Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি ।। গোয়েচা লা ভ্রমণ - শেষ পর্ব ।। অভিজিৎ নস্কর


  

গোয়েচা লা ভ্রমণ - শেষ পর্ব 

অভিজিৎ নস্কর  



ষষ্ঠ দিন.... 

 
থাংসিং থেকে গোচালা ভিউ পয়েন্ট-১ = ৮.৩ কিমি
লামুনে উচ্চতা = ১৩৭৪৩ ফুট
সমিতি লেক উচ্চতা = ১৪৬৬০ ফুট
গোচালা ভিউ পয়েন্ট-১ উচ্চতা = ১৬২০৭ ফুট

আজ ২১.১০.২১, ঠিক রাত বারোটা দশে ফুর্বা আমাদের ডেকে দিয়ে গেল। যদিও ঘুম হয়নি ভালো তবুও উঠে পড়লাম। তৈরি হয়ে সাড়ে বারোটায় বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঝলমল করছে। রাতের অন্ধকারে পান্ডিমসহ অন্যান্য পাহাড়ের চূড়া গুলো যেন এক মোহময়ী নারীর আকর্ষণ। বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন সাদা ঘোমটা টেনে আমাদের বলছে, আয়। আমরা মা কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই ডাকে অন্ধকারের মধ্যে শুধুমাত্র একটি হেডটর্চ সম্বল করে যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যেতে থাকলাম।অন্ধকারে পথে কত ঝরনা পড়ল। আমরা জোৎস্নার আলোয় সেগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম নেশাগ্রস্ত ভাবে। সবার লক্ষ্য একটাই পাঁচটা পনেরোতে সূর্যোদয়। তার আগে পৌঁছতেই হবে আমাদের। পথের আগে-পরে শুধুমাত্র ছোট ছোট টর্চের আলো। আমাদের হাঁটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন কত চেনা পথ। উঁচু-নিচু পথ বেয়ে এগিয়ে চললাম। যারা দাঁড়িয়ে দম নিল তারা আবার ছুটল। মা কাঞ্চনজঙ্ঘার ডাকে এভাবে ৪ কিলোমিটার চলার পর এলো লামুনে ভ্যালি। আমাদের সাথে একজন পোর্টার ছিল সে বলল এটাই লামুনে ক্যাম্প সাইট। পাশে প্রেকচু নদীর গর্জন আর প্রচন্ড ঠান্ডা। প্রত্যেকের গায়ে মাইনাস টেম্পারেচার জ্যাকেট সহ তিন চারটি লেয়ার। মাথায় দুটি টুপি, হাতের ডবল গ্লাভস। হঠাৎ দেখলাম সামনে আলোর বিন্দুগুলো উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে অর্থাৎ সামনে আবার পাহাড় চড়তে হবে। এগিয়ে গেলাম পাগলের মত। 
 

