গল্প ।। খোলঘর ।। শ্রীজিৎ জানা
খোলঘর
শ্রীজিৎ জানা
--দাদু, ও দাদু, তুমি এখানে একা বসে কি করছো? যাবেনা?
--কোথায় দাদুভাই?
--কেন তোমার সেই খোলঘরে? সেখানে আজ কত কিছু হবে জানো!
বলেই এক ছুট। পরিতোষ নাতির চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে। ছোট্ট দুটি পা আহ্লাদে যেন ডগোমগো। তার বাড়িতেও আজ আনন্দের স্রোত বইছে। অথচ তার নিজের ভেতরটায় যেন হু হু করে বাতাস বইছে! শুকনো বাতাস! একবিন্দু স্বস্তি তার কলিজাকে আরাম দিতে পারছেনা। কানের কাছে যেন একটা কথাই বারবার ধাক্কা খাচ্ছে- সব বাঁধন খুলে যাচ্ছে রে, সব বাঁধন!
অথচ একদিন বাঁধা ছিল সবাই একসূত্রে। রশির এক খুঁটে টানা দিলে,টানা হয়ে আসতো আর পাঁচজন। সেইসব দিনের কথা পরিতোষকে ভাবায়। দিনগুলো মিশে ছিল বড় প্রাণের কাছাকাছি!
ছোট্ট গ্রাম ঝুমঝুমি। নামের মধ্যেই যেন বাজনার মিঠেল সুরের অনুরণন! গ্রামজুড়ে খিরিশ বাবলা করঞ্জ আম অর্জুন আর বটের ছায়া! ছোট ছোট ঘরগুলো যেন একে অপরের সাথে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। ডাঁয়ে-বাঁয়ে টুবি পুকুর। পুকুরের পাড় জুড়ে সার সার কলাগাছ। খয়রি রঙের স্বচ্ছ জলে ফিনফিনে ঢেউদের মাতামাতি! পুকুরঘাটে যাও তো হাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে টাবুক টুবুক তেচোখা আর চ্যাং মাছ! রাস্তায় তখনও লাল মোরাম পাড়েনি। বিজলি বাতির আলো গাঁয়ের সব ঘর জ্বলে উঠেনি। দু-একটা ঘর সৌভাগ্যবান। প্রায় ঘরের মাথায় খড়ের ছাউনি। জমাট অন্ধকার মুছে দেয় লম্ফ- লন্ঠনের আলো। তুলসী তলায় প্রদীপ পড়ে। ঘরের বউ গলায় কাপড় জড়িয়ে মাথা ঠুকে সন্ধে দেয়।, তিনবার শাঁখে জোরে ফুঁ দেয়। পূর্ণিমায় ঘরে ঘরে হরি লুটের গান হয়। ছোটরা বড়দের সঙ্গে জেগে থেকে তুলসী মঞ্চের চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়ায়। তারপর গান শুরু করে পরিতোষ অধিকারীর নামের দল। বেজে ওঠে শ্রীখোলা- খঞ্জনি -হারমোনিয়াম। হরিনামের সুরে মেতে উঠে আঙিনা। আর যেই শেষ কলিটি শুরু করবে গায়েন---হরিনামের লুট বাতাসা গুড়িয়ে খাই, অম্নিশুরু হবে কচিকাঁচাদের বাতাস কুড়ানোর ধুম!
