সব ছেলেরা দলবেঁধে ক্রিকেট খেলতে চলে এসেছিলো । এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আউট হলেও আউট দিতে চায় না । তাদের কাছ থেকে ব্যাট কেড়ে নেওয়া রীতিমতো ঝক্কির ব্যাপার । কেউ কেউ আবার সারাদিন ফিল্ডিংয়ে পরিশ্রম করেও বল করার সুযোগ পায় না, নানা অজুহাত শুনতে হয় । দু-একজনকে আবার দুধে-ভাতে করে রেখে দেওয়া হয়, তারা দুই টিমেই প্রয়োজনমতো খেলার সুযোগ পায় । এরকম অসংখ্য নিয়মের ব্যতিক্রম থাকায় ঝগড়াঝাঁটিও কম হয় না । মিত্তিরদের অনেক শরিক । তাঁদের মধ্যে রাগী বৃদ্ধের সংখ্যাও খুব কম নয় । ফলে অনেকেই চেঁচামেচি করে থাকেন, খেলা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন, শাসান, তর্জন-গর্জন করেন, কিন্তু লাভ কিছু হয় না । ভাগ্যিস ওই লালুবাবুদের রোয়াকের আশেপাশের সবক'টা জানালাই কাঠের, কাঁচের হলে এতদিন আস্ত থাকত না । বড়ো গরাদের খড়খড়ি দেওয়া জানালাগুলো দেখলেই মনটা ভারি উদাস হয়ে যায় । মনে পড়ে যায় কতো পুরনো কথা । পাড়ার বৃদ্ধরা এই সমস্ত পুরনো স্মৃতি আগলে বসে থাকেন, কেউ কেউ বসে বসে গল্পগুজবও করেন । কেউবা সারাদিন রেডিও শোনেন, কেউ তর্ক জুড়ে দেন কথায় কথায় । কিন্তু ছেলেদের দলের এসবের কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই । খড়খড়ি দেওয়া জানালার পাল্লায় মাঝেমাঝেই আছড়ে পড়ে ক্যাম্বিস অথবা প্লাস্টিকের বল । ক্যাম্বিসের 'ঢপ' 'ধাস' আর প্লাস্টিকের 'ঠক' 'ঠকাস' চলতেই থাকে সারাদিন । তারপর বেলা পড়ে আসে, মায়েরা রান্না-বান্না সেরে নিজ-নিজ ছেলেদের হাঁকডাক করে, হম্বিতম্বি করে, রোয়াক থেকে নামায় । কিন্তু কখনো কখনো ম্যাচ শেষ না হওয়ার অজুহাতে কেউ কেউ খেলা থামতে দিতে চায়না, তখনই সময় আসে গৃহে আপাতদৃষ্টিতে অকর্মণ্য বাবাদের কর্তৃত্ব ফলানোর । তাঁরা তখন আসরে অবতীর্ণ হন এবং প্রয়োজনে রুদ্ররূপ ধারণ করে থাকেন । এরপর এই ছেলের দল সবাই চলে যায় পুকুরে । কলাগাছের মোটা মোটা ভেলা কেটে ঝাঁপাই জোরে আরো এক ঘন্টা । তাতে স্নানরত বাকিরা অসন্তুষ্ট হন, কিন্তু বারণ করে বিশেষ কিছু লাভ হয় না । কিন্তু আজকের দিনটা ঠিক তেমন নয় । বাড়িতে বড়োরা জানেন না, জানলে নির্ঘাত বাগড়া দিতেন । বাজি ধরে ক্রিকেট খেলা কোন্ অভিভাবকই বা পছন্দ করেন ? তাই অনেকেই নিজের নিজের বাড়িতে ছোটোখাটো মিথ্যে বলে, কায়দা করে চলে এসেছে বাদায় ।
পৌষের শুরু । বাতাসে শীত-শীত ভাব, যদিও রোদে দাঁড়ালো অতটা মনে হয় না । ছেলেরাও সেই সকাল থেকে রোদে । স্কুলের পড়া এরা কেউই প্রায় করে না । তাই পড়াশোনার চাপ ওদের নেই বললেই চলে । এসময় গ্রামের এদিকটায় এসে আউশের জমি ক্রমশ ফাঁকা হয়ে এসেছে । বেশ কিছুটা দূরে দূরে খড়ের গাদা ডাঁই করা, তুলে নেওয়া হতে পারে যে কোনো সময় । এদিকে বৃষ্টিটা দিন পনেরো হলো ধরেছে । এবছর আর হবে না নিশ্চিত । শতকরা আশি ভাগ ধান পাকার সঙ্গে সঙ্গে কাটার ব্যবস্থা করতে হয় । কাটা ধান অযথা স্তূপ করে না রেখে, দ্রুত মাড়াইয়ের ব্যবস্থা