এক টাকওয়ালার দশ জ্বালা
সৌমেন দেবনাথ
বেশ কয়েক মাস পরে ছবেদার বাবা মা ছবেদাকে দেখতে এসেছেন। বাবা মাকে পেয়ে মনের কষ্ট ছবেদা বলতে থাকলো। বললো, বাবা, আমি আর টাকওয়ালা জামাইয়ের ঘর করবো না। তাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে পারি না। সবাই তাকে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়। যেন চিড়িয়াখানার জীব। অনেকে তাকে বয়েসীও ভাবে আর শুনিয়ে বলে, এত সুন্দর মেয়েটার কপালে এমন টেকো স্বামী জুটেছে!
বাবা ছাদেক ব্যাপারী বললেন, মন খারাপ করিস না। আল্লাহ সব মানুষকে সব দেন না। আর টাকাওয়ালা স্বামী অভিশাপের কিছু না। প্রথম প্রথম তাকে তোর এমন লাগবে, পরে দেখবি সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।
ছবেদার মা ছমিরন বললেন, স্বামীকে অবজ্ঞা করতে নেই, ঘৃণা করতে নেই, অপমান করতে নেই। তোর স্বামী একাই কি টাকওয়ালা? কত মানুষের টাক আছে! তোর স্বামী কাজ করে, পরিশ্রমী, সুখের সংসার।
ছবেদা বললো, বাইরে-ঘাটে যখন কাজ করি পাড়ার লোক আমাকে বলে, ঐ দেখো, টাকওয়ালার বৌ! মা, তখন খুব খারাপ লাগে।
ছমিরন বললেন, মানুষ বললে প্রতিবাদ করবি, যুক্তি দিয়ে বোঝাবি, ঝগড়া করবি না। বলবি, আল্লাহ কাউকে কালো, কাউকে ফর্সা বানিয়েছেন। আমার স্বামীরও এক সময় চুল ছিলো, এখন নেই। সব আল্লাহর ইচ্ছায় হয়।
তখন রাজীবের মা রহিমা এলেন আর বললেন, রাজীবের মাথা ভর্তি চুল ছিলো। মনে হয় কোনো হিংসুটে লোকের নজর পড়েছে। আমার ছেলেটা এক মাসের মধ্যে দেখতে দেখতে টাক হয়ে গেলো।
ছমিরন বললেন, রাজীবকে নিয়ে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই, কষ্ট নেই। পুষ্টিকর খাদ্য খেলে ওর মাথায় আবার চুল গজাবে।
ছবেদা কটাক্ষ করে বললো, আবার কালো অরণ্য হয়ে উঠবে স্বামীর টাক মাথা। যত্তসব।
কয়েক দিন পর রাজীবের শ্বশুর শ্বাশুড়ি বাড়ি চলে যাবেন। ছাদেক ব্যাপারী বললেন, মারে, ক দিন থাকলাম, দেখলাম তুই রাজীবকে যাচ্ছেতাই করে বলিস। এমনটা ঠিক না। স্বামীর অবর্তমানে কি হবে একবার ভেবে দেখিস।
ছমিরন বললেন, সংসারে তোর জন্য যেন অশান্তি সৃষ্টি না হয়। স্বামীকে ভক্তি করবি। স্বামীকে ভালো ভালো জিনিস রান্না করে খাওয়াবি। শ্রদ্ধাও করবি, যত্নও নিবি।
ছবেদা বললো, আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমরা রাস্তা দেখে শুনে যেও।
রহিমা বললেন, আপনারা কিন্তু মাঝে মাঝে আসবেন।
এদিন রাজীব কাজ শেষে বাড়ি এলো। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি এনে দিয়ে ছবেদা বললো, মাথায় তো গামছাটা বেঁধে কাজ করতে পারো। একটু রোদ কম লাগবে।
বৌয়ের এমন আদরসুলভ কথা সে কোনো দিন শোনেনি। আজ শুনে মনে মনে ভাবলো, নতুন ভাবে অপমানের পায়তারা করছে নাকি?
আচল দিয়ে স্বামীর মাথাটা মুছে দিয়ে ছবেদা বললো, রোদে রোদে কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে ছায়ায় থাকা যায় এমন একটা কাজ নাও, যেমন বাজারে দোকান দিলে...
রাজীব আশ্চর্য হচ্ছে বৌয়ের মিষ্টি মিষ্টি কথায়। ছবেদা আবারো বললো, যতই তোমার উপর রাগ করি না কেনো তোমার যে কষ্ট আছে আমি জানি। রাগের মাথায় যা বলে ফেলি, মনে মনে কিন্তু আমি আফসোসও করি, দুঃখও করি।
রাজীব বিমোহিত হয়ে বললো, আমার তো আয়না দেখা লাগে না, প্রায়শই ভুলে যাই যে, আমার মাথায় চুল নেই। তুমিই বরং মনে করিয়ে দাও যে, আমি টাক।
রাজীবকে নিয়ে ছবেদা ঘরে গেলো, তারপর টাকে মমতাস্পর্শ দিয়ে বললো, কোনো মানুষই সব দিক দিয়ে সম্পূর্ণ না। আমি ভেবে দেখেছি, এ নিয়ে বেশী মন খারাপ করলে মানসিক রোগী হয়ে যাবো। বিশ্বাস করো, তোমার কষ্ট এখন আমাকেও কষ্ট দেয়। কাজে গেলে মাথায় গামছা বাঁধবে, না হয় মাথাল দেবে। আর বাজারের দিকে গেলে ক্যাপ পরবে।
রাজীব বৌয়ের কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে বললো, তুমি ভালো হলে কত ভালো, আর মন্দ হলে কত মন্দ!
ছবেদার হঠাৎ রাগ হয়ে গেলো, বললো, মন্দ মানে, আমি মন্দ? কি করেছি? ধনীরা টাক হয়। ধনীরা টাক হলে মানায়। তুমি কৃষক মানুষ। তুমি টাক হয়েছো কেনো? বিজ্ঞানীরা টাক হয়, তুমি বিজ্ঞানী? গণ্ডমূর্খ কৃষক, টাক হয়ে জ্ঞানী মানুষদের ইজ্জত ডুবিয়েছো।
বাইরে থেকে রহিমা উচ্চস্বরে বললেন, ঐ আবার শুরু করেছে স্বামীকে শাসানো। ঘরের মধ্যে শান্তি না থাকলে বৌমা, কোথাও শান্তি পাবে না, মনে রেখো।
ছবেদা বাইরে এসে শ্বাশুড়ি মাকে বললো, এই যে টেকো ছেলের গর্বিত মা, কি আদর যত্নে ছেলে মানুষ করেছেন যে, মাথার চুল পড়ে গেলো! ঠিক মত খেতে দিতেন, না নিজে খেতেন?
