ধারাবাহিক উপন্যাস।। পরজীবী- তৃতীয় পরিচ্ছেদ ।। অভিষেক ঘোষ
পরজীবী
অভিষেক ঘোষ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
২০১৫
"তুই মিলিয়ে নিস্, তোর বিয়ে ফিয়ে কোনোদিনও হবে না ।"
"ছিঃ কেন একথা বলছিস ?"
"কারণ আছে... তুই মন থেকে কী চাইছিস, নিজেই কোনোদিন বুঝে উঠতে পারলি না.. এটা হল প্রধান কারণ ।"
"যাহ্ সবসময় এরকম হয় না । কিন্তু সমস্যা হল, যাকেই দেখি তাকেই ভালো লাগে । আমার মনটা খুব বড়ো রে... সমুদ্রের মতো.. কেউ বোঝে না ।"
"সেই ! তা হঠাৎ করে মাথায় ডকুমেন্টারি বানানোর শখ চাপলো কেন ?"
"হঠাৎ ! হঠাৎ করে তো না.. অনেকদিন ধরেই ভাবছি ।"
"সেটাও আমাকে অন্য লোকের মুখ থেকে শুনতে হয়েছে । নিজে থেকে তো কিছু বলিস নি । তা তোর অফিস ছাড়বে তোকে ?"
"ধুর ওটাকে একটা অফিস বলে ? আজ এখানে যাও... কাল সেখানে ছোটো... সেই ভোরবেলায় চলে যাও পাসপোর্ট অফিসে । দু-দিন ভালো করলে, তো প্রশংসা । তারপর একটু পিছলে গেলে, তো গালিয়ে ভূত ভাগিয়ে দেবে । আজ যে রাজা, কাল সে ফকির । টাকা দেওয়ার সময় খালি ফাঁকি দেওয়ার তাল । এটা একটা কাজের মতো কাজ ? বেনিয়মটাই শালাদের নিয়ম ! একটা ভালো কিছু পেলেই ছেড়ে দেবো ।"
"উফ্ ! পার্থ ! এতো অভিযোগ করিস না তুই ! শহরটা কতো ভালো করে চিনলি বলতো ? পায়ে হেঁটে ঘুরলি বলেই না ! তা কোথায় যেন যাচ্ছিস ক্যামেরা নিয়ে ?"
"বেশি দূর না । শিয়ালদা থেকে ঘন্টা আড়াই মতো । গ্রাম এরিয়া । দুর্গা পুজোটা পুরোনো । বাড়ির পুজো । যোগাযোগটা হয়ে গেল । ভাবছি চলেই যাই । এই সুযোগ আর পাবো না । সেলস্-এর কাজ করে করে মনটা ঘেঁটে যাচ্ছে, সারাক্ষণ টেনশন কাজ করে... অমুক তো ফোনটা করল না.. খালি পার্টিকে তাগাদা দাও । বস্ আবার কী বলবে ! এর থেকে একটু বেরোতে পারলে বাঁচি ।"
"বুঝলাম । তা নাম কী জায়গাটার ?"
"নাম ? তা ধর্ সুন্দরপুর ।"
"ধ্যাত্ ধর্ আবার কি ! বল না, কী নাম ?"
"বললাম তো সুন্দরপুর । সত্যি, ওটাই নাম ।"
"কবে যাবি ?"
"অষ্টমীর দিন, সকালে ।"
"সেই পুরোনো হ্যান্ডিক্যামটা নিয়ে ? একটা DSLR জুটল না ?"
"নাহ্ পয়সা নেই রে । তোর বাবাকে বল না হাজার আশি মতো পণ দিতে । হামি তো গরিব আদমি আছি ।"
"আমার বাবার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই 'গরিব আদমি'-র হাতে মেয়ে দেবে ?"
"তাও বটে ! মেয়ের বাবার মন কখনও 'আসান' হয় না... সবসময় পাষাণ-ই হয় ।"
"এই ! ভুল বকাটা বন্ধ কর্ তো । বরং তোর বর্ধমানের গল্পটা বল তো, শুনি ।"
"ওরে বাবা ! সে তো লম্বা গল্প !"
"কবে থেকে বলবি বলবি করে আর বলছিস না । এর'ম ঝুলিয়ে রাখলে ভাল্লাগে না । বলবি তো বল্... না বললে, বলিস না । এই আমার বাস এসে গেছে । তুই তো কিছু বলবি না ! যাই তাহলে ?"
"যাই বলতে নেই ! বল আসি !" - চোখ মেরে বলে পার্থ । বাসের পাদানি-তে পা রাখতে রাখতেই তৃষা-র হাতের চড়টা বাম বাহুতে অনুভব করে পার্থ । তারপর বাসের ভিড়ের মধ্যে একটা পাঁচ ফিট পাঁচ হাইটের সবজেটে টপ আর ব্লু জিনস্ হারিয়ে যায় । বাসটা ছেড়ে দিতেই পার্থও হাঁটা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে । হাঁটতে হাঁটতেই ফিরবে সে । এখন অভ্যেস হয়ে গেছে, টাকা বাঁচানো আর চলতে চলতে চিন্তা । একটা ফুড স্টলে থামে সে । বেশ ভিড় আছে দোকানটায় । জিজ্ঞাসা করে ফ্রায়েড মোমো হবে কিনা... হবে শুনে অর্ডার দেয় । কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষার পর হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, "দাদা ছেড়ে দিন, একটু তাড়া আছে.." বলে এগোতে থাকে ভবানীপুরের দিকে । রাস্তায় ডালমুট কিনে নেয় ।
গতবছরের আগের বছর চৈত্র মাসে পার্থ গিয়েছিলো বর্ধমানের কুরমুন গ্রামে । গত বছরও গিয়েছিলো বন্ধুদের সাথে । কিন্তু প্রথম বারের সাথে, গত বছরের অভিজ্ঞতার বেশ ফারাক । তার কারণও আছে অবশ্য । এই গ্রামটা ভারী অদ্ভুত । প্রতিবছর শিবের গাজন উপলক্ষ্যে গ্রামে প্রচুর জনসমাগম হয় । গ্রামে দুটো বহু প্রাচীন মন্দির আছে - একটা হল ঈশানেশ্বর মন্দির, মন্দিরে রয়েছে শিবলিঙ্গ, এলাকার শৈব ভক্তরা এই দেবতাকে অত্যন্ত জাগ্রত বলে মনে করে । চৈত্র মাসে এই শিবের গাজন হয় । এছাড়া রয়েছে দুলে পাড়ায় কালাচাঁদ ধর্মরাজ মন্দির । এই কালাচাঁদের গাজন হয় সাধারণত বুদ্ধ পূর্ণিমার সময় । শিবের মন্দিরে একটি প্রাচীন প্রস্তর মূর্তি আছে, নাম সপ্তমাতৃকা ইন্দ্রানী । শৈব ও শক্তির উপাসকদের ধর্ম-ভাবনার যৌথ প্রভাব তাতে রয়েছে বলে মনে করা হয় । যাই হোক্… কুরমুন