গল্প ।। পুত্রদান ।। উত্তম চক্রবর্তী
পুত্র দাণ
উত্তম চক্রবর্তী
বাঁকুড়ার মকুর গ্রামের মহেন্দ্র ঘোষের পৈতৃক সম্পত্তি বলতে দশ বিঘা জমি, একটা পাকা দালান বাড়ি আর চারখানা গরু। এই জমির ফসল আর গরুর দুধ বেঁচে মহেন্দ্র প্রচুর টাকার মালিক হয়েছে এখন। বাবা মারা যাবার তিন বছর আগে তার একমাত্র ছেলেকে বর্ধমানের মেয়ে বন্দনা ঘোষের সাথে বিয়ে দিয়ে গেছেন। মহেন্দ্রর বিয়ের পাঁচ বছরে বাদেও কোন সন্তান হয়নি। ওর মা এখনো জীবিত, কিন্তু তাকে বংশধরের মুখ দেখাতে পারেনি মহেন্দ্র। শহরের অনেক ডাক্তার বৈদ্য সব দেখিয়ে হতাশ হয়ে শেষে একদিন ওর এক বন্ধুর পরামর্শে কলকাতায় ডাক্তার মানসী মল্লিকের সাথে ফোনে কথা বলে পরদিনের একটা এপয়েন্টমেন্ট করে নিলো মহেন্দ্র।
সেন্ট্রালএভেনিউয়ের উপর বেশ বড় নার্সিং হোম মানসী মল্লিকের। জানা গেছে তাছাড়াও সরকারি কয়েকটা হাসপাতালের সাথেও নাকি উনি যুক্ত আছেন। ডাক্তারের বয়স পঁয়ত্রিশ,কথা বার্তায় বেশ ভাল ও স্মার্ট। বিয়ের পাঁচ বছর বাদেও কোন সন্তান হয়নি শুনে ,সমস্ত ডাক্তারি রিপোর্ট দেখে ডাক্তার মহেন্দ্র ও বন্দনাকে সরো-গেট পদ্ধতিতে একটা বাচ্চা জন্মাবার প্ল্যান বুঝিয়ে বললেন। মহেন্দ্র আর বন্দনাকে বললেন, 'এর জন্য আপনাদের কিছুই করতে হবে না। শুধু মহেন্দ্র বাবুর স্পার্ম লাগবে আর আপনাদের মোট পনের লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে। আমি আমার নার্সিং হোমের জানাশুনা কোন মহিলাকে রাজি করিয়ে তার গর্ভের সাহায্যে আপনার সন্তান ডেলিভারি করিয়ে দেব। এছাড়া আর কোন উপায় নেই কারণ বন্দনা দেবী কোনদিনই মা হতে পারবেন না।'
মহেন্দ্রকে এই কথাটা আগেও দুজন ডাক্তার বলেছিলেন। তবুও মহেন্দ্র কলকাতায় এসে বড় ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল আর অন্য কোন উপায় আছে নাকি জানতে চাইছিল। বন্দনা মহেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বলল ,'তুমি ওনার কথায় রাজি হয়ে যাও। আমার এই ব্যাপারে কোন আপত্তি নেই। তুমি বাবা হবে তাতেই আমার আনন্দ।' বন্দনার উৎসাহে ও নিজের বংশধর পাবার আশায় মহেন্দ্র রাজি হয়ে গেল। ডাক্তার মল্লিকের মুখে হাসি ফুটে উঠল। একটা বেল টিপে একজন সহকারীকে ডেকে মহেন্দ্রর কী কী করতে হবে সেটা বুঝিয়ে দিলেন।
মহেন্দ্রকে কিছু টেস্টের মধ্যে যেতে হল এবং তৃতীয় ও চতুর্থ দিন, দুবার মহেন্দ্রর স্পার্ম জমা নেওয়া হল। টাকা আগেই তুলে রেখেছিল, কথামত ডাক্তারকে দশ লাখ টাকা নগদে দিয়ে মহেন্দ্র ও বন্দনা চতুর্থ দিন সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে যায় বাঁকুড়ায়। এরপর বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয় ও ডাক্তার জানান যে ওর সন্তান এখন একজনের গর্ভে বড় হচ্ছে। নয় মাস বাদে সময় হলেই মহেন্দ্রকে কলকাতায় এসে ওর ঔরসের সন্তানকে নিয়ে যেতে হবে বাকি টাকা পেমেন্ট করে।
