Click the image to explore all Offers

গল্প ।। মেছাল ।। শ্রীজিৎ জানা



ঋণস্বীকার- ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। 
 

মেছাল



শ্রীজিৎ জানা




--তা বলে তরা এৎকালের একটা পধাকে  কুনু মানবিনি?

---মানতেই যে হবে এমনত কেউ মাথার দিব্বি দ্যায়নি!

---অরে ঘোর সব্বনাশ হোয়ে যাবে। নিব্বংশ করে দিবে উ ঠাকুর। কত পুব্বাপুরুষের আমল থিকে ইকাজ করিঠি আমরা। তরা মুখ মুড়িসিনি। কমিটিকে বোলে দিবি আমরাই মাছ দুব।

ছোটদের মতো আছাড়বিছাড় খেতে থাকে শশধর।কথার ভিতরে মিশে আছে কান্না মেশা আকুতি।চৈত্রের শেষ সপ্তাহ। পাশের রসিকগঞ্জ গাঁয়ে বাবা বুড়ো শিবের থান। দুরদুরান্তের লোকে বলে রাখাল মাড়। শশধর সেই গল্প অনেকবার তার নাতি নাতনিদের শুনিয়েছে। গল্প বলবার সময় বারবার হাত জোড় করে কপালে ঠেকানে চাই তার। আজ যেখানে শিব মন্দির,এককালে সেখানে ছিল নাকি বিশাল বনজঙ্গল! গাঁয়ের রাখাল গরু ছেড়ে বনের একটা ধারে বসে থাকত। কিন্তু মনিব খেয়াল করে তার একটি গাই গরু বেশ কিছু দিন ধরে ভালো দুধ দিচ্ছে না। সন্দেহ যায় রাখালের উপর। তাকে যারপরনাই গালমন্দ শুনতে হয়। তখন রাখাল গাইটিকে চোখে চোখে রাখতে শুরু করে। দেখা যায় ঠিক দুপুরবেলা সূর্য যখন মাথার উপরে গাইগরুটি এক জায়গায় গিয়ে যেই না দাঁড়ালো,অম্নি তার দুধ ঝরতে শুরু কোরলো। রাখাল কদিন দেখার পর মনিবকে জানায় সেকথা। তখন মনিব লোকজন নিয়ে সেই জায়গা খুঁড়েই বুড়োশিবের হদিশ মেলে। সেদিন থেকেই রসিকগঞ্জে বুড়োশিবের থানকে বলে রাখাল মাড়।


 সাতদিন আগে সেই মাড় উঠবে।  সাত ভোগের মাড় হোলো বুড়ো শিবের থান। মাড় ওঠার প্রথম দিনেই মাগুরমাছ লাগে মন্দিরে। মাগুরমাছ বলি দেওয়া হয় শিবের থানে। বহুকাল থেকে এই প্রথা চলে আসছে। শশধরের বংশের পূর্বপুরুষ মানে গোপালপুরের কোটাল পরিবারের এই মাগুরমাছ দেবার রীতি রয়েছে।এ নিয়ে শশধরের গর্বের অন্ত নেই। বুড়ো শিবের তারা সেবাইত। মনে মনে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে।

--ইটা কি চাট্টিখানি ব্যাপার। আমরা বামুন-বোষ্টম নই। জাতে বাগ্দী। বাবা শিব এই কদিন মোদের হাতে সেবা লিবে।  আমরা বুড়া শিবের থানের মেছাল।ই কি কম পুন্নের কাজ! বল দিখি।

যতকথা বলবে শশধর তারচে অধিকবার হাত কপালে ঠেকাবে। তার কথা সহজে থামাবে না।

---মাগুরমাছ দুটা লাগে। একটা মাড় উঠার দিনে। আরেকটা মেলের দিনে। পথমটার ছেদ হয় শিবপুকুরের ঘাটে। ভটচাজ ঠাকুর বলে ওই মাগুরমাছটা নাকি অসুর। অকে বলি দিলে অশুভ নাশ হোলো,ইবার শুভকম্ম শুরু।

