গল্প ।। ঘাতক ।। আবদুস সালাম
ঘাতক
আবদুস সালাম
এক)
ইংরজি নববর্ষের ছুটি থাকবে জেনে সুভাষীনী দেখতে এসেছেন তার নাতনিকে। অনেকদিন আসেন নি । হঠাৎ নাতনির জন্য মনটা কেমন করে উঠলো তাই । সঙ্গে এনেছেন নাতনির পছন্দের কিছু খেলনা আর শীতের পোশাক । শরোমারা বিডিও অফিসের কোয়ার্টারেই থাকে ।শরোমার বাবা সুকান্ত বাবু এখানে চাকরি করেন বলে এখানেই তারা আছেন ।
অফিসের সকল কর্মী মিলে নববর্ষের ছুটি উপভোগ করতে গেছেন ম্যাসান্জোড় । বছরের প্রথম দিনটাকে কাজের দিন থেকে একটু আলাদা করে নিয়ে উপভোগ করাতে যাওয়া । একটু হৈচৈ,একটু হৈহুল্লোড় । সারা বছরের কাজের ফাঁকে একটু বিরতি । মনটা কে চাঙ্গা করে নিয়ে নতুন উদ্যমে আবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া।
অফিসে নতুন বি ডি ও শুভজিৎ বাবু জয়েন করেছেন ।একেবারে কাজ পাগল মানুষ । যেমন অমায়িক লোক তেমনই তার কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা । তিনি জানেন অফিসের সহকর্মীদের কেমন করে কাজ করিয়ে নিতে হয় ।বি ডি ও অফিসের কাজে এক এক সময় এমন চাপ আসে যেন নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতে হয়। একাই তো আর সব কাজ তুলতে পারবেন না । সহকারি দিয়ে কাজ তো তুলতেই হবে।আর সেটা
শুভজিৎ বাবু ভালো করে জানেন ।
সিদ্ধার্থ যেমন রাজহংসীর বুক থেকে তীর খুলে নিয়ে শুশ্রূষা করে শিকারিকে ফেরত দেননি । বরং তার দাবির সার্থকতা বুঝিয়ে তাকে ধার্মিক হতে সাহায্য করেছিলেন। নতুন বিডিও সাহেব ও তেমনি কাজ করার চাপ থেকে সবাইকে খুশি করার জন্য মিলে মিশে একটু আনন্দ উপভোগ করার ব্যাবস্থা করতেন মাঝে মাঝে, যেখানে তিনি এতোদিন ছিলেন । এই ফর্মূলায় তিনি সাফল্য পেয়েছেন । তাই এখানে ও তিনি সেটা প্রয়োগ করে দেখছেন । এই বনভোজন হলো বি ডি ও সাহেবের কাজের অঙ্গ।
আজ অফিসের কোয়ার্টারগুলো শুনশান । দরজা জানালা সবার বন্ধ ।কেবল সরোমাদের কোয়াটারের সামনে এসে দেখে দরজা ভেজানো ।কলিং বেল টিপে টিপে কোন সাড়া না পেয়ে শিকলে দিয়ে ঠক ঠক শব্দ করে। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে কাকে চাই? বাড়িতে কেউ নেই । ফিস্ট করতে ম্যাসাঞ্জোর গেছে। আবার আরো জোরে কড়া নাড়ার শব্দ ।আরে বাবা বলছি কেউ নেই।
আরে বৌমা আমি তোমার শাশুড়ি ।
আপনি মা !
খুলছি- থামুন । খুলছি ---!
