Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। ছপর ।। শ্রীজিৎ জানা


 

ছপর


শ্রীজিৎ জানা




সরমা বুড়ির মৃত্যু সবার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। বিশেষ করে পাড়ার লোকজনদের কাছে। তবে  সরাসরি খুন জখম নয়, আত্মহত্যাও নয়। ছেলে-বৌমারা যে অত্যাচার করত- এমনটাও কারো চোখে পড়েনি।  বয়স নেহাত কম নয়, প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই। তাতে কি, এখনো বুড়ির বেশ চরকি মেজাজ। বয়সের কথা জিজ্ঞেস করলেই বলে,

-- সেই যে বড় ঝড় গেলো,  আমি তখন মায়ের কোলে।

 সে যাই হোক বুড়ির মৃত্যুটা আর পাঁচটা মৃত্যুর মতো নয়। গ্রামে তাকে  ছপরবুড়ি বলেই জানে সকলে। আসলে তার যত কথা সবই ছপর অর্থাৎ ঘর নিয়ে। পথ চলতি যাকেই কাছে পাবে তাকে জোর করে শোনাবে তার ছপরবৃতান্ত ।

-- বে হয়ে যখন এনু তখন  দুটি ছোট ছোট কুঁড়াঘর। শ্বশুরেরা চার ভাই। তাতেই যাহোক করে  গুঁজেটিপে থাকতম্।  তারপর বড় বানে সেবছর ঘরগুলাকে গিলে খেলো।বানের জল নামলে সবাই জেদ ধন্ন নতুন করে ঘর করবে। এদিকে  আমি নতুন বউ তার উপরে পেটে বাচ্চা, তাতেই পাঁচজন করে মজুরের রান্না, তার ফাঁকে কলসিতে করে পুকুর থেকে জল বয়ে  দেওয়া, সবই কন্নি। 

বুড়ির  কথা থামতে চায় না।

--ভিটার নিচে বড় বড় দুটা অর্জুন গাছ ফেলানো হলো, কাঠ চেরাইয়ের মিস্ত্রি এলো রসিকগঞ্জ থেকে। কত খেটেখুটে দাঁড় কন্নুম এই মাটির দুতালা ছপর।  কাঠের কড়িকাঠগুলা এখনও যেমনের তেমন আছে, ঘুণপোকা ধরেনি। 

ঘর হল আর তার দু'সপ্তাহ পরেই বুড়ির কোল আলো করে এলো ছেলে। তখন বুড়ির স্বামীর সেকি আনন্দ! কাজিরহাট থেকে বুড়ির জন্য কাপড়, ছেলের জন্য জামা কিনে আনে স্বামী। বুড়ির কানের কাছে মুখ এনে বলে,

--- তুমি এলে ঘর হলো! আর  ঘর হতে না হতেই ছেলে। ঠাকুর  আমার দিকে চেয়ে গেছে।

বলতে বলতে বুড়ির চোখমুখ আনন্দে চকচক করে উঠতো। আবেগে দু'চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে জলের ধারা।

 সেই বুড়ি এখন এই বয়সে চার ছেলের সংসারে   ভাগের মা। আগের দিনের মানুষ বলে আজকালকার বৌমাদের সঙ্গে সহজে পটেনা। খিটিরমিটির লেগে থাকে। বুড়ি বলে,

--সোয়ামি তো কিছু রেখে যেতে পারেনি। কিন্তু  যেটুকু রেখে গেছে সে তো কম নয়! এত বড় বাঁশ বাগান, দুটো পুকুর, জল- কালা জমিন মিলে বিঘা পাঁচেক। এদ্দিনে তোদের তো মুরাদ হোলো নি দু'কাঠা কিনার! 

