আমি অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী। বছর আঠাশের এক যুবক। পেশায় আমি এখন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। একটা বিখ্যাত আই টি সেক্টরে চাকুরীরত। কাজের সূত্রে নানা দেশ বিদেশ ঘুরতে হয়। কর্পোরেট জগতে ওঠা বসা। যথেষ্ট স্মার্ট ও সুদর্শন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করে উঠতে পারলাম না। বলতে পারেন তেমনভাবে কাউকে মনে ধরেনি। বাবা মায়ের পছন্দ মতো মেয়েকেই বিয়ে করবো ঠিক করেছি। এ ব্যাপারটা মায়ের উপরেই ছেড়ে দিয়েছি। কারণ মায়ের উপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে। আমার মা শিক্ষিতা, রুচিশিলা ও বুদ্ধিমতী। আমার নিজের সম্পর্কে বলে গেলাম এতক্ষন। আপনারা ভাবছেন এটা কি "পাত্রী চাই" বিজ্ঞাপন নাকি! না, একদম তা নয়। যাই হোক। আসল কথায় আসা যাক। আমি, মা আর বাবা কলকাতায় একটা ফ্ল্যাটে থাকি। পৈতৃক বাড়ি আমাদের গ্রামে। নদীয়া জেলায়। আমার চিরদিনই ইচ্ছা যে বিয়ে যদি করতেই হয় একজন শিক্ষিতা, সুন্দরী মেয়েকেই করবো হোক না সে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাতে আমার কোনো আপিত্তি নেই। মেয়েটি যেন ভালো হয়, মেধাবী হয়। পাত্রী দেখা চলছে। কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না কাউকেই। হঠাৎ কিছুদিন আগে আমার পৈতৃক বাড়ি থেকে একটা চিঠি আসে। আমার কাকুর চিঠি। আমার খুড়তুতো বোন মহিমার শুভ বিবাহ। আমি আর মহিমা একাধারে ভাই বোন অপরদিকে হরিহর আত্মা। দুজনে দুজনকে সব কথাই বলি। খুব বন্ধুত্ব আমাদের মধ্যে। যেহেতু মহিমা কলকাতায় হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছে তাই যোগাযোগটা আমাদের ভালোই রয়েছে। জানতাম ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কাকুর চিঠি হাতে পেয়ে খুব খুশি হলাম। মহিমা বলেছে দাদাভাই তুই যদি না থাকিস আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসবো না। অগত্যা বেশ কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মা বাবা কয়েকদিন আগেই পৌঁছে গেছে। আজ পৌঁছেতে আমার বেশ রাত হবে।
যাই হোক, ট্রেন থেকে যখন নামলাম তখন রাত এক টা। বেশ অনেকদিন পরে গ্রামের বাড়িতে আসছি। সচরাচর গ্রামে আসার সময় হয়না। চারদিক ভয়াবহ অন্ধকার। জনপ্রাণী নেই। এখানে যানবাহনও খুব একটা চলে না। প্রত্যন্ত অঞ্চল। রিক্সাই একমাত্র বাহন। কিন্তু এত রাতে রিক্সা পাব কি? দুরে কোথায় যেন শিয়াল ডাকছে। নীরবতার ঐ শব্দকে ভৌতিক ভয়ংকর শোনাচ্ছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আমি ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। যেখানে রিক্সা থাকার কথা সে যায়গাটা ফাঁকা।এরকম অবস্থায় কোনোদিন পরিনি। এখন কি করি? একটু ইতস্ততঃ করে ধীরে ধীরে সামনে এগোতে লাগলাম। কেমন একটা গুনগুন আওয়াজ ভেসে এলো। মৃদু গুনগুন শব্দ কানে যেতেই ভয়টা কিছুটা কেটে গেল। আমি সাহস করে এগিয়ে যাই। দেখি একটা রিক্সার সিটে বসে বিড়ি ফুকছে একটা রিক্সাওয়ালা। দেখলাম সিটে বসা চাদর মুড়ি দিয়ে আরও একজন। আমাকে দেখে লাফ দিয়ে নেমে দাড়াল চালক রিক্সা থেকে। বলল "কোথায় যাবেন বাবু ?" আমি গ্রামের নাম বললাম। বললো" চলুন।" আমি জিজ্ঞাসা করলাম "ইনি কে? রিকশা ওয়ালা বললো আমার মেয়ে। শহরে কলেজে পড়ে। আজ ছুটি পড়লো তাই বাড়ি ফিরছে। আমি অপেক্ষা করছিলাম যদি শেষ ট্রেনের কোনো প্যাসেঞ্জার পাই। তা আপনি যখন এলেন ভালোই হলো। দুটো পয়সা পাবো।
