ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পরজীবী (পর্ব -৪) ।। অভিষেক ঘোষ
পরজীবী
অভিষেক ঘোষ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৯৯১
"কে করলো বলতো মার্ডারটা ?" - চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করে নন্দদা । একটা নোংরা ধুতি আর ঘামে গায়ে লেপটে থাকা ফতুয়া পরে আছে সে ।
"তা আমি কী জানি ! তাছাড়া মার্ডার হয়েছে, কে বললো তোমায় ? এসেছিলাম লালু বাবুর ঘরে চুরি করতে । দেওয়াল বেয়ে নেমে দেখি এই ক্যাঁচাল ।" - মধু অসহিষ্ণু স্বরে জানায় ।
"ও !" মদের ঘোরে অতিসংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় নন্দ ।
"বলছি মেয়েটা যে বেঁচে আছে গো ! কী করা যায় বলো তো ?"
"বেঁচে আছে ?" - নড়বড় করতে করতে দেওয়াল ধরে অন্ধকারে বসে পড়ে নন্দ । তারপর মেয়েটার নাকের কাছে হাত নিয়ে, শ্বাস চলাচলের বিক্ষিপ্ত ও মৃদু চলন খেয়াল করে, আবার সংক্ষেপে বলে, "হ্যাঁ ।"
"তা কী করবে ?"
"আমি কী করবো ? আমার নিজেরই বলে কিছু ঠিক নেই ! আমি কী করবো ?" - মধুকে তেড়ে ওঠে নন্দ । তারপর রাধাকান্তর জল-কাদা-রক্তমাখা শরীরটার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে, "রাধা না ? এ কী করছে এখানে ?"
"তোমাদের বাড়ির লোক ! তোমারই তো জানার কথা ! চরিত্তির তো ভালো নয় । সবাই জানে । তুমি জানো না ?"
"জানি জানি ! একটু বেশি জেনে গিয়েছিলাম বলেই তো তাড়িয়ে দিলো । তা ওর কী দশা ? বেঁচে আছে ? মরলে অবশ্য আপদ কমে !"
"নন্দদা... পুলিশ কেস হবে গো.. দুটো পথ । হয় মেয়েটা-সমেত রাধা বাবুকে বাঁচাতে হবে, নয়তো এখানে থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে পড়তে হবে ।"
"চম্পট দিবি ?" রাধাকান্তর নাড়ি টিপে নন্দ বলে ওঠে, "দু-দুটো মানুষকে মরতে গলিতে ফেলে রেখে পালাবি ? ভ্যান আন । পালপাড়া থেকে ডাক্তার কাকাকে ডাক্, আমার নাম করে ডাকবি ।"
"ওই দেখো ! এত রাতে ভ্যান কোথায় পাবো ? সেই সর্দার পাড়া যেতে হবে ! এখন যাবো ? বড্ড ভেতরপানে যে গো ! তার ওপর ডাক্তারবাবুকে আমি ডাকলে আসবে ?"
"বললাম তো আমার নাম করবি, বলবি সদানন্দ মিত্তির বলেছে । বুঝলি ? এখনও কিছু লোকের এই মক্কেলের কাছে ঋণ আছে । বাবা বেঁচে থাকতে ওই ডাক্তারের ডাক্তারখানা আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বানিয়ে দিয়েছি । ডাক্তার কাকার ছেলেকে হসপিটালে ঢোকানোর পেছনেও মিত্তিরবাড়ি । তাড়াতাড়ি যা… ।"
মধু অগত্যা একাই রওনা দেয় । সময় কাটতে থাকে । নন্দ ফতুয়ার বাঁ পকেট থেকে রুমাল বের করে আনে, ডান পকেট থেকে বার করে ছোটো একখানা দিশি মদের বোতল । দু-ঢোক গিলে, রুমালটাতে একটু মদ ঢেলে ভিজিয়ে নেয় । তারপর ভিজে রুমাল দিয়ে মেয়েটার চোখ-মুখ মুছে দেয় । নন্দ নামমাত্র আলোতেও চিনতে পারে । তার মনে পড়ে, এই মেয়ে এক ঝড়জলের রাত্রে সুন্দরপুরে এসেছিলো । তারপর কৃষ্ণকান্ত এক হপ্তার জন্য