রহিমা বললেন, বৌমা, তোমার মুখটা মুখ না, অস্ত্র। তুমি এ বাড়ি যে যাচ্ছেতাই করছো, তা অন্যায়। মনে রেখো, স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ির সেবা করা বাড়ির বৌয়ের পরম আনন্দের কাজ।
ছবেদা ঠোঁট, মুখ বাঁকিয়ে বললো, বৌমার সেবা পাওয়ার ইচ্ছা খুব, তাই না? ছেলের মাথায় চুল উঠান, নতুবা এ বাড়ি আগুন লাগাবো। নাম লিখতে কলম ভাঙে, চেহারাখান জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীর।
প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসশূন্য হয়ে পড়লো রাজীব। যা করতে যায় ভুল হয়ে যায়, যা বলতে যায় ভুল হয়ে যায়। মানুষের কাছে হাসির খোরাক হতে থাকলো দিনে দিনে।
দোকানে গেলো চাল, ডাল কিনতে। দোকানদার বরাবরের মত রাজীবের টাক মাথার দিকে অপলকে বেশক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, টাক হওয়ার কারণে তো তোর তেল, স্যাম্পু কেনার টাকা লাগছে না। টাক হওয়ার এই সুবিধা, অনেক টাকা বেচে যায়। আমার মাথাও যদি টাক হতো!
রাজীব দোকানদারের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে চাইলেও কিছু না বলে বাজার থেকে চলে আসছে। স্যালুনের সামনে আসতেই স্যালুনের ভেতর থেকে একটি কথা ভেসে এলো, টাকেদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে আর আমরা হয়ে পড়ছি বেকার! সেভ করতে এলে ডাবল টাকা নেবো।
রাজীব বুঝতে পেরেছে একথা কে বলেছে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ মাটি করে বাড়ির পথে রওনা দিলো। পথে বন্ধু শহর আলীর সাথে দেখা, শহর আলী বললো, এতদিন খেয়াল করিনি, তোর টাকটা তো ফুটবলের মত গোল!
রাজীব আগুন চোখে তাকালো, শহর আলী তাতে ভয় না পেয়ে বললো, আর তোর টাকটা স্টিলের প্লেটের মত ঝকঝকে! মাংস খাওয়া হাতের মত তেলতেলে!
রাজীব রেগে বললো, আমার টাক নিয়ে তোদের এত গবেষণা কেন্? অন্য কাজ কি তোদের নেই?
এমন মুহূর্তে কোমর উদ্দিন এলো, রাজীবের টাকের দিকে আশ্চর্য চোখে চেয়ে বললো, টাক তো না যেন নতুন কেনা হাড়ির তলা। এমন টাকের অধিকারী কজন হতে পারে!
রাজীব বললো, ও, তুইও আমার টাক নিয়ে আলোচনা শুরু করলি? আমার মাথায় চুল নেই, তোদের সবার থেকে ব্যতিক্রম, কিসের প্রশংসা করবি, তা না সমালোচনা করিস।
শহর আলী বললো, আচ্ছা, তোর টাক হওয়ার কারণ কি? রাতে যখন ঘুমিয়েছিলি তখন কি তেলাপোকা আর ইঁদুর দুই দোস্ত মিলে চুল গোড়া থেকে কেটে দিয়েছে নাকি?
রাজীব বললো, আমার মাথার চুল যে কিভাবে পড়লো আমি নিজেও জানি না। বলা চলে, চুলগুলো আমাকে ফাঁকি দিয়েছে।
কোমর উদ্দিন বললো, অবশ্য তোর মাথায় চুল না থাকার কারণে একটি সু্বিধা হয়েছে, প্রকৃতির উন্মুক্ত বাতাস টাকে লাগে, আর তুই শীতল হয়ে যাস।
রাজীব ক্ষেপে বললো, আর যখন পাজী সূর্যটার রোদ এই টাকে সরাসরি লাগে তখন কেমন গরম হয়? একটি বার কখনো তা কি ভেবেছিস?
শহর আলী বললো, তবুও টাকাওয়ালাদের অনেক সু্বিধা, চিরুনি করতে হয় না, আয়নার প্রয়োজন হয় না। তাই আয়না, চিরুনি কিনতেও হয় না। গোসলের পর মাথাও মুছতে হয় না। তাই গামছাও কিনতে হয় না।
রাজীব বললো, টাক নিয়ে যে ঝামেলায় আছি, গাছতলা দিয়ে নিশ্চিন্তে হাটতে পারি না, পাখি কখন মল ছুঁড়ে দেয়! মাথায় চুল থাকলে তো ঐ মল দেখা যেত না!
কোমর উদ্দিন বললো, আমার মনে হয়, কবিরাজের পানি পড়া মাথায় মাখলে তোর মাথায় আবার চুল গজাতে পারে।
রাজীব আফসোস করে বললো, কবিরাজের তেলপড়া, জলপড়া কি মাথায় মাখতে আমি বাদ রেখেছি? আমার মাথায় আর চুল উঠবে না। আমার মাথাটা রোদে পুড়ার জন্য আর বৃষ্টিতে ভেজার জন্য।
রাজীব কথাটি বলতে বলতে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলো। চাল, ডাল নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলো। পথে এক চাচা সম্পর্কের লোক হাকিমের সাথে দেখা। তিনিও একটু টিটকিরি কেটে বললেন, অল্প বয়সে চুল পাকে, কিন্তু চুল পড়ে যায় তোকেই প্রথম দেখলাম। বিয়েটা কপাল গুণে করে ফেলেছিস। এমন টাকাওয়ালাদের তো বিয়ে হয় না, বিয়ে হলেও বৌ টেকে না।
রাজীব ভয় পেয়ে বললো, কি বলছেন চাচা, বৌ চলে যাবে?
হাকিম চাচা আরো একটু যোগ করলেন, বললেন, মাথায় চুল ছাড়া কি মানুষ চলতে পারে? মাথার সৌন্দর্যই তো চুল! তোর বৌ যা বলবে সব শুনবি। টাকাওয়ালাদের ঘরে কিন্তু বৌ থাকে না, বিশেষ করে অল্প বয়সে যারা টাক হয়েছে।
রাজীব থমমত খেয়ে বললো, শুনবো, বৌয়ের সব কথা শুনবো। সামনে পিছে সবখানে বৌয়ের প্রশংসা করবো।
এ কথা বলে রাজীব বাড়ির উদ্দেশ্যে চলতে থাকলো। পথে আর এক বন্ধু শরফুদ্দিনের সাথে দেখা। রাজীবকে পেলে শরফুদ্দিন অনেক মজা করে। আজ বললো, আচ্ছা বলতো, মাথার চুল কি বিক্রি করে দিলি? আর কিছু কি বিক্রি করার পেলি না?
রাজীব রেগে বললো, আমার টাক নিয়ে লাগা ছাড়া তোর কি আর কোনো কাজ নেই?
শরফুদ্দিন থেমে থাকলো না, বললো, না, তোর মাথার চুল কেউ ছিনতাই করেছে? মানুষ কি ছিনতাই করার আর কিছু পেলো না?
রাজীব প্রচণ্ড রেগে গেলো। রাজীব যত রেগে যাচ্ছে শরফুদ্দিন তত হাসছে আর বলছে, এবার তোর জন্মদিনে সবাই মিলে তোর টাকে কেক মাখাবো। এখন একটু গোবর পেলে মাখাতাম।
রাজীব হাত দিয়ে টাক ঢাকার চেষ্টা করে বললো, খবরদার, গোবর হাতে নিবি না। গোবরে জীবাণু। টাক মাথায় সংক্রমণ এমনিতেই দ্রুত বাড়ে। আমার বৌ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, আমিও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকি। এজন্যই মাথার উপর চুল জাতীয় কিছু রাখিনি। চুল পেটে গেলে পেট খারাপ হয়, এই চুল জীবাণুর চেয়ে ক্ষতিকর। পারলে তুইও মাথার চুল ফেলে দে।
এ কথা শুনে শরফুদ্দিন একগাল হেসে একটু পথের ধুলো হাতে নিলো রাজীবের ঘামে ভেজা টাকে দেবে বলে। তা দেখে রাজীব বললো, খবরদার, আমার টাকে ধুলো দিবি না, আমার বৌ আমার টাকের কত যত্ন করে জানিস?
