প্রবন্ধ।। দরদি কথাশিল্পী- ডঃ তাপস রায় ।। অঞ্জনা দেব রায়
দরদি কথাশিল্পী- ডঃ তাপস রায়
অঞ্জনা দেবরায়
আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন ভাবনায় , নতুন চেতনায় নতুন আঙ্গিকে ও লেখনীতে সমৃদ্ধ করেছেন যিনি তাঁর নাম ড.তাপস রায় । যদিও তিনি সাহিত্য জগতে কবি তাপস রায় হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বর্তমানে শুধুমাত্র কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি নয় , তিনি একধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং প্রাবন্ধিক।
স্কুল জীবন থেকেই সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা ছিল তাঁর । পড়ার ফাঁকে যখনই সুযোগ পেতেন কবিতা লিখতেন । উনার পিতা ঈশ্বর জ্ঞ্যানেন্দ্র নাথ রায় মহাশয়ের লেখার অভ্যেস ছিল । উনিও কাজ থেকে বাড়ি ফিরে এসে এক কাপ চা নিয়ে ডাইরি ও কলম নিয়ে বসে পড়তেন লিখতে । কবিতা , গল্প কখনো ছড়া যখন যেটা মনে আসত তাই লিখতেন । কথায় আছে ' কবি হয়ে জন্মাতে হয়, জোর করে কবি হওয়া যায় না ।' জন্মসুত্রে তাপস রায় কবি হয়ে জন্মেছেন । উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া বানীপুর তার জন্মস্থান । সেখানেই তার বড় হয়ে ওঠা । ছাত্রজীবনে স্কুল ম্যগাজিনে, ও কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশ পেত । ছাত্রজীবন শেষ করে চাকরি পাবার পর 'ত্বস্টা' নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা করেন। এরপর কলকাতায় বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে তাঁর কবিতা প্রকাশ হওয়ার পর অনেক সাহিত্যপ্রেমিকদের সাথে পরিচয় হল আর কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যেমন রবীন্দ্রসদন মঞ্চ, বাংলা এক্যাডেমি মঞ্চ, শিশির মঞ্চ প্রভৃতি জায়গায় নিজের লেখা কবিতা পাঠের সুযোগ পান। এইভাবে কলকাতায় সাহিত্য মহলে তাঁর পরিচিতি হতে লাগল । ১৯৯৪এ কবি তাপস রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'বনববিবির বসতি ' প্রকাশ পায় । এই কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি কবিতার চারটি লাইন আমি তুলে ধরলাম—
তুষার পাতের শব্দ । ধবনিময় লাফ মন্ত্রোচ্চারণ। নাকের পাতায় এসে ছবিটি হঠাৎ স্থির । এলোমেলো হাওয়া সহসা সহজ , চেনা অক্ষর। ভাস্কর্য জুড়ে ছিল কল্পভয় গোলার্ধ বাগান রঙিন আসবাবহীন পরিচ্ছন্ন ফুলফুল অভ্যস্ত ভীরুতায় প্রভাতফেরির গান ।
এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত পরপর ১২ টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় । তারমধ্যে কৃত্তিবাস থেকে প্রকাশিত 'ব্যবহারিক রূপবিজ্ঞান তত্ত্ব' কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০০৬ সালে বীরেন্দ্র পুরস্কার পান । আর ২০১৭তে সিগনেট থেকে প্রকাশ পায় 'মে মাস নরম হয়ে আসে' কাব্যগ্রন্থটি ।
তাপস রায়ের লেখা গল্প , কবিতা , প্রবন্ধ কলকাতার নামি পত্রিকা যেমন –কৃত্তিবাস ,একুশ শতক, ও দেশ পত্রিকা থেকে প্রকশিত হয় । তবে তাঁর প্রথম গল্পের বই 'দশে দশ' এবং একটি প্রবন্ধের বই 'মিথ্যে মিথ্যে কবিতা' প্রকাশিত হয়েছে । এছাড়া তিনি 'সুইনহো স্ট্রিট ' নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা করেন । উনার লেখা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রকাশিত হয় এবং তিনি বিভিন্ন ভাষার কবিতার অনুবাদ করে থাকেন ।
