Click the image to explore all Offers

গল্প ।। খুনিয়াপুকুর ।। অঞ্জন রায়চৌধুরী

 

 

খুনিয়াপুকুর 

অঞ্জন রায়চৌধুরী 

 


অফিসে যাওয়ার সময় বাস রুটে একটা স্টপেজ পড়তো। খুনিয়া পুকুর। প্রথম দিন থেকেই নামটা শুনে একটা কেমন অন্যরকম অনুভূতি হতো। একটা রহস্য যেনো লুকিয়ে আছে ওই খুনিয়াপুকুর নামটার মধ্যে।

একদিন বাসে করে ফিরছিলাম, তখন শীতকাল। এক ভদ্রলোক আমার পাশের সিটে বসেছিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো। বিভিন্ন কথা বার্তার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে উনি খুনিয়াপুকুরের আদি বাসিন্দা। পেশায় স্কুল মাস্টার। ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম," আচ্ছা, খুনিয়াপুকুর নাম কেন এই স্টপেজের?"

উত্তরে ভদ্রলোক বললেন," আসলে এই নামটা এসেছে একটা পুকুরের নাম থেকে যেমন দত্ত পুকুর ঠিক তেমনি। আমি বললাম," তা বেশ। কিন্তু খুনিয়া পুকুর কেনো? খুনটুন হয়েছিল?"

উনি বললেন," না, ঠিক খুন নয়, কিন্তু অনেকটা সেই রকমই। আসলে জায়গাটার একটা প্রাচীন ইতিহাস আছে।"

আমি বললাম," বলুন না, সেই কবে থেকে আমি রোজই ভাবি কেনো এমন নাম জায়গাটার।"

উনি বললেন," বেশ। শুনুন তাহলে।" উনি শুরু করলেন,"সে অনেক দিন আগের কথা। গ্রামগঞ্জে তখন টিউবওয়েলের ব্যবহার ছিল না। যে পুকুরটার নাম খুনিয়াপুকুর, সেটা ছিলো ওই গ্রামের একমাত্র পুকুর। তখনও খুনিয়াপুকুর নাম হয়নি তার। গ্রামের মূল যে রাস্তা, তার পাশেই ছিল গভীর  বড়সরো ওই পুকুর। গরমকালে আর সব পুকুরের মতোই এই পুকুরের জলও শুকিয়ে পুকুরের মাঝখানে চলে যেত, আবার বর্ষাকালে দুপার ছাপিয়ে রাস্তায় চলে আসতো। মানুষ তার সব কাজের জন্য পুকুরই ব্যবহার করতো।


গ্রামে ভট্টাচার্য্য পরিবার ছিলো একমাত্র ব্রাম্ভন পরিবার। তখন বর্নভেদ প্রথা আমাদের সমাজে ছিলো খুব প্রকট। ভট্টাচার্য্য পরিবার ছাড়া ওই গ্রামের বাকি সবাই ছিলো হয় ক্ষত্রিয়, হয় বৈশ্য আর না হয় শুদ্র। বর্ণশ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য ভট্টাচার্য রা তাদের আধিপত্য রীতিমত বিস্তার করেছিল গ্রামের ওপর। ওনাদের কথা ছিল গ্রামের মানুষদের শেষ কথা। বিশেষ করে ফনি ভূষণ ভট্টাচার্য বা ফনি ভরচাজ ছিলো ওই গ্রামের যাকে বলে মুরুব্বী। তখন যেহেতু গ্রামগঞ্জে ডাক্তার বদ্যি ভালো ছিলো না, তখন গ্রামের মানুষদের একমাত্র ভরসা ছিল গুণীন বা কবিরাজ জাতীয় লোকজন। ফনি ভর্চাজ কিন্তু খুব বড় গুনীন ছিলো। তন্ত্র সাধনায়ও নাকি সিদ্ধি লাভ করেছিল। ভুত প্রেত ও ছাড়াতে জানতো আবার আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাও করতে পারতো। ফলে গ্রামের লোকজন ফনি ভর্চাজ কে একটু সমীহ করেই চলতো। তো সেই ফনি ভর্চাজ বিধান দিয়েছিল যে কোনো শুদ্র পরিবার ওই পুকুর থেকে জল নিতে গেলে বা পুকুরের জল ব্যবহার করতে গেলে তাকে হয় সূর্য উদয়ের আগে আর নয় সূর্যাস্তের পর জল ব্যবহার করতে হবে। সূর্য উদয়ের সময় ফনি ভর্চাজ আগে স্নান করে তন্ত্রক্ত মন্ত্র পড়ে পুকুরের জলকে আগে শুদ্ধ করবে তারপর সেটা গ্রামের অন্য বর্ণের মানুষের ব্যবহার্য হবে। 

গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে ছিলো একটা শ্মশান। ওই শ্মশানে মরা পোড়াতো এক চণ্ডাল। নাম হারু। লোকে হারু চণ্ডাল বলে ডাকতো। তার একটা ছোট্ট পরিবার ছিলো বউ আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। পরিবার ওই শ্মশানের পাশেই একটা চালা ঘরে থাকতো। মরা পোড়াবার জন্য শ্মশান যাত্রীদের কাছ থেকে যে বকশিস পেত তাতে তিনটে পেট কোনরকমে চলে যেত।


ফনি ভরচাজও মাঝে মাঝে শ্মশানে যেতো কখনো সাধনা করতে, আবার কখনো তন্ত্র সাধনা বা ক্রিয়ার জন্য শ্মশান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে এবং সেগুলোতে ফনি ভরচাজকে সাহায্য করতো হারু। কিন্তু হলে কি হবে, সমাজে হারু ছিলো শুদ্রেরও অচ্ছুত। 


একবছর গ্রামে বর্ষাকালে বৃষ্টি তেমন হলো না। খরায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো গ্রাম। ফসল মাঠেই শুকিয়ে গেলো জলের অভাবে। গ্রামের মাটি ফুটিফাটা হয়ে গেলো।  খুনিয়াপুকুরও শুকিয়ে গেলো সেই খরায়। শুরু হলো তীব্র জলকষ্ট। একফোঁটা জল তখন অমূল্য হয়ে উঠলো গ্রামবাসীদের কাছে। জলের জন্য যে কোনো মূল্য দিতে রাজি ছিলো তারা। সবাই ছুটলো ফনি ভরচাজের কাছে। ফনি ভরচাজ সব সমস্যা শুনে বললো," মা কালী কুপিত হয়েছেন গ্রামবাসীদের উপর। তাই এই অবস্থা। ঠিক আছে। আমি দেবীর আরাধনা করবো। তারপর দেবী কিসে সন্তুষ্ট হন সেটা জানাবো। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে হবে।" রাতে শ্মশানে গিয়ে রাতভোর তন্ত্র সাধনা করলো ফনি ভরচাজ। পরের দিন সকালে সে সমস্ত গ্রামবাসীদের জড়ো হতে বললো। তারপর গ্রামবাসীদের জানালো," মা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। উনি রক্ত খেতে চান। নর রক্ত, নর মাংস দিয়ে পুজো দিতে হবে। বলো তোমাদের মধ্যে কে উৎসর্গ করবে নিজের জীবন এই গ্রামের জন্য?" সমস্ত গ্রামবাসী মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো,পাছে মাথা তুলে রাখলে সম্মতির লক্ষণ বলে ধরে নিয়ে তাকে উৎসর্গ করা হয়। ফনি ভরচাজ গ্রামবাসীদের মানসিকতা বুঝতে পারলো। বললো," মানে আমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে তাইতো? ঠিক আছে।"

পরের কৃষ্ণ চতুর্দশীর মাঝ রাত। হারু শ্মশানে মরা পড়াচ্ছে, আর তার বউ বছর পাঁচেকের ছেলেকে নিয়ে বাড়ির দালানে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। সেখানে চুপচাপ হাজির হলো ফনি ভর্চাজ। ঘুমন্ত ছেলেটাকে আস্তে আস্তে মা এর পাশ থেকে ওঠালো সে। তারপর সোজা চলে এলো খুনীয়াপুকুরের মাঝখানে। শুকনো মাটি খুঁড়ে একটা গর্ত করলো সেখানে। তারপর ছেলেটাকে খাঁড়ার এক কোপে বলি দিলো ফনি। বলির মাথাটা পুঁতে দিলো ওই গর্তে। তারপর ওই গর্ত বুজিয়ে তার উপর আসন পেতে বসে,কলজে টা ছিঁড়ে নিয়ে একটা কাঁসার বাটিতে রেখে, বলির বাকি মুণ্ডুহীন দেহটাকে সামনে রেখে তন্ত্রক্তো মন্ত্র উচ্চারণ করে সারারাত কালী পুজো করলো ফনি। তারপর ভোর বেলা মুন্ডু কাটা দেহটাকে ওই পুকুরের মধ্যেই পুঁতে দিয়ে চলে গেলো ফনি ভরচাজ। পরদিন হারু আর হারুর বউ সারা গ্রাম তাদের ছেলে কে  তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেরালো কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না। হারুর বউ ছেলের শোকে পাগল হয়ে গেলো, আর হারু সারাদিন মরা পুড়িয়ে নেশা করে শ্মশানেই পড়ে থাকতো। হারুর সাজানো সংসার শেষ হয়ে গেলো।