রাজীব ভাবলো ক্ষেপলে আরো ক্ষেপাবে। তাই সে চুপ করে বাড়ির পথে রওনা দিলো। চাল, ডাল, লবণ নিয়ে বাড়ি এলো। ছবেদা উঠানে ছিলো, বললো, নারকেল তেল কি এনেছো? আজ নারকেল তেল না এনে থাকলে তোমার টাক ফাঁটাবো।
রাজীব আফসোস করে বললো, আমার টাকটা ফাঁটানোর জন্য সবার এতো টার্গেট কেনো?
ছবেদা কেঁকিয়ে বললো, নারকেল তেল কই?
রাজীব বললো, আমার মাথায় চুল নেই বলে দোকানদার আমাকে নারকেল তেল দিলোই না তো, দিলোই না। বললো, টাক মাথায় তেল দেয়া ঠিক না, গরম হয়ে ফেঁটে যাবে।
ছবেদা ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো, তো বলতে পারোনি যে, আমার বৌর মাথায় চুল আছে, সে নারকেল তেল মাথার চুলে দেবে!
রাজীব বললো, না মানে, মনের ভুলে বলে ফেলেছিলাম আমরা স্বামী-স্ত্রী দুই জনই টাক! টাক নম্বর এক আমি আর টাক নম্বর দুই তুমি!
ছবেদা ঝাটাটা উচিয়ে বললো, কি? তুমি অন্যের কাছে আমাকে টাক হিসেবে উপস্থাপন করেছো? কি? আমি টাক নম্বর দুই?
রাজীব দৌঁড় মারলো আর বললো, তুমি টাক না ঠিক আছে, কিন্তু টাকওয়ালার তো বৌ!
ছবেদা উচ্চস্বরে বললো, মাথায় নকল চুল পরে বিয়ে করেছিলে নতুবা কোনদিনও আমি তোমার বৌ হতাম না!
রাজীব বেশ দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখলো ছবেদা খুব রেগে যাচ্ছে। হাকিম চাচার কথা মনে পড়লো, বৌ যদি চলে যায়! তাই শান্ত গলায় বললো, বৌ, আমি দোকান থেকে তোর জন্য নারকেল তেল এনে দিচ্ছি।
এই বলে রাজীব বাজারের উদ্দেশ্যে আবার রওনা দিলো। অন্য এক দোকানে যেয়ে বললো, নারকেল তেল দেন।
দোকানদার বললো, বড় বোতল দেবো, না ছোট বোতল দেবো? ছোটটাই দিই, মাথায় যখন চুল নেই অল্প তেলই লাগবে।
রাজীব হুট করে রেগে বললো, তেল কি আমি একা মাখবো? আমার বৌ নেই?
দোকানদারও রসিক মানুষ, বললো, যার মাথায় চুল নেই, তার আবার বৌ থাকে কি করে? আজব!
রাজীব রেগে বললো, পারলে আমার বাড়ি চলেন, দেখে আসবেন আমার বৌ আছে কি না! আমি আমার একমাত্র বৌয়ের গর্বিত স্বামী।
দোকানদার বললো, আপনি দেখি খুবই রাগী মানুষ।
রাজীব বললো, আমার বৌ বলেছে, রাগলে আমাকে ভারী সুন্দর লাগে। তাই যার তার উপর রাগ দেখাই।
দোকানদার হাসি চেপে নিয়ে বললো, কারো অভিশাপে মনে হয় আপনার মাথার চুল পড়েছে, নাকি?
রাজীব বললো, হতে পারে। কিন্তু আমাকে অভিশাপ দিলো কে? আমার বৌ আমাকে বলে, আমি ভ্যাদা মাছ, মানে গর্দভ, আমাকে অভিশাপ কে, কি কারণেই বা দেবে? যাহোক, বড় তেলের বোতলটাই দেন।
দোকানদার বড় তেলের বোতলটা দিলো আর বললো, দুঃখ লাগে আপনার মাথার দিকে তাকালে। কি ঝড়টাই না আপনার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে যে, একটা চুলও নেই।
রাজীব দোকানদারের দিকে কটমট চোখে তাকালো আর বললো, ঝড়ে গাছ পড়ে, ঝড়ে ঘরের ছাউনি পড়ে, ঝড়ে কখনো মাথার চুল পড়ে?
দোকানদার আবারো বললো, তবে আপনার মাথার চুলগুলো গেলো কি করে? চুরি করতে যেয়ে ধরা খেয়েছিলেন নিশ্চয়? আর তারা আপনার মাথা ন্যাড়া করে নিশ্চয় ঘোল মাখিয়ে দিয়েছিলো?
কথাটি শুনেই রাজীব তেল নিয়ে হাটা শুরু করে দিলো। দোকারদার চিৎকার করে বললো, বুঝেছি, চুরি করেই তবে ধরা খেয়েছিলেন! আহারে!
রাজীব আবার ফিরে এসে বললো, এখন চুরি করে ধরা খেলে মাথা ফাঁটিয়ে দেয়, মাথা ন্যাড়া করে দেয় না। আর ঘোল মাখানো মাথাতে চুল উঠে, বেক্কল দোকানদার। আমার বৌ বলে তুমি জ্ঞানী মানুষ, বেক্কলদের সাথে লেনদেন রাখবে না।
দোকানদার একগাল হেসে বললো, তবে মাথার চুলগুলো কি করে গেলো সেটা বলেন না কেনো?
