অনিন্দ্য পাল
সেটা ১৯০০ সালের কাছাকাছি একটা সময় ।আফ্রিকার উগান্ডা আর কঙ্গো এই দুই অঞ্চলে ঘটে গেল এক ভয়াবহ মহামারী। মারা গেল প্রায় পাঁচলক্ষ মানুষ। কিন্তু কেন? কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানী আর স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকদের কাছে ধরা পড়লো একটা অদ্ভুত ব্যাপার । এই মহামারীর জন্য দায়ী হিসেবে উঠে এল এক ধরনের মাছির নাম। তিসিতিসি (Tsetse) মাছি । আফ্রিকা এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ একে চেনে 'ঘুম পাড়ানি মাছি' নামে। এই মাছির কামড়েই নাকি মহামারী! মানে এর কামড়ে এক ধাক্কায় মরণ ঘুমে ঘুমিয়ে পড়লো লাখ পাঁচেক মানুষ ! হ্যাঁ, বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটাই প্রমাণিত সত্য ।
কী এই ঘুম পাড়ানি মাছি ? সত্যিই কি এদের মানুষ কে ঘুম পাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা আছে ? বিজ্ঞানীরা নেমে পড়লেন একেবারে কোমর বেঁধে। পৃথিবী জুড়ে চলতে লাগলো গবেষণা। আর সেই গবেষণায় পাওয়া গেল অবাক করা তথ্য। জানা গেল , এই মাছির কামড়ের নথিভুক্ত ইতিহাস খুব প্রাচীন না হলেও , ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে বৃটিশ উপনিবেশে আফ্রিকান মানুষদের যখন ক্রীতদাস হিসাবে ব্যবহার করা হত তখন থেকেই এই ঘুম পাড়ানি মাছির কামড়ে রোগের কথা জানা যায়। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মাছি আজকের পৃথিবীর নয় , আজ থেকে সাড়ে তিন কোটি বছর আগেও এরা পৃথিবীর বুকে বহাল তবিয়তে ছিল।
আফ্রিকায় এই মাছির প্রায় ২৩ টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায় । তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক সেই মাছি গুলো যারা দুটো মাত্র প্রজাতির জীবানু নিজেদের শরীরে বয়ে বেড়ায় । একটা ট্রাইপেনোসোমা ব্রুসি রোডেসিয়েন্স আর অন্যটা ট্রাইপেনোসোমা ব্রুসি গ্যামবিয়েন্স। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ( WHO) মতে এই দুটো প্রজাতির মধ্যে ঘুম রোগ বেশী তৈরী করে গ্যামবিয়েন্স ধরণের জীবানু । প্রায় ৯৫ শতাংশ ঘুম রোগের জন্য দায়ী এই গ্যামবিয়েন্স আক্রান্ত মাছি ।
এই এককোষী জীব গুলো ঘুম পাড়ানি মাছির শরীরের ভিতর বাসা বাঁধে। তবে তিসিতিসি জন্মের সময় এই পরজীবী সমেত জন্মায় না। তিসিতিসি বাঁচে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রক্ত খেয়ে । আক্রান্ত পশু বা মানুষের শরীরে রক্ত খাওয়ার সময় এরা নিজেরাও সংক্রমিত হয়ে যায়। আর এই সংক্রমিত মাছি যখন কোন সুস্থ পশু বা মানুষের রক্ত খেতে শুরু করে, তখন সেই পশু বা মানুষটিও আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
তবে কখনও কখনও রক্ত দিতে বা নিতে গিয়ে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে গিয়েও এই সংক্রমণ ঘটে। খুব সামান্য কিছু ক্ষেত্রে হলেও দেখা গেছে সংক্রমিত মায়ের থেকে সন্তানেরও এই সংক্রমণ ঘটেছে।
কী ঘটে এই সংক্রমণ হলে? সাধারণত যেটা দেখা যায়, একটা ঘুম ঘুম ভাব আচ্ছন্ন করে ফেলে আক্রান্ত মানুষ বা পশুটাকে। মানুষের কথা জড়িয়ে যায়, পেশীর খিঁচুনি আর মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। জ্বর আসে খুব বেশী । সঙ্গে সারা গায়ে চুলকানি, গাঁট ফুলে ওঠা এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে প্লীহা, হৃৎপিন্ড, কিডনি পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সবচেয়ে ভয়ের যেটা, কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই যে এই সব লক্ষণ দেখা যাবে, তা নাও হতে পারে। যেমন, যদি রোডেসিয়েন্স সংক্রমণ হলে তিন দিন থেকে এক মাসের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। আবার গ্যামবিয়েন্স সংক্রমণ হলে একমাস থেকে একবছর পর্যন্ত যেকোন সময় এর লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এমনকি এটাও দেখা গেছে যে এই সংক্রমণ বেশ কয়েক বছর পর