আমি রিক্সায় উঠে বসলাম।
"অন্ধকারে রিক্সা চালাবে কীভাবে?" রিকশাওয়ালা বললো - " অসুবিধা নেই।"
রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ মাঠ। খাঁ খাঁ করছে। দুপাশে মাঠ দুটোর সামনে দুটো বিশাল দৈত্যাকার বট গাছ যেন তার বিশাল বিশাল অজস্র ঝুরি বার করে মাঠ দুটিকে আগলে রেখেছে। রাতের অন্ধকারে গাছদুটি কে আরও ভয়াবহ দেখাচ্ছে। এই জায়গা সম্পর্কে নানা রকমের গল্প শুনেছি ছোটবেলায়। দিনের বেলায়ই যেতে গা ছমছম করে। রাতের বেলা ওখান দিয়ে গেলে নাকি ভূতে ধরে।
একটু পরে সে জিজ্ঞেস করে "গ্রামে আপনার কে থাকে?" আমি বললাম " আমাদের পৈতৃক বাড়ি। কাকারা থাকে। কিছুদিন পরে আমার খুড়তুতো বোনের বিয়ে তাই যাচ্ছি।" তারপর আবার বেশ খানিকক্ষন নিশ্চুপ। পাশের চাদর মোড়া মানুষটি নট নড়াচড়া। কিন্তু একি রে বাবা ! রাস্তা এগোচ্ছে না কেন? সেই দুদিকে মাঠ আর বট গাছ। যতই যাচ্ছি এগুলোও সঙ্গে যাচ্ছে। পথ যেন শেষ হয় না।কিন্তু রিকশা তো ভালোই টানছে। ভুতুড়ে জায়গা নাকি!
ছোটবেলার শোনা গল্প আবার মনে পড়লো। চিরকালই আমি নির্জনতা আর অন্ধকার কে একটু ভয়ই পাই। আজকের পরিস্থিতিতে যে যত সাহসীই হোক না কেন ভয় পেতে বাধ্য। ভয় হাত পা হিম হয়ে এলো। তারপর ভাবলাম আমি তো আর একা নই। দুজন তো আছে। নীরবতা ভাঙতে রিক্সাওয়ালা কে নাম জিজ্ঞাসা করলাম। বললো যে তার নাম রতন। আর তার মেয়ের নাম মিঠা।
আমি মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। তবে হাত দুটি দেখে মনে হলো বেশ ফর্সা। যাই হোক মাঝ পথে আসার পরে রিকশা চালক টি বলল "স্যার আপনারা বসেন আমি একটু খালি করে আসি।" বুঝতে পারলাম সে বড়ো বাইরে যাবে। আমার পাশে বসা চাদর ঢাকা মেয়েটির কোনো সাড়া-শব্দ নেই, চুপচাপ বসে আছে।
এরপর আমি নিজেই সেধে মেয়েটির সাথে আলাপ করার চেষ্টা করলাম। অনেক অনুরোধ করাতে সে চাদর সরালো শরীর থেকে। আমি মুগ্ধ। একজন রিকশাওয়ালার মেয়ের এত রূপ? বৃষ্টিতে তার কামিজ ভেজা। মেয়েটি বলে যে বাবা বলেছিলো চাদর মুড়ি দিয়ে বসতে। আপনি অচেনা তাই আপনি রিকশায় ওঠার আগেই চাদর মুড়ি দিয়ে দিই। বুঝলাম বাবা কেন বলেছিলো। ভিজে কামিজ লেপ্টে রেখেছে তার শরীরকে। পাশে বসে আমার একটা অদম্য ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করলাম। চোখ সরছে না মেয়েটির থেকে। পৌষের ঠান্ডায় তার গোলাপী ঠোঁট কাঁপছে। ইচ্ছা করছে তার সব শীতলতা নিমেষে মিটিয়ে দি। কিন্তু আমি তো একজন শিক্ষিত ভদ্র ছেলে। তবে এ আমি কি সব ভাবছি! বুঝলাম আমি মেয়েটির প্রেমে পড়েছি। তখনও রতন আসেনি। মেয়েটির সাথে বেশ ভাব জমে উঠলো। খুব আপন লাগছে মেয়েটি অর্থাৎ মিঠাকে।
কিছুক্ষন পর রতন এলো। রতন বললো বাবু কিছুদূর এগোলেই আমার বাড়ি। আমি মেয়েকে বাড়িতে রেখে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো। মেয়েটি তখন বলে উঠলো "বাবা বাবু তো ভিজে গেছে। আমাদের গরিবের ঘরে উনি যদি একটু চা খেয়ে যেতেন।" আমি না বলতে পারলাম না। এক অদ্ভুত আকর্ষণে রাজি হয়ে গেলাম।
