সোমা চক্রবর্তী
'নেড়াপোড়া' বললে নিশ্চয়ই আমাদের মতো অনেকেরই নিজেদের ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ে যায়! কেউ কেউ আবার বলে, "বুড়ির ঘর পোড়ানো"। হিন্দীতে বলে "হোলিকা দহন"। দিনটা হলো দোলের ঠিক আগের দিন। আমাদের ছোটবেলায় স্কুলে সেদিন হাফ-ছুটি হতো। মানে টিফিনের সময় পর্যন্ত স্কুল, তারপর ছুটি। সেও এক ভীষণ খুশীর বিষয় ছিল আমার কাছে। এমনি দিনের থেকে হাফ-ছুটির দিনগুলোতেই স্কুলে যেতে বেশী ভালো লাগতো আমার। সে যাই হোক, নেড়াপোড়ার দিন তো স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বিকেল থেকেই শুরু হয়ে যেতো শুকনো কাঠ, পাতা জোগাড়ের তোড়জোড়। অনেকেই আবার আগের দুই-তিন দিন ধরে একটু একটু করে জমিয়ে প্রচুর শুকনো পাতা জোগাড় করে রাখতো। আমাদের বাড়িতেও অনেকে শুকনো পাতা নিতে চলে আসতো। বড়ো বড়ো গাছের তলা থেকে ঝরা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে যেতো। ছোটবেলায় দেখেছি, শুকনো কলাপাতায় খুব দ্রুত আগুন ধরে যায়। শুকনো কলাপাতা বা কলাগাছের ছালকে অনেককেই বলতে শুনেছি "কলার বাসনা"। (উচ্চারণ অনেকটা 'বাশ্না'- এইরকম। বাংলা অভিধানে 'বাসনা' শব্দটির অন্য একটি অর্থ রয়েছে কলাগাছের শুকনো পাতা বা ছাল।) সেই কলার বাসনা নিতেও অন্য পাড়ার ছেলেমেয়েরা আসতো আমাদের বাড়িতে। তারপর সন্ধ্যে হতে না হতেই সেই শুকনো পাতার স্তূপে আগুন ধরানো হতো। মায়েদের কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে নিয়ে আসা কয়েকখানা আলু মহা উল্লাসে সেই আগুনে ফেলে দিতাম আমরা। যতক্ষণ না পুরোপুরি ভাবে আগুন জ্বলে ওঠে, ততক্ষণ মাথা উঁচু করে বাতাসের সঙ্গে নাচতে থাকা আগুনের শিখাগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম, আগুন যতো বেড়ে উঠছে, ততোই হলুদ আগুনের ধারে ধারে লালের রেখা ফুটে উঠছে। তার উপর অগুন্তি হালকা নীল রঙের শিখা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তারও ওপর থেকে ছোট ছোট আগুনের ফুলকি উড়ে উড়ে মিশে যাচ্ছে চৈত্রের বিহ্বল হাওয়ায়।
আমরা অবাক বিস্ময়ে সেই দিকে শুধু তাকিয়ে থাকতাম। আগুনের ভেতর থেকে ছোট ছোট শুকনো গাছের ডাল ফুট্-ফাট্ শব্দ করে ফেটে উঠতো। আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের বাতাস গরম হয়ে উঠতো। মাথার ওপর তখন প্রায়-গোলাকার বিশাল হলুদ চাঁদ। পরের দিন দোল পূর্ণিমা! আমাদের কচিকাঁচাদের সম্মিলিত চেষ্টা চলতো যতক্ষণ পারা যায়, আগুনটাকে জ্বালিয়ে রাখার। কারণ, যতক্ষণ নেড়াপোড়ার আগুন জ্বলবে, ততক্ষণই মজা। ততক্ষণই পড়াশোনা থেকে ছুটি। ততক্ষণই সন্ধ্যের অন্ধকারে বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ির বাইরে থাকা। তবে শত চেষ্টা সত্ত্বেও, একসময় স্বাভাবিক ভাবেই নিভে আসতো আগুন। তখন চলতো লম্বা লম্বা কঞ্চি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গরম ছাইয়ের ভেতর থেকে কালিতে মাখামাখি পোড়া আলুগুলোকে খুঁজে বের করা। গম্ভীর মুখে সেই আধসেদ্ধ আলু দিয়ে আলুকাবলি বানিয়ে অপরিসীম আনন্দে খেতাম আমরা। এখন কালেভদ্রে কখনো আলুকাবলি খেলে, তা সে বাড়িতে বানানোই হোক, কিম্বা কেনাই হোক, তার মধ্যে সেই পোড়া পোড়া গন্ধের অভাব বোধ করি ভীষণ ভাবে। মেয়েকে আগ্রহ সহকারে বলতে চাই সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা। মেয়ে মন দিয়ে শোনে ঠিকই, হয়তো ধরতে পারে কিম্বা পারে না ছেলেবেলার ঠিক কোন্ হারিয়ে যাওয়া সুরের কথা ওকে বোঝাতে চাইছি আমি!
