রাজু কাকা
সান্ত্বনা ব্যানার্জী
"অ্যাই ! অ্যাই!সর, সর।উর ডাবায় মুক দিচিস কেনে?তুর নিজের যাব খা কেনে!মুই কি কারো মুকের গেরাস কেরি খাই? তু কেনে খেছিস?"....রাজু কাকা এই রকম করেই অনর্গল কথা বলে গরু গুলোর সঙ্গে।রাজু কাকা আসার পর থেকে সেজো কাকুর কাজ একটু কমে গেছে আর মেজাজটা ও ভালো হয়েছে।এখন প্রায়ই বাঁশি বাজায় সন্ধের পর।তখন ইংরেজী টা কাকুর কাছে নিয়ে গেলে পরিয়ে দেয়।এখন অঙ্ক কষতে কষতে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখে এক মনে গোয়াল পরিষ্কার করছে রাজু কাকা।
প্রায় ছয় মাস হয়ে গেলো রত্নাদের বাড়িতে এসেছে রাজু কাকা।বীরভূমের কোন এক গ্রামে বাড়ী।স্টেশনে বসেছিল আর একে তাকে কাজের জন্য অনুরোধ করছিলো।সেজো কাকুর সঙ্গে সেখানেই দেখা,আর বাড়িতে নিয়ে আসা।সেই থেকেই বাড়ীর বাঁধা মুনিষ রাজু কাকা। বেঁটে খাটো কালো , কিন্তু ভারি সতেজ ।
সব সময় যেন তেল মেখে আছে। তেমনি যত্ন করে গোয়ালের গরু মোষ গুলোকে।ওর নিজের মতো ই চকচকে করে ফেলেছে গরু মোষ গুলোকে।
বাড়িতেও যেন এক শান্তির হাওয়া। সবচেয়ে খুশি হয় রত্না ওর মায়ের জন্য।মায়ের কাজ অনেক টাই কমে গেছে।সকাল থেকে মা আর কাকীমা যেন তাঁতের মাকুর মত বাড়ীর এ প্রান্ত।থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়ায়।দক্ষিণের ঘরে চালতো উত্তরের ঘরে আলু,কুমড়ো। ভোর থেকে ছুটোছুটি, অফিস,ইস্কুলের ভাত,তারপর জন কিষেনের রান্না,তার ওপর ধান সেদ্ধ,মুড়িভাজা।
এখন এই ধান সেদ্ধ শুকনো র কাজ গুলো করে রাজুকাকা,মায়ের হাতের কাছে শাক সবজির যোগান দেয়।মা এখন একটু বিশ্রাম পায়,দুপুরে চুল মেলে দিয়ে একটু গড়িয়ে নেয় রেডিওতে গান শুনতে শুনতে।ভারি ভালো লাগে রত্নার।কাজ সারা হলে রাজু কাকা ও গান শোনে আর বক বক করে মায়ের সাথে।"মেজ ঠাকরুন একট সবুজ পারান ডিংলা আনলাম,নাককেল দিয়ে রান্ধ দিকি আজ রেতে বেশ ভালো করি,গরম গরম রুটি দে খাতি বড্ড ভালো নাগে।".....তোমাদের বাড়ীতে কে রান্না করে রাজু?মা জিজ্ঞেস করে।"আগে মা করতো,একুন বৌদিদি রান্দে,মায়ের মতন লয়।তুমার রান্না আমার খুব ভালো নাগে মেজ ঠাকরুন"।মা একটু চুপ করে যায়,তারপর বলে .....তুমি একবার বাড়ী ঘুরে এসো না রাজু, বাড়ীর সবাই চিন্তা করছে.....।না!বাড়ী যাব নেকো।....বলেই কেমন মাথা নিচু করে চুপ করে যায়,আর উঠে গোয়ালের দিকে চলে যায়।গরু গুলোকে খাবার দিতে দিতে বকতে থাকে নিজের মনে..... তু বড়ো বাচাল হইছিস কেলো! নাগার ধোলোর ডাবা তে মুক দিছিস।দ্যাক তো ছেমলিকে!কি নক্কি মেয়ে, কারও ডাবাতে মুক দেয় নাকো!.......
