অণুগল্প ।। নাগরদোলা ।। সুমন্ত কুন্ডু
নাগরদোলা
সুমন্ত কুণ্ডু
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায় । মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বিশয়চিন্তা । যাচ্ছি মহাজনের বাড়ি, মোটা টাকর তাগাদার ব্যাপার আছে ।
-'কি রে বুবুন কেমন আছিস !'
পিছন থেকে আচমকা ডাক । ঘুরে তাকালাম । একটা ক্ষয়াটে চেহারার মানুষ । চোখের নীচে কালি । চেহারায় বিবর্ণতা । অবিন্যস্ত পোশাক । দেখেই বুঝলাম লোকটার নিদারুণ অর্থনৈতিক দুর্দশা চলছে । তবুও ঠিক চিনতে পারলাম না । লোকটাও আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল -চিনতে পারিস নি। আমি ভোলাদা । সাউথ পার্কের ভোলাদা রে ।'
থমকালাম ! চেনা চেনা লাগছিল বটে । স্মৃতির কোন এক অতলে রয়ে গেছে হয়ত স্মৃতিচিহ্ন । নামটা বলতে মনে পড়ল । ভোলাদা, আমার একসময়ের রিয়েল হিরো । সাউথ পার্কের মাঠে একসময় খুব খেলাধুলা করেছি । মূলত ফুটবল । ভোলাদা ছিল আমাদের কোচ, কাম ম্যানেজার কাম গাইড । সুঠাম চেহারা, দীপ্ত চোখ আর তারুণ্যের উজ্জ্বলতায় ভরা এক ধারালো মানুষ । ওনাকে শুধু কোচই না প্রায় আমাদের গুরুদেব বলে মানতাম । আমাদের সময়ে সাউথ ক্লাব যে কয়টা ট্রফি জিতেছে তারবেশিরভাগই ভোলাদার আমলে । বয়েসে আমাদের চেয়ে বছের কয়েরই বড় । নিজে খেলতো না বটে কিন্তু টিম সিলেকশান থেকে টিম পরিচালনা, টুর্নামেন্ট অরগানাইজ করা থেকে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করা সবই সামলাতো ভোলাদা ।
সেদিনের সেই ভোলাদা , আর আজকে দাঁড়ানো এই ছেঁড়াখোঁড়া লোকটা মেলাতে পারছিলাম না ।
আমি বললাম 'অনেকদিন পরে দেখা, তোমার চেহারার যা হাল, চিনতে না পারাই স্বাভাবিক।'
ভোলাদাও একটু হাসল, বোধহয় নিজের ওপরেই ।
'তুই তো ব্যস্ত মানুষ এখন দেখা আর হয় কই । তোকে দেখে ভালো লাগে, বাবার ব্যসবসাটা নিজে হাতে চালাচ্ছিস । নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছিস ।'
কথাটা মিথ্যে নয় । বাবার ব্যবসাটার হাল আমিই ধরেছি এখন । রোজগার মন্দ হয় না । মেনমার্কেটে দোকান, জনাছয়েক কর্মচারী কাজ করে ।
-তুমি কি করছ আজকাল । ক্লাবের দিকে আর যাও নাকি !' আমি আলগোছে প্রশ্ন ছুড়লাম ।
- নারে আর ক্লাব কোথায় । ওসব ছেড়ে দিয়েছে কতকাল হয়ে গেল' বলে ভোলাদা একটু থামলো ।
আমার বাস এসে গেল । তৎক্ষণাৎ আর কিছু বলার না পেয়ে বাসে ওঠার জন্য এগিয়ে গেলাম ।
-ভাই বুবুন আমার জন্য কাজ দেখে দিবি ভাই । তোদের দোকানে যদি কর্মচারী লাগে দেখিস না । খুব বিপদে পড়ে গেছি রে ভাই । কাজটাজ নেই একদম, রোজগারপাতি বন্ধ, সংসার চলে না ।
আচমকা কথাটা বলেই আমার হাতটা চেপে ধরল ভোলাদা । এমন অসহায় মানুষ জীবনে আর কখনও দেখিনি । বেশ কিছুক্ষণ স্থির মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে রইলাম । আমার যৌবনের রিয়েল হিরো এই মুহুর্তে কি অসহায়, কি দুর্বল, কি বিপন্ন । জীবনের কি বিচিত্র রুপ । অজানা একটা ভাবনা উগরে এলো বুকে । কিছু না বলেই বাসে উঠে পড়লাম । বাস ছেড়ে দিলো । ভোলাদা উৎসুক চোখে বাসের দিকে তাকিয়ে আছে । বাস চলে যাচ্ছে দূরে, তবুও তাকিয়েই আছে ।