 
দলের সবাই একে একে আমাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার সাথে তিনজন। তাদের বললাম তোমরা এগিয়ে যাও। আমার জন্য তোমারা যেন সূর্যোদয় দেখা থেকে বঞ্চিত না হও। আরো কিছুক্ষণ চললাম। পায়ের নিচে তখন বরফের আস্তরণ। তাড়াতাড়ি চলার ফলে পা স্লিপ খাচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম আমার আগে পিছে কেউ নেই, আমি একা এই বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। শুধু দূরে বহুদূরে ছোট ছোট আলোর বিন্দু। ওগুলো আমারই সহপথযাত্রীদের হেট টর্চের আলো। যতটা সম্ভব বরফের উপর পায়ের ছাপ দেখে এগিয়ে চলতে থাকলাম। এভাবে আরো একঘন্টা যাওয়ার পর হঠাৎ করেই সেই পায়ের ছাপ কোথায় মিলিয়ে গেল। বুঝলাম আমি পথ হারিয়েছি। এখান থেকে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার রাত্রি কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদের আলো বরফের উপর পড়ে আমাকে আলো দিয়ে রেখেছে। তবুও ভয় করতে লাগলো। চিন্তা করলাম কি করা যায়। প্রচন্ড হওয়া আর হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। এত পোষাক পোরেও চড়াই পথ অতিক্রম করছি, তাও এক বিন্দুও ঘামের দেখা নেই । দম নিতে পারছিনা। যেন নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। মুহুর্তে ঠিক করলাম আমাকে কোন একটি উচু জায়গাতে যেতেই হবে। সেইভাবে আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটি উঁচু জায়গা দেখতে পেলাম। সেখান থেকে দেখলাম দূরে অনেক দূরে আমার বন্ধুরা এগিয়ে চলেছে কিন্তু আমি পথ হারিয়েছি। এখান থেকে নামবো কি করে। নিচে অনেক নিচে সমিতি লেক। আমি মাথার টর্চটি হাতে নিয়ে জোরে জোরে ঘোরাতে থাকলাম আর চেঁচাতে লাগলাম - "হেল্প, হেল্প" । কেউ নেই, কেউ আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না। এভাবে বসে আধাঘন্টা পর হঠাৎ দেখলাম একজন কেউ আসছে। অনেক নিচে। ফুর্বা আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলো - "দাদা আপ উধার ক্যায়সে গেয়া"। আমি বললাম - "ভাই পথ হারিয়েছি" । আবার সেখান থেকে নেমে সমিতি লেকে এলাম। প্রচন্ড হাওয়া আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। টেম্পারেচার মাইনাস ১৫ এর ওপরে তো হবেই। ও বলল চলুন সামনে ওই বড় পাথরের পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। সেখানে গেলাম। পথ হারানোর ফলে কিনা জানিনা আমার আত্মবিশ্বাসে তখন ঘাটতি পড়েছে। ও বলল চলুন। আমি বললাম তুমি এগোও, বাকিদের দেখো, আমি একটু রেস্ট নিয়ে এগোচ্ছি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এগোতে থাকলাম সমিতি লেকের পাড় ধরে। তখন নিজেকে অনেকটা সুস্থ করে ধাতস্থ করে ফেলেছি। সমিতি লেকের বেশিরভাগ অংশই জমে বরফ আর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, আমি ভুল করে যে পাহাড়ের দিকে সোজা উঠে যাচ্ছিলাম ওটা পান্ডিম। মনে মনে হাসলাম। দূর থেকে যে স্লিপিং বুদ্ধ অনেকবার দেখেছি আজ আমি সেই স্লিপিং বুদ্ধের পায়ে নিজেকে সঁপে দিলাম কারণ পান্ডিম হল স্লিপিং বুদ্ধার পা। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকেই পান্ডিম শুরু হয়েছে সোজা উঠে গেছে। ঘাড় উঁচু করে দেখলাম। এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে চললাম। এবার সমিতি লেকের শেষ, উঠতে হবে গোচালা ভিউ পয়েন্ট-১, দূরত্ব ১.৩ কিমি। পুরোপুরি খাড়াই, ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি তো হবেই। দম শেষ। হাঁটুর বেশি ঢুকে যাচ্ছে বরফের মধ্যে। বেশ কিছুক্ষণ এগিয়ে গেলাম। তখনো দেখলাম উপরে একদম শেষের দিকে দু-একজন উঠছে। গোচালা আসার আগে একটা জিনিস শুনে এসেছি, এখানে সূর্য উদয় হওয়ার পরে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে নেই কারণ বরফ গলা শুরু করে ফলে নামতে গেলে পিছল খেয়ে পড়তে হয়। হয়তো উঠে যাব প্রতিদিনের মতোই, বাকিদের থেকে একটু পরেই কিন্তু নামার সময় আর পাবো না। হয়তো তাই আর যে এক কিলোমিটার বাকি ছিল ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজে নিজেকে সতর্কীকরণ করলাম। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হয়তো সবারই হয়। তাই ফিরলাম। পথ হারিয়ে যদি সময় নষ্ট না হতো তাহলে হয়তো এই শেষ এক কিলোমিটার চলে যেতাম। নেমে আসতে থাকলাম। ধীরে ধীরে এসে সমিতি লেকের পাড়ে সেই বড় পাথর কাছে এসে দাঁড়ালাম। বাকিদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। এখান থেকে খুব ক্লিয়ার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। মা কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাকে বিরূপ করেনি। ছবি নিতে থাকলাম কিন্তু প্রচণ্ড ঠান্ডায় যেন মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাব। নিজেকে ঠিক রাখার জন্য বারকয়েক উঠবোস করলাম। দেখলাম সেই স্বর্ণালী মুহূর্ত শুরু হয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে সোনালী আলোর খেলা। কেউ যেন সোনালী চাদর বিছিয়ে দিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার বুকে।
 

