ঋণস্বীকার- ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ
ডঃ অভিষেক ঘোষ
হাওড়া-ঢ্যাঙাপুর লোকাল করতালগঞ্জের মাঠের ধারের থার্ড লাইনে পড়ে আছে আজ দশদিন হল। মাঠের ধারের দিক থেকে যারা স্টেশনে উঠবে তাদের গালাগাল শুনে শুনে রেকটা পাথর হয়ে গেছে। তার কীসের দোষ। কিন্তু মাঝখান থেকে তার ঊর্ধ্বতন অষ্টাদশপুরুষ… যাকগে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। এখন আপ ডাউন কোনওদিকেই সে ভবিষ্যতের আলো দেখতে পাচ্ছে না। নিজে নিজে চলার বিদ্যা তার জানা নেই। যারা ভুতুড়ে ট্রেনের গপ্পো লেখে, তারা কীরকম লোক ঠকায় সেটাই এখন ভাবছে সে। খাতায় কী যেন একটা নাম তার আছে বটে, কিন্তু এখন সে ঢ্যাঙাপুর লোকাল। এর আগে, অনেকদিন আগেই, সে ছিল মেছোডাঙা গ্যালপিং। তখন তার কদর ছিল অন্যরকম। নিজেকে ভিআইপি মনে হত। সকাল হলেই ওড়ো, সন্ধ্যে সন্ধ্যে কারশেডে ঢুকে পড়ো। এখন প্রতি স্টেশনে দাঁড়াতে হয়, তাতেও হাটুরে আর আপিসবাবুদের মুখের ধারে গা কেটে যায়। ছোঃ, ভদ্দরলোক । আর এখন, কেন সে যে এই ধূ ধূ মাঠের পাশে চৈত্রের রোদে দাঁড়িয়ে আছে কেউ জানে না। কী তার দোষ কেউ বলবে এসে? পাশ দিয়ে মালগাড়ি যায়, সুপার যায়, প্যাসেঞ্জার যায়, লোকাল যায়। তারা বাঁকা হাসি হেসে শিষ দিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রত্যেকটা একেকটা হাড়বজ্জাত। তার সঙ্গে আপ সুন্দরীপুর ফার্স্ট প্যাসেঞ্জারের সম্পর্ক হাওড়ায় কান পাতলেই শোনা যায়। এই তো সেদিন, টিকিটবাবু পর্যন্ত মুখে পান ঢোকাতে ঢোকাতে দুজনকে পাশাপাশি দেখে সরু হেসে বলল, "জিতে রহো বেটা"। সে তো জিতেইছে। সুন্দরী তো রাজি আছেই। দুজনের কাজ দু'লাইনে। কিন্তু দিনের শেষে এক কারশেডে পাশাপাশি বেশ। কমদিন তো হল না। এখন মাঠের পাশের কুলবনের মশার ঝাঁক আর বেশি রাতে রাতচরার উত্পাতে সে চমকে চমকে ওঠে। আজ দশদিন হল সে বাড়ি ফেরেনি। সুন্দরী কী করছে। তাকে কেউ খবরটা পর্যন্ত দেয়নি। সে নিশ্চিত জানে, জানলে সুন্দরী ছুটে আসতো। টিকিটবাবুর টিপ্পনী শুনে সুন্দরীর চোখমুখ সেদিন লাল হয়ে উঠেছিল নববধূর মতো। এই তো সেদিন। কারশেডে ঢুকতে ঢুকতেই সুন্দরীর পাশের রেকটা নাকি ম্যালফাংশন করছিল। হঠাৎ করেই হেডলাইড জ্বলে নিভে সকলকে ব্যতিব্যস্ত করা। শালাকে আর একদিন এমন করতে দেখলে চোখমারার মজা টের পাওয়াবে। লোকাল ট্রেন-ফার্স্ট প্যাসেঞ্জারের প্রেম হতে নেই নাকি বিয়ে হলে রেল কোম্পানি উঠে যাবে। মালগাড়িটা সেদিন শুধু বলেছিল, তোর ভাড়া তো কুড়ি টাকা। তুই ওকে বিয়ে করবি ভাবছিস। ওর ভাড়া তোর পাঁচগুণ। সেদিন রাগটা মাথায় চড়ে ছিল।। শোধ তুলেছিল পরদিন। খানিকটা গিয়েই ছিঁড়ে পড়ল তার। ব্যাস, পিছনের মালগাড়িটা আর পথ পেল না। লাইনের সব নিত্যযাত্রীদের খিস্তি আর ঢিল খেল দুজনেই। তাতে কী! শোধ তো তোলা গেল। পেটে খেলে পিঠে সয়। তারটা সন্ধ্যার আগে সারানোই গেল না। পিঠে মাল নিয়ে একপায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা গেল শয়তানটাকে। সুন্দরী সেদিন খুব হেসেছিল আর বকেওছিল খানিক। "তুমি বড্ড ছেলেমানুষ। চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাও কেনে? শুধু শুধু হাঙ্গামা করে কর্তাদের ধমক খেলে, ওষুধ পড়ল একগাদা। মাঝখান থেকে সারা লাইন জুড়ে ঝঞ্ঝাট। নিরীহ লোকগুলোর দোষ কোথায়?" ঢ্যাঙা মাথা চুলকে চুপ করে থাকে। হ্যাঁ, বাড়াবাড়ি হয়েছে তো খানিক। কিন্তু ও অমন বলবে কেন? সুন্দরী চোখ টিপে বলে, গেট পড়লে দেখো না, টোটোগুলোর পিছনে কী লেখা থাকে? দেখবি আর জ্বলবি। লুচির মতো ফুলবি। আমাদের বিয়ের বাজার ঐ মালগাড়িতেই আসবে দেখো। ডোন্ট ওরি।