ডাক্তারের ফোন পেয়ে দুর্গা পূজার ঠিক আগে কলকাতায় গিয়ে মহেন্দ্র আর বন্দনা ওদের ছেলেকে কোলে তুলল। ডাক্তার জানালেন ওঁর নার্সিং হোমেই নাকি তিনদিন আগে ওদের এই পুত্র সন্তান প্রসব করেছে। শিশুটির মায়ের পরিচয় গোপন রাখতে ও ওকে একটু সুস্থ করে ওর বাবার হাতে তুলে দিতে কমপক্ষে তিন দিন সময় লাগে। আজ চতুর্থ দিনে সেই সরো-গেটেড মাকে নার্সিং হোম থেকে টাকা দিয়ে ডিসচার্জ করা হয়ে গেছে। এখন এই শিশুটিকে মহেন্দ্র ও বন্দনা নিশ্চিন্তে নিয়ে যেতে পারে। খুশিতে আনন্দে মহেন্দ্র বন্দনাকে চেম্বারের মধ্যেই জড়িয়ে ধরল। ডাক্তার মল্লিকের হাতে তুলে দিল বাকি নগদ পাঁচ লাখ টাকা। ডাক্তার মল্লিক হাসি মুখে টাকাটা নিয়ে নার্সকে ভিতরে ডাকলেন।
মহেন্দ্র ও বন্দনা এবার বাঁকুড়া থেকে একটা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া নিয়ে খুব ভোরে বেরিয়ে এসেছিল এবং কলকাতায় কোন হোটেলেও ওঠেনি। বেলা সাড়ে বারোটার সময় কাগজ পত্রে সই সাবুদ করে শিশুটিকে কোলে নিয়ে বন্দনা তার স্বামীর সাথে গাড়িতে উঠে বসল। দুশো কিলোমিটার রাস্তা, ওরা সাড়ে চার ঘণ্টায় পৌঁছে গেল মকুর গ্রামে। বাড়ির কাজের মহিলারা সবাই উলুধ্বনি দিয়ে শিশুটিকে সম্বর্ধনা জানিয়ে ঘরে তুলল। মহেন্দ্র পরেরদিনই বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজার আয়োজন করে শিশুটির নাম রাখল কার্ত্তিক।
চার মাস বাদে এক সকালে মহেন্দ্রর বাড়িতে এসে দাঁড়ালো বাঁকুড়ার জেলা পুলিশের এক অফিসার ও কয়েক জন পুলিশের একটা দল। ওদের মুখেই প্রথম মহেন্দ্র জানতে পারল যে ডাক্তার মানসী মল্লিককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে অন্য একজন মহিলার বাচ্চা চুরি করবার অপরাধে এবং সেই বাচ্চাটিকে নাকি সে মহেন্দ্র ও তার স্ত্রীকে পনের লাখ টাকার বিনিময়ে বেঁচে দিয়েছে। মহেন্দ্র আকাশ থেকে পড়ল শুনে। পুলিশ অফিসারকে পরিষ্কার ভাবে জানাল যে এটা ওরই সন্তান, ডাক্তার ওর স্পার্ম নিয়েছেন এবং অন্য একজন সরো-গেটেড মায়ের গর্ভে এই সন্তান জন্ম নিয়েছে। তবে ওর কাছে সেই মহিলার নাম বা ঠিকানা কিছু নেই, তার কারণ ডাক্তার সেটা গোপন রাখতে চান। পুলিশ অফিসার মহেন্দ্রর কথা শুনেই বললেন,'ঠিক আছে , আপনি তাহলে ঐ পনের লাখ টাকার রসিদ দেখান। আমি দেখছি কী করা যায়।'
কিন্তু মহেন্দ্র রসিদ দেখাবে কোথা থেকে। ওকে তো মানসী মল্লিক কোন রসিদ বা সই সাবুদ করা কোন কাগজের কপি কিছুই দেননি। মহেন্দ্র এবার বুঝতে পারল যে মহিলা ডাক্তার ওদের গ্রামের লোক পেয়ে একেবারে বোকা বানিয়ে ছেড়েছে। পুলিশ জানাল এই ডাক্তারের নামে আরও কয়েকটা কমপ্লেন জমা পড়েছে। এবার বাচ্চাটির আসল মা এক শান্তি গাঙ্গুলি ও বাবা রতন গাঙ্গুলি পুরসভার হাসপাতাল থেকে ওদের বাচ্চা চুরি যাবার কমপ্লেন করেছিল। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে এর পেছনে সেদিন ডিউটি রত ঐ ডাক্তারের হাত আছে। গ্রেফতার হবার পর পুলিশের জেরায় মহিলা সব কিছু স্বীকার করে পুলিশকে মহেন্দ্রর ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে।
পুলিশ অফিসার জানিয়ে গেলেন যে কোর্টের নির্দেশে মহেন্দ্র ও বন্দনাকে চারদিন বাদে আগামী সোমবার, কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে হাজিরা দিতে হতে হবে এই বাচ্চাটাকে নিয়ে। সেদিন নাকি মহেন্দ্র, ওর ছেলে এবং সেই আসল মা ও বাবার ডি এন এ টেস্ট হবে সেখানে। তারপর যদি সেই ডি এন এ টেস্টের রিপোর্ট প্রমাণ করে যে শিশুটি ঐ শান্তি গাঙ্গুলিরই সন্তান তাহলে কোর্টের উকিলের সামনে পরদিন বাচ্চাটিকে ওর আসল মায়ের কোলে তুলে দিতে হবে। মহেন্দ্র যেন কোথাও পালিয়ে না যায় আর সোমবার কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে হাজির থাকে।