গ্রামের ওই চৈত্রের গাজন আর পাঁচটা গ্রামের গাজনের থেকে অনেকটাই আলাদা । ওই সময় মাঠে খেউড়ের আসর বসে আর ওই গ্রামে একটা অদ্ভুত ধর্মানুষ্ঠান হয়, ইংরেজিতে যাকে বলা চলে 'Ritual' । পার্থ সবান্ধবে গাড়ি নিয়ে, সেসব দেখে এসেছিলো । প্রথমে কোনো হোটেলে থাকবে বলে ভেবেছিলো ওরা, অবশ্যই সেটা গ্রাম থেকে অনেক দূরে হাইওয়ের কাছে । কিন্তু গ্রামে গিয়ে এক ডাক্তার বাবুর সাথে আলাপ হয়ে যায় ওদের । তিনিই জোর করে ওদের চার বন্ধুকে নিয়ে গিয়ে তোলেন এক সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি । ডাক্তারবাবু অত্যন্ত মিশুকে । তাঁর তত্ত্বাবধানে সেখানেই থাকা-খাওয়া সব ব্যবস্থা হয়ে যায় । ওই সময়ে গ্রামে ফটোগ্রাফারদের একেবারে লাইন লেগে যায় । ডাক্তারবাবু নিজে শখের ফটোগ্রাফার । দেখা গেল, তিনি গ্রামের অনেককেই চেনেন । এবং ডাক্তার বলেই হয়তো তাঁকে এলাকায় সবাই খুব খাতির-যত্ন করে । তবে ভদ্রলোক এলাকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে কোনোভাবেই মাথা গলান না, তিনি শুধুই ঘুরে ঘুরে ফটো তুলতে আগ্রহী । গতবছরও, গ্রামে চৈত্র-শেষের ওই গরমের মধ্যেও ভোরবেলা থেকে সন্ন্যাসীদের নাচ শ্যুট করেছিলেন তিনি, তারপর বেরিয়ে যান । প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো ওই নাচে শৈব ভক্ত-সন্ন্যাসীরা বৈষ্ণবদের হারানোর প্রতীকী উল্লাসে মৃত মানবদেহ থেকে নরমুণ্ড সংগ্রহ করে থাকে, শুনেছিলো পার্থ । পরপর দুবার নিজের চোখে দেখলো । মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনাও থাকে চোখে পড়ার মতো । আশেপাশে সমস্ত বাড়ি থেকে, জানালা বা, ঝুল-বারান্দা, ছাদ থেকে লোকজন গাদাগাদি করে সেই বীভৎস নাচ দেখে । নরমুণ্ডগুলোতে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করা হয়, সেই সঙ্গে গায়েও অনেক রকম রঙিন উল্কি কাটেন সন্ন্যাসীরা । ছবি তুলতে তুলতেই পার্থরা এমন কিছু মন্তব্য করে ফেলে আর এমন কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে এলাকার মানুষকে, যা সম্ভবত তাদের পছন্দ হয় নি । না হওয়াই স্বাভাবিক । প্রাচীনত্ব সাধারণত পৈশাচিক উল্লাসকেও সহনীয় বিনোদনের রূপ দেয় । কিছু দৃশ্য, কিছু শব্দ পার্থদের রুচিবোধেও তীব্র আঘাত করেছিলো, ওই সবের অর্থ বুঝে উঠতে পারে নি তারা । ওই উন্মাদনা ক্যামেরাবন্দি করতে গিয়ে তারা স্বাভাবিক সংযম হারিয়ে ফেলে । অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভোরাই মিছিল দেখে তারা স্তম্ভিত হয়ে যায় । ছোটো বাচ্চাদের মুখগুলো হালকা অথচ উজ্জ্বল নীল রঙে অপার্থিব লেগেছিলো তাদের । তন্ত্রসাধনার ব্যাপারে ওদের কিছুই জানা ছিল না । কিন্তু মড়ার মাথার খুলি ছাড়াও এমন কিছু ব্যাপার ওদের দৃষ্টিগোচর হয়, যা ওদের হতবাক করে দেয় । মানুষের সমবেত জয়ধ্বনিতে তখন আকাশ-বাতাস কাঁপছে । একজন শিবের মতো বাঘছাল পরে, ত্রিশূল নিয়ে হাজির হতেই গ্রামের মহিলারা হাত জোড় করে লোকটির পায়ে প্রণত হতে থাকে । ওদিকটায় বহুরূপীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি এখনো কতটা, এও তাদের অজানা ছিল । ভক্তরা মাটি মেখে মাটিতেই গড়াতে থাকলে জনতা তাদের ঘিরে ধরে, কাঁসি-ঘন্টা বাজতে থাকে একসুরে । একটা আশ্চর্য উন্মাদনার আবহ তৈরি হয় চারিপাশে । পার্থরা সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলো প্রথমবার । তেমনি ভক্তদের হাত থেকে ঝুলন্ত রঙ-মাখা নর-করোটির ভয়াবহতাও তারা ভুলতে পারে নি । সেবার রাতে গৃহস্বামী নকুলবাবু সাদরে ডাক্তার বাবুর সাথে তাদেরও পংক্তি-ভোজন করান । ভাতের সাথে গরম গরম পাঁঠার মাংসের ঝোল । অন্য সময় হলে জমে যেতো । কিন্তু তারা সেই রাতে যেন তৃপ্তি করে খেতেই পারে নি, একটা অস্বস্তি কিছুতেই যাচ্ছিলো না । পরদিন সকাল ন'টা নাগাদ ওরা বেরিয়ে পড়েছিলো । এই ডাক্তার বাবুই সেবার পার্থ-কে সুন্দরপুর গ্রামের ঠিকানা দিয়েছিলেন ও দুর্গা পূজার সময় ওখানে গিয়ে ডকুমেন্টারি তুলতে উৎসাহিত করেছিলেন । ফোন নম্বর আর ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলেন । সেবার ডাক্তার মুখার্জির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেলেও কোনো আশ্চর্য টানে ফের গতবছর তারা চারজন কুরমুনে গিয়েছিলো । কিন্তু ফল ভালো হয় নি । সেই অতিথি-বৎসল গৃহস্বামী যেন এবার বেশ ক্ষুণ্ন তাদের আগমনে । কেউই তাদের সেভাবে আগের মতো খোলা মনে আপ্যায়ন করেনি । ডাক্তার মুখার্জিরও এবার থাকার সুযোগ হয় নি, তিনি নিজেই কাজের চাপে দুপুর নাগাদ চলে গেলেন । ফলে তারা চারজন অসহায় বোধ করে । গ্রাম থেকে দূরে একটা হোটেলেই রাত কাটায় । তারপর একটু ঘোরাঘুরি করে, ফিরে আসে । তৃষা-কে এসব না বললেও, পার্থ সেই স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে বারেবারে নাড়াচাড়া করে চলে, নিজেই বিরক্ত হয়, কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারে না ।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