এদিকে ভেতরে শুভঙ্কর হতভম্ব হয়ে গেছে। শরোমা কি করবে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা ।বেগতিক দেখে শুভঙ্কর ঢুকে পড়ে বাথরুমে । শরোমার গলা শুকিয়ে কাট । শাশুড়ি যে কি জিজ্ঞেস করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ।বলে বৌমা তোমার শরীর খারাপ নাকি? সুমিকে তো দেখছি নে । মা সুমি তো ওর বাবার বন্ধুর সাথেই ম্যাসানজোড় ফিস্ট করতে গেছে। আমার শরীর খারাপ তাই যায়নি। বাথরুম থেকে জল টপ টপ করে পড়ছে।
অনেক দূর থেকে এসেছেন।চোখ মুখে জল দিয়ে মলিন মুখখানা কে একটু সতেজ করে নেওয়ার ইচ্ছেয় বাথরুমে যাওয়া ।বাথরুমের দরজা খুলতেই দেখে অগোছালো কাপড় পড়া জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষ।দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে।চ্যাঁচাতে থাকে চোর -চোর -চোর-।
শুভঙ্কর সুভাষীনীকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে মার ছুট।বাবারে মেরে ফেললো রে বলে ধপাস করে বসে পড়ে।
দুই)
প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর কন্যা শরোমা আদরের ঘরের দুলালী ও বটে। কিন্তু যখন" পিরিতে মজেছে মন কি বা হাঁড়ি কি বা ডোম" এই প্রবাদ বাক্য তাদের জীবনে সত্য হয়ে উঠতে চলেছে । সুরজিৎ বাবুর কানে ব্যাপারটা না যাওয়াও নয় । তার অনেক স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে বসেছে। তাই নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। প্রথম প্রথম ধমক দিয়েছেন মেয়েকে, কিন্তু কোন কাজ হয়নি । বরং আরও জেদী হয়েছে। কথায় কথায় বিষ খাবো , গলায় দড়ি দিবো বলে মেয়ে বাবা কে ভয় দেখায়। সুরজিৎ বাবু ভিতরে ভিতরে শরোমাকে না জানিয়ে চলে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ঘটকেরা আনতে শুরু করে হবু জামাইয়ের বায়োডাটা ।
ব্লকে অফিসার লেভেলে চাকরি করা জামাইয়ের সন্ধান পেয়ে তাদের আমন্ত্রণ জানাই। মেয়ে দেখে তাদের পছন্দ । এমনিতেই শরোমা সুন্দরী । ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করছে । চাকরি করা জামাই দেখে সুরজিত বাবু অন্যমত করেনি । তাতে আবার তাদের কোনো দাবি দাওয়া নেই । ব্যবসা করলে টাকা পাওয়া যায় অনেক, বেশি রোজগার ও করা যায় । কিন্তু যেদিন বাজার খারাপ থাকে সেদিন বোহনিটূকু করার জন্য হাপিত্যেশ নয়নে বসে থাকতে হয় । ঐ একটা খরিদ্দার আসছে বুঝি ।
চাকরিতে এসবের বালাই নেই। দিন গেলেই হলো ।মাসের শেষে মোটা রকম মশলা নিয়ে বাড়ি ফেরা।
আমি ও তো সমাজের বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো আমার জামাই ব্লকের অফিসার । সমাজে আমার প্রভাবটাও অক্ষুণ্ন থাকবে । হেয় হতে হবে না ।
শরোমার মনে কালি জমতে শুরু করেছে । চারিদিকে সে অন্ধকার দেখছে ।মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কালবৈশাখী যেমন প্রকৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেয় তেমনি শরোমার মন দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে গেছে। শুভ কে ব্যাপার টা জানায়। ও কি করবে!বেকার ছেলে ।বাবা মায়ের অবস্থা ও তেমনি ।সে কি সিদ্ধান্ত নিবে। নিরুপায় শুভ শরোমা কে বোঝানোর চেষ্টা করে।
শরোমা শুভ কে বলে চলো আমরা পালিয়ে যায়।ভয়ে শুভ এগোয় নি।
কিছু দিন আগের ঘটনা রিজওয়ানের প্রেমের কাহিনী খবরের কাগজ পড়েছে। অসম প্রেমের কী পরিণতি হবে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। এছাড়া শুভ তো বেকার, আর্থিক অবস্থাও তেমন ভাল নয় ।
অতএব এ প্রেমের পাঠশালায় শুভ বিদ্যালয়ের ছুটের তালিকায় চলে আসতে বাধ্য হয়। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও শুভ সাহস করতে পারেনি। শরোমা তো শুভ ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী বলে মেনে নিতে পারছে না। হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে ,মন ভেঙে গেছে। যেন পাথর হয়ে গেছে সে । এদিকে বাড়ির কঠোর নির্দেশ । কোত্থাও যাওয়া আসা চলবে না জরুরী প্রয়োজন ছাড়া । সবকিছু তার বন্ধ ।এমন কি কলেজ যাওয়া ও বন্ধ ।।
মেয়েরা যাকে ভালোবাসে প্রাণ দিয়েই ভালবাসে ।কোন ছলচাতুরি তাদের মনে থাকে না।মন প্রাণ উজাড় করে দিতে চাই তাকে । তাতে কার কি ক্ষতি হলো বা লাভ হলো চিন্তা করার অবকাশ থাকে না । অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম হয় বইকি । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন পাকে পড়ে লাইনচ্যুত হয়ে যায় ।কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে তখন তারা পিছপা করেনা । এমনকি ছলনার আশ্রয় নিতে কুন্ঠিত হয় না ।
এরই মাঝে শরোমা শুভকে একান্ত ভাবে ডাকে। বলে ফোনে সব কথা বলা সম্ভব নয় । তুমি তাড়াতাড়ি কলেজে দেখা করো । নবীনবরণ উৎসব চলছে কলেজে । শরোমা বাবাকে জানাই বাবা এইতো আমার জীবনের শেষ কলেজ যাওয়া। বিয়ের পর তো লেখাপড়া শিকেই উঠবে। সুরোজিৎ ও অন্যমত করেনি।
শেষ সুযোগে আরো একবার শুভকে ডেকে তার প্রেমের পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত হয় । নিরুপায় শুভ তার হাত দুটোকে ধরে নিজের বুকে টেনে নেয় । বলে তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো?