-"ওঃ খুব ইংরিজি শিখেছিস দেখছি। ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার হয়ে তোর দেমাক আর ধরে না দেখছি।
-মোটেই না। তোমার যত বাজে কথা।
কারশেডের ওপারে কৃষ্ণচূড়ার পাতা নড়ে। তিরতির করে কাঁপে রেলদীঘীর জল। ফাগুনের বাতাস জোনাকির আলো মেখে নক্ষত্রলোকের দিকে ভেসে যায়।
আচমকা দারুণ হৈচৈ শব্দে সাড় ফেরে ঢ্যাঙার। কী কাণ্ড ঘটে গেছে। দূরে স্টেশনবাড়িতে তখন যেন ভূমিকম্প ঘটে গেছে। ডাউন জঙ্গলগ্রাম এক্সপ্রেস একগাড়ি লোক নিয়ে প্লাটফর্মে দিব্যি উঠে এসেছে। আতঙ্ক আর আর্তনাদে এরপর চার-পাঁচ ঘণ্টা কীভাবে যেন কেটে যায়। মাঠের পাশের এই অখ্যাত স্টেশন তখন ডুবে গেছে নিকষ অন্ধকারে। মাঝরাতের ব্রেকিং নিউজ তখন ইথার তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে দূরে দূরে। নিউজপ্রিন্ট বেরোচ্ছে একে একে। ব্রেকিং নিউজ ভেঙে পড়ছে টিভির পর্দায়। আত্মীয়দের উত্কন্ঠা আছড়ে পড়ছে হাওড়ার স্টেশনে। গ্রামের লোকেরা ছুটে আসছে, ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে একে একে - - - ঢ্যাঙা সব দেখে কিন্তু কিছুই যেন তার মাথায় ঢোকে না। এমন সময় পাক দিয়ে নড়ে ওঠে তার পুরো শরীর। ডাউন ঢ্যাঙাপুর হাওড়া লোকালে নিমেষে প্রাণের স্পন্দন জাগে। কে যেন বলে "কালিদাসবাবু, দেরি করবেন না। একটা ফাঁড়া কেটে গেল। একটা বাঁচোয়া, মরেনি কেউ। তাহলে আর দেখতে হত না। হাওড়ায় লোক বাড়ছে। যতক্ষণ রিকভারি করে এই লোকালটা লোকজন নিয়ে হাওড়ায় না পৌঁছয়, আমার চিন্তা থেকেই যাবে কিন্তু।কী ভাগ্যি এই গাড়িটা এখানেই ছিল। তাই তাড়াতাড়ি অ্যারেঞ্জ করা গেল। আর কুড়ি মিনিট দেরি হলে একটাও মার বাইরে পড়ত না। যান যান। কুইক।
কালিদাস শশব্যস্ত হয়ে লগবুক খুঁজতে থাকেন।
হায়, কোন সুদূরের পারে কালগর্ভে হারিয়ে যাওয়া কোনও শাপগ্রস্ত কবি তখন হয়ত টেনে নিচ্ছেন নতুন একটি তাড়পত্র। লেখনী মস্যাধারের গভীর তমসা থেকে তুলে আনছে মণিমাণিক্য। রত্নরাজি স্ফুট হয়ে উঠছে প্রতি অক্ষরে-বর্ণে। কোনও শাপাবিষ্টের জীবনবেদের মন্ত্ররাজি ভেসে যায় দূরে, আরো দূরের অলোক অলকায়।
কালিদাস লগবুকের এন্ট্রি সেরে হাতলে চাপ দেন। অহল্যার ঘুম ভাঙে যেন। শাপমোচন। আজও হয় বুঝি। ঢ্যাঙার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে স্টেশনের দিকে গড়ায়। সেখানে তখন তুমুল ভিড়। ডাউন ঢ্যাঙাপুর লোকাল বসন্তের বাতাস কাটিয়ে রাতের বুক চিরে ছুটে চলে অলকার দিকে। চৈত্ররজনীর আকাশে তখন খানিক ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা।
-----------------------
ডঃ অভিষেক ঘোষসহকারী অধ্যাপক
সংস্কৃত বিভাগ
বাগনান কলেজ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়