গ্রামে তখন একটাই নাম সংকীর্তন- এর দল পরিতোষ অধিকারী এবং সম্প্রদায়! পূর্ণিমার গান, কীর্তনগান, গৃহপ্রবেশ, শবদাহ সবেতেই তাদের ডাক পড়ে। গাঁয়ের মাঝখানে হরিচালা, তার এক পাশেই পরিতোষের আখড়া। গাঁয়ের ভাষায় খোলঘর। বাঁশ বাতা আর কঞ্চির বেড়া বেঁধে তার উপর খড়মাটির ছোপ দিয়ে এক সমান করে মাজা। ঘরের মাথায় খড়ের ছাউনি। সামনে বনতুলসী গাছের বেড়া।
একপাশে তুলসী মঞ্চ। ছেঁচা বাঁশের কপাট ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলে ধূপধূনোর গন্ধে মন প্রাণ ভরে যাবে। দেয়ালের গায়ে সাদা চাল বাটার কত রকম আলপনা। ধানেরছড়া, লক্ষ্মীর পা, হাতি, ফুল -লতা- পাতা আরো কত কি! পেরেকে ঝোলানো রাধাকৃষ্ণের পট। ঘরের কোণে চৌকিতে রাখা তিনটে শ্রীখোল একটা মৃদঙ্গ, কযেক জোড়া খঞ্জনী, আড় বাঁশি, হারমোনিয়াম -এসব নিয়েই পরিতোষ অধিকারীর খোলঘর।
সারাদিন পরিতোষ জমিতে হাড় খাটুনি খাটে। বসে থাকার মানুষ নয় সে। কাজের মাঝেই গুন গুন করে সুর ভেঁজে চলে। হয়তো গাছের ছায়ায় একটু জিরেন দিতে বসেছে সেখানেও সে জল খাওয়ার ঘটি উল্টে তাতেই খোলের বোল তুলবে। আর যেই সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়বে পরিতোষ হাজির হবে খোলঘরে। ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে আগে তুলসী তলায় প্রদীপ দেবে, তারপর প্রণাম করে শ্রীখোল খঞ্জনি নামিয়ে আনবে খেজুরপাতার তালাইয়ের উপর। একে একে আসবে গনেশ সাঁতরা, উপেন সাঁপুই, বংশী সামন্ত, অভিরাম দাস। শুরু হবে রাধা কৃষ্ণের গান, কীর্তন গান। কত রকমের পালা কীর্তন- সুবল মিলন, নৌকা বিলাস, কলঙ্ক ভঞ্জন, ভক্তমিলন। প্রাণ জুড়িয়ে যায় সেইসব কীর্তন পালায়। খোলের বোল নিয়ে, গানের সুর নিয়ে কত বাকবিতণ্ডা চলে। কীর্তনের পদ নিয়ে, তত্ত্বকথা নিয়ে কত আলোচনা হয়। মাঝে মাঝে রসিকগঞ্জ থেকে আসেন বাসুদেব পন্ডিত। সেদিন তো খোলঘর একেবারে সরগরম! গানে,বাজনায় সারারাত গমগম করতে থাকে আখড়া! সেই সন্ধ্যায় গাঁগাঁওলি থেকে বেশ কয়েকজন জড়ো হয় আসরে। এদিকে রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়। বাসুদেব পন্ডিত রাতে ফিরে যেতে পারবে না। পরিতোষের বাড়িতেই থাকবে। তার যেমন গানের গলা তেমনি তার তত্ত্বকথায় দখল! পরিতোষের গিন্নি কত যত্নআত্তি করে তার। গুণী মানুষের পায়ের ধুলা পড়েছে যে তার ঘরে!
সন্ধ্যা ভালো করেই জানে মানুষটাকে। মাঝে মাঝে ঘর- উদাসীন মানুষটার উপরে তার রাগ হয়। সব সময় নামের দল আর নামের দল। কথায় কথায় খোলঘর। সন্ধ্যার সঙ্গে কখনোসখনো মন কষাকষি হলে পরিতোষ সোজা চলে যায় খোলঘরে। কোলের উপর খোলটাকে নিয়ে ডুবে যায় সাধনায়। পিছু পিছি সন্ধ্যাও চলে আসে। দেখে কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুলের মানুষটা বিভোর হোয়ে বাজাচ্ছে শ্রীখোল। খালি গা, গলায় তুলসী কাঠের মালা যেন কালোবরণ কেষ্ট ঠাকুর! একটু নরম হলে সন্ধ্যা বলে ওঠে একবার সেই গানটা শোনাও দেখি কলঙ্ক ভঞ্জন পালার। নিমিষে রাগ মুছে পরিতোষ খোল বাজিয়েই ধরে গান।