 
 আর সেই রক্তিম কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি সমিতি লেকের বুকে। যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রেম নিবেদন অথবা আত্মসমর্পণ সমিতির কাছে। আকাশে রক্তিম নিশান আর তার মাঝে ছোট ছোট পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে যেন আমাদেরই মনের ছবি হয়ে। ছবি নিলাম মন ভরে। তখনো সানরাইজ পুরোপুরি শেষ হয়নি, দেখলাম আমাদের অনেকেই নেমে আসছে। আসলে তারাও জানে বরফ গলা শুরু করলে ফেরার পথটা প্রাণহানিকর হয়ে যেতে পারে। কিছুক্ষণ পর তাদের সঙ্গে এবার ফেরার পালা। এখন চারিদিক পরিষ্কার। আরেকবার দেখে নিলাম পান্ডিমকে, যার পায়ের তলার এতক্ষন সময় কাটালাম। এভাবে হয়তো পান্ডিমকে আর কোনদিন দেখতে পাবো না। সমিতি লেকের শক্ত বরফের উপর একটু মজা করা হলো সবাই মিলে। যা নিয়ে ফিরছি তা আমার কাছে সারাজীবনের সম্পদ। আমি চাইলেও এর ভাগ কাউকে দিতে পারবো না। ক্রমে পথের বরফ হালকা হলো। আমরা নেমে এলাম লামুনে ভ্যালিতে। অবিশ্বাস্য অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লামুনে। মন ভরে সেই ভ্যালির সৌন্দর্যকে গায়ে মাখলাম, মনের মনিকোঠায় সাজিয়ে রাখলাম। লামুনে ভ্যালির যেখানে আমাদের টেন্ট পিচ করার কথা ছিল আজ, সেখানে বসে অনেক্ষণ গল্প করা হলো সবাই মিলে। পিছনে প্রেকচু নদীর গর্জন, চারিদিকে বরফগলা পাহাড়ের সারি, স্বর্গ এর কাছে হার মেনে যাবে কিন্তু ফুর্বা বলল ককচুরং এ ঘোড়ার খাবার পাওয়া যাবেনা তাই আমাদের কষ্ট হলেও আগামীকাল সোজা গিয়ে সোখায় নামতে হবে। আমরা তাই আগামীকালের পথ কমানোর জন্য আজ আর এখানে টেন্ট পিচ করলাম না। আজ থেকে যাব থাংসিং ভ্যালিতেই। এবার সবাই ফেরার পথে। গতকাল সকাল থেকে বিকাল চারটে পর্যন্ত হেঁটে আবার রাত বারোটার সময় উঠে হাঁটা চলছে। শরীর যাই বলুক না কেন মন কিন্তু সতেজ। তবে খুব খিদে পেয়েছে। ফিরে চললাম থাংসিং এর পথে। রঙিন উপত্যকা, বরফের ঘোমটা টানা পর্বতশৃঙ্গ, ছোট ছোট ঝরনার কল কল শব্দ, প্রেকচুর গর্জন, যেন এক কনসার্ট চলছে। সেই কনসার্ট শুনতে শুনতে ফিরে আসলাম। জুতো ওয়াটারপ্রুফ হলেও আজ ভিজে গেছে একটি ঝর্ণা পেরোতে গিয়ে। এসে রৌদ্রে দিলাম। সোজা চলে গেলাম বিছানায়। আর শরীর দিচ্ছে না। বন্ধুরা জোর করে ব্রেকফাস্ট খাওয়াতে নিয়ে গেল। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙলো বিকেলে। চারটের সময় আজ লাঞ্চে নুডুলস সুপ। সবার বিছানাতেই দিয়ে গেল। ওরাও জানে আমাদের শরীরের অবস্থা। এরপর খানিক আড্ডা আসর। কাল অনেকটা পথ যেতে হবে তাই আমরা রাত আটটা নাগাদ ডিনার করে স্লিপিং ব্যাগের চেইন টেনে দিলাম।

সপ্তম দিন.... 
 