হঠাৎ করেই মহামারীর আকার নিয়েছে। বছরের পর বছর হয়ত আক্রান্ত মানুষটা এই গ্যামবিয়েন্স সংক্রমণ শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু সে নিজেই জানেনা। আর হঠাৎ করেই একদিন ঘুম রোগে ভুগে মারা গেল। ঠিক এভাবেই ১৯৭০ সালে আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মহামারী হয়েছিল । এখনও আফ্রিকার প্রায় ৩৬ টা দেশের ৬ কোটি মানুষ এই আতঙ্কে রয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে, পৃথিবীর ১৮টি দেশের প্রায় শ দেড়েক বিজ্ঞানী এই "ঘুম পাড়ানি মাছি " নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই মাছি গুলো আকারে বেশ বড় হয়। এরা প্রায় দেড় সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। মাথাটা অন্য ধরনের মাছির তুলনায় বেশ বড় হয়। মাথার উপর দিকে চোখ দুটো একদম সুচারু ভাবে আলাদা থাকে। আর থাকে একটা অদ্ভুত অ্যান্টেনা। এদের পেট আর বুকটাও একটু বড় হয়। এদের শরীর মোটেও সাধারণ মাছির মত নরম নয়, আঙুলের চাপে বা টিপে মারা খুব শক্ত। আবার এদের চোষক টা খুব বড় হয়, মাথার নীচের একটা বাল্বের মত অংশ থেকে বের হয়ে সরাসরি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তবে আর একটা বৈশিষ্ট্য, যার সাহায্যে এই মাছিটাকে সাধারণ মাছির থেকে খুব সহজেই আলাদা করে চেনা যায় সেটা হল এর ডানা মোড়ার কায়দা। এই মাছি গুলো তাদের ডানা গুলোকে পিঠের উপর এমন ভাবে মুড়ে রাখে, যাতে একটা ডানার উপর আর একটা ডানা পুরোপুরি ধরে যায়। এ বৈশিষ্ট্য অন্য মাছিদের দেখা যায় না। ধূসর রঙের বা ধূসর বাদামী রঙের এই মাছি সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। এদের কামড় খুব যন্ত্রণাদায়ক হয়। পুরুষ এবং স্ত্রী উভয়েই স্তন্যপায়ী দের রক্ত খেয়ে বাঁচে।
জীবনচক্রের দিক থেকেও এরা একটু আলাদা। এরা এক বছর সময় কালে চারটে প্রজন্ম ভূমিষ্ঠ করে, আর সারা জীবনে প্রায় একত্রিশটা প্রজন্ম ভূমিষ্ঠ করতে পারে। একটা স্ত্রী তিসিতিসি একবারে মাত্র একটা ডিম পাড়ে, যেখানে এমনি মাছিরা শ খানেক ডিম পাড়ে। আবার এরাই একমাত্র পতঙ্গ, যারা ডিম পাড়ার পর থেকে লার্ভা তৈরী হওয়া পর্যন্ত সেটাকে জরায়ুর ভিতরেই বড় করে তোলে। এই সময় লার্ভা মায়ের জরায়ুর ভিতরে একটা বিশেষ গ্রন্থি থেকে বেরোনো একধরনের দুধের মত তরল পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে। এই তরলটা উন্নত মানের দুগ্ধ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, যেটা কিনা অনেকটাই মানুষের মাতৃদুগ্ধের মত পুষ্টিকর খাবার।
এই মাছির কামড়ের থেকে বাঁচতে স্থানীয়রা মোটা এবং ফুলহাতা জামাকাপড় পরে, টুপি আর পা ঢাকা জুতো ও পরার রেওয়াজ আছে। এই মাছি খুব উজ্জ্বল আর গাঢ় রঙের দিকে বেশী আকৃষ্ট হয়, তাই যেখানে এই তিসিতিসি থাকে সেখানে হাল্কা রঙের বা সাদা কালো পোষাক পরাই দস্তুর। একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে জেব্রা প্রাকৃতিক ভাবে তিসিতিসি মাছিকে এড়িয়ে চলতে পারে। আসলে জেব্রার শরীরে যে সাদা কালো রেখা গুলো থাকে সেগুলোই মাছি গুলোকে আটকে দিতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬০ সালের আগে আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যত মানুষ আক্রান্ত হত, এখন আর তত বেশী হয় না। WHO এর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে ১০০০০ জন মানুষ আক্রান্ত হলে ও ২০১৫ সালে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৩০০০-এ । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশা, আগামী ২০২০ সাল পর্যন্ত এই রোগ পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে। তবে এখনও প্রায় প্রতিবছর ৩০ লক্ষ গবাদি পশু আক্রান্ত হয়ে চলেছে আফ্রিকায়, আবার এই কারণে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
===============================
অনিন্দ্য পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত