ফেকবুক ক্লাব চালু হয়েছে, আজ বছর পনেরো আগে। তার আগে আমাদের গোটা জীবন ধরে আমরা সামাজিক জীবনে বহু ধরনের ক্লাব, সমিতি, মন্ডলী , আড্ডাখানা ইত্যাদি দেখেছি। সেই সব ক্লাব বা সমিতি রা সমাজ জীবনে একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করত! মানুষ দরকারে, অদরকারে তাদের দ্বারস্থ হত। ইদানীং কালের এক নব্য অ্যামেরিকান যুবক এই ফেকবুক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করল আর সাড়া পৃথিবীতেই এক আলোড়নের সৃষ্টি হল! পৃথিবীর সমস্ত মানুষেরা হুড়মুড় করে তাতে যোগ দিল। কিন্ত কেন মানুষের এই বিপুল উদ্দীপনা দেখা দিল!? তার একমাত্র কারণ মানুষ নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়ে গেল। নিঃখরচায় নিজেকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার এহেন মাধ্যম পেয়ে , বাচ্চা থেকে বুড়ো সবারই আনন্দের অবধি রইল না। সবাই এর সৃষ্টিকর্তার আবিষ্কারে চমৎকৃত হয়ে গেল। তখন শুরু হয়ে গেল নিজেদের ছবি তুলে তুলে এই ফেকবুক ক্লাবে র দেওয়ালে ছেপে দেওয়ার এক প্রানান্তকর প্রতিযোগিতা। সেই সব ছবি যেই মাত্র ছাপা হল, অমনি ফটো র মালিকের পৃথিবী তে যত বন্ধু বান্ধব আছে তারা সবাই জানাতে লাগল, এই ফটো দেখে তাদের কী বিপুল পরিমাণ ভাললাগা জন্মেছে! এই ক্লাবের অলিখিত নিয়ম অনুসারে, তুমি যদি আমার ছবি পছন্দ না কর, তাহলে আমিও তোমার ছবি কদাপি করব না! একটা ঠান্ডা রেষারেষি র সূত্রপাত ঘটতে লাগল এই ক্লাবের জগতে। যদি নিতান্ত খেঁদা নাকি মহিলার ছবি দেখে, তুমি প্রশংসক না হতে পার তাহলে তোমার মিষ্টি ছবি দেখেও কেউ উচ্চবাচ্চ করবে না। শুধু চুপচাপ দেখে যাবে। আজকের পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষ এখন ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত তার সমস্ত কার্য কলাপে র বর্ণনা ছবি সহ এখানকার দেওয়ালে ছেপে দিচ্ছে। একমাত্র কিছু দৈনন্দিন গোপন কাজ এখনও এখানে স্থান পায়নি। তাতে ও বন্ধুদের প্রশংসা পাবে কিনা, সে বিষয় টা এখনও সংশয়াধীন ! লোকে দন্ত মন্জন করাকালীন হয়তো নিজেকে তুলে ধরল তার চালাক ফোনের ক্যামেরায়! মূহুর্তে র মধ্যে তার বন্ধু তালিকার বন্ধুরা বলে দিল, তাকে এই ভঙ্গি তে কী অপরূপ সুন্দর লাগছে। তবে এই প্রশংসা পাওয়ার জন্য তোমাকে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে আগে। তোমাকে ও বসে বসে ধৈর্য ধরে তাদের সব অখাদ্য ছবি গুলো দেখতে হবে এবং শুধু দেখলে হবেনা, তোমার ভয়ঙ্কর মূল্যবান প্রশংসায় তাকে ভরিয়ে দিতে হবে। তা যদি করতে না পার, তাহলে এ জগতে তুমি ব্রাত্য হয়ে গেলে! তখন তোমার প্রকৃত ভাল ছবি তে ও কেউ কিচ্ছুটি বলবে না! সব জায়গাতেই একটা নিয়ম শৃঙ্খলা থাকে, এখানে এগুলোই নিয়ম! এখানে প্রত্যেক এর নিজের দেওয়াল আছে, তার মানে একটা ঘর ও আছে, যাকে এখানকার ভাষায় বলে 'প্রোফাইল'। সেই ঘরের মালিক স্বাভাবিক ভাবেই তুমি, তাই সে ঘরে বসে যা ইচ্ছা তাই, তুমি করতেই পার! সে অধিকার তুমি, ফেকবুক ক্লাবে যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে গ্যাছো! অনেক টা জন্মগত অধিকারের মতই। তাই তুমি রোজ তোমার শ'খানেক ছবি তোমার ঘরের দেওয়ালে যদি ঝুলিয়ে দাও, তাতে কারো কিচ্ছু বলার নেই! তাও আবার নিঃখরচায়! কাগজে ছবি ছাপাতে গেলে অনেক পয়সা লাগে আর তুমি যখন সেলিব্রিটি নও তখন কাগজ ওয়ালা রা তোমার ছবি ছাপবেও না। এই দুনিয়ার