থাংসিং ভ্যালি থেকে সোখা = ১৪.৫ কিমি
(ককচুরং থেকে ফেডং = ৮ কিমি) 
ভায়া ককচুরং, ভায়া ফেডং

আজ  ২২.১০.২১ তারিখ, আমাদের গন্তব্য থাংসিং থেকে ককচুরং, ফেডং হয়ে সোখা। শুনলাম, আমাদের সাথে আরও যে ৭ জনের একটি টিম ছিল তাদের মধ্যে দুজনতো আগেই অসুস্থ হয়ে জংরি থেকে ফিরে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে আরো দুজন জুতো ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে গতকাল গোচালা যেতে পারেনি। আমাদের ট্রেকিংয়ের আজ সব থেকে বেশি দূরত্ব আমরা অতিক্রম করব। সবাই বেশ খোশ মেজাজে। সকলে থাংসিং কে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চললাম ককচুরং এর উদ্দেশ্যে। কিছুদূর যেতেই পাহাড়ি ধ্বসযুক্ত নদীখাত বরাবর হাটতে থাকলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে দলের সবাই পাহাড়ি রাস্তা ধরে নামার পর এল প্রেকচু নদী। সবাই বেশ খানিকক্ষণ সেখানে কাটালাম। এখান থেকে পান্ডিম দেখা যাচ্ছে। পান্ডিমকে সাথে নিয়ে চলল ফটোসেশন। তারপর আবার প্রেকচু নদীর ধার বরাবর কর্দমাক্ত রাস্তা হেঁটে ককচুরং। অর্থাৎ যে পথে আমরা এসেছিলাম। এখান থেকে আমরা জঙ্গলের রাস্তা ধরবো। হাটা শুরু করলাম জঙ্গলের রাস্তা ধরে ফেডং এর দিকে। গত দুইদিন আগের ঝড়-বৃষ্টিতে রাস্তার মধ্যেই প্রচুর গাছ পড়ে গেছে। আমরা কোথাও সেই বড় বড় গাছের গুড়ি টপকে, কোথাও গাছের গুড়ির তলা দিয়ে এগোতে থাকলাম। ঘন জঙ্গলের পথ। রাস্তা তথৈবচ। বৃষ্টি কাদা এবং পচা পাতা পোড়ে রাস্তা মর্মান্তিক। আমরা ধীরে ধীরে এক জন করে রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। পথে অনেকগুলি ঝরনা পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে একটি জায়গা নজরে এলো পাহাড়টি যেনো পুরো হেলে আছে। তার তলা দিয়ে হাঁটার রাস্তা। দেখলে ভয় লাগার মত। সেই ঝুলে থাকা বিরাট পাথরের চাঁই এর তলায় বসার জায়গা। এগিয়ে দেখলাম আমাদের সহপথযাত্রী প্রদীপ কিছু বলছে। শুনলাম এই জায়গাটিতে "কারকি" নামের একজন পোর্টার তার জিনিসপত্র রেখে মারা যায়। সেই মানুষটির নাম অনুসারে এই জায়গাটির নাম হয় "কারকিওরাল"। এই ওরাল হল নেপালি শব্দে গুহা বা গুম্ফা। এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আমরা তিনজন এখন চলেছি। দলের বাকিরা অনেকটা আগে। অনেকক্ষণ ধরেই একটি শব্দ আমি লক্ষ্য করছিলাম। অদ্ভুত পাখির ডাকের মতো। কি পাখি দেখার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। ৫ মিনিট সেখানে চুপচাপ অপেক্ষা করার পর দেখলাম একদল পাহাড়ি বনমোরগ। প্রত্যেকটি বিভিন্ন রকমের রং, অদ্ভুত রঙিন তাদের গায়ের রংগুলি। আস্তে আস্তে তারা আমাদের কিছুদূর দিয়ে চলে গেল। বেশ ভালোলাগা একটা তৈরি হলো কারণ এরকম একটি জঙ্গলে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি অথচ কেবলই মনে হচ্ছিল কিছুই কি দেখতে পাবো না। একপাশে রডোডেন্ড্রনের জঙ্গল সহ পাহাড়ের ঢাল আর একপাশে পাহাড়। বছরের পর বছর ধরে সেই পাহাড়ের গায়ে শ্যাওলা পড়ে গোচালার আদিমতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আর সেই শ্যাওলার মধ্য থেকে অনবরত টুপটাপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখতে থাকলাম। বেলা পড়ে আসছে তাই সামনের দিকে এগোতে হবে।
 