তবে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে কবিতা ,প্রবন্ধ ও গল্প লেখার পর ২০১৬ সালে প্রথম উপন্যাস লেখেন । তাঁর প্রথম উপন্যাস 'পোড়ামাটির দেউল' আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয় । এই উপন্যাসটি লেখক মহলে সাড়া জাগায় । আনন্দ পাবলিশার্স থেকে উপন্যাসটির জন্য বিশেষ সন্মান দেওয়া হয় তাকে । 'পোড়ামাটির দেউল' উপন্যাসটি মূলত ইতিহাসাশ্রিত। ১২৫২ সালে বীরভূমের হেতমপুরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের চন্দ্রনাথ শিবমন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে শুরু হয় উপন্যাসের ইতিহাসযাত্রা। শিবমন্দিরের কুলপুরোহিতের কন্যা মণিদীপার ভর ওঠা এবং তাকে কেন্দ্র করে অগণিত ভক্তসমাগম ও তাদের সমস্যার সমাধান করে দেওয়া নিয়ে উপন্যাস শুরু । চন্দ্রনাথ মন্দিরের নির্মাতা ছিদাম, তার স্ত্রী কমলমণি , পুত্র শাল্মলীকে নিয়ে সেই সময়ের বিভিন্ন জায়গার দেবালয় নির্মাণকলার বিস্তৃত বর্ণনার সঙ্গে সম্পূর্ণ রাঢ়বাংলার সামাজিক –অর্থনৈতিক – রাজনৈতিক ইতিহাস বিবৃত করেছেন । ইংরেজ আধিকারিকদের জীবনযাত্রা , তাদের বাগানবাড়ির মেহফিল, বাঈজিবিহার , শিকার যাত্রা এবং সবার উপরে রায়বাহাদুর খেতাব লাভের জন্য লালায়িত বঙ্গীয় রাজন্যবর্গের নির্লজ্জ পদলেহনের এক অনবদ্য দলিল যেন এই উপন্যাস । এছাড়া মন্দিরগাত্রের শিল্প ঢেউয়ের মতো ধরে রেখেছে ইতিহাসকে । মণিদীপা দেবাঞ্জনের প্রেমকাহিনী এবং শাল্মলি-মোক্ষদা – কমলমণির সম্পর্ক অবাক করে , মন ছুঁয়ে যায় । কাহিনীকে করে তোলে সময়োত্তর।
২০১৮ সালে তাপস রায়ের আর ও একটি উপন্যাস 'মানদাসুন্দরীর কাথা' আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয় এবং এই উপন্যাসটিও লেখক মহলে সাড়া ফেলে । এই উপ্ন্যাসটির পটভূমি উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ । চন্দনীমহলের জমিদার বরদাকান্ত বসুর তেরো বছরের মেয়ে মানদাসুন্দরীর বিয়ে হয় চৌগাছার জমিদার পঞ্চাশ বছর বয়সের কৃষ্ণমোহনের সঙ্গে। মানদা লেখাপড়া জানে কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে এসে দাসী গোলাপির জালে জড়িয়ে পড়ল মানদা । শুধু সে একা নয় , জড়িয়ে পড়ল গোটা জমিদার বাড়ি । কিন্তু সেই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও মানদা খুঁজে নিল নিজের সুখ – কখনও বই পড়ায়, কখনও কাজের মেয়ে সরলাকে লেখাপড়া শেখানোয় আবার কখনও –বা কাঁথা বোনায় ।
''মানদাসুন্দরীর কাঁথা'' উপন্যাসে উনিশ শতকের সমাজচিত্র ও একজন তেজস্বিনী নারীর মুক্তচিন্তা চমৎকার ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে উঠে এসেছে বাংলার একটি লুপ্তপ্রায় শিল্প, কাঁথার কথা । মূলত মানদাসুন্দরীর জীবন আর কাঁথার নকশা একসময় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ।
তাপস রায়ের আরো একটি উপন্যাস ''হেভেন হোকাস – পোকাস '' একটি রহস্য উপন্যাস ২০২০সালে একুশ শতক থেকে প্রকাশিত হয় । এছাড়া তাপস রায়ের তিনটি ধারাবাহিক উপন্যাস - ''গরানহাটির কীর্তনিয়া ", "ব্যাটলশিপ'' আর "শুধু পটে লেখা" প্রকাশিত হয় যুগশংখ সংবাদপত্রে ও গৃহশোভা পত্রিকায় ।
তাপস রায় হলেন মূলত আশির দশকের লেখক । কিন্তু বর্তমানে তাঁর কলম নতুন নতুন গল্প, কবিতা , প্রবন্ধ ও উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে । আশা রাখি বাংলাসাহিত্যে তাঁর নতুন সৃষ্টি বাংলার পাঠকগণকে প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ করবে আগামিদিনে । এবং বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর রচনার বিশেষত্বের জন্য তিনি চিরদিন উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক হিসেবে থাকবেন ।
------------------