ট্রেনে উঠে বসার জায়গা পেয়ে যাবে, ভাবতে পারে নি পার্থ । তার কারণ যত সময় যাচ্ছিল ভিড় বাড়ছিল, জিন্সের ফাঁকে পার্থর পা-দুখানাও ক্রমশঃ ভারী হচ্ছিল । এক-একদিকের সীটে চারজন বসেছে, মধ্যিখানের সরু একজনের দাঁড়াবার মতো প্যাসেজে পার্থ-সহ আরো ছয়জন দাঁড়িয়ে । ক্লান্ত আর ঝুলন্ত হাতের ফাঁকে হাত গলিয়ে উপরে ধরার যোগ্য অবলম্বন পায় নি পার্থ । বাঙ্কেও ভর্তি মালপত্র । তাই কোনো নিত্যযাত্রীর লাগিয়ে রাখা হুকে আরো তিনজন যাত্রীর ব্যাগের সাথে পার্থর ব্যাগটাও ঝুলছে আর দুলছে । ট্রেনে চড়তে হয় তাকে কালেভদ্রে । তাই এই ঠাসাঠাসির মধ্যে সে পার্শ্ববর্তী শরীরগুলোর ভরসাতেই নিজেকে ছেড়ে দেয় । ভাবনায় পড়ে, তাহলে প্রতিদিন কত লোক শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চাপে ? পঞ্চাশ হাজার ? এক লাখ ?
কিন্তু গোটা সাতেক স্টেশন যেতেই হাজার-লাখের চিন্তা উবে যায়, কারণ সামনে একজন উঠতেই পার্থ সীট পেয়ে যায় । প্রায় দু-ঘন্টার রাস্তা, তার পর অটো বা, ট্রেকার । ওদিকটা কেমন… কে জানে ? তার গন্তব্য সুন্দরপুর, যাকে বলে বর্ধিষ্ণু গ্রাম । ট্রেন পরিষেবা আছে মানে দোকানপাট ও আছে নিশ্চই । এরকম দুম্ করে লোকের বাড়ি গিয়ে পড়া মানে তাঁদের অসুবিধেয় ফেলা । চেনা নয়, জানা নয় । তাছাড়া বাড়ির পুজোর ব্যস্ততা । দেখা যাক্ । একটাই সুবিধে, ফোকটে প্রচার সবাই চায় । তাই কাউকে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে দেখলে অনেকেরই মনে একটা আশা জাগে, এটা বলে বোঝানো যাবে না । তবে সেখানেও নিশ্চই এখন হাতে-হাতে স্মার্ট ফোন, আশা কি এখনও জাগে ? নাকি যে যার মতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ?
পেয়ারাওলা, বাদাম-ডালমুটওলা, লাইটার সারানেওয়ালা, বক্স লাগিয়ে গান শোনানেওয়ালা ('আমরা অমরসঙ্গী…' ইত্যাদি), টাইগার বাম-ওলা ইত্যাদিরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যাত্রীদের কাছে পৌঁছানোর অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন । অন্যের এঁটো ভাঁড়ে চা খাওয়ার মতো এই জীবন । সে নিজেই মাস আষ্টেক রয়েছে একটা এজেন্সিতে, ট্রাভেল এজেন্সি । দশটায় ঢুকতে হয় অফিসে, ডেইলি সেলস্ রিপোর্ট লিখে কতক্ষণে বেরোতে পারবে, তার ঠিক নেই । সে যেরকম ভেবেছিল, কাজটা সেরকম নয় । সে ভেবেছিল, এজেন্সির কাস্টোমার চেইন আছে, তাদের নিয়ে নানা রাজ্যে শুধু ঘুরে বেড়াতে হবে । সেইটাই ছিল তার ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নেওয়ার মূল কারণ । কিন্তু দেখা গেল, কাজটা দোরে দোরে ধাক্কা খাওয়ার । তবু কলকাতা শহরের বড়ো বড়ো অফিস বা, ব্যাঙ্কে গেলে কিছু কাজ হয় । কিন্তু একবার সল্টলেকে গেলেই হয়েছে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট কি অ্যায়সি কি ত্যায়সি । কেউ কথা রাখে না । দেখা করবে বলে ঠায় বসিয়ে রাখে । এর চেয়ে অনেক অনেক ভালো হাওড়া ডি.আর.এম., স্টেট ব্যাংক এল.সি.পি.সি., জীবনসুধা, জীবনদীপ, ম্যাগমা হাউস ইত্যাদি । ওইসব জায়গায় গেলে কাজ হয় । কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে অভিজ্ঞতার অভাব আর চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা । তোমাকে খুঁজে বা, বেছে নিতে হবে সেই লোকটাকে, যে বেড়াতে যাবেই । নয়তো একগাদা কাস্টোমারের নাম লিখে, তাগাদা দিয়ে দিয়ে হা-ক্লান্ত হয়ে পড়তে হবে । আর মাসের শেষে মাত্র দু-হাজার টাকা ধরিয়ে বস্ বলবে, ‘আসুন’ । এই 'আসুন' মানে 'গেট আউট' । আর ভাগ্য এখানে নাগরদোলা । এই মাসে তুমি সেরা তো পরের মাসে পিছনে দুই লাথ্ । আর এই লাথ্ শুধু মুখে নয়, পকেটেও । এছাড়া মুখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া আছে, সরাসরি অপমান আছে । এদিকে কমিশনের লোভে ভুল লোককে ফোন করে করে বিরক্ত করাও আছে । কিন্তু দেখা যায়, তারা যাবে না কোথাও । বুঝতে ভুল হয়েছিল । দেখে শেখা যায় না, শিখতে হয় ঠেকেই । তারপর সুযোগ এল, উত্তরাখণ্ড ভ্রমণের । ভোর সাড়ে চারটের উঠে পাঁচটায় বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে কিছুতেই ট্যাক্সি পায় না । তারপর কোনোমতে ছ'টা নাগাদ হাওড়ায় ঢোকে বাসে । ওমা ! লেট হয়েছে তার, সে কোথায় ভাবছে স্টেশনে ট্রেন দিয়ে দিয়েছে... চাপ হয়ে গেল ! গিয়ে শুনলো, ট্রেন পাক্কা বারো ঘন্টা লেট ! লে হালুয়া ! নাও এবার বোঝো ঠ্যালা । ফলে ট্যুরটাও সে-বারে কম্রোমাইজড্ হলো... এজেন্সির খরচা বাড়লো হু-হু করে । এর অর্থ হলো, পার্থর পেটে লাথ্ । তারপর মাঝরাতে ট্রেন পৌঁছালো, ঘুমের সাড়ে সব্বোনাশ ! সর্বক্ষণ হাসিমুখে পার্টি নিয়ে ঘোরাঘুরি তো আছেই, তার উপরে যদি চারতলা হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে রান্না আর ছাতে পার্টির নৈশভোজ হয় - মানে তুমি গেলে ! ওই খাবার-ভর্তি গামলা আর বালতি নিয়ে পাহাড়ে পঞ্চাশবার সিঁড়ি ভাঙা মানে শরীরের দফা রফা । সেটাই হলো তার সাথে । তার পরে মাঘের শীতে ফের সুন্দরবন যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, সে যায় নি । এখনও দিনগুলো খুব জ্যান্ত মনে হয় । এখনও কত কিছু দেখা বাকি কে জানে ! সবে তো মাস আষ্টক হলো ! ...এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন তার চোখদুটো লেগে গিয়েছিল । খুলতেই দেখে ট্রেন ফাঁকা । তার পাশে বসে একটা মোটকা বাচ্চা পা দোলাচ্ছে, ফলে পায়ের বুটটা তার প্যান্টে বারবার লাগিয়ে ফেলেছে । তার ততোধিক মোটাসোটা মা উদাসীন চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে । আর একটা স্টেশন, তার পরেই তার গন্তব্য । এখন সকাল ৯:৫৫ বাজে, তার মানে সাড়ে দশটার মধ্যে সুন্দরপুর মিত্তিরবাড়ি ঢুকে যাওয়ার কথা, স্টেশন থেকে অটো ধরতে হবে, এটুকুই সে জানে । ট্রেন থেকে নামবার পরই পার্থকে হাত ধুতে হলো, কারণ দরজায় একজনের জানালা দিয়ে ফেলা থুতু বাতাসে উড়ে এসে তার হাতেই বেমালুম জুড়ে বসেছে ।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
একটা জরাগ্রস্ত, জীর্ন আটচালার প্রবেশদ্বারে থমকে দাঁড়িয়ে পার্থ দেখছিলো, নানারকম গাছপালা আর শিকড়-বাকরে দালানটা ধুঁকছে । গাছগুলো যথেষ্ট বেড়ে উঠেছে, মনে হয় না মিত্ররা তাঁদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে তেমন যত্নবান । আবার এমনও হতে পারে, অর্থকৌলীন্য হ্রাসপ্রাপ্ত – তাই সংস্কারের ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই । পার্থ প্রবেশের আয়োজন করে । ভিতর থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে । সোজা হাত তিরিশেক দূরে মঞ্চের মতো উঁচু একটা জায়গায় দুর্গা ঠাকুর দৃশ্যমান । ভিতরটা বেশ পরিচ্ছন্ন । অনুমেয়, একান্ত বাধ্য হয়েই ওই অংশটুকু সারিয়ে নিতে হয়েছে । নইলে প্রবেশদ্বারের দৈন্য তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতো । বাইরের দেওয়ালে, থামে ছত্রাক জাতীয় কিছু হয়ে আছে – কেমন ধূসর-হলদেটে মতো দেখতে । কী করে ওইভাবে ইঁটের ফাঁকে-ফোকরে বাঁচে কে জানে ! ওইজন্য কেমন শুকনো শুকনো লাগছে । নাকি ওটা ওদের ছলাকলা ! প্রাণশক্তির হদিশ এভাবেই লুকিয়ে রাখে ওরা ! নিজের ভাবনার ধূসরতায় আপন-মনে হেসে ওঠে পার্থ । এমনও হতে পারে, ওই ধূসর-হলদেটে রঙটাই ছত্রাকের নিজস্ব রঙ্ । ওগুলোকে যেন ‘পরজীবী’ না কী একটা বলে ? অন্যমনস্ক পার্থ যখন ঊর্ধ্বমুখ হয়ে থামের উপরে, ছাদের ভঙ্গুর সিলিংয়ে ছত্রাকগুলোর বিচিত্র রঙ ও রূপ পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত, ঠিক তখনই তার পাশ দিয়ে সবজেটে হাফ-শার্ট আর রঙচটা ট্রাউজার-পরা একজন রোগাটে যুবক চলে গেলো ছড়া বলতে বলতে – ‘ভাঙাচোরা ঘর-বাড়ি / এতো স্নেহ-মায়া ছাড়ি, / যাইবে কোথায় ?’ পার্থর কেমন সন্দেহ হলো, কথাগুলো তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা ! পার্থ তাকেই ডাক দিলো, “হ্যালো ! মিত্রবাড়িটা কোনদিকে ?” উত্তর এলো – “এটাই । সোজা ভিতরে চলে যান ।” যুবক আর দাঁড়ালো না, ওর চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে আর নিষ্প্রাণ ! এরকম অদ্ভুত দৃষ্টি পার্থর অভিজ্ঞতায় প্রথম । পার্থ যুবকের কথামতো আটচালার ভিতরে সোজা হেঁটে যায় । তিন-চারটে ছোটো ছেলে প্রতিমার সামনের নিচের চত্বরটায় দৌড়াদৌড়ি করছে । এমন সময় গৌরবর্ণা, স্থূলা এক বছর ষাটেকের মহিলা এগিয়ে এলেন পার্থর দিকে, দু-চোখে প্রশ্ন নিয়ে তিনি বললেন, "তুমি কে বাবা ? কিছু মনে কোরো না... চিনলাম না তো ঠিক !"