 
 এরপর হঠাৎই আবহাওয়ার বদল করলো। মেঘ ঢুকে যাচ্ছে, একটু ঠান্ডাও লাগছে, হঠাৎই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। রাস্তা আর শেষ হয়না। জঙ্গলের পথ একেবারেই অন্যরকম। গত কয়েকদিনের থেকে পচা পাতা আর কাদায় পথকে করে তুলেছে আরো বিপজ্জনক পিচ্ছিল। খুব সাবধানে না এগোলে বিপদ ঘটে যেতে পারে। ধীরে ধীরে সেই কুয়াশায় ঘেরা বৃষ্টিপূর্ণ আবহাওয়াকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পৌছালাম পুরনো চেনা জায়গা ফেডং। ইতিমধ্যে আমাদের সহপদযাত্রীরা তাদের লাঞ্চ শুরু করেছে। তারা বলল একটু অপেক্ষা করে কিছু পাখির ছবি তুলবে। খুব সুন্দর সুন্দর পাখির দেখা পাচ্ছি। সত্যিই এটি পাখির রাজ্য। অতঃপর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু সোখার উদ্দেশ্যে। বড় বড় বোল্ডার সহ রাস্তা, রডোডেন্ড্রনের গুড়ি ফেলে রাস্তা সবই অতিক্রম করলাম। পঞ্চু পরে ভাল হাঁটা যায় না কিন্তু সোখাতে গিয়ে অনেকদিন পরে মোবাইল নেটওয়ার্কের দেখা পাবো। এই খুশিতে আমরা বেশ জোরেই হাঁটছিলাম। এখন প্রায় সবাই একসঙ্গে হেটে চলেছি গল্প করতে করতে মজা করতে করতে। সামনে দেখা গেল সোখা লেক আর মনেস্ট্রি। সেসবকে পাশে ফেলে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে। দলের তিনজন ইতিমধ্যেই এসে পৌঁছেছে। গরম গরম চা রেডি। বৃষ্টি হচ্ছে তখনও ঝিরঝির করে। তার মধ্যেই আমাদের টেন্ট খাটিয়ে নেয়া হলো। টেন্টের মধ্যে স্যাক রেখে আমরা কিচেন রুমে বসলাম। প্রথমে চা, পরে টমেটোর স্যুপ খেয়ে শরীরকে চাঙ্গা করা হলো। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। দু-একজন গিয়ে তাদের টেন্টে ঢুকেছে। আমরা কয়েকজন গেলাম না। ডাইনিং রুমে বসে গল্প করতে থাকলাম। পাশেই আমাদের সঙ্গে যে আরেকটি দল এসেছিল তারা এই ট্যুর সেলিব্রেশন করছে কেক কেটে। ওরা কাল খুব ভোরে রওনা দেবে এবং একেবারে ইয়াকসম পৌঁছাবে। তাই ওদের এটাই ট্রেকিংয়ের শেষরাত্রি। যদিও আমাদের হাতে আরো একদিন সময় আছে। আমরা সাচেন থাকবো। তাই আমাদের খুব একটা তাড়া নেই। আমাদের এই কয়েকদিনের মধ্যে আগামীকালের পথ খুব স্বল্প এবং তুলনামূলক কম কষ্টকর হবে। সাড়ে আটটার সময় ডিনার হলো। ডিনার শেষ করে যে যার টেন্টে গিয়ে ঢুকলাম।

অষ্টম দিন.... 