বুড়ো শিবের থান থেকে নেওতা দিয়ে গেছে অনেক আগেই। দাদপুরের সত্য ঢাকির ছেলে প্রথামত ঢাক বাজিয়ে এসে শশধরের হাতে দিয়েছে হলুদমাখা গোটা সুপুরি। সেই থেকে শশধরের আকুলিবিকুলি বেড়েছে।যদিও গেল দু'তিন বছর থেকেই  শুরু হোয়েছে দড়ি টানাটানি। মন্দির কমিটিতে এসেছে সব নতুন লোকজন। তাদের ধরণধারন শশধরের পছন্দ হয় না। পুরোহিত অক্ষয় ভটচায্যিকে বলেছে তার অভিমানের কথা,

--ইটা কি হয়ঠে বল দিখি ভটচাজ ঠাকুর। আগে ঢাকির সঙে কমিটির কেউ নেওতা দিয়ে যেত। এখন ঢাকির হাতেই সুপারি পাঠি দেয়ঠে। তারপর দেখ এখনো সেই তিন কেজি আতবচাল আর একভাঁড় আখগুড়! আমি মেনে লেইঠি বলে কি আজকের ছ্যানাছকরারা মেনে লিবে? বল ঠাকুর?অদের একটা বিবেচনা নাই?

অক্ষয় ভটচাজ মুখে কিছু না বল্লেও শশধরের কথায় যে যুক্তি আছে তা মাথা দুলিয়ে সমর্থন করে। শশধর বোঝাতে চায় আজকের দিনে ভক্তিভাবের বড় আকাল। মানুষজন অর্থকড়ি বোঝে ভালো রকম।বংশে তার প্রজন্মের শেষ প্রতিনিধি সে। তার পরেই এই রীতি পালন করতে হবে তার ছেলেকে। মাধ্যমিক পাশের পর একমাত্র ছেলে রাস্তার ধারে ষ্টেশনারী দোকান দিয়েছে। তার অন্য দুই ভাইয়ের ছেলেরা থাকে মুম্বাইয়ে,সোনার কাজে। এসবের খোঁজখবর আদৌ রাখে না তারা।

আগে সেইসব দিন ছিল। দুই দাদার সঙ্গে শশধর নিজেদের টুবিপুকুরে মাগুরমাছ ধরতে নামতো। মাড় ওঠার দু'দিন আগে থেকে চোলতো মাছ ধরার ধূম।চাবিজাল নিয়ে পুকুরকে দলমাদল করে তুলতো তিনজনে। অনেকসময় পাশের পাড়ারও দু'একজন যোগ দিত বাবার নামের মাছ ধরতে।পুকুর পাড়ে তখন লোক ভীড় কোরতো বিস্তর। মাছ যত না জালে ধরা দিত,তত হাঁক দিত শশধরের দাদা-বাবা বুড়ো শিবের চরণে সেবা লাগে/ সেবা করিলে সেবা/ মহাদেব। তার সাথে সকলে গলা মিলিয়ে বাবা বুড়োশিবের জয়ধ্বনি দিত।

সেইসব দিনের ছবিতে কবেই ঝুলকালি পড়েছে।আগে সব ঘর থেকেই মাছ ধরার জাল বেরোতো। আজকাল দু'এক ঘরে মিলবে কিনা সন্দেহ!পাঁকজলে চাবিজাল চেপে মাছ ধরার পাট কবেই চুকে গ্যাছে। এখন মাছের আড়ৎ থেকে মাগুরমাছ আনা হয়। হাঁড়িতে জিয়িয়ে রাখতে হয় যত্নে। মাছের গায়ে কাটা,চেরা দাগ থাকলে খুঁত আছে বলে সেই মাছে আর মন্দিরে দেওয়া যায় না। ওইটুকু এখনো মেনে চলে মাত্র। বাকি সব আচারবিচারের ধার ধারেনা কেউ।

