শীতের এক দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া সেরে নরম রোদের আমেজ উপভোগ করছি। আমার সঙ্গে রয়েছে পলটু আর সুখেন। পলটু তার বাড়ির ডাসা পেয়ারা আমার হাতে দিয়ে বললো "নে তুহিন, পেয়ারা খাবি?"
পলটুর থেকে পেয়ারা নিয়ে প্রথম কামড় বসাতে যাবো এমন সময় সুখেন বললো, সামনে তাকিয়ে দেখ, কে আসছে!"
রাস্তার ধারে আমার বাড়ি। আর আমার বাড়ির ঠিক সামনে বিশাল বড় এক পুকুর। তার নামটাও চমৎকার। গারুল। এই রাস্তা ধ'রে পশ্চিমে মিনিট দু'য়েকের মধ্যে পড়ে স্টেশন। আর পূর্বে বাসরাস্তা। বাড়ির রোয়াকে ব'সেই গুলতানি করছিলাম তিনজনে। চশমাটা নাকের ওপর তুলে সুখেন আনন্দে হাততালি দিয়ে বললো, "আরে তাই তো! বাদলদাই বটে!"
এসব ঘটার মধ্যে মেদহীন, দীর্ঘদেহী, সাদা ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবী পরিহিত, কাঁধে একটি শান্তিনিকতনি কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ সুশোভিত বাদলদা আমাদের কাছাকাছি চলে এলেন।
পলটুর পিঠে একটা আদুরে চপেটাঘাত ক'রে বাদলদা বললো, "থ্রি মাস্কেটিয়ারস! খুব জমিয়ে গুলতানি হচ্ছে দেখছি। এই ভরদুপুরে!"
"আক্"শব্দটি নিক্ষেপ করে পলটু বললো,
"ওসব ছাড়ো। তুমি এই এক সপ্তাহ হলো, এতদিন কোথায় উধাও হয়েছিলে?"
"এত তাড়া কিসের?", আজ সন্ধ্যায় তো সব শুনবি।" পলটুর পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললো সুখেন।
আমিও দলে ভারি হলাম। ভালো দিনে ফিরেছো দাদা। মা আজকেই পাঁঠার মাংসের ঘুঘনি বানিয়েছেন। চ'লে এসো আজ সন্ধ্যায়। আমরা সবাই থাকবো।
কি জানি। হয়তো পাঁঠার মাংসের ঘুঘনি শুনে বাদলদা কী একটু বেশি ব্যাস্ত হ'য়ে পড়লো? অবশ্য মুখে বললো, "সে সব পরে হবেখন। আগে বাড়ি যাই। একটু ফ্রেস হই আগে। ওদিকে আবার পিসিমা কেমন আছেন কে জানে। এই বলে আমাদের চক্রব্যূহ থেকে বেড়িয়ে একবারও পেছনে না তাকিয়ে বাড়ির দিকে পিঠটান দিলো বাদলদা।
পর পর তিন প্লেট ঘুঘনি খাওয়ার পর পেল্লাই একটা ঢেকুর তুলে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বাদলদা বললো, "দুপুরে তোরা তিন মক্কেল কী নিয়ে আলোচনা করছিলি?"
"সিনেমা।" ব্যাপ্ত করলো পল্টু। "ভূতের ছবি লেগেছে ছবিঘর সিনেমা হলে।"
"কাল তো রবিবার। সবার ছুটি। চলো না, কাল সবাই মিলে সিনেমা দেখে আসি।" সুখেন তার সুখের দৃষ্টি দিয়ে যথারীতি নাকের ওপরে চশমাটা তুলে দিয়ে বললো।
এবার বাদলদাকে কিছু বলতে হয়। বললেনও। কিন্তু তাতে যেন আমাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়লো। "সিনেমা?, ভূতের ছবি?
সিনেমা তো আমি দেখি না। তোরা যেতে চাইলে যা না। দেখে আয়।"
যা ব্বাবা! সিনেমায় আবার এলার্জি কিসের তোমার? অবাক হয়ে বললাম। আমার কথা শুনে সোজা চোখে কয়েক মুহুর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল বাদলদা। একটু থেমে বললো, "সিনেমা? বহুদিন হলো সিনেমা যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি বিশেষ একটি কারণে। তার ভয়াবহতা শুনলে তোরা ভয় পাবি না তো?
আমরা সমস্বরে বললাম, "না।"
"বলছিস? বেশ তাহলে বলি, শোন্।" বাদলদা গল্প বলা শুরু করলো। "তোরা তো জানিস, আমি খুব ছোটবেলা থেকে পিসিমার কাছে মানুষ। তখনও পিসেমশাই বেঁচে ছিলেন।
আমার বয়স তখন তোদের মতো। এই কুড়ি বাইশের ভেতর। সেই সময় থেকে বছর দুয়েক আগে স্টেশনের কাছে 'চিত্রকুটির' নামে একটি নতুন সিনেমা হল চালু হয়েছিল। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্স নিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি। কলেজ শেষে...."
"তা তুমি কত অব্দি পড়েছিলে?" ফস ক'রে যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল পল্টু। গল্প বলার মাঝে হঠাৎ বাধাপ্রাপ্ত হ'য়ে একটু থতমত খেয়ে গেল বাদলদা। গম্ভীর অথচ দৃঢ়স্বরে বললো, "বিয়েটা কমপ্লিট করেছিলাম।" দুচোখের মাঝামাঝি মনি দুটোকে নিবদ্ধ ক'রে পল্টুর উদ্দেশে বললো, "এ বিষয়ে তোর কোনোরকম সন্দেহ আছে?"