"আমি... পার্থ.. পার্থ ভট্টাচার্য । মিত্রবাড়ির হাউস ফিজিসিয়ান ড. কৃষ্ণেন্দু মুখার্জি আমায় চেনেন । আসলে... আমি এইমাত্র এলাম । কাউকে ঠিক চিনি না এখানে ।" - একটু ইতস্তত করে বলল পার্থ । এছাড়া আর কী বলা যায় বুঝতে না পেরে, হাসিমুখে সুসজ্জিতা মহিলার সামনে হাতদুটো প্রণাম জানানোর ভঙ্গিতে জড়ো করে ফেললো সে ।
"ও বুঝেছি । ডাক্তার বাবুর চেনা । উনি তো আবার মাধুরীর কে হন বলে শুনেছি ।"
"মাধুরী কে ?"
"যে বাড়িতে এয়েছো, সেই বাড়ির গিন্নি… বুঝলে ? তার মানে হলো গিয়ে কৃষ্ণ মিত্তিরের বউ । মাধুরী তো তেমন বেরোয় টেরোয় না, চোখেও ভালো দেখতে পায় না আর ওই সেজো ছেলেটা অকালে চলে যাওয়ার পর থেকেই… ।" – কথাটুকু অনুক্ত রেখেই মহিলা ঠাকুর প্রণামের মতো হাত দুটো জড়ো করে কপালে ঠেকালেন, অস্ফুটে শোনা গেল বললেন, "শ্যামসুন্দর... রক্ষা করো !" তারপর আবার স্বাভাবিক গলায় বললেন, "যাক্ বাবা ! পরের কথায় থেকে আমার কাজ নেই । একটু দাঁড়াও বাপু । আমি কাউকে ডেকে দিচ্ছি ।"
পার্থ দেখছিল চারপাশটা । মোটা থাম গোটা চারেক তার সামনে । তার ওপারে সাদা রঙের দালান, নতুন রঙ করা বোঝাই যাচ্ছে । খাঁজে খাঁজে সরু হালকা নীল রঙ । সপরিবারে মা দুর্গা দালানে বড়ো চৌকিতে বসে আছেন । কেন কে জানে, পার্থর সবসময় আগেভাগেই কার্তিক ঠাকুরের ময়ূরের দিকে চোখ চলে যায় । এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না । সব মিলিয়ে বেশ লাগছে । তবে কোনো ঝাড়বাতি-টাতি নেই । টিউব লাগানো চারটে থামে, এই সকাল সাড়ে দশটাতেও টিউবলাইটগুলো জ্বলছে । লাল পাড় হলুদ শাড়িতে মা দুর্গা, হাতে একমাত্র বড় খাঁড়াটা ছাড়া বাকি অস্ত্রগুলো টিনের বলেই মনে হলো । লাল শাড়িতে লক্ষ্মী, সাদা শাড়িতে সরস্বতী । সিংহটা বেঁটেখাটো গোবেচারা, দুর্গার পায়ের নিচে, অসুরের উদ্যত খাঁড়ার ফাঁক থেকে কেশর দুলিয়ে হাঁ করে আছে । সিংহের ওর'ম হাঁ-করা মুখ দেখলেই 'জয়বাবা ফেলুনাথ' মনে পড়ে । মাথার উপর চাঁদোয়া চারপাশে দড়ি টানটান করে টাঙানো । দালানের একদিকে উঁচুতে আবার একটা বড়ো জানালা, বোধহয় অন্তঃপুরবাসিনীদের জন্য সেকালে বানানো ।
পার্থ দালান আর আটচালাটা মেপে নিচ্ছে, এমন সময় এক বৃদ্ধ অথচ শক্ত-সমর্থ ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন । তাঁকে অনুসরণ করে এলেন আরেক বৃদ্ধা, সম্ভবত তাঁর স্ত্রী । সঙ্গে এলেন এক বছর ত্রিশের মহিলা, বয়সটা আরেকটু বেশিও হতে পারে, তবে অল্প বয়সে যে ইনি যথেষ্ট রূপবতী ছিলেন, তা এখনও বেশ অনুমান করা যায় । প্রত্যেকেরই লাল শাড়ি, একেকরকম, কিন্তু মোটের উপর লাল । প্রথমেই বৃদ্ধ হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন । পার্থ যথারীতি কী বলবে বুঝতে পারছিল না । ভদ্রলোক নিজেই বললেন, “শুনলাম সব বউদিদির কাছে, মানে যার সাথে আলাপ হয়েছে আপনার একটু আগে । তা ‘আপনি’ বলবো ? নাকি... ‘তুমি’ই বলি । আসলে আমি নবকান্ত ঘোষ । আমি সকলের জ্যাঠামশাই, তুমিও তাই বলতে পারো । আসলে কৃষ্ণকান্ত অসুস্থ হওয়ার পরে এই সকলের সাথে আলাপ, কোথায় কী লাগবে, বিশেষতঃ পুজোর সময়ে, টুকটাক ভালোমন্দ সব আমাকেই দেখতে হয় । তো তুমি যাকে দেখেছো ইতিমধ্যে, উনি আমার বউদিদি, করবী রায় । আমার বাল্যবন্ধু বলো, গ্রামের অন্যতম মাতব্বর বলো, সে হলো যতীন্দ্রনাথ রায় । পাশেই থাকেন, ওঁদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হয় । তাঁরই স্ত্রী হলেন ওই বউদিদি । আর ইনি আমার স্ত্রী”, বলে পাশে বৃদ্ধাকে দেখালেন । এইসময় পার্থ কী মনে করে দুজনকে প্রণাম করতে যেতেই বৃদ্ধা কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, "করো কী ! মায়ের সামনে ওসব করতে নেই । ওসব থাক্ ।" পাশ থেকে অন্য মহিলাটি মাথায় ঘোমটা আরো একটু টেনে প্লাস্টিকের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, “আপনি বসুন না । জ্যেঠু… আমি বরং দেখি, একটু লুচি-টুচির ব্যবস্থা করি ।” বলেই, কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ভিতরে রওনা দিলেন ।
"ও হলো আমাদের কৃষ্ণকান্তের ছোটো ছেলে চন্দ্রকান্তর স্ত্রী, অনুশ্রী, ভারি মিষ্টভাষী । ওর ছেলে বুবুন আবার আমার ভারি ন্যাওটা । তোমার জলখাবারের ব্যবস্থা ওই করবে । চিন্তা নেই আর কোনো । মুখার্জি সবই বলে দিয়েছে ফোনে । সে তো আসতে পারলো না, বললো ট্যুর আছে । তা আমরা তো আছি । তা… তোমরা কথা বলো, আমি একটু দেখে আসি, বাজিগুলো এলো কিনা ।" - নবকান্তবাবু স্ত্রীকে ইশারা করে বাড়ির ভিতরের দিকে চলে গেলেন ।
বৃদ্ধা পার্থকে নিয়ে বসলেন । আরতি শুরু হবে । তার তোড়জোড় চলছে । দালানে রয়েছে লাল আর কালো প্লাস্টিকের চেয়ার, কয়েকটা এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে । তারই দুটো টেনে নিয়েছেন তিনি । নিজে গুছিয়ে বসেই বললেন, "বসো বাপু । সেই কলকাতা থেকে এলে… এতটা পথ.. তা তুমি নাকি পুজোর ভিডিও তুলবে শুনলাম । টিভিতে দেখা যাবে ?"