করতে হয় । খাবার ধান যথাসম্ভব শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হয় । ধান কেটে নেওয়ার পর হলদেটে ধান গাছের গোড়াগুলো এখন শক্ত হয়ে আছে রোদে শুকিয়ে । ২০ থেকে ২৫ সেমি দূরত্বে এক-একটা সারি, আবার ১৫ থেকে ২০ সেমি দূরত্বে এক-একটা শক্ত হয়ে, খোঁচা হয়ে থাকা ধানের গোড়া । পা দেখে ফেলতে হয় তাই, আলপথ দেখেদেখে ও ধানের গোড়া বুঝে পা ফেলা এই তল্লাটের ছেলেদের অভ্যাস আছে । কিন্তু মাথায় রোদ নিয়ে বাদায় ছোটাছুটি করে বল ধরতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল বামুন ও কায়স্থ পাড়ার ছেলেদের । ওরা এদিকটায় বড়ো একটা খেলে না । এখন নেহাত বাজি ধরা হয়েছে, তাই না খেলে উপায় নেই বলে বাদায় এসেছে । কতখানি সতর্ক থাকলে তবে জমির ফাটলে বা, খাঁজে পা পড়লে মচকে যাবার ভয় নেই, তা ওরা জানে না । এই বিষয়গুলোতে অতিরিক্ত সাবধানতার কারণেই বোধহয় তারা কিছুতেই ভালো ফিল্ডিং করে উঠতে পারছিল না । একের পর এক চার হচ্ছিল আর প্রায় সব বলই গলে যাচ্ছিল ফিল্ডারদের হাত থেকে । মাঝে মাঝে এক-একটা দমকা হাওয়া আসছিলো, তাতে আবার ধুলো উড়তে থাকে । তখন তাদের চোখ-মুখ কুঁচকে থাকা দেখে মন্ডলপাড়া বা সর্দারপাড়ার ছেলেদের হাসি পায় ।
মধু নস্করের ছেলে রাজু, এইসময় উইকেট কিপিং করতে করতেই লক্ষ্য করে দূরে দিগন্তরেখায় একটা রোগা চেহারার ছেলে কাঁপতে কাঁপতে এদিকেই এগিয়ে আসছে । আরেকটু কাছে এলে সে বুঝতে পারে, তারই সমবয়সী ছেলেটা । পরনে শুধু একটা ছেঁড়া প্যান্ট, গায়ে কোনো জামা নেই । ছেলেটার হাতে পায়ে কীসব কাটা-কাটা দাগ কেমন সবজেটে হয়ে আছে । মাথাটা দেখলেই বোঝা যায় অনেকদিন স্নান করেনি । তার চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে । রাজু-কে তার বাবা শিখিয়েছে, মাছ টাটকা না হলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মাছের চোখ ঘোলাটে ও নিষ্প্রাণ হয়ে যায় । এটা মাথায় রাখলেই টাটকা আর পচা মাছের পার্থক্য সাদা চোখেই করা যায় ৷ ছেলেটার চোখ দুটো ঠিক সেইরকম, যেন একটা মরা মানুষ উঠে হাঁটছে । সে ক্রিকেট খেলার জন্য পরিষ্কার করা, পেটানো, সমান গজ পঁচিশেক জমিটার কাছে এসে দাঁড়াতেই সবাই খেলা ফেলে তাকে ঘিরে দাঁড়ায় । মধু আরো শিখিয়েছিল, মাছের গায়ে হাতের দুই আঙুলের চাপ দিয়ে সরিয়ে নিলে যদি দেখা যায়, চাপ দেওয়া জায়গাটা নিজের থেকেই আগের মতো হয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে মাছ টাটকা আছে, কোনো ভেজাল নেই । রাজু কী মনে করে যেন ছেলেটার একটা হাত টেনে নিয়ে গা টিপে দেয় । ছেলেটা একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কিছু বলে না ।
বেলা বাড়তে থাকে । খবর ছড়াতে দেরি হয়না । ক্রিকেট খেলা চলতে থাকে । ছেলেটাকে কোনো দলেই কেউ নিতে চায়না । সে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে থাকে । কেউ দূরে দাঁড়িয়ে দর্শক হতে চাইলে তাকে তো আর বাধা দেওয়া যায় না । তাই অন্য ছেলেরা আর কোনো আপত্তি করেনি । কিন্তু তার দিকে গড়িয়ে যাওয়া বল হাত দিলেই তাকে শুনতে হয়েছে, "ওই হাত দিবি না" নয়তো "এদিকে ছুঁড়ে দে জলদি" । ছেলেটার হাবভাব দেখে মনে হয় যেন ক্রিকেট খেলা দেখার আশাতেই তার এদিকে আসা, সে খেলতে নয়, শুধু দেখতেই চায় ।