ঘরে তেমন সচ্ছ্লতা ছিল না কখনো। পরিতোষের দুই ছেলে দুই মেয়ে। চাষের উপর নির্ভর তার সংসার। এটা নেই ওটা নেই, নিত্যদিন টানাটানি লেগেই থাকে। কিন্তু শ্রীখোলের চামড়াটা নষ্ট হয়ে গেছে, হারমোনিয়ামের পর্দা ছিঁড়ে গেছে তা দেখামাত্রই অম্নি দৌড় লাগাবে সারাই দোকানে। ঘটিবাটি বন্ধক পড়লেও হুঁশ থাকবে না পরিতোষের। একদিনের কথা সন্ধ্যার আজও মনে পড়ে। বড় ছেলে জ্বরে সাতদিন বিছানা সজ্জায়। এতোটুকু ছেলে যা মুখে দেয় সবই উগরে দেয়। ঘরে তেমন টাকাপয়সা নেই। এদিকে পরিতোষের নামের দল যাবে জয়কৃষ্ণপুর কীর্তন গান গাইতে। কিন্তু এক জুড়ি খঞ্জনির অভাব। পরিতোষ গুম হয়ে বসে থাকে। মুখের দিকে তাকাতে পারে না সন্ধ্যা। ছেলের অসুখ ভুলে নিজের একটা কানের দুল হাতে তুলে দেয়। তাকে বন্ধক দিয়েই পরিতোষ দু'জোড়া কর্তাল নিয়ে আসে। এভাবেই চলছিল পরিতোষের হরিনাম সম্প্রদায়।
তারপর দিনগুলো যেন বদলে যেতে থাকে। বাড়ির ছোট ছেলে বড় হয়ে সোনার কাজে বাইরে যায়। গাঁয়ের রাস্তায় মোরার পড়ে। বিজলি বাতির আলো জ্বলে ওঠে ঘরে ঘরে। দুচার ঘরে টিভির আসর বসে।পাড়ায় পাড়ায় মিছিল হয়। খবরের কাগজ পড়ে শোনানো হয়। এখন গাঁয়ে পরিতোষের বাদেও আলাদা দল তৈরী হয়। নিয়ম আপনা থেকেই চালু হয় যে, যে পার্টির সমর্থক সেই পাটির নামের দল আসবে পূর্ণিমার গান গাইতে। পরিতোষের দল ভেঙে শীতল, বংশী, চরণ মিলে আলাদা একটি নামের দল করে নেয়।
কেমন যেন ফিকে হয়ে যায় খোলঘরের দেওয়ালের আলপনা। সন্ধ্যার বয়স হয়েছে। আর ন্যাতাঝাঁটা দিতে পারে না। বৌমারা খোলঘরের দিক পা মাড়ায় না কখনো। ঘরের সামনেটা আগাছায় ভরে উঠেছে। পরিতোষও তেমন করে আর পেরে উঠতে পারে না। ছেলেদের সাফ- কথা এবারে সব বন্ধ করে দাও।
ওদিকে শীতলদের রমরমা ব্যাপার! তারা বালক সঙ্গীতের দল করেছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জরির ওড়না পরিয়ে মুখে রঙ মাখিয়ে রাধাকৃষ্ণ সাজিয়ে হিন্দি গানের সুরে হরিনাম গেয়ে নাচায়। লোকজন কত মজা পায়। চরণ আখড়ার সামনে একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাতে লেখা রাধাকৃষ্ণ বালক সংগীত সম্প্রদায়। সেদিন সন্ধ্যা এসে বলে,
--শুনেছো চরণ ঠাকুরপোদের দল যাবে বড় শিমুলিয়া, নবকুঞ্জের গান গাইতে। সেখানে নাকি তাদের টিভিতে দেখাবে।
পরিতোষ সব চুপচাপ শোনে। বাড়ির সামনের পুরনো আম গাছটার দিকে তাকায়। কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছে গাছটা। ভেতরে ভেতরে অনেকটা পোকায় কুরে খেয়ে নিয়েছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না অথচ একটা ঝড়েই হয়তো তার সমস্ত বীভৎসতা বেরিয়ে আসবে।
বড় ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কিছুদিন বসেছিল তারপর অঞ্চলে একটা কাজ পেয়ে যায়। বড়বউ কি যেন একটা করে! রোজ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দুপুরে বেরিয়ে যায়। তারা বুড়োবুড়ি শুধু দেখে। চুপ থাকতে পারে না বলে, সন্ধ্যা বড় ছেলেকে শুধায়,
-- আরে খোকা বৌমা রোজ রোজ কোথায় যায় বল দিখি
--- ওর মিটিং থাকে। তোমারা অই দিকে চোখ দাও ক্যানো?
