প্রতি বছর জাঁকিয়ে বসে মেলা ৷বছরের বিভিন্ন সময়ে যেখানে সেখানে মেলা বসলে কি হবে এর সঙ্গে তাদের কোন তুলনা হয় না ৷ জ্ঞান হওয়া অবধি রথিন মা বাবার সঙ্গে এই মেলায় এসেছে ৷তবে এর জৌলুস কিছু কমেছে বলে তার মনে হয় না ৷
রথিনদের গ্রামটা পার হলেই ভাজনা রামচন্দ্র পুরের শুরু ৷এই ভাজনার পরেই দক্ষিণ গঙ্গাধর পুর ৷মেলাটা বসে এই দুই গ্রামের মাঝে ৷ শীতলা দেবীকে নিয়ে পন্ডিতদের এই মেলা ৷পন্ডিত বলতে পদবি ৷ ক্ষান্ত পন্ডিত আজ আর বেঁচে নেই ৷কিন্তু তার মেলাটা আজ ও বেশ জাঁকিয়ে বসে ৷চারদিকে কতো দোকান,৷কোথাও খেলনা সাজিয়ে বসেছে দোকানি ৷আবার কোথাও রকমারি খাবার দোকান ৷কোথাও আবার মিষ্টান্ন৷ ঘুগনি,চপ,ফুলুরি দোকান ও খুব জমে উঠেছে মেলার মাঝে ৷ আশপাশের গ্রামের মানুষের কাছে এটা এক প্রকার লোকাল ফেস্টিভ্যাল ৷স্থানীয় বিদ্যালয় গুলো এই মেলার সময় অর্ধ দিবস বন্ধ থাকে ৷
রথিন তখন ক্লাস টেনের ছাত্র ৷ছাত্র ছাত্রীরা সই সংগ্রহ করে অফিসে রীতিমতো জমা করেছে মেলার ছুটির জন্যে ৷
----কি নিখিল যাবি তো ?
নিখিল রথিনের ক্লাস মেট ৷বরাবরের ভালো ছাত্র ৷টেস্ট পরীক্ষা সদ্য শেষ হয়েছে ৷সামনে মাধ্যমিক ৷জোর প্রস্তুতি চলছে তখন ৷তবে মেলার প্রতি ওর খুবই দুর্বলতা ৷
-----কি রে কিচ্ছু বলছিস না যে কিছু ?
-----হ্যাঁ যাবই তো ৷
নিখিলের বাড়ি রথিনদের পাড়ায় নয় ৷অনেক দূরে ৷সোনারপুরে ৷এখানে ও হোস্টেল এ থেকে পড়াশোনা করে ৷মাধ্যমিকের পর কে কোথায় চলে যাবে তার খোঁজ থাকবে না ৷
-----তুই কখন যাবি রথিন?আমাকে যাওয়ার সময় ডাকিস ৷
তখন সময় বোধ হয় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল ৷দুই ক্লাসমেট চলল মেলার পথে ৷তারা জীবনের এক মোক্ষম সময়ের মানুষ ৷দেহ মনে তাদের দুরন্ত ঘোড়ার চঞ্চলতা ৷পোশাকে আশাকে চুলের স্টাইল বিন্যাসে ভীষণ পরিপাটি ৷তাদের চলার মাঝে কি অপরূপ ছন্দ ভরা ৷ ধানের ছোট ছোট নাড়া তখনো মাঠে ৷চারদিকের মাঠ ,খেত জমি সবুজে সবুজ হয়ে উঠেছে খেসারি কড়াই শাখে ৷ দক্ষিণের হাল্কা বাতাসে দুলে দুলে উঠছে মাঠের কোল আলো করা সূর্যমুখী ৷ আর তার পাশে বিছিয়ে আছে মেঠো আল পথ ৷ধারে ধারে গজিয়ে উঠেছে ঘাস আর আগাছা ৷
ওরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মেলার মাঠের কাছে এসে হাজির ৷ভাজা চপ,ফুরুলির গন্ধে বাতাস একেবারে মো মো করছে ৷মিষ্টির দোকানে লোক গিজগিজ করছে ৷ স্টেশনারি দোকানে মহিলাদের থিকথিকে লাইন ৷
----কি নিখিল প্রথমে কোন জায়গায় যাবি ?এখানে মায়ের পায়ে ছাগ বলি হয় ,যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি?