সারারাত কার্ত্তিককে পেঁচিয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে কাঁটাল ওর হতভাগ্য এই পালিত বাপ মা। মহেন্দ্র ভাবতেই পারে নি যে ওকে এইভাবে ঠকাবে সেই শয়তান মহিলা। মহেন্দ্রর বৃদ্ধা মার মনও খুব ভেঙে পড়েছে।
সোমবার মেডিক্যাল কলেজে কার্ত্তিক, মহেন্দ্রর এবং শান্তি গাঙ্গুলি ও রতন গাঙ্গুলির ডি এন এ টেস্ট করা হল। পরদিনই রিপোর্ট এলো যে কার্ত্তিক আসলে শান্তি গাঙ্গুলিরই সন্তান। কোর্টের আদেশে একজন উকিল, পুলিশের একজন অফিসার, শান্তি ও রতন গাঙ্গুলি এবং মহেন্দ্র ও বন্দনা উপস্থিত ছিল মেডিক্যাল কলেজের সেই ডাক্তারের চেম্বারে। শান্তি ও রতনের একটি পাঁচ বছরের ছেলে আছে। এটি ছিল ওদের দ্বিতীয় সন্তান। ডাক্তার ব্যানার্জি নামের সেই ইন-চার্জ সবার সামনে ডি এন এ রিপোর্ট পড়ে শুনিয়ে বললেন,'আমি দুঃখিত মহেন্দ্র বাবু। এই বাচ্চা ছেলেটি আসলে এই শান্তি দেবীরই সন্তান। আপনাকে এই বাচ্চাটিকে ওর হাতে তুলে দিতে হবে।' পুলিশ অফিসার জানালেন, 'আমরা ইতিমধ্যেই আপনার পনের লাখ টাকা সেই অপরাধী ডাক্তারের কাছ থেকে আদায় করেছি। আপনাকে সেটা আপনার ব্যাঙ্কে ট্র্যান্সফার করে দেব আমরা।' কোর্টের উকিল ভদ্রলোক সায় দিয়ে বললেন, 'কোর্ট আপনার অজ্ঞানতার জন্য এবার আপনাকে মাফ করে দিয়েছে। আপনি বাচ্চাটাকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে বাঁকুড়া ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু ভবিষ্যতে এই রকম কোন ডিল করতে গেলে অবশ্যই সব দেখে শুনে ও রসিদ ইত্যাদি হাতে নিয়ে তবেই টাকা পয়সা পেমেন্ট করবেন।'
এদিকে চারমাসের শিশু কার্ত্তিক বন্দনার গলা পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বন্দনার এই চারমাসের মধ্যে শিশুটির উপর যেই ভালোবাসা মমতা জন্মে গেছে তাতে ওর বুক ফেটে যাচ্ছিল যেন। কাঁদতে কাঁদতে সমানে বাচ্চাটাকে চুমু খেয়ে ওর ঘুম ভাঙ্গাবার চেষ্টা করছিল বন্দনা। ভগবান যাও ওর ঘরে একটা শিশু পাঠালেন তাকেও কেন ওর কোল থেকে কেন কেড়ে নিচ্ছেন ? ও কী এমন পাপ করেছিল আগের জন্মে ?
বন্দনার ও ক্রন্দনরত মহেন্দ্রর অবস্থা দেখে শান্তি ও রতন গাঙ্গুলি চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ শান্তি গাঙ্গুলি তার স্বামীকে বলে উঠল,'আমি যেটা ভাবছি তুমিও কি সেটাই ভাবছ গো ?'
রতন ঘোষ জবাব দিল, 'একদম ঠিক শান্তি। আমাদের তাও একটা সন্তান আছে। চাইলে আবারো সন্তান পেতে পারি। কিন্তু এইভাবে একজন মায়ের কোল খালি করে আমি আমাদের বাচ্চার কোন ক্ষতি হোক সেটা চাইনা। চল বাড়ি চল। কার্ত্তিক ওর এই বাবা মার কাছেই বড় হোক আর জীবনে অনেক উন্নতি করুক।'
রতন কার্তিকের মাথায় হাত রেখে বলল, 'মহেন্দ্র বাবু, আপনি কার্ত্তিককে ও আপনার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। আমরা আমাদের কমপ্লেন তুলে নিচ্ছি। আপনারা ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন। এই ছেলে এখন থেকে আপনাদের সন্তান।'
ডাক্তার ব্যানার্জি শান্তি ও রতন গাঙ্গুলির এই মানবিকতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে।
---------------------------------
উত্তম চক্রবর্তী।