দীপঙ্কর সরকার
আজকের দিনে পরিবেশ ভাবনা আট থেকে আশি কমবেশি সকল ব্যক্তিকেই তড়িত করে । বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ-সঙ্কটের কথা আজ আর কারো অজানা নয় । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেতনায়ও পরিবেশ ভাবনার বীজ অঙ্কুরিত ছিল । আজ থেকে একশ বছর আগেই তিনি পরিবেশ সঙ্কটের কথা অনুভব করতে পেরেছিলেন । ' ছিন্নপত্রাবলী 'র পাতায় পাতায় তাঁর সে পরিবেশ ভাবনার নিদর্শন সম্যক বিধৃত ।
জমিদারি কাজে যখন কবিগুরুকে মাঝে মাঝেই শিলাইদহ , সাহজাদপুর অথবা পতিসরে যেতে হত ,তখন তাঁকে নদী বক্ষেই যাতায়াত করতে হতো । তখন ঋতুর আবর্তনে নদীর স্ফীত হওয়া কিম্বা শুষ্কক্ষীণ হয়ে আসা জীবনের সঙ্গে মানবজীবনের উত্থান ও পতনের রূপ দেখে তিনি বিচলিত হন ।
' ছিন্নপত্র ' এর অন্তর্ভুক্ত একটি চিঠিতে শিলাইদহ থেকে কবিগুরু লিখছেন ," আমি মানুষকে স্বতন্ত্র মানুষ ভাবে দেখিনে -- যেমন দেশ দিয়ে নদী চলেছে , মানুষের স্রোতও তেমনি কলরব সহকারে গাছপালা গ্রাম নগরের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চিরকাল ধরে চলেছে -- এ আর ফুরোয় না ।" অর্থাৎ সামগ্রিক পরিবেশই যে ' মানুষ -প্রকৃতি পরিবেশ ' এর সামঞ্জস্য
এখানে তারই ইঙ্গিত আছে । মানুষ ছাড়াও আছে প্রকৃতির পরিসর । অন্য প্রাণীর চলাফেরা -পাখির ডাক কিম্বা মৌমাছির গুঞ্জন , আকাশ ও জলের বিস্তার -- সব মিলিয়েই যে একটা জীবনীয় পরিবেশ ( Eco-life system ) অর্থাৎ জীবন ধারণের উপযোগী বাসভূমির কথাই রবীন্দ্রনাথের মনে জেগে উঠেছিল পদ্মার এই প্রাকৃতিক ও জৈব পরিবেশের মধ্যে ।
এই সামঞ্জস্যময় পরিবেশের ঘাটতি দেখা দিলেই পরিবেশ যে হয়ে উঠবে ভয়াবহ , তা ক্রান্তদর্শী কবি আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন । তাই প্রকৃতির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই তিনি শিক্ষাদানের উদ্দেশে শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলায় প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন ।
আদি প্রাণ বৃক্ষ যে পরিবেশ রক্ষার অন্যতম সহায়ক এ কথা উপলব্ধি করে বৃক্ষকে তিনি তাঁর বহু গল্প-উপন্যাস -নাটক-কবিতা ও প্রবন্ধে নিসর্গ প্রকৃতির অন্যতম উপাদান হিসেবে নিজ দর্শন অনুযায়ী ব্যবহার করেছেন । পরিবেশ সম্বন্ধে তাঁর গভীর আগ্রহাতিশয্যেই তিনি ১৯২৮ সালে ' বৃক্ষ রোপণ ' নামক গাছ লাগানোর একটি উৎসবের সূচনা করেন।
শুধু বৃক্ষ রোপনই নয় হল কর্ষণের কথাও বলেছেন । তিনি এও জানেন প্রকৃতিকে ব্যবহারের যে ক্ষতি তার পূরণ হয় বৃক্ষ রোপণে ।
রবীন্দ্রনাথ জানতেন " প্রকৃতির ব্যবহারকে নতুন সজীবতায় ফিরিয়ে আনতে হবে ।" বর্তমান সমাজে লোক সংখ্যা বাড়ায় , বসতি বাড়ায় , জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ঔষধ প্রয়োগ করায় ভূ-প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে । তাই শান্তিনিকে-তনে আশ্রম বিদ্যালয় খুলে , তার চারপাশে গাছ লাগিয়ে পশুপাখির কলতানে সব রকম প্রাণ বৈচিত্র্য বা ' biodiversity ' তৈরি করে , প্রকৃতি ও প্রাণী জগৎকে তার সজীবতা রক্ষার আহ্বান জানিয়েছি -- লেন -- এ তাঁর অসামান্য দূরদর্শিতারই পরিচায়ক ।
পরিবেশের প্রাকৃতিক নীতি মেনে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক জীবনের সঙ্গে যে সামঞ্জস্য আনার চিন্তা করেছেন তিনি তার অন্যতম ফসল হল ' মুক্তধারা ' নাটক , যেখানে তিনি যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকৃতির বিদ্রোহকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন । আবার' রক্তকরবী ' নাটকেও দেখা যায় সেই পরিবেশ সামঞ্জস্যেরই প্রয়াস । নন্দিনী রাজাকে তাঁর যক্ষপুরী
থেকে বেরিয়ে মাঠে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে , কেননা ," পৃথিবী আপনার প্রাণের জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয় ।" কিন্তু রাজা যে জোর করে তার সম্পদ কুক্ষিগত করে , তাতে সে অভিসম্পাতই কুড়ায় । তাই নন্দিনী রাজাকে বলেছে , " আলোয় বেরিয়ে এসো , মাটির উপর পা দাও , পৃথিবী খুশি হয়ে উঠুক ।" এ খুশি তো পরিবেশের ভারসাম্য বহনেরই ইঙ্গিতবাহী ।
আসলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন প্রকৃত অর্থেই এক পরিবেশবিদ । পরিবেশ বিঞ্জানী হিসেবে তাঁর দর্শনের একটি বিশেষ সূত্র হল , " বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ।" ' বসুধৈব কুটুমবকম্ ' ই তাঁর অন্তর্দশনের সারকথা ।
' ছিন্নপত্রাবলী 'র সময় থেকেই তিনি ' প্রাণময় বিশ্বাত্মীয় ' তার কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন । প্রকৃতি পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করেছিলেন । আর সেই বিশ্বাস বোধ থেকেই রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিদেবীকে একটি পত্রে লেখেন ," আমি একদিন সমুদ্র স্নানাসিক্ত তরুণ পৃথিবীতে গাছ হইয়া পল্লবিত হইয়া উঠিয়াছিলাম । ... আমার মধ্যে গাছের প্রাণের গূঢ় স্মৃতি আছে । আজ মানুষ হইয়াছি বলিয়াই একথা কবুল করিতে পারিতেছি । শুধু গাছ কেন , সমস্ত জড় জগতের স্মৃতি আমার মধ্যে নিহিত আছে । বিশ্বের সমস্ত স্পন্দন আমার সর্বাঙ্গে আত্মীয়তার পুলক সঞ্চার করিতেছে -- আমার প্রাণের মধ্যে তরুলতার বহু যুগের মূক আনন্দ আছে সে এই জল স্থল গাছপালা পশুপক্ষীর আনন্দ ।..." তখন স্পষ্টতই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঞ্জানাবধি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রকৃতির জৈব পরিবেশের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পক্ষেই ওকালতি করে গিয়েছেন ।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
---------------------------------------
দীপঙ্কর সরকার
কাঁঠাল পুলি
(সিংহের হাটের কাছে)
চাকদহ
নদীয়া
৭৪১২২২
M 6297618158