রাজীব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে গেলো। পথে দুই বন্ধুর সাথে দেখা। কোমর উদ্দিন বললো, বাহ্, তোর টাকটাতে দেখছি বিন্দু বিন্দু ঘাম। টাক থেকে কেমন সুন্দর করে ঘাম বের হচ্ছে। কি আশ্চর্য যন্ত্ররে তোর টাকটা। খেজুর রসের মত স্বাদ আছে নাকি, দেখি একটু, দেখি।
রাজীব বললো, মশকরা করবি না, পেরেশানিতে টাক ঘামছে।
শহর আলী বললো, পাথর ঘামে, তোর টাকও ঘামছে। অর্থাৎ তোর টাকটা পাথর। ওরে পাথর টাক ঝাটার বাড়িতে ফাঁটবে না। ভুল-ভ্রান্তি করলে তোর বৌ ঝাটা পেটা করতে এলে দৌঁড় মারবি না।
রাজীব বললো, আমার বৌ যা বলে তাই করে। ঝাটা নিয়ে মারতে এলে মেরেই ছাড়বে। দৌঁড় না মেরে দাঁড়িয়ে থাকা বোকামি হবে। একদিন বৌ একমুঠো পিঁপড়া ধরে এনে আমার টাকের উপর ছেড়ে দেয়। আর পিঁপড়ারা আমার টাক কামড়ে ফুঁটো ফুঁটো করে দেয়। বৌকে এখন ভয় না করে উপায় নেই।
কোমর উদ্দিন বললো, আসলে দোষ বন্ধু আমাদের, যে মেয়ের চুল লম্বা সেই মেয়েকে সব পুরুষ বিয়ে করতে চায়। এখন তোর মাথায় একটাও চুল নেই, তোকে মেয়েরা পছন্দ করবে কেনো? তোর বৌ তোকে তো অপছন্দই করবে।
রাজীব বললো, বিয়েটা করেই ধরাটা খেয়েছি। এতদিন কোনো মনোকষ্ট ছিলো না। এখন বৌর অত্যাচারে মনে হচ্ছে টাক হওয়া অপরাধ।
শহর আলী বললো, অচেনা মানুষ তোকে দেখলে ভাববে তুই ন্যাড়া হয়েছিস, কিন্তু চেনা লোকগুলো জানেই তুই টাক, এখন এই চেনা মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্ট বটে।
রাজীব বললো, মানুষের মুখ বন্ধ করা যায় না। তবে অন্যান্যদের চেয়ে বৌর যন্ত্রণা বেশী পীড়াদায়ক। আমার বৌটা তো বৌ না, এটম বোম।
কোমর উদ্দিন বললো, তাও তোর কপাল ভালো, ছোট বেলাতে চুলগুলো হারাসনি। ছোট বেলাতে টাক হলে পাড়ার ছেলেরা দেখিস তো কিভাবে ক্ষেপায়, বড় বয়সে টাক হয়েছিস অন্তত ছোটদের যন্ত্রণা থেকে বেঁচেছিস।
রাজীব বললো, কত লোক কত কথা বলে, কেউ বলে তাক লাগানো টাক। কেউ বলে টাক তো না, ঢাক। বাজাতে ইচ্ছে করছে। শুনে খুব খারাপ লাগে।
শহর আলী বললো, আসলে মাথার উপর কি দরকারই ছিলো চুলের? দুই দিন পর পর স্যালুনে যেতে হয়, না থাকলে কি দারুণই না হতো।
রাজীব বললো, মজা রাখ্। ভালো লাগে না আর। দবির সেদিন বললো, খবরদার, আমার বাড়ি যাসনে, আমার ছোট ছেলে তোকে দেখলে ভয় পাবে। জোহর আমাকে দেখে দৌঁড় ইচ্ছা করে মারলো আর বললো, মারিস না, মারিস না, গুতা মারিস না। শুনে কি ভালো লাগে?
এমন সময় দূর দিয়ে নুরু মিয়া যাচ্ছিলো। রাজীবকে ডাক দিলো, ঐ টাকাওয়ালা!
রাজীব প্রচণ্ড রেগে গেলো। সে লোকটিকে চেনে না। নুরু মিয়ার কাছে গেলো আর বললো, আমার বন্ধুরা আমার টাক নিয়ে মন্তব্য করতেই পারে। তুই কে? আমাকে টাকাওয়ালা বলে ডাকলি কেন্?
নুরু মিয়া বললো, সূর্যের আলো আপনার টাকে পড়ার পর তা প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখে পড়েছে। আর আমি চোখে ধাঁধাঁ দেখছি। এমন ঝকঝকে টাক নিয়ে পথে-ঘাটে বের হওয়া ঠিক না। মানুষকে অন্ধ করার পায়তারা করছেন নাকি?
রাজীব থমকে গেলো। নুরু মিয়াকে কিছু বলতে পারলো না। রাজীব দুই বন্ধুর কাছে ফিরে এলো। শহর আলী বললো, কি বললেন ঐ ভদ্র লোক?
রাজীব কথাটি চেপে যাওয়ার জন্য বললো, লোকটির হাতের তালুতে ঘা হয়েছে। কে নাকি বলেছে আমার টাকে হাত বুলালে তার হাতের তালুর ঘা সেরে যাবে, তাই এসেছিলো। আমি বললাম, আমার টাকে হাত বুলাতে এলে টাক দিয়ে এমন গুঁতা দেবো মনে হবে, এঁড়ে গরু গুঁতা মারলো। এঁড়ে গরুর গুঁতার চেয়ে আমার টাকের গুঁতা তীব্র ভেবে সে পালিয়েছে।
কোমর উদ্দিন হেসে বললো, তোর টাক নিয়ে দেখছি গ্রামের বাইরের মানুষেরও অনেক কৌতূহল! কি টাকের মালিক হলিরে তুই! তোর টাকটা না আজব জিনিস।
রাজীব বললো, তোরা না বেশী বেশী ব্যস্ত আমার টাক নিয়ে। কিন্তু আমার বৌও আমার টাকের পিছে লাগলো কেনো? রেগে গেলেই টাকে কনুই বসিয়ে দেয়! কনুই দিয়ে মারবে কেনো? ওরে লাগা লাগে!
শহর আলী বললো, ওরে টাক বিদ্বেষী মানুষগুলো সব নির্বোধ হয়। চান্দার আলীরও তো টাক আছে। ওর বৌ তো ওকে বকে না। একদিন চান্দার আলীর কাছে যা, দেখ্ চান্দার আলী কি বুদ্ধি অবলম্বন করে বৌর অত্যাচার থেকে বাঁচলো!
রাজীব বললো, ওরে আমার বৌকে সামলাতে কোনো বুদ্ধিতেই কাজ হবে না।
বলেই সে থেমে গেলো। কারণ শরফুদ্দিন চাচার কথা মনে পড়েছে। বৌকে সে প্রশংসায় না রেখে সমালোচনায় রেখেছে। টুক করে কথা ঘুরিয়ে নিলো, বললো, ওরে আমাকে জ্ঞান দিসনে, আমার বৌ আমাকে কি বলে জানিস? আমি বুদ্ধির ঢেঁকি।
কোমর উদ্দিন, শহর আলী তা শুনে হেসে দিলো। রাজীব চকিত চেয়ে বললো, আমার কথা শুনে হাসলি? আমাকে অবজ্ঞা করলি? আমার বৌ আমাকে কত আদর করে জানিস? আমার বৌ যদি শোনে তোরা আমাকে অবজ্ঞা করিস, তবে কিন্তু তোদের সাথে মিশতে মানা করে দেবে।
রাজীব বাড়ি এলো। বৌকে তেলের বোতল দিলো আর বললো, আমি রোদে হাটতে পারি না, মাথাটা রোদে পুড়ে যায়। তুমি তত আমাকে বাইরের কাজে পাঠাও।
ছবেদা বললো, সবার মাথায় চুল আছে, তোমার মাথায় নেই কেনো? বয়স কালেই বৃদ্ধ হয়েছে, ব্যর্থ জীবন তোমার, আবার ছায়ায় থাকতে চাও? রোদে রোদেই থাকবে, মাথাটাকে ঘামতে দাও, দেখো তো, পানি পেলে গাছ বাড়ে, মাথায় ঘাম থাকলে চুল গজাবে।
বৌর এমন কটাক্ষ আচরণে রাজীব মূর্ছা গেলো। নিমিলিত নয়নে বললো, মাথার চুল পড়ে যাওয়ার পিছনে কি আমার হাত আছে? আমাকে এভাবে লজ্জিত করো কেনো? চুল কবে পড়ে গেলো নিজেও জানতে পারিনি। চুল না থাকার কারণে আমার খুব লজ্জা করে।
ছবেদা কটাক্ষ করে বললো, ওরে লজ্জাশীল পুরুষ, ছাদ খালী, পাদের গন্ধে নাক ঢাকে। মাথায় নেই চুল, বোগলে জঙ্গল, তার আবার লজ্জা! কৃষক ক্ষেতের কোনখানে চারাগাছ না থাকলে অন্যখান থেকে এনে সেখানে রোপন করে, তুমি বোগল থেকে কিছু চারাগাছ নিয়ে টাকে রোপন করো।
এমন অপমান রাজীব সহ্য করতে পারলো না। দ্রুত চান্দার আলীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। পথ মাঝে শরফুদ্দিনের সাথে দেখা। শরফুদ্দিন এদিক সেদিক থেকে রাজীবের টাক মাথাটা পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর বললো, চুলগুলো যদি না পড়ে পেকেই যেত তাও তো মনের সান্ত্বনা থাকতো।
রাজীব বললো, পড়ার আগে সব ফল পাকে। আর আমার চুলগুলো না পেকে কাঁচা কাঁচায় পড়ে গেলো। দুঃখে বুকটা ফাঁটেরে, বন্ধু।
শরফুদ্দিন বললো, দুঃখ পাস না, বন্ধু। দেখ্, আমাদের মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দেয় না। শুধু টাক হওয়ার কারণে সবাই তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
রাজীব একটু শান্ত হয়ে বললো, বন্ধুরে, কি পোড়া কপাল আমার, সবাই আমাকে নিয়ে মশকরা করে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।
শরফুদ্দিন রাজীবকে আরো উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করলো, বললো, দেখ্ বন্ধু, রাস্তা দিয়ে যখন আমি হাটি কেউ আমার দিকে তাকায় না, কিন্তু তুই রাস্তা দিয়ে হাটলে সবাই তোর দিকে তাকায়। আমাকে দেখে কেউ কৌতূহলী হয় না, তোকে দেখে সবাই কৌতূহলী হয়। এটা তোর জন্য সৌভাগ্যের। সব কিছু পজিটিভলি নিবি।
রাজীব শরফুদ্দিনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, বন্ধু, তুই আমাকে উজ্জীবিত করলি। মনের দুঃখে বনে থাকি। মাথায় হাত দিই, আর আক্ষেপ করি, সবার মাথায় চুল থাকবে আমার মাথায় কেনো থাকবে না?