চার ছেলের ছোট তো অনেক আগেই আলাদা করে ঘর করে সরে পড়েছে। তিন ভাই থাকে একঘরে। বৌ- ছেলেপুলে মিলে দশ-বারোজনের থাকার জায়গা বলতে ওই একটাই মাটির ঘর। তবু সম্বৎসর খড়ের চাল ছাউনি নিয়ে যত গন্ডগোল।  মটকার চাল কে ছাইবে,ঝিটচাল কে ছাইবে তা নিয়ে তিন ভাইয়ে ফিবছর আকচাআকচি লেগেই থাকে। বুড়ি কতবার ছেলেদের বোঝায়,

--- তোরা সবাই মিলে ছপরটার পেছনে একটুকুন টাকাকড়ি  খরচা করতে ত পারু। আমার হাতে লাগানো তেঁতুল গাছ আছে, তাকে ফেলে চেরাই করে, মিস্ত্রি লাগিয়ে কাঠামো করে করকেট চাপাতে ত পারু। কিন্তু কে শুনে কার কথা?

সারাদিন বুড়ির একটাই কথা  ছপর আর ছপর। দোতলা মাটির ছপর নিয়ে তার যত সাধ- আহ্লাদ। সময় পেলেই সোজা দাসপাড়া চলে যায়। সেখানে বুড়ির স্বামীর বন্ধু যতন দাসের  সাথে শলাপরামর্শ করে। তার কাছে জানতে চায়  ঘরের  খড়-ছাউনি টেনে ফেলে দিয়ে টিন বা অ্যাসবেস্টাস চাপালে কত খরচ পড়বে।ফিরে এসে ছেলেদের কাছে সব আওড়াতে থাকে। দিনে দিনে ঘরের অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার অত্যাচারে বাঁশপাতা সব পচে গেছে। বুড়ির ঝড়কে বড় ভয়। ঝড় দিলেই দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বারবার বলতে থাকে,

--পবন রাজা বোস।পবন রাজা বোস।তোর মা-বাপকে গড়টি করি।

ছেলেরা  বুড়ির কথায় কোন কান দ্যায় না।ঘরের মাথায় ছাউনি নিয়ে নিজেরা নিজেরাই বিবাদ শুরু করে। খরচের ভাগাভাগি নিয়ে তুমুল হট্টগোল ।আর সেই হট্টগোলের মাঝখানে ঘরের চেহারাটা আরও করুণ হয়ে যায়। সেবছর আর খড় চাপানো হয় না। বুড়ির আশা ভঙ্গ হয়। আনমনে বসে কাঁদতে থাকে।

পার্টির দৌলতে বুড়ি আজকাল বার্ধক্য ভাতা পায়। কিন্তু ওই,যখন যে ছেলের কাছে থাকে, তারাই নিয়ে নেয়। বুড়ি কতবার বলে,

--- তরা টাকাগুলান  গচ্ছিত করে ছপরটাকে একটু বাঁচা। 

 ছড়া কেটে বলে,'মাথার ওপর ছপর/জানবি সনার টপর'!

 

বুড়ির ঘোলাটে চোখে একটাই স্বপ্ন তার ঘরের চাল একদিন সাদা অ্যাসবেস্টাসে ঢাকা পড়বে। ভাঙাচোরা চেহারাটা নতুন করে  সেজে উঠবে। তাতেই যেন তার সুখ! বেঁচে থাকা সার্থক।

এরই মাঝে বুড়ি কার মুখে শুনে তার সাধের ছপর ভেঙে ফেলবে ছেলেরা । নাতিরা সোনার কাজে বাইরে গেছে। টাকা হয়েছে তাদের। তারা মাটির ঘরটা ফেলে দিতে চায়। গ্রামে আর মাটির ঘর কেউ রাখতে চায় না।শুনে বুড়ির মাথা গরম হয়ে ওঠে। যাকে কাছে পায় তাকেই গালমন্দ করে। এই নিয়ে শুরু হয় তুমুল গন্ডগোল। শেষমেষ গাঁয়ের দু' একজন লোক ডেকে ঠিক হয় ঘরটা না ফেলে যে কোনো এক ভাই ঘরটা নিয়ে নেবে। বুড়ি তাতেও রাজি। তবু একটা ভয় তাকে তাড়া করে। কত রাতে ঘুম ভেঙে যায়। কড়ি কাঠের দিকে চেয়ে থাকে। দেয়ালে হাত বুলোতে থাকে, যেন কাকে খুঁজে চলেছে সে। কারো উত্তাপ পেতে চাইছে সে হাত ছুঁয়ে। 