তোমার নিঃশ্বাস ,তোমার উষ্ণ রক্তের স্রোত ,আমার প্রতিটি অঙ্গের সঙ্গে মিশে আছে শরোমা। আমাদের মতো গরীব ছেলেদের প্রেম করতে নেই। প্রেমে পড়তে নেই । এই বলে সে অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে । মন ,প্রাণ ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। তবে বলবো তুমি যেখানেই যাও না কেন আমি তোমাকেই ভালবাসি , ভালোবাসবো । তুমি সুখে থেকো, ভালো থেকো ।এই বলে চোখের জলে গাল ভিজিয়ে নিঃশব্দে ছুটে চলে যায় ।
শরোমার ও মনে চলছে অনন্ত পিড়ন ।একবার ভাবছে যারে সঁপে দিলাম মন প্রাণ তাকেই যদি না পেলাম তবে কিসের বেঁচে থাকা!
কলেজের ফাংশনে অংশগ্রহণ না করে বাড়ি ফেরার পথে কিনে আনি ঘুমের ট্যাবলেট। রাতে খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ট্যাবলেটগুলো খুলে মুখে ভরবে এমন সময় মনের পরিবর্তন ঘটে।
সঙ্গে সঙ্গে একশো আশি ডিগ্রী ঘুরে যায়।যতো রাগ গিয়ে পড়ে হবু বরের উপর। এই শত্রুটা যদি সেদিন পছন্দ না করতো তবে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হতো না। নকল মন নিয়ে বিয়ে করতে উৎসাহ দেখায় । সুরজিৎ ও মনে মনে শান্তি পায় ।যাক মেয়ে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। একটা বেকার, আনকালচার্ড, সিম্পল বাড়িতে কেমন করে থাকবে। বাড়িতে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। বাড়ির সবাই মনে মনে দারুণ খুশি। ধুমধাম করে মিটে যায় বিয়ের পর্ব। বড়োলোকের মেয়ে বলে শ্বশুরবাড়িতে দারুণ খাতির। তবে শরোমার মনে যে ফাটল ধরেছে তাতে যতোই ফেভিকুইক লাগাও না কেন দাগ কিছুতেই মিটছে না । কেনো না তার মন প্রাণ যে শুভর কাছে বাঁধা পড়ে আছে। এতো আদর আপ্যায়ন তবু কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। উড়ুক্কু উড়ুক্কু ভাব।
সময়ের নদী দিয়ে জল বয়ে গেছে । দিন যায় দিন আসে ।স্মৃতির পাতা ভরাট হয়। অব্যক্ত যন্ত্রণা মনের গভীরে দাগ ফেলে। কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসে আছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে চাকরির বিভিন্ন রকম সুবিধা অসুবিধা কায়দা করে স্বামীর কাছে জেনে নেয় । কোনো অ্যাক্সিডেন্ট যদি হয়ে যায় তবে কি সুবিধা পেতে পারবে ? ভগবান না করেন কিছু হোক । তবু ও তোমাকে জিজ্ঞেস করছি । বড়োলোকের মেয়ের মন পাওয়ার জন্য তার অবর্তমানে কি কি সুবিধা সে পেতে পারে সব বলে দেয় ।
পাড়ায় কোয়াক ডাক্তার থাকেন মদন বাবু। শরীর খারাপ বলে শাশুড়ির সঙ্গে আসে মদন ডাক্তারের কাছে। কাকু রাতে আমার ঘুম আসে না । প্রায়ই রাত জেগে কাটাতে হয়। প্রেসার ও তো নরমাল আছে। কোনো তো কিছু হয়নি মা । হয়তো নতুন শ্বশুরবাড়ি এসে বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে । রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে হাত মুখ ধুয়ে ,ঠান্ডা জল খেও। ঠিক ঘুম আসবে । একান্তই ঘুম না এলে এই ওষুধ টা খেতে পারো। পরের দিন আবার যায়। কাকু এই ফর্মূলা তে অঙ্ক হচ্ছে না ।একটু ভালো ওষুধ দেন ।। অগত্যা মদন বাবু দামি ঘুমের ওষুধ দেয়। একটা- দুটোর বেশি ট্যাবলেট কাউকে দেননা সাধারণত।বহু জেদাজেদিতে পুরো পাতা নিয়ে যায়। আমি নতুন বৌ মানুষ ।রোজ রোজ কতো আসবো। তিনি অভিজ্ঞ মানুষ। নতুন বিয়ে হয়েছে।আরে বাবা দুজনে নতুন কর্মের অনাবিল স্বাদ নিলে এমনিতেই তো চোখের পাতা জড়িয়ে আসবে । কিন্তু এ মেয়ের ঘুম আসছে না কেন? তবে তাদের আসল খেলা খেলা হয়না !