সূর্য যখন আকাশে সামান্য হেলেছে, বেলা প্রায় একটা, তখনই দূরে একটা গোলমাল শোনা যায় । ছেলেরা তখন একে একে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে । পরিস্থিতি মাঠেই মৃদু উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলো শেষ মুহূর্তে, কায়স্থ পাড়ার ছেলের দল পুরোপুরি পর্যুদস্ত হওয়ায় । তাদের রাগ হওয়াই স্বাভাবিক, উইকেট, ব্যাট ইত্যাদি ভালো ভালো জিনিসগুলি তারাই বয়ে এনেছিল এতো দূরে । নয়তো গাড়ির পুরনো টায়ার নিয়ে উইকেট বানায় চাষাদের ছেলেপিলেরা । অথচ বাড়িতে বানানো, খুব সাধারণ ব্যাট নিয়ে খেলেও প্লাস্টিক বল পিটিয়ে তারাই ম্যাচ জিতেছে । তাই অসন্তুষ্ট, বিরক্ত ছেলেগুলো একে অপরকে হারের জন্য দোষারোপ করতে করতে আগে-ভাগেই ফিরতি পথ ধরেছিলো । শুধু সেই আগন্তক ছেলেটি সেখানে প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকে । মৎস্যজীবী বাগদিদের দুটি ছেলে চমৎকার স্পিন বোলিং করে সক্কলকে চমকে দিয়েছিল । আগন্তক ছেলেটি-কে তারা কিছু প্রশ্ন করেছিলো, নাম কী, কোথায় বাড়ি, এখানে কী করছে - এসবই । কিন্তু ছেলেটা ড্যাবড্যাব করে শুধু চেয়ে থাকে । তার চোখের উপরে ভ্রু-দুটি আশ্চর্যরকম পাতলা, এরকম সচরাচর দেখা যায় না । তেমনি তার চোখের তারাদুটি, এক-বারেই চোখে পড়ার মতো । কেমন যেন অস্বস্তিকর, মনে হয় সে ঠায় চেয়ে আছে, যেন তার চোখের পাতা পড়ে না । প্রশ্ন করেও উত্তর না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বাগদিদের ছেলেদুটি ফিরবে বলে ঘুরে দাঁড়ায় কিন্তু যেতে পারে না । কারণ তাদের যাত্রাপথে দুটি বাইক ধেয়ে আসে । সঙ্গে অন্তত জনা তিরিশ লোক, হৈহৈ করতে করতে । সকলেরই চোখে প্রশ্ন । বোঝাই যায় গ্রামে এসে পড়া একটা অপরিচিত, রহস্যময় ছেলেই তাদের এখানে এসময়ে আগমনের কারণ । অবশ্য ওই বাইকদুটি না এলে এতলোকের জমায়েত হতো না । দুটি বাইকই এলাকার মানুষের কাছে চেনা – মিত্তিরবাড়ির সূর্যকান্ত ও চন্দ্রকান্তর । সূর্যকান্তর বাইকটা এই তল্লাটে সবচেয়ে পুরোনো, অদ্ভুত ভোঁতা শব্দ হয় ওটায়, খুব পুরোনো মডেল । ওটা আসলে কৃষ্ণকান্ত মিত্রের বড়ো ছেলে রাধাকান্ত চালাতো, কিন্তু একটা বিশ্রী দুর্ঘটনার পর থেকে তাকে আর কেউ দেখে নি । পরের দুই ভাইয়ের কারোরই রাধাকান্তর মতো অতটা মাথা গরম স্বভাব নয় । রাধাকান্তকে যখন শেষ দেখা গিয়েছিলো, সেই স্মৃতি এখন মানুষের মনে আবছা হয়ে এসেছে । ফলে তাকে নিয়ে কোনো প্রশ্নও আর অবশিষ্ট নেই ।
মিত্তির বাড়ির মেজো ছেলে সূর্যকান্তর বয়স বছর তিরিশ । স্বভাবে লোকটা মিচকে শয়তান । নড়বড়ে বাইকটায় বসে ভাই চন্দ্রকান্তর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে, "চিনলি ?"