সোখা থেকে সাচেন = ৭ কিমি

২৩.১১.২১ তারিখ। আজ আমাদের আজ সাচেন যাওয়ার কথা। খুব কম সময়ের রাস্তা, তাই সকালে আমরা কয়েকজন ঘুরতে বেরোলাম সোখা মনেস্ট্রীর দিকে। খুব মনোরম পরিবেশ। ওখানে গিয়ে তোতোনদা এবং পবিত্রর মুখে শুনলাম সোখার ইতিহাস। অনেক আগে একটি সমৃদ্ধ গ্রাম ছিল সোখা। প্রচুর লোকজনের বসবাস ছিল কিন্তু ভারত-চীন যুদ্ধের সময় সরকার থেকে এখানকার পুরো বসতিটাই তুলে ইয়াকসামে নিয়ে যায়। সেই থেকে এই গ্রামটি জনমানব শূন্য হয়ে যায়। এখনো আশেপাশে বহু পুরনো বাড়িঘরের ধ্বংসপ্রায় ভিত দেখা যায়। এখানে কিছু ঘর এখনো ভগ্নপ্রায় দশা। সেগুলি এখন ঘোড়ার আস্তাবল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যাই হোক একটি ছোট কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে ৫০ ফিট উপরে একটি পাহাড়ের টিলায় সোখা মনেস্ট্রি। খুব সুন্দর শান্ত নিরিবিলি। সকালবেলা মনটা ভাল হয়ে গেল। ওখানে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম। এসে দেখি আমাদের টেন্ট প্যাক করা হয়ে গেছে। স্যাক গোছানো ছিল, কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। চেনা পাহাড়ি পথ, বাকিম পর্যন্ত খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো জঙ্গলের রাস্তা। বাড়ি ফেরার আনন্দে সবাই গল্প করতে করতে বাকিম পৌছালাম। ভাবলাম যাওয়ার দিনের মতো এখানে কিছুক্ষণ বসে আড্ডা হবে কিন্তু মেঘ ঢুকে পড়েছে। যদি বৃষ্টি এসে যায় এই ভয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। এখান থেকে ঘন জঙ্গলপূর্ণ পাথুরে রাস্তা, পাহাড়ের ঢালু একটু বেশি। খুব ধীরে ধীরে আমরা নামতে থাকলাম। উঁচু-নিচু পথ বেয়ে এলো বাকিম ব্রিজ। এবার চড়াই শুরু। প্রচন্ড চড়াই এক ঘন্টার মত, তারপর আবার নতুন একটি পাহাড়ে পড়লাম। কর্দমাক্ত রাস্তা খুবই সংকীর্ণ ও বিপদসংকুল। খুব ধৈর্য সহকারে সেই রাস্তা পেরিয়ে একটি ল্যান্ড স্লাইড জোন পেরিয়ে চলে এলাম সাচেন। ফুর্বা চা এবং কিছু পরে স্যুপ দিতে এসে বলে গেল আজ টেন্টে ডিনার দিয়ে যেতে পারবে না। কারণ পাহাড়ের রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে গেছে, খাবার নিয়ে পড়ে যেতে পারে। তাই আমাদের প্রায় দুশো ফুট নেমে কিচেন রুমে খেতে যেতে হবে। একটি ঘটনা ঘটলো প্রদীপ জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল, রেড পান্ডা দেখতে পেয়ে আমাদের ডাকতে এলো। আমরা নিঃশব্দে দৌড়ালাম কিন্তু ততক্ষণে এক গাছ থেকে আরেক গাছ লাফিয়ে সে বন্ধু পগারপার। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আমরা প্রত্যেকে গল্পগুজব এ মশগুল। সাতটার দিকে ডিনারের ডাক পড়ল। পাহাড়ি পথ নেমে ডিনার করে পাশেই ঝর্ণায় মুখ ধুলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা জল। প্রত্যেকে কিচেন থেকে নিজের বোতলে গরম জল ভরে নিয়ে টেন্টে এসে শুয়ে পড়লাম। 

নবম দিন.... 
 