জষ্টি মাস, ফাঁকা মাঠে শেষ দুপুরের রোদ যেন গিলে খেতে আসছে।  আলপথ ধরে বুড়ি ফিরে আসছিল ঘরে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।ঠাওর করতে পারেনা রাস্তা। এক মাসের মধ্যে যেন কত কিছু পাল্টে গেছে মনে হয়  এই একমাস বুড়ি বাপের বাড়িতে ছিল। যদিও এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। মেজো বৌমা ঘরের উপর থেকে জল ফেলতে গিয়ে সেজো বউয়ের দুয়ারে পড়ে। আর তা নিয়েই তুমুলঝগড়া।  আগেও যে এরকম হয়নি তা নয় কিন্তু সেদিন ঐটুকুকে  কেন্দ্র করে লংকাকান্ড বেঁধে যায়। বুড়ি থামাতে গেলে দুই বউমা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুড়ির উপর।

-- ওই বুড়ি যত পাপের মূল! এই ঘর ভেঙে ঘর হয়ে যেত কত আগেই।কিন্তু ওনার সোয়ামীর হাতের তৈরি ছপর। বেঁচে থাকতে ভাঙতে দেবে না! আমাদের হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছে!

 কতবার এসব কথা শুনেছে বুড়ি এর আগেও। কিন্তু কিছু মনে করেনি  অথচ সেদিন কি যে হলো বগলে পুঁটলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে, কেউ তাকে ফেরায় না।

কখনো কোথাও থেকে এলে বুড়ি নিজেই বলতো,

-- ওই যে তাল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় মাটির দেয়াল, ওটাই আমার ছপর

অম্নি যেন পায়ের গতি বেড়ে যেত তার।  আজ আর তার সোহাগের ছপরটাকে সহজে নজরে আনতে পারছে না। বারবার থমকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দাশপাড়ার নিত্যবালার সাথে দেখা হয় বুড়ির। নিত্যবালা বুড়িকে এই রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেও থমকে দাঁড়ায়। তারপর বুড়িকে সব কথা শোনায়। ঘরের যে দিকটা ওই পথ দিয়ে এলে দেখা যেত সেই অর্ধেকটা সেজ ও মেজো ছেলে  ভেঙে দিয়েছে। সেখানে নতুন ঘর হবে। সরকারি আবাস যোজনার ঘর পেয়েছে। কথাটা প্রথমে নিত্যবালা বলতে চাইনি।  বুড়িই প্রথমে জানতে চায়,

-- আরে নেত্ত বুড়ো বয়সে আমি কি চোখের মাথা খেনি। নাকি আমি কি রাস্তা ভুল কন্নি।ছপরটাকে ত লজর করতে পারিঠি নি। 

  বাকিটা নিত্যবালা তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিমায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আগাপাশতলা আউড়ে যায়।



বুড়িকে সেখান থেকে ধরাধরি করে তুলে আনা হয় তক্ষুনি।  ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে,  ডান পায়ে, ডান হাতে সুচ  ফোটায়। বুড়ি কোন সাড়া দেয় না। শুধু পিটপিট করে চেয়ে থাকে ঘোলাটে চোখে। ডাক্তার জানায় ডান সাইড পুরোপুরি প্যারালাইজড হোয়ে গ্যাছে। ছেলে-বৌমাদের মধ্যে তেমন একটা তাপ-উত্তাপ  পাড়ার কেউ দেখতে পায় না। বোধহয় এমনটা হওয়াতে তাদের কাজ সহজ হোয়ে গ্যাছে।

আর তাই  যেদিনে আচায্যি এসে দুই ছেলের ঘরের সীমা নির্দেশ করে বাস্তুপুজা করে গেল,সেই রাতে বুড়ির চোখ দিয়ে শেষ জলের ফোঁটা তার কুঁচকানো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।  মরার সময় অব্দি বুড়ির হাত পাশের দেয়ালকে ধরার ভঙ্গিমায় আঁকড়ে থাকতে দেখে সকলে। যেন ছেড়ে যেতে চাইছেনা তার ছপর'কে।

--------------------------------

 ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.