ঘরহারানো চরের লোকগুলোকে আশ্রয় দেয়, দশ-বারোটা পরিবার আটচালায় গিয়ে উঠলো । শুধু এই মাধবীকে সে বাড়িতে এনে তুললো । মেয়েটা সদানন্দ-কে কাকা বলতো । বরাবরই ওর উপরে রাধাকান্তর নজর ছিল । কিন্তু রাধাকান্তর এই হাল করলো কে ? ভাবতে ভাবতেই নন্দ নিজের ফতুয়াটা খুলে ফেললো, তারপর মেয়েটার হুক-ছেঁড়া ব্লাউজটা খুলে নিয়ে, নিজের ফতুয়াটা পরিয়ে দিলো । যাক্... তাকে 'কাকা' বলে ডাকতো মেয়েটা, লজ্জাটুকু অন্তত বাঁচাক সে.. তারপর হারামিগুলোকে ধরতে হবে ।
নন্দ হিসেব মেলাতে পারছিলো না ! এক হতে পারে, কৃষ্ণকান্ত গুন্ডা লাগিয়েছে । কিন্তু মাধবীকে সে নিজেই প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছে । এখানকার গ্রামীণ হাসপাতালে সে নার্সিং ট্রেনিং নিচ্ছে । দশ ক্লাস পাসও দিয়েছে । তাহলে ? আর রাধাকান্তকেই কৃষ্ণকান্ত সবচেয়ে ভালোবাসে, যা চেয়েছে বরাবর তাই পেয়েছে । ওই কারণেই বেশি আদরে বাঁদর হয়েছে । গ্রামের সব মেয়েকেই সে ভালো করে চেখে দেখতে চায় ! ঝি-বউ মানে না ! অথচ কীই বা বয়স ওর ! বাপের পয়সা সরায়, কথায় কথায় মিথ্যে বলে । মিথ্যে কান ভাঙিয়ে, চেঁচামিচি করে, তাকেও মিত্তির বাড়ি থেকে তাড়ালো । আর আজ দেখো ! জলে-কাদায় রক্ত মেখে পড়ে আছে ! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সদানন্দ মিত্তির ।
তারপর আবার মাধবীর দিকে তাকায়, মেয়েটা তাকে কাকা বলতো । ঠিকই... কিন্তু সদানন্দ তো একজন আর্টিস্ট ! সে শুধু মাধবীকে আঁকতে চেয়েছিলো । কি ফিগার ! অভাবের ঘরে ওর'ম স্বাস্থ্য হয় কী করে, কে জানে ! ওর গায়ের রঙটাও অদ্ভুত, হাতের ময়লা-লাগা সাদা খড়ির মতো । নন্দ বলেছিলো, ‘খোলা পিঠে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে পারবি ?’ কে জানতো, হাবা মেয়েটা সে কথা বেছে বেছে রাধাকান্তকেই বলে ফেলবে ! মাধবী কি তবে ওই খোক্কসটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো ? না না… তা কী করে হবে ? চালাক-চতুর মেয়ে বলেই তো মনে হতো ! চরের লোকগুলোর মতো হাবা নয় । অবশ্য ওই বয়সে ওইরকম একটা তেজি ছোঁড়াকে, ওর মতো একটা মেয়ের পক্ষে ভালোবেসে ফেলা আশ্চর্যের কিছু নয় । আর সেটা যদি না-ই হয়, তাহলে কী ? ঈর্ষা ? একটা কানাঘুষো শুনেছিল সে, মাধবী নাকি আসলে কৃষ্ণকান্তের ঔরসজাত ? তাহলে কি ও রাধাকান্তকে কোনোভাবে বিপাকে ফেলতে চাইতো ? হিংসে করতো বলে ! কারণ বাবা তো ওর-ও, রাধাকান্তর একার তো নয় ! চন্দ্র-সূর্য-কেও মেয়েটা হিংসে করতো ! কৃষ্ণকান্তর চোখে ওর প্রিয় ছেলে ক্রমশঃ বখে যাবে, বিগড়ে যাবে, বাবার মুখে মুখে তর্ক করবে, হঠকারি সিদ্ধান্ত নেবে, মাধবী কি তাই চাইতো ? সেজন্যই কি মাধবী আসার পর থেকেই রাধা আর কৃষ্ণর – বাপ-ব্যাটার সুসম্পর্কে চিড় ধরলো ? তারপর থেকেই কি ? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেয়ে, সদানন্দ নিজেই প্রচণ্ড আশ্চর্য হয়ে গেল ! ওইটুকু মেয়ের তলে তলে এতো বুদ্ধি ! শুধু শেষটুকু গোলমাল হয়ে গেলো ! তাই হয় ! রাধাকান্ত বড়ো জেদি ছেলে, ওই বয়সে ওর বাপও অমন ছিলো ! শুধু বৌদিদির চোখের সমস্যটাই কৃষ্ণকান্তর চোখ খুলে দিয়েছিলো, নিজেকে সামলে নিয়েছিলো দাদা । নাকি সেজো ছেলেটার অকালমৃত্যু ? কিন্তু রাধাকান্তকে বড্ড আলগা দিয়ে ফেলেছিল সে-সময়, ভুল করেছিলো । আজ দেখো তো ! যদি সত্যিই মাধবী দাদার নিজের মেয়ে হয় আর যদি সত্যিই রাধা ওর সাথে শুয়ে থাকে... না না.. তার তো কোনো প্রমাণ নেই ! ছিঃ ছিঃ ! কিন্তু তাহলে রাধাকান্তকে কে এভাবে মারলো ? দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরে এলো গায়ে গলির কাদাতেই থেবড়ে বসে পড়ে সদানন্দ ।
মাধবীকে একবারই এঁকেছিলো সদানন্দ । ওই তার মিত্তিরবাড়িতে বসে শেষ ছবি আঁকা । পূবের ঘরের জানালা দিয়ে খাসা আলো এসে পড়ছিল ওর গায়ে । মাধবী পিছন ফিরে, ব্লাউজ খুলে খোলা পিঠে সদানন্দর দিকে পিঠ করে দাঁড়ালো, আঁচলটা কায়দা করে বুকে চেপে ধরে । সদানন্দ ওকে পোজটা কয়েকবার বুঝিয়ে দিয়ে, নিশ্চল থাকতে বলেছিলো । ব্যাস ওইটুকুই । তারপর দেড় ঘন্টা মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে সদানন্দর মুখে "বোস্ এবার..." এটুকু শুনেই, আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে ছুটে এসেছিলো মেয়েটা । স্কেচটা ভালো করে হাতে তুলে নিয়ে দেখে, ঝলমলে মুখে বলেছিলো, "তুমি কী ভালো আঁকো গো ! না দেখলে ভাবতাম, মিছে কথা !"
কথাটা কৃষ্ণকান্তর কানে যাওয়া মাত্রই চূড়ান্ত অপমান আর পত্রপাঠ সদানন্দর বিদায় । সম্পর্কে কৃষ্ণকান্ত তার জ্যেঠার ছেলে, ছয় বছরের বড়ো দাদা । বিদায় অবশ্য মুক্তি হয়েই এসেছে তার জীবনে, সদানন্দ সেকথা ভেবে মনে মনে হাসে । বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সে তো একরকম নিজের বাড়িতেই দাদার গলগ্রহ হয়ে ছিলো । সদানন্দ এখন গ্রামের শেষ সীমায় পুরোনো ধানকলের ফাঁকা ঘরটায় থাকে । এখানে তার বাবার আমলে কাজ হতো । এখন পরিত্যক্ত । কৃষ্ণকান্তই ব্যবস্থা করে দিয়েছে । দাদা ওপরে যতই কড়া হোক্, ভিতরে নরম । সেটা সবাইকে বুঝতে দেয় না । খুড়তুতো ভাই সদানন্দকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে সে নিজেই তাই পৃথক ব্যবস্থা ও মাসোহারার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে । অন্য কেউ হলে এতো করতো না ! সদানন্দর একটা ছোটো বিজনেসও হয়েছে এখানে আসার পর। তার বর্তমান আশ্রয় ওই পরিত্যক্ত ধানকল যেহেতু বাস রাস্তার গায়ে, তাই যাত্রীদের সাইকেলগুলো সে চার আনার বিনিময়ে রাখে । বেশ দু-পয়সা রোজগারও হয় বসে বসে । টিফিনে পেটা পরোটা আর ঘুগনির পয়সা উঠে আসে । দুপুর আর রাতের খাবার তো নিতাই দিয়ে যায় সাইকেলে করে, টিফিন ক্যারিয়ারে । নাহ্... কৃষ্ণকান্তকে খবরটা দিতে হবে.. রাধা-র এই অবস্থা । মধুকেই বলতে হবে মিত্তির বাড়ি যেতে । কিন্তু ও কি রাজি হবে ?