পরিতোষ এনিয়ে টুঁ শব্দ করে না। এখন সে প্রায় সময় খোলঘরে একা একা কাটায়। মাঝেমধ্যে কেউ এলো তো এলো। নিজেই গুন গুন করে গান গায়। কতকিছু মনখারাপের মধ্যেও পরিতোষের স্বান্ত্বনা তার খোলঘর। কিন্তু হঠাৎ সেদিন বড় ছেলে বলে,
-- বাবা তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।খোলঘরের অবস্থাটা তো ভালো নয়, আর তোমার দলও তো নেই তাই ওটাকে আমরা পার্টি অফিস বানাবো। তোমার জিনিসপত্র সরিয়ে নিও।
পরিতোষের পায়ের তলার মাটি যেন নড়ে উঠে। ছেলের মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকায়। সন্ধ্যা আপত্তি করে ওঠে,
---এমনটা করিসিনি বড় খোকা। তোর বাপকে বাঁচাতে পারবিনি।
--- তুমি বুঝবেনা।ওসব নামের দলটলে আর পেট চলে না। পার্টি অফিসটা করতে দিলে তোমার বৌমাকে একটা কাজ দিবে বলেছে বুজলে!
পরিতোষ পাথর হোয়ে বসে থাকে। বিকেলে খোলঘর থেকে একে একে শ্রীখোল হারমনি খঞ্জনি সব সরিয়ে নিয়ে আসে। শোবার ঘরের তক্তপোশের নিচে লালসালু দিয়ে বেঁধে চৌকির উপর রেখে দেয়।
আজকাল শুধু দুয়ারে চুপচাপ বসে থাকে পরিতোষ।আর আম গাছটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। কখনো কখনো নাতিকে কোলে বসিয়ে হাঁটুতে তার খোলের চাঁটি মারার মতো ভঙ্গি করে সুর তুলতে চায়।
ছেলেদের পার্টি অফিস উদ্বোধন আজ। পার্টির সব বড় বড় নেতারা এসেছেন। মাইকে গান বাজছে সজোরে। খোলঘরের চারপাশে ছোট বড় পতাকা উড়ছে। ধসে পড়া দেওয়াল সারিয়ে চুনকাম করেছে। খড়ের চাল ফেলে দিয়ে ঘরের মাথায় চেপেছে অ্যাসবেস্টাস। দেয়ালে আলপনা মুঝে লেখা হয়েছে স্লোগান। পরিতোষ শুনেছে দু'মাসের মধ্যে মেঝেটাও নাকি পাকা হবে। ছেলে-বৌমার নাম এখন সবার মুখে মুখে। নাতি এসব দেখার জন্যই পরিতোষ কে টানাটানি করছিল।
দুয়ারে বসেছিল পরিতোষ। সন্ধ্যা কোথা থেকে এসে তাকে মন মরা হয়ে বসে থাকতে দেখে ধমক দিয়ে ওঠে,
--তুমি এখনো এখানে ঠায় বসে আছো! একটু তো মাঠের দিক থেকে ঘুরে আসতে পারো!
---যাই।
প্রাণহীন অস্ফুট উচ্চারণে যেন উত্তর দ্যায়। সন্ধ্যা স্বামীর মুখের দিকে তাকাতে পারে না। সামনের গাছটার মত মানুষটা হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে! শোবার ঘরে এসে বাদ্যযন্ত্রগুলোয় হাত বুলোতে বুলোতে হুহু করে ওঠে কেঁদে ওঠে। এদিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাইকে পার্টি নেতার বক্তব্য শোনা যায়। --বন্ধুগণ, আমাদের পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী আমাদের সংগঠনের শিবির করার কাজে যে উদারতা দেখিয়েছে তার কোন তুলনা হয় না।আসুন সবাই মিলে তার এই মহৎ দান কে করতালিতে স্বাগত জানাই...।