বন্ধুদের হয়তো তুমি জীবনেও চোখে দেখোনি কিন্ত তাদের ছবির মাধ্যমে তাদের হাল হকিকত মোটামুটি তোমার জানা! কে কখন হুশ করে ফ্লাইটে চেপে কোন দেশে ফ্লাই করে সেটা সে নিজেই সবাইকে জানিয়ে দেয়, এটা কে বলে আপডেটেড হওয়া বা করা। এটা নাহলে তুমি এযুগে অচল! তুমি হয়তো এত ভাল করে তোমার বাড়ীর লোকের খবর ও রাখো না। একটু যদি তোমার রূপ ব্যতিত কোনও গুন থেকে থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। সব কিছুই সেই চালাক ফোনের দৌলতে তুমি ছবি তুলে বা ভিডিও করে তুলে ধরতে পার! তারপর শুধু অপেক্ষারত অবস্থান! কজন সেই ছবি বা ভিডিও পছন্দ করল, তা বসে বসে গুনতে থাক! তারপর তাদের প্রত্যেকের পছন্দের পেছনে তুমি আবার তোমার ভাললাগা জানাও! এইরকম ভাবে দিনের অনেকটা সময় যদি তুমি এখানে দিতে পার তাহলে তোমার ও দিন টা বেশ কেটে গেল! তোমাকে হয়তো সাজলে গুজলে বেশ দেখায়, আবার ফটো তে আরও ভাল, কিন্ত সামনাসামনি এত প্রশংসা র বন্যা তো কখনোই কেউ পায়না, তাই এহেন সুযোগ হাতছাড়া করাটা নিরেট বোকামি! এই ফেকবুক ক্লাবের আবির্ভাব একটা নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে সাড়া পৃথিবীর সামাজিক জীবনে। পরবর্তী কালে যখন ইতিহাস লেখা হবে তখন, এইভাবে লেখা হবে , প্রাক ফেকবুক এরা (era) আর পশ্চাৎ ফেকবুক এরা! মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এটি একটি মাইলস্টোন হিসেবেই লিপিবদ্ধ হবে কারণ মানুষের চরিত্রের মধ্যেই আস্তে আস্তে একটা বদল ঘটিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে ফেকবুক! মানুষ প্রাক ফেকবুক কালে বেশ সহজ সরল জীবন যাপন করত, নিজের ঢাক নিজে পেটানোর এই পেটেন্ট যখন হাতের কাছে পেল, তখন থেকে তার চরিত্রের আমূল পরিবর্তন হতে থাকল! কেউ আর ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকার ভুলটা করতে চাইলো না। আত্মমগ্নতার ভ্রান্ত বাতাবরণ তৈরী করল না ! এখন সে যা কিছুই করবে, তাতে সে অন্য কে তাক লাগিয়ে দেবে। শুধু আনন্দ পাওয়ার খুশী তে সে আর খুশী নয়, যদি অন্য কে সেই খুশী না দেখাতে পারি তাহলে তো সেই আনন্দ পাওয়া বৃথা হয়ে গেল ! শতকরা আশি ভাগ লোক এখন এই দলে। আমার কত সুন্দর বাড়ী, কত ব্রিলিয়ান্ট ছেলেমেয়ে, কী অসাধারণ আমার সব কিছু, এ যদি আমি সবাই কে নাই দেখাতে পারি তাহলে তো এসব পেয়ে আমার কোনও লাভই হলনা! বাকী কুড়ি শতাংশ মানুষ এখনও এই দলের বাইরে, নিজের জীবন, নিজের আনন্দ, হামলে পড়ে অন্য কারু সাথে ভাগ করার স্পৃহা তাদের নেই। কিছু মানুষের এখনও ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও চালাক ফোন নেই। তারা একটু বিরল জাতের প্রাণী। এখনও তারা বই পড়ে সময় কাটাতে বা শুধু গান শুনে সময় কাটাতে বা আকাশের তারা গুনে দিন কাটাতে পছন্দ করেন! আজকাল হরবখত চোখে পড়ে যায়, কাছের মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা টা এত বেড়ে গেছে যে, পাশাপাশি, ঘেঁষাঘেষি করে একঘরে থাকা স্বত্বেও, তারা আর ঘরের মধ্যে বসে জন্মদিন বা বিবাহ বার্ষিকী র ভালবাসা জানাতে পারছে না কারণ তাহলে তো পৃথিবীর বাকী মানুষ দের সেটা জানানো গেলনা ! তাদের ও তো জানাতে হবে যে ,পাশের ঘরে থাকা পুত্র কে সে কী পরিমাণ ভালবাসে! স্বামী হয়তো স্ত্রী র সঙ্গে রাতদিন খেঁচাখেঁচি করছে কিন্ত ফেকবুকের দেওয়ালে লিখছে, এই স্ত্রী তার জীবনে না এলে তার জীবন হয়ে যেত অন্ধকার ! সেইসঙ্গে তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ, মাখোমাখো প্রেমের চারটে ছবি ও আটকে দিল! ব্যস, তারপর আর যায় কোথায়! যে জন্য এই ক্রিয়া কলাপ, তা সার্থক হতে শুরু করল! তার বন্ধু তালিকার বন্ধুদের মধ্যেও একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল, কে কত ভাল ভাল প্রতিক্রিয়া দিয়ে, বাহারী মন্তব্যে ছয়লাপ করে দেবে। এরপর আজকাল আবার যেমন আনন্দের ফোয়ারা ছোটানো হয়, তেমনি দুঃখের ও। আমি আমার বাবা বা মা'র মৃত্যু তে ঠিক কত টা দুঃখ পেলাম, সেটা যদি আমি ফেকবুকের দেওয়ালে না লিখতে পারি, অন্য লোককে যদি নাই জানাতে পারি, তাহলে তো আমার এই দুঃখ পাওয়াটাই বৃথা হয়ে গেল। আমি এরকমও দেখেছি, একজন তার শাশুড়ীর সদ্য মৃত চেহারার সঙ্গে তার স্ত্রী র যন্ত্রনায় ভেঙে পড়ে উৎকট কান্নার গোটা দশেক ছবি এবং ভিডিও ফেকবুকের দেওয়াল জুড়ে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন ! এতাবৎ যেসব ছবি, পরিবারের চৌহদ্দির মধ্যেই ব্যাক্তিগত হয়ে থাকত, আজকাল তা জনতার দরবারে মুহূর্তেই প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। এতকাল মানুষের বিশেষ গুণ প্রকাশিত হওয়ার মাধ্যম হিসেবে ছিল খবরের কাগজ বা পত্রিকা তথা প্রিন্ট মিডিয়া। তারপর পরবর্তী কালে বেতার তরঙ্গ আবিষ্কারের সূত্রে এল রেডিও, সেখানেও মানুষের নিজেকে প্রকাশিত করার সুযোগ থাকত, এখনও থাকে। প্রাক নিউজ পেপার বা রেডিও যুগে মানুষের জীবন যাপন নিশ্চয়ই আরও সরল ছিল! এনটারটেনমেন্টের সুযোগ ও ছিল খুব সীমাবদ্ধ। আমরা জন্মেছি এই দুই যুগের পরবর্তী সময়ে। আমাদের জন্মের পরে পৃথিবীতে নতুন যুগের সূচনা হল ইলেকট্রনিক মিডিয়ার হাত ধরে। সেখানে একে একে এল টেলিভিশন এবং মোবাইল। এই দুটি জিনিসের আবিষ্কার এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিল সমাজ জীবনে।
মোটকথা হল, মানুষের জীবন থেকে গোপনতা হারিয়ে যাচ্ছে, গভীরতা র কথা তো বাদই দেওয়া ভাল। মানুষ মানসিক ভাবে হালকা হয়ে যাচ্ছে। এখন আর ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কিছুই থাকছে না। এটা ভাল হচ্ছে নাকি খারাপ, তা মনস্তাত্বিক বা সমাজবিদ রা বলতে পারবেন। হয়তো হতে পারে, মানুষের জীবন থেকে চিরকালের মত হারিয়ে যাবে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি, মহান কোনও শিল্প বা ভাস্কর্য আর তৈরী হবেনা, কারণ তার জন্য যে সময় দিতে হবে তা আর মানুষের হাতে থাকবেনা। মানসিক যে এষনা, বৃহৎ সৃষ্টির জন্য দরকার হয় তা আর অবশিষ্ট থাকবেনা। যদি না আবার সামাজিক জীবনের এইসব চাহিদা গুলোর থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে পারে, কারণ ভোগের শেষে ই ত্যাগের শুরু। মানুষ এখন আরও আরও চাহিদার যুগে। বহির্মুখী, বানিজ্যিক এবং ভোগ কেন্দ্রিক সমাজের চূড়ান্ত অবস্হায় বিরাজ করছে সবাই। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ কোনদিকে, একথা কারুর সঠিক জানা নেই।
* মাসিক কথাকাহিনি অনলাইন গল্পপত্রে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বক্তব্যের সম্পূর্ণ দায়ভার সংশ্লিষ্ট লেখক/লেখিকার; পত্রিকা সম্পাদমন্ডলী বা প্রকাশকের নয়। আমরা বহু মতের প্রকাশকমাত্র।
** প্রতিটি লেখার কপিরাইট সংশ্লিষ্ট লেখক/লেখিকার। কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ উঠলে তার সম্পূর্ণ দায়ভারও সংশ্লিষ্ট লেখক/লেখিকার।