শরফুদ্দিন বললো, ভেঙে পড়িস না, বন্ধু। সত্যটাকে মেনেনে। দেখ্, জীবন যাপন সহজ হয়ে যাবে।
শরফুদ্দিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনে যেতেই শহর আলীর সাথে দেখা। রাজীব বললো, চান্দার আলীর বাড়ি যাচ্ছি। দেখি বৌকে বশ করার কোনো বুদ্ধি পাই কিনা!
শহর আলী বললো, তোর বৌকে বশ করবি মানে? তোর বৌ তোর কথা শোনে না?
রাজীব কথাটি বলেই ঘরের কথা বাইরে আনলো কেনো তা ভেবে বিব্রত হলো। সে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলো। বললো, বৌ তো বশীভূত। তাই তো আমার যত দুঃখ মন্দীভূত। বৌ তো আমার টাক দেখলেই চোখের পলক ফেলে না। কি দারুণ নাকি লাগে তার চোখে। টেলিভিশনের জাম্বুকে সে দেখেনি, আমাকে দেখলেই সে জাম্বুকে দেখার স্বাদ পায়। আমার টাকে যদি একটু ময়লার দাগ পড়ে তো দাগটা যেন তার হৃদয়ে পড়ে।
শহর আলী বললো, ও আচ্ছা, ভাবী তো বড্ড ভালো। তা চান্দার আলীর বাড়ি যাচ্ছিস কেন্?
কথা ঘুরিয়ে উত্তর দিলো রাজীব। বললো, সেও তো টাক। টাকের যত্ন কিভাবে নেয়া উচিত, তা শিখতে যাচ্ছি। প্রকৃত চাষীই কিন্তু গরুর যত্ন বোঝে। পুরাতন টাকাওয়ালাই টাকের যত্ন ভালো বোঝে।
শহর আলী বললো, বাহ্, চান্দার আলী যে বুদ্ধি দেবে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি। তোর কষ্টে আমারও কষ্ট লাগেরে, বন্ধু। ঘাস মারার ঘাসনাশক দিলে ঘাস মরে যায়, তোর মাথায় তোর অজান্তে কেউ কখনো চুল পড়ার চুলনাশক দেইনি তো?
রাজীব মাথায় হাত দিয়ে বললো, তাই তো! কেউ কি কখনো আমার মাথায় শত্রুপনা করে চুলনাশক দেইনি তো? চুল তো গিয়েছে, আমার জীবন যাবে না তো?
শহর আলী বললো, নারে মরবি না, পাগলও হবি না। তোর বিপদ তোর চুলের উপর দিয়ে গিয়েছে। ঝড় যেমন গাছের উপর দিয়ে যায়, ঘরের উপর দিয়ে যায় না। আফসোস করিস না চুলের জন্য, জীবনটা তো আছে।
রাজীব আশ্বস্ত হয়ে বললো, হ্যাঁ, তাই তো, যাই, চান্দার আলীর কাছে থেকে ঘুরে আসি।
রাজীব চান্দার আলীর বাড়ি গেলো। চান্দারকে ডেকে বললো, চান্দার ভাই, আমার বৌ তো টাক কিলিয়ে নরম বালিশ বানিয়ে দিলো। হাতের কাছে যা থাকে তাই দিয়ে মারে, চামচ, খুন্তি দিয়ে আমার টাকে বাড়ি মেরে বৌ তো দিব্যি আনন্দ নিয়েই চলেছে! আর কটাক্ষের কথা কি বলবো!
চান্দার আলী বললো, মাথায় তবে গোবর মাখিয়ে রাখবি! চামচ-খুন্তি দিয়েও মারবে না, কিলও মারবে না, ঘুষিও মারবে না।
রাজীব বললো, মাথায় গোবর দিলে তো গোবরের গন্ধে বমি হয়ে যাবে। আর প্রত্যেক দিন অত গোবর পাবো কোথায়? তাছাড়া আমার তেলা মাথায় কি গোবর থাকবে?
চান্দার আলী বললো, তবে তো সমস্যা! বৌকে বোঝাবি, টাকলারা বুদ্ধিমান হয়, আমি বুদ্ধিমান মানে তুমি বুদ্ধিমানের বৌ, বুদ্ধিমতী। তোর বৌ খুব খুশী হবে। মেয়ে মানুষ পাগল তো, শুধু বোঝাবি, বুঝে যাবে।
রাজীব বললো, একথা বলতে কি বাদ রেখেছি? প্রত্যেকদিন বৌ বলে আমার টাক ফাঁটিয়ে তবে সে ভাত খাবে। তাই তিন বেলা ভাত খাওয়ার সময় আমি বাড়ি ত্যাগ করি। দেখেন চান্দার ভাই, আমার টাক যদি ফেঁটে যায় তবে জোড়া লাগাবো কী করে? আপনি কি বুদ্ধি করেছিলেন যে, আপনার বৌ আপনার টাককে এত ভালোবাসে!