পার্থ দেঁতো হেসে বলতে বাধ্য হল, "এমা না না । আমি সেরকম কেউ নই, মানে টিভি চ্যানেল থেকে আসি নি । আমি নিজের মতো কিছু ভিডিও তুলবো আর-কি । একটা ডকু বানাবার প্ল্যান আছে ।"
"ডকু ? সে আবার কী হে ?"
"ওই মানে তথ্যচিত্র আর কী..."
"ও ! তা যাকগে । পুজো নিয়ে যদি কিছু জানতে চাও... আমি আছি, আমার কর্তা তো আছেনই.. এছাড়া তুমি মেজোর মানে সুয্যির বউকেও জিজ্ঞেস করতে পারো । তবে খুব সাবধান, একটু ডাঁট আছে । এবার বলো তুমি কী করো-টরো.. ।"
পার্থ সংক্ষেপে বললো নিজের পরিচয় । তারপর প্রশ্ন করলো “পুজোর গত দুদিন কী কী হয়েছে বা, প্রথামতো কী কী হয় আপনাদের ?” প্রশ্নটা করে ফেলেই মনে পড়ায়, চট করে হ্যান্ডিক্যামটা খুলে বসলো সে ।
বৃদ্ধা বেশ গুছিয়ে বর্ণনা করে গেলেন, - "আমাদের গোপাল আছেন, গোপালের নিত্যপুজো হয় । প্রতিদিন স্নান করে নতুন কাচা জামা কাপড় পরেন গোপাল । পুজোয় তিনি অনেক জামা-কাপড় পান কিনা... । তারপর পূজার থালায় করে নৈবেদ্য সাজিয়ে তাঁর পুজো হয় । আবার সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যারতি করা হয়, প্রতিদিন একটা করে রাজভোগ খান রূপোর বাটিতে । সারা দুপুর ফ্যান চালিয়ে গোপালকে বসিয়ে রাখা হয় । রাত্রিবেলা গোপালের আলাদা খাট আছে, গোপালকে সেখানে শোয়ানো হয় । আবার পরের দিন সকালবেলা গোপালকে খাট থেকে তুলে তাঁকে সিংহাসন বসানো হয় । আবার চান টান করিয়ে পুজোটুজো করা হয়, এইভাবে নিত্য গোপালের পুজো চলে । তাছাড়া গোপালের জন্মাষ্টমী হয়, দোল হয়, অশোকষষ্ঠীতে পুজো হয় । জন্মাষ্টমীর দিন গোপালের যখন পুজো হয়, ঐদিন গোপালের জন্মদিন পালন করা হয় । জন্মদিনের পরের দিন নন্দ-উৎসব হয়, নন্দ-উৎসবের দিনে, ওই ধরো ভাদ্র মাসে মা দুর্গার কাঠামো পুজো হয় । পুরনো কাঠমাতে একটা নতুন কাঠ যোগ করে পুজো করা হয় । ঠাকুরমশাই আগে থেকে সময় বলে দেন, সময় ধরে তিনি আসেন । বাসরঘড়ি থাকে, যোগাড় করে দেয় । ওহ্ ‘বাসরঘড়ি’ কাদের বলে জানো তো ? ওই যারা রাত জেগে পুজোয় থাকে, সব গুছিয়ে দেয় । তারপর আস্তে আস্তে কাঠামোতে মাটি লাগিয়ে, দোমেটে করে প্রতিমা তৈরি হয় । সেই প্রতিমার ঘট-স্থাপনা হয় আমাদের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, মহালয়ার ক'দিন আগে । মানে পুজোর পনেরো দিন আগে থেকে গোপালের ঘরে ঘটস্থাপনা করে, তার উপর কাপড়, গামছা দিয়ে, নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা করা হয় । প্রতিদিন গোপালের পুজোর পরে ঘটের সামনে চন্ডী পাঠ করা হয় । একেক দিন, একেক রূপ চণ্ডীপাঠ হয় । এই চণ্ডীপাঠ পনেরো দিন ধরে হবে । অবশেষে ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়, সকাল বেলা ঐ ঘরে বসেই পুজো হয় । ষষ্ঠীর রাত্রিবেলা প্রতিমাকে সাজিয়ে, দালানের এই মেঝেতে আলপনা দিয়ে, চৌকি ধুয়ে, মাকে ওইখানে বসানো হবে । তারপর তাঁর প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হবে । তারপর ষষ্ঠীর পুজো হবে আবার, এছাড়া যে আচারগুলো আছে সেগুলো করে নিয়ে, আরতি সেরে নেওয়া হবে । আর হচ্ছে, বোধনতলা বলে একটা জায়গা থাকে, ওই বোধনতলাতে ষষ্ঠীর সন্ধ্যাতে কলাবউকে পুজো করতে হয় । তাকে