মায়ের পায়ে ছাগ বলি !সত্যিই গা শিউরে ওঠার বিষয় ৷না -না আমি ওখানে যাব না ৷তবে কি জানিস তো বলির পরে একবার পায়ে পুজো দিয়ে ফিরে যাব৷ তাহলে এখন কি করা যায় ?
------আচ্ছা নিখিল ওখানে একদল পুলিশ দাঁড়িয়ে,যাবি নাকি ?
--------পুলিশ!
পুলিশের পোশাক,সাহেব সুবাদের মতো চাল চলন ওদেরকে কেমন যেন মোহাবিষ্ট করে তুলেছিল ৷তাই নিখিল বলে তাহলে যাওয়া যেতেই পারে ৷
মেলার মাঝে টহলদার পুলিশ ৷তাও আবার গ্রামে ৷ভাবতে অবাক লাগছে ওদের ৷আসলে মেলার মাঝে কোন বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে ওখানে পুলিশ নয় ৷ তখন ওই এলাকায় শুরু হয়েছে হিন্দু মুসলমানের সংঘাত ৷হিন্দু কিংবা মুসলমান একে অপরের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়েছে ৷সকলেই আড় চোখে সকলকে দেখে ৷বড়ো মাটির রাস্তার পাশে মুসলমানদের মসজিদ ৷আবার রাস্তার পাশে পুকুরের একেবারেই কোলে এই হিন্দুদের শীতলা মায়ের মন্দির ৷মন্দিরের শাঁখ ঘন্টার ধ্বণিতে মুসলমানরা রে রে করে তেড়ে আসে ৷মসজিদের আজানের ধ্বণিতে হিন্দুরা চটে যাচ্ছে ৷ এমন সংকট কালে তা প্রায় বছর খানেক ধরে তখন চলছে পুলিশি টহল ৷
হাঁটতে হাঁটতে ওরা দু,জন পুকুর পাড়ে মসজিদের পাশে এসে দাঁড়ায় ৷এই মাত্র শুরু হয়েছে আজানের ধ্বণি ৷ওদের অদূরে বন্দুকধারি কয়েকজন পুলিশ ৷ আপন মনে খইনি ডলায় ব্যস্ত এক পুলিশ ৷নিরীহ ছেলে দুটো আপন মনে কথা বার্তায় মশগুল ৷ ডলা খইনিটা অদ্ভুত ভাবে মুখে পুরে দিয়ে গম্ভীর ও কর্কশ গলায় বলল ,অ্যাই তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো ?
নিখিল সোজা সাপটা কথা বলতে ভালোবাসে ৷ও একটু সাহসী ও বটে ৷পুলিশের আকস্মিক এ ধরনের প্রশ্নে কেমন ভ্যাবাচ্যাখা হয়ে বলে, আজ্ঞে বন্দুক দেখছি৷
বিরক্ত হয়ে বদমেজাজি পুলিশ অফিসার সেদিন এগিয়ে এসে সঁপাটে এক চড় কষিয়ে দেয় নিরীহ নিখিলের গালে ৷বলে,এই বয়সে তোমার বন্দুক দেখার শখ হইয়াছে ৷এই কে আছিস একে ক্যাম্পে নিয়ে যা ৷
মেলার মাঝে সে দিন ওদের মেলার আনন্দ মাটি হয়ে গেল ৷চারদিকে লোক গিজগিজ করছে ৷তাদের মাঝ থেকে নিখিলকে দুটো পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে গেল ক্যাম্পে ৷হতবুদ্ধি রথিন মেলার মাঝে চিৎকার জুড়ে দেয় ৷চারদিকে ছুটো ছুটি করে মেলা কমিটির কাছে সব ঘটনা খুলে বলে ৷সেদিন মেলা কমিটির অনুরোধে নিখিল ছাড়া পায় ৷রথিনের বেশ মনে আছে পুলিশটি শুধু চিৎকার করে বলছে ---ওই টুকু ছেলের কি সাহস আমার বন্দুকে ও হাত দিচ্ছে ৷ সে দিনের মেলার পর আর কখনো ওরা দুজনে এক সাথে মেলায় যায় নি ৷
--------------------------------
(সুভাষগ্রাম,দক্ষিণ ২৪ পরগণা)