আমরা যখন আলুকাবলি নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, সেই সময় একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের মা-বাবার দল আমাদের কান্ড দেখে কোনোমতে হাসি চেপে ঘরে চলে যেতেন। আমার বাবা আবার ঘরে যাবার আগে কাছাকাছি কোনো টিউবওয়েল থেকে বালতি বালতি জল পাম্প করে নিয়ে এসে নেড়াপোড়ার আগুনের শেষ ফুলকিটি পর্যন্ত নিভিয়ে দিয়ে যেতেন, যাতে সেই আগুন থেকে কারোর কোনো বিপদ না ঘটতে পারে। ছোটবেলায় অনেকবারই আমাদের নিজেদের জমিতেই নেড়াপোড়া করেছি পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা মিলে। আশেপাশের বাড়ি থেকে বড়োরাও সেই সঙ্গে এসে জুটে যেতেন। "আজ আমাদের নেড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল... পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বলো হরিবোল" - কচি কচি গলায় এই ছড়ার রোল আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তো। রাত বাড়তো, সঙ্গে বাড়তো আমাদের উত্তেজনা। সদ্য কেনা নতুন পিচকিরি, নানারকম রঙের উপস্থিতিতে রাতে সহজে ঘুম আসতে চাইতো না। সকালে ঘুম ভেঙেই বাইরের রাস্তায় বাচ্চাদের হৈ-হল্লা শুনতে পেতাম। রঙ খেলা শুরু হয়ে গেছে!
তাড়াতাড়ি উঠে মায়ের ঠিক করে রাখা পুরোনো একটা জামা পরে নিয়ে আমরাও রঙ খেলতে নেমে যেতাম সবার সঙ্গে। নিজের ছোটবেলার কথা মনে আছে, যত না রঙ অন্যদের মাখাতে পারতাম, তাদের থেকে রঙ মেখে আসতাম তার চেয়ে অনেক বেশী। এ গালে সোনালী, ও গালে রূপালী, গায়ে-মাথায় বাঁদুড়ে রঙ- পাড়ার বড়ো বড়ো ছেলেমেয়েরা যে যা পারতো রঙ মাখিয়ে দিতো। আমি ছোট বলে ওদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না। স্নানের সময় যখন বাড়ি ফিরতাম, বাবা আমার দিকে এমনভাবে তাকাতেন যে আমার মনে হতো, প্রজাপতি ব্রহ্মার মতো বাবারও বোধহয় চারটে মাথা। আর সেই চারটে মাথায় অবস্থান করা চারটে মুখেই দেখতাম ভয়ঙ্কর রাগের প্রকাশ। অবশ্য বাবার চার মুখ ভর্তি রাগের যথেষ্ট কারণও ছিল। মা দোলের 'স্পেশাল মেনু' বানাতে তখনও রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকতো। তাই সেদিন যে-সব জিনিস মাথায় আর গায়ে মেখে আমরা বাড়িতে ফিরে আসতাম, সেসব আমাদের গা থেকে ঘষে-মেজে তোলার দায়িত্ব বাবার ওপরেই পড়তো! কাজটা শুধু কঠিনই ছিল না, প্রায় অসম্ভব ছিল! তাই চার মুখে কেন, বাবা দশ মুখে রাগ দেখালেও কারো কিছু বলার থাকতো না। তবে, এখন বড়ো হয়ে মনে হয়, মা বোধহয় ইচ্ছা করেই ওই সময়টা রান্নাঘরের কাজে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়তো। আমাদের দোল খেলার বাহাদুরিটা নিজে সামলাতে ঠিক সাহস করতো না। এখনকার বেশীরভাগ ছেলেমেয়েরা তো বাবা-মায়ের বানানো কৃত্রিম বাতাবরণে দোল খেলার একটা হালকা স্বাদ পায় মাত্র! 