"মানে ? তুমি চেনো নাকি ?"
"না আবার হ্যাঁ ।"
"বুঝলাম না ! সবসময় হেঁয়ালি করো কেন !"
"চোখদুটো দেখেছিস ?"
"হ্যাঁ কেমন যেন ! মাছের মতো !"
"ঠিক বলেছিস । কিন্তু আর কিছু মাথায় আসছে না ?"
"নাহ্... একটু খুলেই বলো না.."
হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে সূর্যকান্ত বাইক থেকে নেমে ছেলেটার হাতটা ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনে চন্দ্রকান্তর সামনে । তারপর দৃঢ় গলায় বলে, "দ্যাখ চাঁদ, ভালো করে দ্যাখ, কিছু বুঝলি ?"
থতমত খেয়ে চন্দ্রকান্ত ছেলেটার খসখসে থুতনিটা ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ভালো করে । তারপর অবিশ্বাসের চোখে, সন্দেহ আর বিস্ময় মিশিয়ে চাপা গলায় বলে, "তুমি শিওর ?"
"শিওর এবং শিহরিত । মালটা অ্যাদ্দিন ছিলো কোথায়, তাই ভাবছি ।"
"এই তোর মা কোথায় রে ?" - চন্দ্রকান্ত প্রশ্ন করে ।
"ভালোয় ভালোয় উত্তর না দিলে, তোমায় জুতোবো শুয়ার ।" - হুমকি দেয় সূর্যকান্ত ।
ঠিক এসময় ভিড়টা দুপাশে ভাগ হয়ে যায় । প্রায় ছয় ফিটের কৃষ্ণকান্ত মিত্র ভ্যান থেকে নেমে চালকের হাতে টাকা গুঁজে দিচ্ছেন । জনতা জানে, তিনি ঘটনাস্থলে আসবেন । কিন্তু তিনি নিজেই যেন যতই এগোতে থাকেন, ততই নার্ভাস বোধ করতে থাকেন । সূর্যকান্তর তা চোখ এড়ায় না ।
"বাবা শরীরটা কি খারাপ লাগছে ?"
কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণকান্ত বলেন, "সেটা লাগাই স্বাভাবিক নয় কি ?"
তারপর যেন বিরক্ত মুখে ভিড়ের দিকে লক্ষ করে বলেন, "এই তোমরা যে যার কাজে যাও... অনেক বেলা হয়েছে.. এখানে দেখার কিছু নেই ।" তারপর একটু নরম হয়ে সামনের দুয়েকজনকে প্রশ্ন করেন, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিনা, খুচরো কুশল-জিজ্ঞাসা ইত্যাদি । তারপর হঠাৎ সূর্যকান্ত-চন্দ্রকান্তর দিকে ফিরে বলেন, “বাড়ি নিয়ে চলো ওকে । ওর খিদে পেয়েছে, দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে । ওখানেই কথা হবে । বেলা হয়েছে । আমি চললাম ।” – কথাগুলো দ্রুত বলেই তিনি একটু হেঁটে গিয়েই একজন ভ্যানওলাকে খুঁজে নেন ।
----------------------------