আগে শশধর-গিন্নী মাছের সব কাজ কোরতো। বড় দুটো হাঁড়িতে সাবধানে আলাদা করে দুটো মাছ রাখত।মুখে বেঁধে দিত পরিস্কার মশারির জাল। ঘরের কোণায় গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে হাঁড়ি বসাত। সারারাত দুটো মাছের সেকি ছটপটানির শব্দ। শশধর শুয়ে শুয়ে গিন্নীকে বোলতো -

---উ এখন মাছ নাকি। অকে অসুরে ভর করেছে। বাবা বুড়া শিবের নামে উচ্ছুগ্গু করে দিছি। ইবার উদ্ধার পাবার জন্যেই অমন লাফানঝাঁপান।

পরদিন সকালে পেতলের বড় ঘটিতে করে শশধর হাজির হয় শিবের থানে। এদিকে মধুকামার দা নিয়ে হাজির। মন্ত্র পড়ে সিঁদুর লাগিয়ে মাগুরমাছকে আসুদ কাঠের উপর রেখে "জয়বাবা বুড়োশিব" বলেই কোপ বসিয়ে দেবে। তার আগে সহজে কি কাবু করা যায় মাগুরমাছকে। এর-ওর হাত থেকে ফসকে, এঁকেবেঁকে পালানোর চেষ্টা করে। মধুকামার চোখ নাচিয়ে বলে উঠে,

---দ্যাখা ব্যাটা তুই কত খেল দেখাবি।


---খেলা নয় রে মোধো বাবা তোকে বিড়ে দেখছে।

বামুন ঠাকুর রসিকতা করে মধুকামারের সাথে। তারপর ছেদ হোয়ে গেলে টুকরো দুটো গামছার খুঁটে বেঁধে নেয় মধু। কাটারির গায়ের রক্ত ধুয়ে নেয় শিবপুকুরের জলে।

শশধর যতবার এইসব কথা মনে করে  দুচোখ তার ছলছলিয়ে উঠে আবেগে।  সে মনে করে শিবের থানের মেছাল হওয়া সোজা কথা নয়। আশপাশের গাঁয়ে তার পরিবারকে রাখালমাড়র মেছাল বলে চেনে। জেনে গর্ব হয় তার। বুড়ো শিবের সেবাইত তারা। শশধর কথায় কথায় ছেলে-বৌমাদের বলে,

---ই কি কম পুন্নের কাজ। একভাঁড় গুড় আর তিনকেজি আতবচালের জন্যে কোটাল বংশ ই কাজ পাইনি। পেইছে সেবার জোরে। পুন্নের জোরে।নইলে মোদের মত ছোট জাতের জল ল্যায় ঠাকুর!

 ছেলের যতই রাগগোঁসা থাক গাজনের ঢাকের শব্দ পেলেই নিজে থেকেই মাছের আড়তে ফোন কোরে মাছের বায়না দ্যায়। শশধর সেকথা বিলক্ষণ জানে। কিন্তু ঝামেলা হোলো গত বছর। বুড়োশিবের থানে জলঢালার দিনে শশধরের বৌমার সাথে তুমুল বচসা হয় পুজো কমিটির। ফিবছর শশধরের পরিবারের জন্য জলঢালার প্রণামী বাবদ যে টাকা পুজো কমিটি ধার্য করে তার ছাড় থাকে। কিন্তু নতুন কমিটি সেই নিয়ম বাতিল করলেও শশধরকে জানায় না। মন্দিরের দরজা থেকে তার বৌমাকে ফিরিয়ে দ্যায়। আগে টিকিট কেটে আনতে বলে।চৈত্রের রোদে অতবড় লাইনে দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে হয় তাকে। তার উপর লোকের সামনে অপমান। মনে রাগ চেপে জলঢালার পর্ব মিটিয়ে ঘরে ফিরে শশধরের উপর একচোট নেয়। সন্ধ্যায় শিবের থানে ছেলে গেলে কমিটির সাথে বাকবিতণ্ডা বাঁধে।কমিটির লোকজন  মুখের উপর সাফ জানিয়ে দ্যায়,