পরদিন রাত থেকে শুরু হলো চারদিন ধরে মুষল ধারায় বৃষ্টি। বৃষ্টিতে শুকনো পুকুর জলে প্রায় ভর্তি হয়ে গেলো। ফনি ভরচাজের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে। সবাই তাকে সাক্ষাৎ কালীর সন্তান বলে মনে করতে লাগলো।

এই ঘটনার পর বছর খানেক কেটে গেলো। একদিন এমনই এক কৃষ্ণ চতুর্দশীর রাতে গ্রামের একজন লোক হাট থেকে ফিরছিলো। সে বছর বর্ষা বেশ ভালই হওয়াতে খুনিয়াপুকুর জলে টই টুম্বুর। এমন সময় হ্যারিকেন এর আলোয় লোকটা দেখলো পুকুর থেকে দুটো হাত উঁচু হয়ে আছে আর আঙ্গুলগুলো নড়ছে যেনো কেউ পুকুরে ডুবে যাচ্ছে। ভালো করে খেয়াল করে লোকটা সাহায্য করার জন্য জলে ঝাঁপ মারলো। কিন্তু আর সে জল থেকে উঠলো না। পরেরদিন তার মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেলো পুকুরের জলে। 


আর একদিন রাতের ঘটনা। এক শুদ্দুর বাড়ির বউ বাসন মাজতে গেছিলো খুনিয়াপুকুরে। বউ টা দেখে একটা বাচ্চা ছেলে পুকুরের জল থেকে শুধু মাথাটা বের করে তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে যেনো চোখ দুটো জ্বলছে। যেই বউ টা " কে রে" বলে হাঁক দিয়েছে অমনি মাথাটা জলের মধ্যে ডুবে গেলো। এইসব ভুতুড়ে কান্ড কারখানা ঘটতে থাকায় সবাই আবার ফনি ভরচাজের দ্বারস্থ হলো। সব শুনে ফনি বললো," হুম, পুকুরটাকে বিশেষ ভাবে শুদ্ধ করতে হবে।"

ফনি ভরচাজের নির্দেশে গ্রামবাসীরা পুজোর উপকরণ সব জোগাড় করল। ঠিক হলো আগামী অমাবস্যায় পুজো করা হবে। তারপর ছাগল বলি দিয়ে তার মুন্ডু পুকুরে উৎসর্গ করা হবে মা কালীকে উদ্দেশ্য করে।

অমাবস্যার রাতে শুরু হলো বিশেষ পুজো। তন্ত্র মতে পুজো করতে লাগলো ফনি ভরচাজ। সঙ্গে জনা দশেক গ্রামবাসী। পুজো শেষ হলে শুরু হলো পাঁঠা বলি। বলির মাথা টা নিয়ে নিজেই পুকুরে নেমে এক বুক জলে দাঁড়ালো ফনি। মাথা টা জলে বিসর্জন দিয়ে প্রয়োজনীয় মন্ত্র পড়ে যখন সে জল থেকে উঠে আসতে যাবে,এমন সময় ফনি অনুভব করলো তার পা দুটো জলের তলায় কেউ শক্ত করে চেপে ধরে আছে। ফনি অনেক চেষ্টা করেও সেটা ছাড়াতে পারলো না। এইবার ফনি কে যেনো কেউ জলের তলায় টানতে লাগলো। চিৎকার করতে লাগলো ফনি। জলে ডুবে গেলেও হাত দুটো উপরে তুলে সাহায্য চাইতে লাগলো গ্রামবাসীদের কাছে। কিন্তু ফনির ওই অবস্থা দেখে কোনো গ্রামবাসী সাহস করে এগিয়ে এলো না, কারণ এই একইরকম ভাবে তাদের একজন আগে মারা গেছিল। ফনি তলিয়ে গেল সবার সামনে। তারপর উপস্থিত গ্রামবাসীরা দেখলো একটা বাচ্চা ছেলে জল থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে আর তার চোখ দুটো ভাঁটার মত জ্বলছে।  মুহুর্তের মধ্যে সেটা চলে গেলো জলের তলায়। সবাই যে যার মতো ছুটে পালালো পুকুর পাড় থেকে। পরদিন পুকুর থেকে উদ্ধার হলো ফনি ভরচাজের মৃতদেহ। 

সেই থেকে ওই পুকুর কে খুনে পুকুর বা খুনিয়াপুকুর বলেই সবাই ডাকে আর ওই নামেই এই স্টপেজের নাম।  তারপর থেকে কেউ আর ওই পুকুর ব্যবহার করতো না।"

-----------------------




Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.