'নেড়াপোড়া'র তো প্রশ্নই নেই। জায়গা কোথায় আগুন জ্বালানোর? আর জায়গা থাকলেও, সেসব জায়গার ওপরে তো টেলিফোন, কেবল্ লাইন ইত্যাদি প্রভৃতি হাজার রকমের তারের ভিড়। তাই নেড়াপোড়ার সেই ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ লাগা আধপোড়া আলু, যার অর্ধেকটাই শক্ত থেকে যেতো, যাকে আমরা 'আলুকাবলি' বলে তারিয়ে তারিয়ে খেতাম, তা আর ওদের জেনারেশন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। মাঝপথে কোথায় যেন পড়ে রয়েছে আমাদের মনের ধূসর স্মৃতি-গুহার ভিতরে। আর তাই ঠান্ডা রেস্তোরাঁয় পিৎজা, বার্গার, বড় জোর দইবড়া, পাপড়িচাট বা ফুচকা খাওয়াকেই 'সেলিব্রেশন' বলে জানে ওরা।
আমার একটা বিশেষ নেড়াপোড়ার কথা বিশেষ কারণে মনে আছে। তখন আমি মাত্র ক্লাস ওয়ান বা টু তে পড়ি। ভাই আরো ছোট। আমাদের বাড়ির দু-একটা বাড়ি পরে ছিল আমার একটা বন্ধুর বাড়ি। ধরে নেওয়া যাক, তার নাম বুড়ি। ঘটনাটা নির্জলা সত্যি, তবে নামগুলো নয়। কে জানে, আসল নাম ব্যবহার করলে জীবনের কপিরাইটের দাবীতে আমাকে আবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে কি না! তাই ছদ্মনামেই চলুক আমার এই স্মৃতিচারণ। বুড়ি আমার সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তো। বুড়ির দাদা 'ট' আর আমার এক আত্মীয় দাদা 'ক'- এরা দুজনেও একই ক্লাসে, তখন হয়তো ফাইভ বা সিক্সে পড়তো। সেবার ওরা ঠিক করলো, আমরা শুধু ছোটরা মিলে নিজেরা নিজেরাই নেড়াপোড়া করবো। আমাদের সবার থেকে ওরাই একটু বড়ো। তাই নেড়াপোড়ার দিন ওই দুজনের তত্ত্বাবধানে সারা বিকেল ধরে প্রচুর শুকনো পাতা জড়ো করলাম আমরা। জায়গাটা ছিল আমাদের পাড়ার একদম প্রান্তে একটা পোড়ো জমি। সচরাচর সেখানে কেউ যেতো না। তাই পুরো জায়গাটাই আগাছায় ভরা ছিল। পেছনের দিকে একটা অর্ধসমাপ্ত বাড়ি। সেখানেও কেউ থাকে না। জানলা দরজাও লাগানো হয়নি। ক-দাদা আর ট-দাদা ছাড়া, বড়ো বলতে আর কেউ নেই আমাদের সঙ্গে। নেড়াপোড়ার দিনে আবার অদ্ভুত সব মজার ঘটনাও ঘটতো আমাদের পাড়ায়। এই যেমন, এক পাড়ার ছেলেমেয়েদের জমানো পাতা অন্য পাড়ার কমান্ডো বাহিনী সুযোগ পেলেই নিয়ে চলে যেতো। সরস্বতী পূজার সময় ফুল চুরির মতোই এটাকেও ঠিক চুরি বলে মনে করা হতো না। আবার কখনো বা শুধুমাত্র রেষারেষি করে কিম্বা স্রেফ বোকা বানানোর জন্য, সন্ধ্যে নামার আগেই অন্যদের জমানো পাতায় চুপিচুপি এসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যেতো কেউ কেউ। এটাই মজা! সেই