বলে কলাবউয়ের অধিবাস, একটা কলাগাছকে কাপড় পরিয়ে, সাজিয়ে, ওইখানে ছোটো করে নৈবেদ্য দিয়ে অধিবাসের রাত্রিবেলা পুজো হয় । পরের দিন সকালবেলা মহাসপ্তমী পড়ে । মহাসপ্তমীর দিন নিয়ম মেনে, সময় ধরে কলাবউকে গঙ্গায় স্নান করিয়ে আনতে হয় । এবার আমাদের গঙ্গা মানে এই পুকুর আর কি, আমরা বলি ষানের ঘাট (স্নানের ঘাট) ! তখন সঙ্গে একট মহাস্নানের থালা বলে থাকে । পঞ্চশস্য, পঞ্চামৃত, পঞ্চ-অর্ঘ্য, গঙ্গামাটি, পঞ্চপল্লবের উপচার ওই থালার মধ্যে সাজানো থাকে । ফুল থাকে, পদ্মফুল যেমন - দিতেই হবে । দুটো ঘটি থাকে, ঠাকুরমশাই ওই ঘটিতে করে একটু জল নিয়ে, প্রত্যেকটা বাটি থেকে একটু করে ওই তিল, হরিতকী, পঞ্চশস্য, পঞ্চরত্ন নিয়ে ঘাটে, ওই একঘটি জলের মধ্যে ওগুলো একটু করে গুলে নেবেন । তারপরেই ঐ ঘটির জল দিয়ে কলাবউকে চান করানো হয় । তারপর কলাবউকে বাড়িতে নিয়ে আসা হবে । বাড়িতে একটা বিরাট বড়ো থালা আছে, সেই থালার উপরে কলাবউকে দাঁড় করিয়ে, নতুন বস্ত্র, চাঁদমালা, ফুলের মালা, বেলপাতার মালা - সব পরিয়ে, ঠাকুরমশাই সিঁদুর পরিয়ে দেবেন । এবার মা দুর্গার ঘরে ঢুকে চৌকির কাছে আবার একটা থালা পেতে, তার উপর কলাবউ মানে নবপত্রিকা-কে রাখেন ঠাকুরমশাই । এবারে বাড়ির সবথেকে যে বড়ো, মানে ধরো এ বাড়িতে আমি, নবপত্রিকাকে বরণ করি । বরণডালা এনে, আগুনের তাপ দিয়ে, পান দিয়ে, বাড়িতে নতুন বউ এলে যেমন করে লোকে বরণ করে ঘরে তোলে, নবপত্রিকাকে ঠিক তেমন করে বরণ করতে হয় । এবারে আবার পুজো হবে, চণ্ডীপাঠ হবে । সপ্তমীর পুজো শুরু হবে । কলাবউ স্নান দেখতে আমাদের আর উলটোদিকে ওই করবীদিদিদের বাড়ির ঘাটে ভিড় হয় । ওদেরও পুজো হয় কিনা । ওইদিন সকালে একটু বৃষ্টি হবেই । গতকালও মিনিট তিনেই ফোঁটা ফোঁটা হয়েছে । কলাবউ স্নানের পর গণেশ পুজোর মাধ্যমে শুরু হয় মূল দুর্গাপুজো । মা দুর্গার সিংহাসনের তলায় একটা বড় হাঁড়ি থাকে, এই হাঁড়ির উপরে একটা দর্পণ বলে থাকে । ওই দর্পণটা হাঁড়ির উপর রেখে, সমস্ত উপচার দিয়ে, দর্পণটাকে স্নান করাতে হয় । ওই জলটাকে মা দুর্গার সিংহাসনের তলায় রেখে দিতে হয় । সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী - তিনদিন ধরে ওই হাঁড়িতে সমস্ত উপচার দিয়ে দর্পণ চান করবে, এজন্য হাঁড়িটা থাকে । এবারে অষ্টমীর দিন সকালের চণ্ডীপাঠ হবে, পুজো হবে আর আরতি হয়ে সকালের পুজো শেষ । বাকিটা তো তুমি এসেই গিয়েছ, দেখতেই পাবে ।" বলতে বলতেই দেখা যায় একটি বছর পনেরোর ফ্রক পরা মিষ্টি মেয়ে হাতে খাবারের থালা নিয়ে এসেছে, থালায় হালকা করে ভাজা সাদা লুচি আর আলুর দম । সঙ্গে আবার দুটো কমলাভোগ । থালাটা কিন্তু পার্থর হাতে দিলো না, "দিদা, মা পাঠালো" বলে নবকান্ত ঘোষের স্ত্রীর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ।
"এ হলো আমাদের তনু, অনু আর ছোটোর মেয়ে । এখন একটু লজ্জা পাচ্ছে । পরে ঠিক হয়ে যাবে । দাও, খাবারটা দাও দাদাকে । আচ্ছা তুমি যাও দিদিভাই ।" - বলতেই মেয়েটি প্রায় ছুটে ভিতরে চলে যায় ।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
খেতে খেতেই পার্থ প্রশ্ন করে, "অষ্টমী থেকে আপনাদের কী কী অনুষ্ঠান থাকে ?"