বক বক করেই যায়।
দেখতে দেখতে দুর্গাপুজো চলে এলো।গ্রামে মোট এ দুটো পুজো। পাড়ার পুজো টা। রত্নার বাড়ীর কাছেই।সারাদিন নিজেরাই ঠাকুরতলা আর বাড়ী আসা যাওয়া করে।কিন্তু অন্য পাড়ায় একা যাওয়ার হুকুম নেই।বিশেষ করে ছোট বোন টুকটুকি,সে তো ভালো করে হাঁটতেই শেখেনি। তো বিকেলবেলা রাজু কাকা সবাইকে নিয়ে চললোঠাকুরদেখাতে,কাঁধে চরলো টুকটুকি,বাকি সবাই হেঁটে হেঁটে।কাঁধে চরা টুকটুকির সঙ্গে একভাবে বকতে বকতে চলে রাজু কাকা....... টুকি,দেখতি পাবা,কি সোন্দর দুগ্গা মা!ইয়া তাগড়া অসুর!গণেশ দাদার পেটটি নাদা, খড় খায় গাদা গাদা!আর নক্বী ঠাকুরের চরণে ঠাঁই দ্যাবরা চোকো প্যাঁচা!সব দিকাবো তোকে। ......ঠাকুর দেখার পর সবাইকে বুড়ির চুল , পাঁপড় ভাজা কিনে দেয়,বাড়ী ফিরে সবিস্তারে গল্প করে মায়ের সঙ্গে।
একদিন সেজো কাকুর সঙ্গে কি এক কারণে ধুন্ধুমার ঝগড়া লেগে গেল।হাত মুখ নেড়ে কাকুকে বললো রাজু কাকা........আর একদিন যদি তুমার জমি পানে যেছি,তো মুই ঢোল গোবিন্দ কম্মকার এর ব্যাটা ই নই!......বলে নিজের ঘরে ঢুকে খিল দিয়ে দিলে।
সবাই মিলে অনেক সাধ্য সাধনা করেও খিল খোলানও গেল না।কাকু ও খুব ভয় পেয়ে গেল।
কোথায় বাড়ী,ঠিকানা কিছুই ঠিকভাবে বলেনি রাজু কাকা।আসার পর থেকে কখন যেন বাড়ির ই একজন হয়ে গেছে। বাচ্চা বড়ো সবাই ভালোবেসে ফেলেছে ওকে।কত কাজ যে সারা দিন করে তার হিসেব নেই। প্রত্যেক দিন বিকেলে রত্নার দাদুকে মোজা জুতো পরিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য তৈরী করে দেয়,রান্নাঘরে বালতি ভরে জল তুলে দেয়,মাঠে কিষেন দের ভাত নিয়ে যায়,কত কি! যাই হোক, শেষকালে মায়ের অনেক অনুনয় বিনয় ফেলতে না পেরে ঘর থেকে বেরোয় রাজু কাকা,মাকে বলে.....এই তুমি ডাকলে তাই আগোর খুল্লুম,মায়ের মত মনিষ্যইরে অমান্যেই কর্তি নাই।দ্যাও ভাত দ্যাও!খিদে নেগেছে বেদম!সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো!
এর ক' দিন পরেই ঘটলো আশ্চর্য এক ঘটনা!দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া সেরে মা আর কাকীমা একটু রেডিও টা নিয়ে বসেছে,। রাজু কাকা ও মাঠ থেকে ফিরে বিরাট কলাপাতায়
প্রায় এক হাঁড়ি ভাত , ডাল তরকারি, দিয়ে মেখে,একবাটি টক এর চাখনা দিয়ে খেয়ে দাওয়ায় গামছা বিছিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে,এমন সময় সদর দরজা ঠেলে উঠোনে এসে দাঁড়ালো আর এক রাজু কাকা! এক চেহারা,এক মুখ!কেবল পরনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি,, চুল বেশ পরিপাটি করে আঁচড়ানো, হাতে বড়ো সরো একটা মিষ্টির হাঁড়ি!সবাই তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এই নতুন রাজু কাকা তরতর করে এগিয়ে এসে বাড়ীর রাজু কাকা কে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠলো আর বলতে লাগলো.......তু কেনে এমন
কল্লি রে ভাই!কি করে এদ্দিন নুকিয়ে রইলি!শেষ কালে বংশের মুকে চুন কালি মাখালি!যাদের ঘরে রোজ দশ বিশ টা মুনিস খাটে ,গোয়াল ভরা গরু মোষ, সার সার ধানের মরাই,সে কিনা.......!
তার বিলাপের আর শেষ নেই!ইতি মধ্যে বাড়ীর সবাই জড়ো হয়ে গেছে।নতুন আগন্তুক ,রাজু কাকার যমজ ভাই সাজু কাকা,বহু খোঁজ খবর করে শেষ পর্যন্ত সন্ধান পেয়ে ভাই কে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। ক্রমশঃ জানা গেলো বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামের
বর্ধিষ্ণু পরিবারের ছেলে রাজু কাকা।একটু সরল প্রকৃতির,আর বদরাগী। বাড়ীতে রাগারাগি করে চলে এসেছিল,ভাই কে দেখে সে রাগ ও পড়ে গেলো।সবার অনুরোধে সে রাতটা ওরা রত্না দের বাড়ীতে থেকে গেলো।রাতে অনেক রকম রান্না করে মা কাকীমা যত্ন করে খাওয়ালে চোখের জল ফেলতে ফেলতে।পর দিন দুই ভায়ে যখন চলে গেলো বাড়ীর সবার চোখে জল।যাবার সময় টুকটুকি কে কোলে তুলে আদর করে রাজু কাকা বললে.......টুকি,আমাদের ঘর যাস কেনে, আমার ছেমলির দুধ খাওয়াবো,সরালের মাংস রান্দি খাওয়াবো! সেজো কত্তা ,মা ঠাকরুন ছেলে পিলে দের ন্যে যেও কেনে আমাদের গেরামে!
কলিন পুর গো কলিন পুর!.....।
-------------------------------
সান্ত্বনা ব্যানার্জী,
হুগলী।