সাচেন থেকে ইয়াকসাম = ৮ কিমি

পরদিন ২৪.১১.২১ তারিখ। আজ আমাদের ট্রেকিং এর শেষ দিন। আমরা যাব ইয়াকসাম। সাচেনে নেটওয়ার্ক প্রায় নেই বললেই চলে তাই সবাই বেরিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে। প্রত্যেকেই এখন পাহাড়ি রাস্তার সঙ্গে অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রায় এক সাথেই যাওয়া হচ্ছে। তৃতীয় ব্রিজ, দ্বিতীয় ব্রিজ অতিক্রম করে এলো অতীব সুন্দর প্রথম ব্রিজের ঝরনা। এবার সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর কোনদিন আসা হবে কিনা জানিনা। যা দেখছি মনের মনিকোঠায় সাজিয়ে রাখছি। সবাই এগিয়ে চলেছে। শেষবারের মতো ব্রিজসহ ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল, বুকটা কনকন করে উঠলো। বিগত তিন মাসের পরিকল্পনা, বিগত ৮ দিনের অমানুষিক কষ্ট অতিক্রম করে আমরা যে স্বর্গের অনুভূতি নিয়ে ফিরলাম তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। একান্তই আমাদের। বিদায় গোচালা। ঝাপসা চোখ রুমালে মুঝে নিয়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। আর যেন ভালো লাগছে না। এবার কেবলই মনে হচ্ছে কখন গিয়ে হোটেলে উঠবো। কিছুক্ষণ পরে দূরের একটি মনমুগ্ধকর ঝর্ণার দৃশ্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। বাকি সবাই চলে গেছে। আমরা তিনজন চুপচাপ। পাখির ডাক আর দূরে ঝর্ণার গর্জন। বরুণদার ডাকে হুশ ফিরল। এবার ফেলে আসা সম্পর্কগুলো যেন টানছে। সবাই যে যার বাড়িতে ফোন করছে হাঁটতে হাঁটতে। আরও দেড় ঘন্টা যাওয়ার পর প্রায় সবার শেষে আমি বাচ্চুদা আর বরুণদা পাহাড় থেকে নেমে এলাম। গোচালা, পান্ডিম, সমিতি লেক, লামুনে দূর থেকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আর একবারের জন্যেও পিছন ফিরে তাকাইনি। সোজা এসে হোটেলের ঘরে ঢুকলাম। আজ রাতে গ্র্যান্ড পার্টি।।

-----------(সমাপ্ত)-------------
 

                                 আমরা ক'জন

Post a Comment

4 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. Summit day the apnar Lekhay tother onek osongoti royeche. Ami apnar 2din por V1 summit korechhi. Samiti lake was crystal clear. Samiti lake theke Kanchenjunga Dekha Jayna. Aaral hoye Jai.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার বর্ণনায় কোন ভুল নেই। আমার এক বন্ধু সাত দিন পর ভিউ ১ এ গিয়েছিলেন। তাঁরা বরফের চিহ্নমাত্র দেখতে পাননি। তাই প্রকৃতির সবার কাছে সমান ভাবে ধরা দেয় না। এটা ভাগ্যের বিষয়।

      Delete
  2. এছাড়াও আমার ফেসবুকের বন্ধুরা আমার করা ভিডিওগুলি দেখেছেন। তারা এই বর্ণনাও পড়েছেন। তাই বিষয়গুলি যথার্থ এবং সত্য এটা তাঁরাও জানেন

    ReplyDelete
  3. পুরানো স্মৃতি গুলো আরো একবার চোখের সামনে ভেসে উঠল অভিজিৎ দা।।

    ReplyDelete