সদানন্দ ধুতির কাপড় তুলে মুখ মুছে, মাধবীর মাথাটা নিজের কোলে ভালো করে রাখে । সেদিন কি মুহূর্তের জন্য ওর মনে হয় নি, পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ি ? হয়েছিলো নিশ্চই, কিন্তু জন্তু তো নয় সে । মানুষ তো ! কিন্তু কৃষ্ণকান্ত যখন রাধাকান্তর কাছে খবরটা শুনে ক্ষেপে লাল হয়ে বাড়ি মাথায় তুললো, তখন জীবনে প্রথম দাদার মুখে তার প্রতি ধেয়ে আসা 'লম্পট' শব্দটা শুনেছিল সদানন্দ । সে লম্পট ? তাহলে কৃষ্ণকান্ত কী ? আর কী যেন বলেছিলো ? গত বছরের কথা... হ্যাঁ মনে পড়েছে তার, 'বেইমান !' কী বেইমানি সে করেছে, তার মাথায় আসেনি তখন । শুধু ক্রুদ্ধ কৃষ্ণকান্তকে সে জোরগলায় বলেছিল, "হ্যাঁ এঁকেছি ! কিন্তু মাধবীর গায়ে হাতও দিই নি । কী করবে তার জন্য ? মারবে ?" তারপর একবার মাধবীর দিকে তাকাতেই সে চোখ নামিয়ে নিয়ে, মৃদুস্বরে বলেছিলো, "আমি তো রাধাবাবুকে ভালো মনেই বলেছি, যেটা সত্যি সেটাই বলেছি ! আমি কী করে জানবো, উনি বলে বেড়াবেন ?" এখন দৃশ্যটা ভেবে দেখতেই মনে পড়ে, কথাগুলো মাধবী এমনভাবে বলেছিলো যাতে শুধু সদানন্দই শুনতে পায় । মড়ার মতো তার কোলে পড়ে থাকা মেয়েটার ভিজে গালে আলতো একটা চড় মারে সদানন্দ । সেদিন অনেক ঝামেলার পর কৃষ্ণকান্ত তার রায় ঘোষণা করেছিলো, বউদিদি বহু চেষ্টা করেছিলো আটকাতে । কিন্তু বেয়াদপ রাধাকান্ত তার মা-কে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে, বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছিলো । চমৎকার ছেলে !
এবার দুয়ে-দুয়ে যদি ঠিকঠাক চার বের করতে হয়, তাহলে সদানন্দ প্রায় নিশ্চিৎ যে, রাধাকান্ত মাধবীর উপর অনেকদিনের জমানো রাগের শোধ নিয়েছে । সে জানতো, কৃষ্ণকান্ত বেঁচে থাকতে সে মাধবীকে পাবে না । আবার বাবার বিরুদ্ধে সোজাসুজি যাওয়াও সম্ভব নয়, সব খরচের টাকা বাবাই তাকে দেয় । ওদিকে মাধবী তাকে দিনের পর দিন বোকা বানিয়েছে, ঠকিয়েছে, ল্যাজে খেলিয়েছে । তারই শোধ নিতে রাধাকান্ত তার মানে মাধবীকে তুলে এনেছিল কাছাকাছি কোথাও । অত্যাচারটা এখানে করে নি সে । তারপর ? তারপর কৃষ্ণকান্ত খবর পেয়ে, লোক পাঠিয়েছে । ওর পাঠানো লোকই কৃষ্ণকান্তকে মেরে এখানে ফেলে রেখে গেছে । হয়তো অন্ধকার গলি বলেই । নাকি মারপিটটা এখানেই হচ্ছিল, আচমকা মধু ওপর থেকে দেয়াল বেয়ে গলিতে নেমে পড়েছে ? আর তাকে দেখেই ভরকি খেয়ে গুন্ডাগুলো পালিয়েছে । ক'জন ? দু-তিনজন তো হবেই ! সম্ভবতঃ ওরা দু-জনকেই তুলে নিয়ে যেত ! বাইকটা নেই, রাধাকান্ত আর ওই অশুভ বাইকটা হরিহর আত্মা । সেটা নেই মানে কৃষ্ণকান্তর গুন্ডারা বাইকটা নিয়ে পালিয়েছে । পালাবে কেন ? তাহলে কি কৃষ্ণকান্তকে খবর দিতে গেছে ওরা ? কে জানে ! তার মানে রাধাকান্তর এই দশার পিছনে কৃষ্ণকান্ত, পাপের শাস্তি ! নিজেরও, ছেলেরও ! তাই হবে ! নিজের মনেই বলে ওঠে সদানন্দ "তাই হবে !" কথাটা ভাবতে ভাবতেই মধু ভ্যান নিয়ে হাজির হল ।
ভ্যানে আধমরা শরীরদুটো টেনেটুনে ওঠানোর সময় ভ্যানওলা তীব্র আপত্তি করেছিলো । কিন্তু দেখা গেল, মধু কাজের ছেলে । ভ্যানওলা কালীপদ সর্দার কোথায় বাগদি পাড়ায় কোন্ মেয়ের সাথে লুকিয়ে দেখা করে, সে কথা ওর বউকে বলে দেবার হুমকি দেয় মধু ! চোরেরা দুনিয়ার খবর জানে । আর তাতেই বেচারা কিছুটা নরম হয় । তারপর গজগজ করতে করতে ভ্যান টেনে নিয়ে যায় রাস্তায় । গলি থেকে বেরোতেই চাঁদের আলোয় অনেক স্পষ্ট হয়ে যায় সবকিছু । রক্ত শুকিয়ে গেছে দুজনের চোখেমুখে, পুলিশ কেস হবে, সে ঝামেলায় পড়তে চায় না - এসব কথাই বারবার ইনিয়ে বিনিয়ে বলে চলে কালীপদ । তারপর গুনোদাদুর দোকানে তাদের চারজনকে নামিয়ে দিয়েই কেটে পড়ে ।
মধু বড়ো কাজের ছেলে । গুনোদাদুকে আগেই বলে রেখেছে সে । গুনোদাদু সারা রাত দোকানেই ঝাঁপ ফেলে একধারে শোয়, কানে ভালো শোনে না । বাজার নির্জন হয়ে গেলে, রাতের খাবারটা সদানন্দ প্রায়ই এই বুড়ো লোকটার সাথে ভাগ করে খায় । অনেক গল্প হয় তখন । বুড়ো কথা বলার লোক পায় না, এদিকে দাঁতও নেই, ফকফক্ করে কথা বলে ।
ডাক্তার কাকা সময় মতো আসেন । মিত্তির বাড়ির হাউস ফিজিসিয়ান । হোমিওপ্যাথি-অ্যালোপাথি দুইই অল্পবিস্তর জানেন । গ্রামের লোকের টাকা কোথায় যে ট্যাবলেট কিনে খাবে ? তাদের হোমিওপ্যাথিই ভরসা । ডাক্তার কাকা বিচক্ষণ লোক, তিনি দুজনেরই প্রাথমিক চিকিৎসা করেন ও পুলিশকে খবর দেন । কৃষ্ণকান্তর ওপর তাঁর পুরোনো রাগ । মিত্তির বাড়ির বৌমার চোখ নাকি তাঁর ভুলেই খারাপ হয়েছে - এই অপবাদ কৃষ্ণকান্তই রটিয়েছে তাঁর নামে । তিনি বেরোবার আগে বলে গেলেন, রাধাকান্তর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে তিনি আদালতে সাক্ষ্যও দেবেন; যদিও মাধবীর উপর কোনো যৌন নির্যাতনের প্রত্যক্ষ চিহ্ন তিনি খুঁজে পান নি, কিন্তু রাধাকান্ত ও মাধবী – উভয়েরই পোশাকে সিমেন লক্ষ করেই তিনি নিশ্চিত হয়ে যান । যদিও তাঁর মতে, অপরাধী রাধাকান্তর বাঁচার আশা কম । মাধবী বেঁচে যাবে । তবে দুজনকেই সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার ।
ডাক্তার কাকা বেরিয়ে যেতেই সদানন্দ মধুকে ডাক দেয়, "আর একটা কাজ করে দে... বাপ্ আমার !"
"ওই দেখো ! আবার কী কাজ ! চোরাই মালগুলো নিয়ে পুলিশের হাতে পড়ে মরি আর কি !"