যাই হোক নামলাম রিকশা থেকে। পুরোনো ভাঙা বাড়ি। বাড়ির ভিতর ঢুকে আমি থ! বইয়ের তাকে সারি সারি বই। একটা ভাঙা কাঁচের আলমারিতে মেয়েটির পাওয়া কত সার্টিফিকেট! জানলাম তার মেধার কথা। মুগ্ধ হয়ে গেলাম তার রূপ আর গুণ দেখে। মনে মনে ভবিষ্যতের কত কিছু এঁকে নিলাম। চকিতে মেয়েটির ডাকে সম্বিৎ ফিরলো। "একটু বসুন, চা নিয়ে আসছি এক্ষুনি"।
আমি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও আমাকে এক কাপ ধূমায়িত চা এনে দিল। কড়া লিকারের চা।
চা শেষ হলে মেয়েটি মানে মিঠা বলল, " রাতে ডিনার খেয়ে যাবেন"।
আমি বললাম " না, এই যথেষ্ট। আমি এখনই উঠব। বাড়িতে সবাই চিন্তা করবেন "।
" বাড়িতে কে কে আছে আপনার?"
আমি বললাম, " মা, বাবা আর আমি। এবার আসি" বলে আমি ঘর থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। মিঠা আমাকে এগোতে এল। মনে হলো ওরও আমাকে ভালো লেগেছে। ওর বাবার রিক্সাতে তুলে দিয়ে বলল, "কাছেই যখন থাকেন, তাহলে মাঝে মধ্যে আসবেন। এলে খুব খুশি হব। আশা করি বাড়ি চিনতে অসুবিধে হবে না"।
বাড়ি ফিরে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ভাবলাম তাকে নিয়ে। এরকম সুন্দরী একাধারে মেধাবী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। মনে মনে স্থির করলাম, আগামীকালই সন্ধের পর ওদের বাড়ি যাব। ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেবো। মা কে ঘটনাটা পুরো বললাম। মা কোনো আপত্তি করলো না।
পরের দিনই ছুটলাম বাইক নিয়ে ওদের বাড়ি। বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখলাম একটা রোয়াকের উপর কয়েকজন যুবক আড্ডা মারছে।
আমাকে দেখে যুবকদের মধ্যে একজন বলে উঠলো "কী চাই?"
আমি বললাম, " বাড়িতে তালা। কখন বাড়ির লোকেরা ফিরবে বলতে পারবেন?"
হাসতে লাগল যুবকগুলো,বলল " কি যে বলেন আপনি? এ বাড়িতে কেউ থাকে না"।
"কেউ থাকে না মানে?" আমি বেশ অবাক হলাম।
" হ্যাঁ, কেউ থাকে না। বাড়িটা বহুদিন থেকে তালাবন্ধ অবস্থায় রয়েছে"।
এ কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। "কী বলছেন আপনারা জানেন? গতরাতেই আমি এ বাড়িতে এসেছিলাম। কত গল্প করে চা খেয়ে গেছি "।
ছেলেগুলো চুপ করে গেল। একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো " দাদা আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। এ বাড়িতে মিঠা নামে একটি খুব মেধাবী মেয়ে আর তার বাবা থাকতো। মিঠার বাবা মিলে কাজ করতো। অভাবের তাড়নায় রিক্সা চালিয়ে মেয়েকে কলেজে পড়িয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় গতবছর কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বাবা ও মেয়ে দুজনেই 15ই ডিসেম্বর মারা যায়। আমার মাথা ঘামতে লাগল। সারা শরীর যেন নিথর। মনে হচ্ছে ধড়ে আমার আমার প্রাণ নেই। মনে পড়লো গত কালই 15ই ডিসেম্বর ছিল। একটা অস্ফুটো আওয়াজ বুক ঠেলে বেরোতে চেষ্টা করল,পারল না। বুকের ভিতরটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি যে একদিনেই মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। অনেক আশা নিয়ে সে কথা বলতে এসেছিলাম। মনে হয়েছিল তার সাথে আমার একদিনের পরিচয় নয়। যেন বহুদিনের পরিচয় আমাদের। হায় রে ঈশ্বর! আমার প্রেম অধুরাই থেকে গেল....
----------------------------------------
ঠিকানা :- হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