চান্দার আলী বললো, টাক বেলতলা একবারই যায়। একথা আমি মিথ্যা প্রমাণ করায় বৌ আমাকে বীরপুরুষ আখ্যা দিয়েছে। তাছাড়া বৌ আমাকে গ্রীষ্মের কড়া রোদে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো, আমি সারাদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন থেকেই আমার টাক দেখে আমার বৌ আর মূর্ছা যায় না। বরং গর্ব করে।
রাজীব বললো, আপনার বৌ তো অশিক্ষিত। আমার বৌ শিক্ষিত। এগুলো যদি করি তবে আর ঘরেই উঠতে দেবে না। বেলতলা যদি বারবার যাই, তবে বৌ বলবে বেলতলায় মুদি দোকান দাও, নতুবা ধ্যান করো৷ আর রোদে যদি তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকি তবে বৌ বলবে রোদে যখন থাকতে পারোই তবে আর ঘরে উঠবে না। সকালে রোদে যেয়ে দাঁড়াবে আর বিকালে রোদ থেকে উঠবে, শুটকি মাছের মত টাকটা শুকালে তবেই ঘরে উঠবে, তখন?
চান্দার আলী বললো, টাক নিয়ে তবে তো তুই বেশ মসিবতে আছিস। আচ্ছা, গরুর সামনে বসতে পারিস, গরু জিহ্বা দিয়ে তোর টাক চেটে দিলে মাথায় চুল উঠতেও পারে।
রাজীব বিরক্ত হয়ে বললো, কিভাবে মাথায় চুল উঠবে তা জানতে আসিনি, বলেন কিভাবে বৌর হাত থেকে রক্ষা পাবো। বৌ টাক মাথা দেখলেই জ্বলে উঠে। আমার টাক দেখলেই তার হাতে ইট উঠে, নিরীহ জীব দেখলেই শিকারী যেমন বন্দুক উঠায়।
চান্দার আলী বললো, তোর বৌ ঘুমিয়ে থাকলে তার মাথার চুল ব্লেড দিয়ে কেটে দিবি। তোর বৌর মাথায় চুল না থাকলে তোর কেনো চুল নেই এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না।
রাজীব বললো, ওর মাথায় লম্বা চুল দেখেই তো ওকে বিয়ে করেছি। যেন তার মাথার চুল দেখেই নিজের আক্ষেপ ঘোচে। বৌর মাথার চুল কাটবো কেনো, নিজের চুল নেই বলেই তো আমি চুলের মূল্য বুঝি। অন্য বুদ্ধি দেন।
চান্দার আলী বললো, নকল চুল লাগিয়ে নিতে পারিস।
রাজীব বললো, নকল চুল লাগিয়ে বিয়ে করেছিলাম। বৌ সেই চুল শাকের সাথে রান্না করে আমাকে খাওয়াতে চেয়েছিলো। আবার নকল চুল পরলে এবার সত্য সত্য চুলের ভর্তা করে খাওয়ায়েই ছাড়বে। বলুন না, আপনার বৌ আপনার কোন্ বুদ্ধিতে কুপোকাত হয়েছিলো? আমিও টাক, আপনিও টাক, অথচ আপনি সসম্মানে পরিবারে বসবাস করছেন! আর আমি টাক রক্ষার জন্য পথে পথে ঘুরছি।
চান্দার আলী বললো, দেখ্ ভাই, বৌকে ভালোবাসতে হবে। দুজনের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন হলে কারোর অসম্পূর্ণতা কারো চোখে পড়বে না। মায়ার জগৎ। মায়া দিয়েই মানুষের মন জয় করা যায়। বৌকে ভালো না বেসে, বৌকে সময় না দিয়ে কোনো বুদ্ধিতেই বৌর সান্নিধ্য পাবি না। যা, আজ থেকে বৌকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাস।
রাজীব বাড়ির পথ ধরলো। পথে কিশোরের সাথে দেখা। কিশোর জিজ্ঞাসা করলো, কোথায় গিয়েছিলি?
রাজীব সত্যটা লুকিয়ে বললো, টাকে একটু রোদ লাগাচ্ছি, রোদে টাক লাল করছি, আমার বৌ আবার আমার লাল টাক পছন্দ করে। এই তোরা আমার টাক কেউ পছন্দ করিস না। অথচ আমার বৌ আমার টাক কত পছন্দ করে। যেন টাক স্বামী তার শত জনমের আকাঙ্ক্ষার ছিলো।
কিশোর বকা দিয়ে বললো, মিথ্যা বলিস কেন্? তোর বৌ তোর টাকের ঘোর বিরোধী।
রাজীব থমকে গিয়ে বললো, তুই আমাকে বকা দিলি? তুই কি জানিস, আমার বৌর কাছে আমি কত সম্মাননীয়?
কিশোর নাক সিটকে বললো, বেকুব একটা তুই!
রাজীব বললো, আমাকে বেকুব বলিস না। আর আমাকে অত অত অবজ্ঞা করিস না। আমি আমার বৌর চোখের মণি।
কিশোর বললো, বৌবুদ পুরুষ জাতির কলঙ্ক। তোকে মরে যাওয়া উচিত।
রাজীব বললো, তুই আমাকে অপমান করছিস? মন ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছিস? তুই জানিস না, আমি ভালো থাকলে আমার বৌ ভালো থাকবে!
কিশোর বললো, একটা টাকলা, যার টাক হওয়ার বয়সই হয়নি, একটা যুবক মানুষকে টাক দেখতে কেমন লাগে? বিশ্রী! সে নাকি বৌর প্রিয়! তোর বৌ তোকে ঘৃণা করে, সেটা প্রতিবেশীরা জানে।
রাজীব বললো, ঘৃণা না, তুমুল ভালোবাসে। এটা আমার অহংকার, আমি আমার বৌর একমাত্র ভালোবাসার মানুষ। তুইও টাক হ্, দেখবি বৌ থেকে অঢেল ভালোবাসা পাবি।
কিশোর নাকে হেসে বললো, বোকারাম একটা।
রাজীব বললো, আমাকে অত বোকা বোকা বলিস না। আমার বৌ আমাকে বলেছে, আমি অনেক চালাক।
কিশোর বললো, যা বাড়ি, তোর বৌ আচল পেতে বসে আছে, তোকে বরণ করার জন্য। বৌ দ্বারা এত অত্যাচারিত, তাও বৌর প্রশংসা করিস। তোর বাড়ির পিছন দিয়ে আসার সময় শুনেছি, তোর বৌ বলছে, আসুক বাড়ি আজ টেকোটা। ওর টাকে নারকেল ফাঁটাবো।
রাজীব বললো, তুই বৌ দ্বারা নিগৃহীত। আর তাই এমন বলছিস। আমার বৌ কখনো এমন বলবে না। আমার বৌ আমার অহংকার। তুই-ও তোর বৌকে নিয়ে অংকার করবি। বৌকে নিয়ে অহংকার করা খুব ভালো কাজ গুলোর একটি। আর কথা কম বলবি, আমি কথা কম বলা পছন্দ করি। আমার বৌ আমাকে কথা কম বলা শিখিয়েছে। বৌর কথা শুনবি, আমি যেমন বৌর কথা শুনি।
কিশোর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে গেলো। রাজীব গেলো স্যালুনে। গণেশ কাকা বললো, তোর বিয়ের সময় তো তোর মাথায় নকল চুল লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তা সে চুল নেই?