"না, ইয়ে মানে..." কনুই দিয়ে পল্টুকে এক গুঁতো মেরে সুখেন বললো, "তোমার আর মানে মানে করতে হবে না, তুমি বলতো দাদা।"
"সেদিন কলেজে যাওয়ার পথে সিনেমা হলের পোস্টারে দেখলাম ভূতের ছবি এসেছে। ছবির নাম "ভয়"। মনে মনে তখনই ঠিক করে নিলাম কলেজ থেকে ফেরার পথে সেকেন্ড শো দেখে বাড়ি ফিরবো। একটা, চারটে, সাতটা, মোট তিনটে শো দেখানো হত। পিসেমশাই অফিসের কাজে বাইরে ছিলেন। তাই রক্ষা।
আমার সহপাঠী সুবলকে একপ্রকার বগলদাবা ক'রে যথা সময়ে টিকিট কেটে হলে ঢুকলাম। ভূতের ছবি দেখবার দর্শক বেশ ভালোই ছিলো। দুই বন্ধু পাশাপাশি বসেছিলাম।
ভয়ানক ভয়ের ছবি। বিদেশী। হিন্দি ডাবিং।" সুবল একবার ভয়ভীতি গলায় বললো "নাঃ, পয়সাটা দেখছি জলে যায়নি। আমার অবশ্য সেরকম ভয় লাগছিলো না। তবে উপভোগ করছিলাম। বিশেষ ক'রে ছবিটির ব্যাকগ্ৰাউন্ড মিউজিক। সুবল তার সিট কামড়ে আড়ষ্ট হয়ে দুটো হাত বুকের কাছে জড়ো ক'রে চুপ করে বসে দেখছে।
হাফ টাইমে উঠে বাদাম কিনতে যাওয়ার সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার ডান পাশের সিটটি তখনও খালি রয়েছে। একটু আশ্চর্যই হলাম। যাঃ এতক্ষন খেয়াল করিনি। বেশ একটু ছড়িয়ে বসা যেত। দু'ঠোঙা বাদামের একটা সুবলের হাতে চালান ক'রে আমারটা আমার সিটে রেখে পাশের সিটে গুছিয়ে বসলাম। একটা একটা ক'রে বাদাম বিট লবন সহযোগে খেতে শুরু করলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য চেয়ারটাতে বসা মাত্র মনে হলো এক মূহুর্তের শীতল বাতাস যেন আমাকে ছুঁয়ে গেল। ওদিকে আবার সিনেমা শুরু হয়েছে। আরো আশ্চর্যের ঘটনা ঘটলো। পর্দায় যার ছবি ফুটে উঠেছে সে তো আমার খুব চেনা। এ যে বিমল! হিম-শীতল কন্ঠে সে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বললো সে দিনের কথা মনে পড়ে বাদল? সেই যে সেদিন জোর করে আমাকে ভুল বুঝিয়ে ভূতের সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেছিলিস?
মূহুর্তের মধ্যে সব মনে পড়লো। বছর দুই আগে আমরা চার বন্ধু মিলে একটা ভূতের সিনেমা দেখতে ঢুকে ছিলাম। আমি, গোবিন্দ, প্রকাশ আর বিমল। বিমলের ছিলো ভীষণ ভূতের ভয়। ওর সাথে সেদিন নিছক মজার ছলেই ওকে না জানিয়ে সিনেমায় আনা হয়েছিল। যদিও আমার কাছে বিমলের আসার খবর ছিলো না। আমি সিনেমা হলে এসে দেখলাম বিমল এসেছে। টিকিট কাটতে যাবো এমন সময় হঠাৎ দেবু কাকার সঙ্গে দেখা। শিগগির বাড়ি চল। তোর পিসের হঠাৎ শরীর খারাপ হয়েছে। পিসিমা ডেকে পাঠিয়েছেন।
পিসেমশাই হার্টের পেশেন্ট। এর আগে দু'বার হার্ট এ্যাটাক হয়ে গেছে। আমি তড়িঘড়ি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটলাম। দেবুদার সঙ্গে।
"সেদিন সিনেমা হলে আমার সাথে কী ঘটেছিল দেখবি?" আবার সেই হাড়হিম কন্ঠস্বর।
পর্দায় পরিস্কার দেখলাম সেদিনের সেই বীভৎস, মর্মান্তিক দৃশ্য। গোবিন্দ আর প্রকাশের মাঝখানে বসে বিমল। ভয়ে তার বিস্ফারিত মুখ। ভূতের ভয়ে তার সিট ছেড়ে যতবার সে উঠে যেতে চাইছে, ঠিক ততবারই দু'দিক থেকে তার দুই বন্ধু তার দুই হাত শক্ত ক'রে ধরে রয়েছে। বিমলকে উঠতেই দিচ্ছে না। এর মধ্যেই কখন ভয়ে হার্ট ফেল করে মারা গেছে, গোপাল, প্রকাশ কেউ টের পায়নি। বিমলের চোখ তো তখনও খোলাই ছিল। সিনেমার পর্দার দিকে তাকানো অবস্থায়!
-----------------------------------------------------------------
সুব্রত দাস
পোঃ রামঘাট, সূচকঃ ৭৪৩১৬৬, গরিফা,
উত্তর ২৪ পরগণা, ফোঃ ৭৪৩১৬৬
------------------------------------------------------------------