জন্যই সারাক্ষণ নিজেদের সম্পত্তি পাহারা দিয়ে রাখতে হতো পালা করে। সেটাই ছিল নিয়ম। নেড়াপোড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতো যুদ্ধকালীন তৎপরতা। তখন তো পাড়ায় পাড়ায় আগান-বাগান, ফাঁকা জায়গা, পোড়ো জমি- কিছুরই অভাব ছিল না, আর নেড়াপোড়া করবার দলেরও কমতি কিছু ছিল না। কাদের বুড়ির ঘর সবচেয়ে বেশী উঁচু হয়ে জ্বললো, কিম্বা কারা সবচেয়ে দেরীতে অর্থাৎ সন্ধ্যা নামার পর অন্ধকার ঘুটঘুটে হয়ে যাবার পর বুড়ির ঘর পোড়াতে পারলো- এইসব নিয়ে ছোট ছোট দলগুলোর মধ্যে শত্রুতা সেদিন তুঙ্গে উঠে যেতো একেবারে।
যে কথা বলছিলাম, ট-দাদা আর ক-দাদার তত্ত্বাবধানে আমরা জনা সাতেক কমান্ডো তো সেদিন খুবই উত্তেজিত। ওরা যা যা বলছে, অক্ষরে অক্ষরে তাই পালন করে চলেছি সবাই মিলে। ওরাও আমাদের ওপর হুকুম করতে পেরে বেজায় খুশী। এই ভাবে সারাটা বিকেল শুধু শুকনো পাতা জোগাড় করে আর সেসব পাহারা দিয়েই সময় কেটে গেলো। যখন সন্ধ্যে হয় হয়, ঠিক সেই সময় হঠাৎ আবিষ্কার হলো, শুকনো পাতা জড়ো হয়েছে প্রচুর, কিন্তু তাতে আগুন জ্বালানোর জন্য সরঞ্জাম কিছু আনা হয়নি। কিন্তু কেউই আর তখন নিজেদের বাড়ি থেকে দেশলাই বা অন্য কিছু আনতে যেতে রাজী হলো না। কারণ, সন্ধ্যের মুখে একবার বাড়ি চলে গেলে আর বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা তার ঠিক নেই। ক-দাদা তখন আমাকেই বললো, আমাদের বাড়ি থেকে একটা দেশলাই নিয়ে আসতে। আমাদের বাড়ি বেশী দূরে নয়। একছুটে বাড়ি গেলাম ক-দাদার আদেশ পালন করতে। গিয়ে দেখি, মা তখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। বাড়িতে যে দিদি থাকতো আমাদের দেখাশোনা করার জন্য, ধরে নেওয়া যাক, তার নাম প্রতিমাদি। প্রতিমাদি এমনিতে আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। কিন্তু আমার হাতে দেশলাইয়ের বাক্স দিতে সে তো এক্কেবারে নারাজ। কিন্তু এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ 'মিশন' থেকে হেরে ফিরতে আমিও ততোধিক নারাজ। তাই অনেক চেয়ে-চিন্তে আর বায়না করে শেষ পর্যন্ত দিদির কাছ থেকে অল্প কয়েকটা কাঠি ভরা একটা দেশলাইয়ের বাক্স জোগাড় করলাম আমি। সেটা এনে দিলাম ওদের হাতে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হলো না। সেই দেশলাই দিয়ে ক-দাদা আর ট-দাদা মিলে যতোবার কাঠি ঠুকে ঠুকে আগুন জ্বালাতে যায় ততোবারই হাওয়ার ঝাপটায় আগুন নিভে যায়। আমরা সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি। কিন্তু ওরা ওই ছোট্ট দেশলাই কাঠি দিয়ে শুকনো পাতায় কিছুতেই আর আগুন জ্বালাতে পারে না। কি করবে? ওরাও তো ছোট!
বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর ক-দাদা বুদ্ধি খাটিয়ে বললো, "একটু কেরোসিন থাকলেই হয়ে যেতো"। কথাটা ঠিক। বুদ্ধিটা সবারই পছন্দ হল। কিন্তু কেরোসিন কে দেবে? আমাদের বাড়ির প্রতিমাদি তো সটান 'না' বলে দিল। এমনিতেই আমার হাতে দেশলাই দিয়েছে, সে কথা জানতে পারলে মা নিশ্চয়ই বকবে প্রতিমাদিকে। এতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আবার কেরোসিন তেল দিতে ঠিক সাহস পেলো না প্রতিমাদি। তখন ট-দাদা বললো, ওদের বাড়ি থেকে ও নিজেই কেরোসিন তেল নিয়ে আসবে। বলে তো সে চলে গেলো। গেলো তো গেলো, আর আসে না। এদিকে সন্ধ্যা ঘন হয়ে উঠছে। আশেপাশের বাড়ি থেকে শঙ্খ-ধ্বনি ভেসে আসছে। মা ফিরে আসলে আমাকে আর ভাইকেও বাড়ি চলে যেতে হবে। আর আমাদের নেড়াপোড়া দেখা হবে না। ক-দাদার বাড়ি বেশ কিছুটা দূরে। ওকেও বাড়ি ফিরতে হবে। আমরা যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি, এমন সময় হাঁফাতে হাঁফাতে ট-দাদা এসে হাজির। হাতে একটা লাঠি। তাঁর মাথায় একফালি কাপড়। সেটা একটু ভেজা ভেজা। ট-দাদা বললো যে কেরোসিন তেল আনতে না পারলেও, ওই লাঠিটা নাকি কেরোসিন তেলের বোতলে ডুবিয়ে নিয়ে এসেছে। আমরা সবাই তারিফ না করে পারলাম না। মহা বীরত্বের একটা কাজ করেছে বটে! ক-দাদা বললো, "তাই সই, এবার আগুনটা জ্বালানো হোক।" দেশলাই ঠুকে লাঠির মাথায় জড়ানো কাপড়টার গায়ে ধরা হলো। এবার সেটা বেশ মশালের মতো জ্বলে উঠলো। আমরা সবাই তো ভীষণ খুশী। ক-দাদা আর ট-দাদা মিলে যেই মশালটা শুকনো পাতার স্তূপে ধরাতে গেছে, ঠিক তখনই একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে আমরা সবাই একেবারে হতভম্ব। তাকিয়ে দেখি, বুড়ির মা- যাকে আমরা সবাই জেঠিমা বলে ডাকি, তিনিই ওই চিৎকারের উৎস। বাড়ি থেকে চুপিসারে ট-দাদার পিছু নিয়ে ঠিক আমাদের গোপন মিশনে হাজির হয়ে গেছেন জেঠিমা। আমাদের সবার মুখ, জিভ, গলা তো শুকিয়ে একেবারে কাঠ। হাত-পা সব অসাড়। বীরপুরুষ ট-দাদা আর ক-দাদার দশা ঠিক ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো। নেড়াপোড়া মাথায় উঠেছে তখন। আগুন জ্বলছে জেঠিমার দুই চোখে। জ্বলন্ত চোখে কিছুক্ষণ অপরাধীদের জরিপ করে নিয়ে, বাকিদের ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। তারপর ক-দাদাকে, আমাকে আর ভাইকে নিয়ে চললেন সোজা আমাদের বাড়ির দিকে।
আমার অবস্থা তখন বর্ণনার অতীত। এর থেকে তৎক্ষণাৎ আমার মৃত্যু হলে আমি বোধহয় বেশী খুশী হতাম! কিন্তু মৃত্যু আমার হলো না। আমাদের তিনজনকে নিয়ে জেঠিমা নির্বিঘ্নেই সামান্য পথটুকু পার হয়ে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। মা তখন সবে বাড়ি ফিরে রাতে কি রান্না হবে, সেসব প্রতিমাদিকে বুঝিয়ে বলছে। জেঠিমা সহ তিন অপরাধীকে দেখে মা একদম হতভম্ব হয়ে গেলো। এমনিতে মায়ের সঙ্গে জেঠিমার সম্পর্ক খুবই মধুর। কিন্তু জেঠিমার সেদিনের সেই বিভীষণ মূর্তির কারণ মা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। বোঝানোর দায়িত্ব নিলেন জেঠিমা নিজেই। কি করতে যাচ্ছিলাম আমরা, তাতে কতখানি বিপদ হতে পারতো..... এতো ছোট সবাই........ আগুন... দেশলাই..... কেরোসিন...। শুনতে শুনতে মায়ের মুখ ক্রমশ গম্ভীর। জেঠিমা আর মায়ের কথার মাঝখানে ক-দাদা এক ফাঁকে পালিয়েছে নিজের বাড়ি। ক-দাদা আত্মীয়ের ছেলে, মা তাই দেখেও কিছু বলেনি। আমি দাঁড়িয়ে আছি- মাথা নীচু, চিবুক গিয়ে বুকে ঠেকেছে। ভয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটাকে সমানে খুঁটে চলেছি আমি। হাতের পাতা দুটো ভয়ে ঘামছে। ভাই আমার পিছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও এতই ছোট যে ঠিক কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর জেঠিমা তো নালিশ করে ফিরে গেলেন। এবার মায়ের বিভীষণ মুখ। মা এমনিতে বেশ হাসিখুশি, কিন্তু রেগে গেলেই বাড়ির পরিবেশ বেজায় থমথমে। মা বেশী চিৎকার করে না, শুধু রায় ঘোষণা করে। সেদিনও মা থমথমে গলায় ঘোষণা করলো, আর কোনদিন যেন কেউ আমাদের নামে কোনরকম নালিশ নিয়ে এ বাড়িতে না আসে। ব্যাস্! ওইটুকুই। এরপর মা রাত পর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলবে না। গম্ভীর মুখ করে খেতে দেবে। আমার তাতেই অবস্থা খারাপ। ভাই ছোট। ওর উপর মা রাগ করলো না। আমি সেদিনও পারিনি, পরেও বলতে পারিনি যে, আমার সত্যিই কোনো দোষ ছিল না। পাড়ার আরো অন্য বাচ্চারাও তো সেখানে ছিল। তাছাড়া, সব পরিকল্পনাই ছিল ক-দাদা আর ট-দাদার। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মুখে একটা কথা খুব শোনা যায় "কেস খাওয়া"। সেদিন আমার অবস্থাও ছিল ঠিক সেইরকম। কিছু না করেও পুরো কেস খেয়ে গেলাম একা আমি।
তখন আমাদের জীবনে কত বৈচিত্র্য ছিল। খেলাধুলা ছিল, খেলার মাঠ ছিল, খেলার সঙ্গী ছিল, বিকেল ছিল। পাড়ার বড়োরা অভিভাবকের মতো ছিল। শাসন ছিল, আদর ছিল। কান্না ছিল, অভিমান ছিল। মায়ের সাথে বিচ্ছেদ ছিল, আবার সন্ধিও ছিল। যা কিছু মধুর, সেই সবকিছু দিয়ে গড়া ছিল আমাদের ছোটবেলার দিনগুলো। সেই জেঠিমার আরও অনেক স্মৃতি রয়েছে আমার মনে। তিনি আজ আর নেই। অনেক দিন হলো ছেড়ে গেছেন আমাদের। বুড়ি, ট-দাদা, ক-দাদা সবাই যে যার মতো কতো দূরে দূরে থাকে। দেখা হয় না অনেককাল। আমার ছোট্ট ভাইটা এখন সারা বছর হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায়। আর আমি? "আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে... "! তবু আজও অতীতের পথ বেয়ে পিছনে ফিরে গিয়ে দোলের আগের দিন আমরা সবাই মিলে 'নেড়াপোড়া' করি। দোল খেলতে গিয়ে এখনও আমি সেকালের মতো নিজেই রঙে রঙে ভূত হয়ে যাই বার বার। সবার হয়ে মায়ের কাছে বকা একা আমিই খাই, অর্থাৎ 'কেস খাই'.... আজও..... একই রকম!
ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।
***********************