--নিয়ম সবার জন্যে এক থাকবে। মেছাল হিসাবে পাওনাগণ্ডা তো লাও। তাতে পোষায় মাছ দেবে না হয় না দেবে।

---পাওনাগণ্ডা মানে? কী দাও? ওই ত একভাঁড় আখগুড় আর তিনকেজি আতবচাল।

---যেটা দেওয়া হোয়ে আসছে ওটাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

এমন ট্যাকটেকে কথা নিতে পারেনা শশধরের ছেলে।সেই থেকে রাগ তার চরমে।যত না মন্দিরের উপরে তারচে বেশি কমিটির লোকজনদের উপর। শশধর বোঝাতে চায় ছেলেকে,

---অদের কথা মনে লিইসিনি খকা। মানুষগুলার রাগ নিয়ে ঠাকুরের থিকে মুখ মুড়িসিনি। এতদিনের কৌলতি কটাল বংশের। শিবের কোপে সব শেষ হোযে যাবে খকা। মাথা গরম করিসিনি। বৌমা তুমি একটু খকাকে বুঝাও।নাতিপুতি লিয়ে সংসার।

রাখালমাড়র গাজন উঠতে আর দু'দিন বাকি। এদিকে ছেলে গোঁ ধরে বসে থাকে।শশধর মনে মনে অস্থির হোয়ে উঠে। পাড়ার কাউকে কাউকে ছেলেকে বোঝাতে বলে। বয়সের কারণে নিজে থেকে কিছু করতে পারে না। স্ত্রী গত হওয়ায় ছেলের সংসারে শশধর একা কোন কাজে জোর পায় না।এরই মাঝে একদিন বিকেলে গিয়ে শিবের থানে মাথা ঠুকে আসে শশধর। বিড়বিড় করে বুড়োশিবকে কত কিছু জানায়

--দোষ লিও না ঠাকুর। ছ্যানামানুষের রাগ। মেছালরা কুনুদিন টাকাকড়ির জন্য ঠাকুর সেবা করেনি। তুমি ত সব জান বাবা। সুমতি দাও ঠাকুর ছ্যানাটার।

সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে শশধর দেখে বৌমা বিছানায় শুয়ে আছে। ডাক্তার এসেছে। ছেলেকে দোকান থেকে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুয়ারে। বৌমা হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় উঠানে। ডাক্তার বলে -প্রেসার কম। শশধর বিচলিত হোয়ে উঠে।

---কি থেকে কি হোলো রে খকা। বাবা বুড়া শিব দোষ দেখনি বাব।

দুয়ারে বসে শশধর কপালে জোড়হাত করে প্রণাম করতে থাকে বারবার। ছেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে পাশটায়।

সেইমাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। অর্জুন গাছটার ডালে পাখিদের কিচিরমিচির চারিদিকের স্তব্ধতাকে ভেঙে দিচ্ছে। শশধর রাতে চোখে পাতায় এক করতে পারেনি। কাল মাড় উঠবে। এদিকে ঘরে বিপদের ইঙ্গিত। বিছানায় উঠে বসে অভ্যাস মতো বিড়ো শিবকে প্রণাম করতে থাকে। আর তখনই বাইর থেকে ছেলের ডাক শুনতে পায়। বাইরে বেরিয়ে আসে শশধর। দ্যাখে ছেলে এই ভোরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে

--আমি যাইঠি মাছেরআড়ত। বৌমা তমার রইল। অকে ওষুধ খেতে বলবে। আর আজকে নিরামিষ খেতে হয় মনে আছে ত তমার। কালকে মাছ লিয়ে যেতে হবে মাড়কে।

বলেই সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে রওনা দ্যায় সে। ছলছলানো চোখে তাকিয়ে থাকে শশধর। তার আর কোনো ভাবনা নেই। রাখাল মাড়র নতুন মেছাল মাছ আনতে চলেছে ভোরের নতুন আলো গায়ে মেখে। 

------------------------------ 




Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.