"তা ধরো এই আজকে রাতে ২8 মিনিট অষ্টমী তিথির আর ২8 মিনিট নবমী তিথির, মানে মোট 8৮ মিনিটের সন্ধিপুজো । এই হল সন্ধিক্ষণ, ১০৮ টা প্রদীপ জ্বেলে, ১০৮ টা পদ্ম দিয়ে সন্ধিপুজো হয় । ওই আটচল্লিশ মিনিট সময়ের মধ্যে সবকিছু করতে হবে । ২২ খানা কুচো নৈবিদ্দি বাইরে দিতে হয়, সমস্ত দেবতাদের নাম করে করে । আর দুটো এই বড়ো বড়ো নৈবিদ্দি ভিতরে দিতে হয় । এই মায়ের সামনেটাতেই হবে সব, দেখতে পাবে । এছাড়া মহাস্নানঘটে দর্পণের স্নান তো আছেই । ওই 8৮ মিনিট সময়ের মধ্যেই কিন্তু সমস্ত নৈবেদ্য নিবেদন করতে হবে । চন্ডীপাঠের ব্যাপারও আছে । সময় তো কম, প্রদীপগুলোকে ও নিবেদন করতে হয় । এই হল সন্ধিপুজো । আমাদের রাত ১১ টা ২৩ মিনিটে শুরু এবার, আরতি করে পুজো শেষ । নবমীর দিন সকালবেলা ওই হাঁড়ির মধ্যে থেকে পিতলের চাকামতো দর্পণ নিয়ে ভিতরের পুকুরে স্নান করিয়ে আনা হয় । মায়ের বিসর্জনের জন্য নবমীর দিনেই দক্ষিণান্ত হয় । ওই দক্ষিণান্ত-তে যখন থেকে এ বাড়ির পুজো শুরু হয়েছে, সেই তিন পুরুষ আগের থেকে রাখা রুপোর দশটা কয়েন কাজে লাগে । দশটা পান, দশটা কলা, দশটা সুপুরি, দশটা হলুদ, পরপর সাজিয়ে তার ওপরে ওই দশটা কয়েন দিয়ে একটা কলাপাতার ওপর সাজিয়ে রাখা হয় । এইবার ঠাকুরমশাই একটা করে নাম বলবেন আর একটা করে নিবেদন করা হবে । মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে, টাকা আবার তুলে রাখা হবে । প্রতি বছরই ওটা দক্ষিণান্তর দিন বেরোবে, আবার ঘরে তুলে রাখা হবে । এত কথা কাউকে বলি না, কিন্তু তোমায় দেখলে বাবা মনে হয়, ভরসা করা যায় । তাহলে এই হয়ে গেলো দক্ষিণান্ত, এর পর রাত্রিবেলা শুধুই আরতি । ওই যে বাজি কেনার কথা বললেন আমার কর্ত্তা, ছোটোরা সব এই ঠাকুর দালানে বাজি পোড়াবে, কেউ কেউ ঘাটের ওদিকে গিয়ে রকেট-মকেট ছাড়ে । সাপবাজি আমাদের দাদুভাইয়ের খুব প্রিয়, দিদিভাইয়ের দড়িবাজি আর রংমশাল । আবার তো কালীপুজো আছে তারপর, তখন আবার কিনবে ।"
"আর দশমীর দিন ?"
"দশমীর দিন সকাল বেলা নির্মাল্য বাসিনীর পুজো বলে, ওটা হয় । এক গামলা জলে ওই যে দর্পণের কথা বলছিলাম, সেটা বিসর্জন করা হয় । ওই গামলার জলে আমরা মায়ের পায়ের প্রতিচ্ছবি দেখি, ছোটোরা অবিশ্যি মায়ের সুন্দর মুখটাই খোঁজে । সবকিছু কিন্তু সময় মেনে, নিয়ম অনুসারে, পাঁজিতে যেরকম আছে । যতীন রায়ের বাড়ির ঠাকুর আমাদের মাঠ থেকে ঘুরে যাবে, তারপর আমাদের ঠাকুর বেরোবে । রাত নামার আগেই মোটামুটি বিসর্জন হয়ে যায় । তবে সে আগে অনেক লোকজন ছিল, বাবুদের দেদার টাকা ছিল, তখন ওই ঘাটে দাঁড়িয়ে ঠাকুরপো বন্দুক ছুঁড়তেন, তারপর ঠাকুর জলে পড়তো । এখন আর কে সেসব করবে বলো ? ঘট বিসর্জনের আগে শান্তির জল দেওয়া হয় । এই মোটামুটি, আরো কত ছোটো ছোটো ব্যাপার, সে শাশুড়িমা বেঁচে থাকলে, আরো বলতেন । কত কিছু উঠেই গেলো আমাদের বাড়ি থেকে, ঝাড়বাতি গেলো, পাঁঠাবলি উঠে গেলো গতবছর, কুমারী পুজো উঠে গেলো... আর কী বলব ? তবু তো এক'শ আটটা উপচারে স্নান হয় । তন্ত্রধারক আর পুরোহিত - দুজনে এখনও চালাচ্ছে । এরপর কী হবে জানি না । এখনও ঢাকিরা আসছে, ওই ওপাশের ঘরটায় থাকে, আটচালার শেষ থামের কোণের ঘরে রান্না হয় । বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা এখন আসে প্যাকেট করে, দশকর্মা ভাণ্ডারে পাওয়া যায় । এবারে দোকানদার গঙ্গামাটি দিচ্ছে না কাদামাটি, সে ঈশ্বরই জানেন !"
"কত কিছু জানি না আমরা ! ভাগ্যিস এলাম !" – বলে হ্যান্ডিক্যামটা নামিয়ে নেয় পার্থ ।
"দেখো এবার নিজে ঘুরে ঘুরে । তবে বাপু যদি রাসযাত্রার সময় আসতে পারো, তবে অনেক বেশি আনন্দ পাবে । কদম ফুল দিয়ে ওপাড়ার শ্যামসুন্দরের মঞ্চ কেমন সাজায় দেখতে পাবে । এসো, জল দিই, হাত ধুয়ে নাও । আমারও এদিকে খেয়াল নেই, তুমি তো বোধহয় হাত না ধুয়েই খেয়ে নিলে ! তার মানে খিদেটাও পেয়েছিল ভালোই ! আর দুটো লুচি আনতে বলি ?"
"না না । কী যে বলেন ? গোটা সাতেক খেলাম বোধহয় । আচ্ছা পাঁঠাবলি হয় না বললেন ? তাহলে যতীন বাবুদের বাড়িতে গেলে কি দেখতে পাবো ?"
"হ্যাঁ তা পাবে । যেও কাল ।" - একটু যেন অসন্তুষ্ট হয়েই বললেন জ্যেঠিমা । ওদিকে নবকান্ত বাবু এসে হাজির । স্ত্রীকে ব্যস্ত গলায় বললেন, "তুমি একটু ভিতরে যাও দেখি । মেজো বৌমা কী খুঁজে পাচ্ছে না । ওদিকে বেহালা থেকে ওরা সব এসে পড়েছে । যাও যাও... ।" - বলে তাড়া লাগান নবকান্ত বাবু ।
"যাচ্ছি যাচ্ছি । একেবারে ঘোড়ায় জিন দিয়ে ছুটতে বলবেন ।" বলে মাথা নাড়তে নাড়তে জ্যেঠিমা ভিতরে গেলে, নবকান্ত বাবু পার্থকে ডেকে নিয়ে বসালেন আটচালার আরেক কোণে । কোথা থেকে যেন চন্দ্রবিন্দুর গান ভেসে আসছিলো, গানটা পার্থরও বড়ো প্রিয় - "আদরের ডাক যদি মোছে
এই নাও কিছু ঘুমপাড়ানি গান আলগোছে,
বোঝো না এটুকু শিলালিপি...
মন রে…" ।