রাজীব বললো, বিয়ের চুল তুলে রেখেছি। নতুন চুল লাগিয়ে দেন।
গণেশ কাকা বললো, বিয়ের আগে কত কাস্টমারই থাকে, বিয়ের পর সব ছুটে যায়। টিংকুর ছেলে প্রতি দুই দিন পর পর সেভ করতো। বিয়ের পর মাসে একদিন দাড়ি-চুল কাটাতে আসে। বিয়ের আগে সাজগোজ করে, বিয়ের পর সংসারের চাপে সব ভুলে যায়। অথবা বিয়ের পর শখটা মরে যায়। অথচ তুই বিয়ের কত পরেও এখনো সৌখিন আছিস। টাকলা মাথায় চুল লাগাতে এসেছিস। মনের এই রংটা মরতে দিস না।
রাজীব রেগে বললো, রোগী পেলে সবাই ডাক্তার। বুদ্ধি দিতে হবে না। সুন্দর করে নকল চুল লাগিয়ে দেন।
নরসুন্দর গণেশ বাবু সুন্দর করে নকল চুল লাগিয়ে দিলো। আর রাজীব নাচতে নাচতে বাড়ি এলো। ঘরে ঢুকতেই ছবেদা চিৎকার দিলো, এই কে আপনি? ঘরে ঢুকছেন কেনো? বাঁচাও, এক লম্পট আমার ঘরে ঢুকেছে।
আশপাশের বাড়ি থেকে দুই চার জন ছুটে এলো। দরজা আটকে দিলো রাজীব। তারপর নকল চুল খুলে ফেললো। ছবেদা তা দেখে হতবাক। রাজীব বললো, নিজের বৌ যদি স্বামীকে চিনতে না পারে এমন চুল আমি মাথায় পরবো না।
ছবেদা বললো, টাক দেখাতে লজ্জা করে কেনো? টাকের উপর কি কাঠঠোকরা বসে ঠুকায়? না, টাকের উপর তালগাছ গজিয়েছে?
রাজীব বললো, পাড়া প্রতিবেশীরা টিটকিরি কাটে। বন্ধুরা কটাক্ষ করে। আর তুমি তো আমার টাককে তবলা বানিয়েছো। মানুষের কত রকমের জ্বালা, আর আমার জ্বালা টাক নিয়ে।
বাইরে থেকে কেউ একজন বললো, ভাবী, ঘরে কে ঢুকেছে? দরজা খুলবেন? কিছু বলছেন না কেনো? দরজা ভেঙে ফেলবো?
ছবেদা উচ্চস্বরে বললো, আপনারা যান। ভূত দেখেছিলাম। অদ্ভুত ভূত কিম্ভূত রূপ বদলে উদ্ভট হয়ে সামনে, লম্পট না। আপনারা যান।
প্রতিবেশীরা চলে গেলেন। ছবেদা বললো, চুল গিয়েছে বলে নকল চুল লাগাতে হবে? তুমি তো পুরুষ, সোনার খণ্ড। চুল গেছে বলে কষ্ট কেনো? তুমি তো সোনার আংটি। সোনার আংটি তো বাঁকাও ভালো।
রাজীব বৌর কথাতে কটাক্ষাঘাত পেলেও চুপ থাকলো। চান্দার আলী বলেছিলো বৌকে ভালোবাসতে, মায়া দিতে। রাজীব কি করবে বুঝতে না পেরে চুপ থাকলো। ছবেদা বললো, শুনছি, টাকাওয়ালাদের মাথার ভেতর কি অমূল্য রতন আছে। তাই সন্ত্রাসীগোষ্ঠী টাকাওয়ালাদের মাথা কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
রাজীব মাথায় হাত দিয়ে বললো, মিথ্যা!
ছবেদা বললো, সত্য। টাকওয়ালাদের মাথার ভেতর ঐ অমূল্য রতন থাকার কারণে নাকি মাথায় বজ্রপাত ঘটছে। ঝড়-বৃষ্টির দিন তাই ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ।
রাজীব বললো, টাকাওয়ালাদের এত জ্বালা থাকবে কেনো? ঘরে থাকলে তোমার জ্বালা, বাইরে বজ্রপাতের জ্বালা। যাবো কোথায়?
ছবেদা বললো, টাকাওয়ালা হয়েছো কেনো? সব মানুষের মাথা ভর্তি চুল, তোমার মাথায় চুল নেই কেনো? তুমি কি ভীনগ্রহের জীব? সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তোমার মাথা কাটতে এলে আমি ধরিয়ে দেবো।
একথা শুনামাত্রই রাজীব বাড়ি থেকে দৌঁড় মারলো। মা রহিমা তা দেখে ডাকলেন আর বললেন, সারাদিন বাড়ি থাকিস না। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক করছিস না।
রাজীব দূর থেকেই বললো, মা, খেয়ে কি হবে মাথায় তো বাঁচছে না।
ছবেদা কেঁকিয়ে বললো, মাথা বাঁচিয়ে কি করবে, মাথায় তো কিছুই নেই, না বুদ্ধি, না চুল!
রহিমা বৌমাকে বকে বললেন, আমার ছেলেটাকে কি বাঁচতে দেবে না? তুমি এই চুল চুল করে আমার ছেলেটাকে মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলেছো।
ছবেদা বললো, পাতায় গাছের সৌন্দর্য। পাতা না থাকলে না গাছ দিতে পারে ছায়া, না দিতে পারে ফল, না সে নিজেই বাঁচে। বাজারে না খেয়ে থাকা পাগলটারও মাথায় এক মুঠো চুল আছে, আপনার ছেলের মাথায় চুল নেই কেনো? দাঁত পড়লো না, চুল পড়লো কেনো? চুল পাকলো না, চুল পড়লো কেনো?
রহিমা বললেন, স্বামী না থাকবে যেদিন সেদিনই বুঝবে স্বামীর মাথার চুল না থাকাটা কোনো অসম্পূর্ণতা ছিলো না।
রাজীব রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। অন্য এক অপরিচিত টাকাওয়ালার সাথে দেখা। লোকটি রাজীবের টাকের দিকে একপলকে চেয়েই থাকলো। রাজীব রেগে বললো, কিছু বলার থাকলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন। আমার টাকের দিকে চেয়ে আছেন কেনো?
অপরিচিত ব্যক্তি বললেন, চোখের দিকে তাকিয়ে যতই কথা বলি না কেনো, নজর টাকেই যাবে। মানুষ বিচিত্র কিছু দেখলে নজর আটকে রাখতে পারেন না।
রাজীব বললো, নিজের তো আস্ত একটা নাক, নাক তো না কলা ঢুকে যাবে। আর আমার টাককে বিচিত্র কিছু বলছেন! বলি, আয়নায় কি নাক দেখেন?
অপরিচিত ব্যক্তি বললেন, মনে হচ্ছে আপনি আপনার নাক নিয়ে খুব চিন্তিত! আমি মোটেও আমার নাক নিয়ে চিন্তিত নই। মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। আমার নাক দেখে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। নাক বড়, বেশী অক্সিজেন পাই, মূর্খ মেয়ে বুঝলো না। বিয়ে করিনি, বৌ নেই, চিন্তার বস্তাও নেই। দুই দিনের জীবন, চিন্তা বাদে করি যাপন।
রাজীব উৎসুকের সাথে বললো, আচ্ছা বলুন তো, আমার মাথা টাক, মানুষ নানা কিছু ভাবে, বলে। এ যন্ত্রণা থেকে কি করে বাঁচি?