"মালগুলো গুনোদাদু লুকিয়ে রাখবেখন, তুই পরে এসে নিয়ে যাবি । আমার বাসা থেকে রঙ-তুলিগুলো একটু এনে দে দেখি ।"
"আজব লোক মাইরি ! মাতাল শালা ! এখন উনি আঁকতে বসবেন ।"
"যা বাপ ! কতো পুণ্য করছিস বল্ তো ?"
"হ্যাঁ পুন্ন না আরো কিছু ! ন্যাকামি করছে আবার !"
মুখে বলে বটে, কিন্তু দোকান থেকে সাইকেল নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে । দশ মিনিটের মধ্যে ফিরেও আসে, সঙ্গে যা হাতের কাছে পেয়েছে বাজারের ব্যাগে করে সব এনেছে ।
"লক্ষ্মী ছেলে । তা হ্যাঁ রে জলের গেলাসটা এনেছিস কেন ?" - বলে ব্যাগ থেকে একটা গ্লাস তুলে মধুকে প্রশ্ন করে সদানন্দ ।
"তা আমি কি জানি ! তুলিগুলো তো ওতেই ছিলো !"
"ওহ্ !" বলে সদানন্দ মহানন্দে রাধাকান্তর মুখের কাছে আর্ট পেপার আর রং-তুলি নিয়ে বসে পড়ে । মধু অবাক হয়ে একবার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা কাহিল রাধাকান্তর জ্ঞানহীন মুখটার দিকে তাকায়, তারপর সদানন্দর হাতে ধরা তুলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, "কী আঁকবে গো ? আধমরা মানুষের মুখ ?"
"তোর মাথা আর আমার মুণ্ডু । এই যে একজন মৃত্যুর মুখোমুখি, এই সময়ে চোখেমুখে অনেক খেলা চলে । অনেক ভুল, দুঃখ, স্বপ্ন, আনন্দ খেলা করে চোখে মুখে । গোটা জীবনটা ওই দুটো বন্ধ চোখের সামনে ঘুরপাক খায় । ওসব তোর চোখে ধরা পড়বে না । বুঝলি ?" - কথাগুলো বলে দোকানের ষাট্ পাওয়ারের ঝুলন্ত বাল্বটার দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে জোরগলায় বলে, "গুনোদাদু… আর আলো নেই জোরালো ?"
ভিতর থেকে বৃদ্ধ একটা বেশি পাওয়ারের বাল্ব এনে দিলে, মধু সেটা লাগিয়ে দিতেই আলো বহুগুণ বেড়ে যায় । ঠিক তখনই রাধাকান্ত চোখদুটো সামান্য খুলতে পারে । ওদিকে রাতের অন্ধকার খানখান করে পুলিশের জিপের আওয়াজ শোনা যায় । আর এদিকে নিজের চরম বিপদের মধ্যেও মধু লক্ষ্য করে, নন্দদা ঠিকই বলেছিলো ! রাধাবাবুর চোখে যেন কতো কী নাচছে !
মধুর বাঁ হাতের কনুই খামচে ধরে সদানন্দ বলে, "পুলিশ আসছে বলে ভয় পাসনি মধু । তোর চুরির কথা কাউকে বলবো না । আর তুই পুলিশকে বলবি, আমরা দুজনে মাল খেতে খেতে ওই গলির মুখে গিয়ে ওদের দুজনকে পড়ে থাকতে দেখতে পাই । মনে থাকবে ? এই নে... একটু মাল খেয়ে নে.. মদ্যপানের উপকারিতাও আছে বাওয়া । কতো বিচি-জমে-যাওয়া শীতে এই মাল টেনে আমি সাইজ হয়েছি !"
গোলমালে মধুর মাথাতেই আসে না, যে গলিতে ঘটনাটা ঘটেছে, সেই গলির পাশের বাড়িতেই সে রাতের চুরিটা করেছে । তাই দুয়ে-দুয়ে চার করতে পুলিশেরও দেরি হবে না । কিন্তু সে জানতো না, ইতিমধ্যে মাধবী আর রাধাকান্তর খোঁজে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে হাজির হয়েছেন কৃষ্ণকান্ত মিত্র । পুলিশের গাড়িতে তিনিও আসছেন । তিনি নিজেই চান না, ঘটনাটা নিয়ে বেশি জলঘোলা হোক্ ।