অপরিচিত লোকটি বললেন, জীবনের গল্প বলি শোনেন, যখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম তখন একবার মা আমাকে টাক করে দিয়েছিলো। স্কুলে গেলে স্যার আমার টাক নিয়ে মশকরা করেছিলেন। টিফিনে আমার বন্ধুরা সবাই টাক হয়ে এসে স্যারের সেই মশকরার প্রতিবাদ করেছিলো। আমি সেই বন্ধুদের সঙ্গ আজো ত্যাগ করিনি। যারা আপনার টাক নিয়ে বেশী বেশী চর্চা করছে, তাদের ত্যাগ করুন। বৌকে ত্যাগের ভয় দেখান। দেখেন না ওষুধের মত কাজ হবে।
রাজীব নিজেকে শক্ত করে বললো, আজই তবে বৌকে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখাবো। আচ্ছা, বন্ধুদের সামলাবো কি করে?
অপরিচিত লোকটি বললেন, দৃঢ় হোন। দৃঢ়তা দেখান। বন্ধুরা তো সহযোগিতার অন্য নাম, সহমর্মিতার অন্য নাম। ইট মারলে পাটকেল মারেন। যে টাকে কড়া মারতে আসে, তাকে ঘুষি মারেন। মনোবল শক্ত করেন। নরমকে কেউ পাত্তা দেয় না, পেয়ে বসে।
নানা জন থেকে নানা বুদ্ধি নিয়েও রাজীব বৌকে সামলাতে পারছে না। পথে হাকিম চাচার সাথে দেখা। রাজীব বললো, চাচা, বৌর তো অনেক প্রশংসা করলাম। বৌ তো আগের মতই আছে। টাক দেখলে ছোঁ মেরে এসে ঠোকর দেয়।
হাকিম চাচা বললেন, বৌর প্রশংসা কি বৌর সামনে করিস, না মানুষের সাথে করিস?
রাজীব বললো, বৌর প্রশংসা মানুষের সাথে করি!
হাকিম চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, বেকুব তুই। বৌর সামনে বৌকে প্রশংসা করবি। বৌ যদি না শোনে তো প্রশংসা করে লাভ কি?
রাজীব ইশ শব্দ উচ্চারণ করে বললো, তাই তো৷ আহা, বৌ তো ঠিকই বলে, মাথার উপর আর মাথার ভেতর দুটোতেই কিচ্ছু নেই আমার।
রাজীব বাড়ির পথে রওনা দিলো। দুই বন্ধুর সাথে দেখা। শহর আলী বললো, টাক জ্বালা কি গেলো, বন্ধু? না গেলে কিছু করার নেই। যে যা বলবে তা শুনতে হবে। তোর তো কপাল ভালো কেউ এখনো তোর টাক নিয়ে ছড়া কেটে কেটে ক্ষেপায়নি।
কোমর উদ্দিন বললো, চুলের কাজ হলো মস্তিষ্কের রক্ষা করা। তোর চুল নেই মাথাতে, তোর মস্তিষ্কের তবে যে কি হয়! কি এক মহাসমস্যায় পড়লি?
শহর আলী বললো, তোর টাক সমস্যার সমাধান তো কোনো ভাবেই সমাধান করা সম্ভব না।
কোমর উদ্দিন বললো, সমাধান আছে। তোর বৌ যদি তোর টাকে কনুই বসিয়ে মজা পায়, তবে তোর টাকে তাকে কনুই বসাতে দে। কনুইয়ের গুঁতা খেতে খেতে তোর সহ্যশক্তি বাড়বে আর তোর বৌও কনুই দিয়ে মারতে মারতে মারা বন্ধ করে দেবে কারণ কনুইয়ে ব্যথা হবে।
রাজীব কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, রাতে যখন ঘুমাবো তখন যদি বৌ আস্ত ইট দিয়ে আমার টাক মাথা ফাঁটিয়ে দেয়?
কোমর উদ্দিন বললো, ফাঁটাতে পারবে না। তোর টাক অনেক শক্ত। এক নম্বর ইটের ঘা ছাড়া তোর টাক ফাঁটবে না। এক নম্বর ইট তোর বৌ পাবে কোথায়? ইটভাটার মালিকরা তো এখন এক নম্বর ইট বানানো বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
রাজীব কিছুটা আশান্বিত হলো, তারপর বললো, আমার বৌর শরীরে প্রচণ্ড শক্তি। কবে না জানি আমার জামার কলার ধরে আমার টাকটাকে দেয়ালে ধাক্কা মেরে থেঁতো করে দেয়! তখন সেই থেঁতো মাথা নিয়ে মানুষের সামনে যাবো কি করে?
শহর আলী বললো, টাক মাথা নিয়ে এত যন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
কোমর উদ্দিন বললো, এত অপমান-অপদস্ত হলে আমি লজ্জায় কারো সামনে মুখ দেখাতাম না। কি একটা জীবন পেলি মাথায় চুল ধারণ করতে পারলি না।
দুই বন্ধুর এমন কথা শুনে রাজীবের হঠাৎ মনে পড়লো অপরিচিত লোকটির কথা, যারা মশকরা করে, তাদের ত্যাগ করতে হয়।
রাজীব ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো, আমাকে মরতে বলিস, তোরা কিসের বন্ধু? ভয় দেখাস বন্ধু হয়ে বন্ধুকে? আজ থেকে তোদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
এই বলে কিছুটা সামনে যেতেই শরফুদ্দিন চাচার সাথে রাজীবের দেখা হলো। রাজীব বললো, চাচা, ইদানিং মানুষ আমার টাকের পিছে লেগেছে ভেবে ভেবে আমার খাওয়া নেই, কাজে যাচ্ছি না। ঘুম হচ্ছে না।
শরফুদ্দিন চাচা বললেন, টাক নিয়ে ভাবনা বন্ধ করে দে। টাক নিয়ে ভাববিই না। যে সে তোর টাককে সম্বল করে ছড়ি ঘুরাচ্ছে। খবরদারি করছে। আর তোকে মানসিকভাবে দুর্বল করে রাখছে৷ সব সময় মনে আত্মবিশ্বাস রাখ্। ভাববি, লোকে যা বলছে নিছক তোকে ক্ষেপানোর জন্য, কিন্তু তুই ক্ষেপবি না।
রাজীব বললো, ঠিকই চাচা। বুকে সাহস সঞ্চার করা দরকার। অর্জুন গাছের ছালের রস খেলে নাকি সাহস বাড়ে, প্রয়োজনে তাও খাবো।
বুকে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস ধারণ করে, মনোবলকে শতভাগ জাগ্রত করে বাঘের মত গর্জন করে রাজীব বাড়ি ফিরছে। দেখলো তার বৌ উঠানে কি যেন কুঁড়াচ্ছে। রাজীব নারকেল গাছের আড়ালে থেকে বৌর কথা শোনার চেষ্টা করছে। তার বৌ রাগে ফুঁসছে আর বলছে, টাক সাহবে বাড়ি ঘরে থাকছে না। উঠানের এই বিষাক্ত পিঁপড়াগুলো সব কুড়িয়ে নিলাম। আজ যখন ঘুমাবে তখন ওর টাকে ছেড়ে দেবো।
একথা বৌর মুখ থেকে শুনতেই রাজীবের আত্মবিশ্বাসের পারদ পড়ে গেলো। সে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে পালালো।
===============
যশোর, বাংলাদেশ