হায়রে নিয়তি! নারী আর সমুদ্র একই সূত্রে গাঁথা। একটা প্রবাদ খুব মনে পড়ছে ।"জল জঙ্গল নারী তিন জানের বরী"। মনে মনে স্বামী নিধনের সমস্ত পরিকল্পনা একে নেয়।
পরিতোষ মানে শরোমার স্বামী একটু পেট রোগা গোছের লোক।পুরাই দিন ই তাকে ওষুধ খেতে হয় ।শরোমা জিজ্ঞেস করে কি তার অসুখ?তাও সে বলে না । অথচ প্রায় প্রতিদিনই টুক -টাক ওষুধ খেয়েই যায়।সেও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। রাতে শিরাপের শিশিতে দেয় জোড়লাভের ট্যাবলেট । তার সাথে দেয় পাঁচ খানা ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে। অসুস্থ পরিতোষের শুরু হয় পাতলা পায়খানা। নিয়ে যায় হাসপাতালে।বালিশ চাপা দিয়ে চির নিদ্রায় শুইয়ে দেয়।
মায়া কান্নায় পাড়া মাত করে ।সবাই হায় হায় করতে থাকে। দুটো বছর যেতে না যেতেই মেয়েটি বিধবা হলো। কেমন করে কাটবে তার জীবনের বাকি অংশ।কতো দিনই বা স্বামী সুখ পেলো হতভাগী। হায় ভগবান কচি মেয়েটার স্বামী সুখ তুমি কেড়ে নিলে।কতো নিষ্ঠুর তুমি । চোখের জল আর মিথ্যা শোকাস্ফালনে সকলের সহানুভূতি অর্জন করে নিল সে ।
শ্রাদ্ধ পর্ব সেরে বাবার সাথে চলে আসে বাড়ি। সেখানে থেকেই চলতে লাগলো ত্ৎবীর তদারকি। হরদম যেতে হতে থাকলো অফিস। বাবা ব্যাবসার কাজে ব্যাস্ত থাকায় সব দিন সঙ্গ দিতে পারেন না।একা একা যেতে ভয় করে । সদ্য প্রয়াত স্বামী সম্বন্ধে শত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অফিসে একাই ঘোরাঘুরি হচ্ছে। কেনোনা সব কিছু আদায় করতে হবে তো। বিডিও অফিস ডি এম অফিস হরদম লেগেই আছে। অফিস থেকে ফেরার পথে দেখা হয়ে যায় শুভর সাথে ।
পুরোনো প্রেমের নদী দিয়ে জল আবার বইতে শুরু করেছে ।শরোমা বলে শুভদা আমার জীবনে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যাক্তির উপস্থিতি অসহ্য। আকার ইঙ্গিতে শুভো কে কাছে পাওয়ার তীব্র আকুতি জানাতে ভোলেনা শরোমা। বেকার শুভো কে অফিস যাওয়ার সাথে ডেকে নেয়। অঢেল সময় এখানে ওখানে কাটিয়ে আসে। বিডিও অফিসের কোয়ার্টার টা এখনও ছাড়েনি ।বিডিও সাহেব তাকে ছেড়ে চলে যেতে ও বলেন নি। অনেক কোয়ার্টার ফাঁকা পড়ে আছে।
------
সুভাষীনী বাড়ি আসে । মনটা কে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না । মনটা খুঁত খুঁত করতে থাকে । বাড়ি না এসে সরাসরি থানায় গিয়ে ডায়েরী করে বৌমার নামে। তার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী তার বৌমা । তদন্তকারী অতি সন্তর্পনে শুরু করে তদন্ত। তদন্তের ভার স্বয়ং , হাতে নেন বড়বাবু খাবির খান।
অতি স্বজ্বন ব্যাক্তি ।বহু কঠিন কঠিন কেসের কিনারা করে দোষী কে তার প্রাপ্য সাজা দিয়ে ছেড়েছেন।উপর মহলে এক ডাকে খাবির সাহেব বললে মনে মনে স্যালুট জানায়। তিনি ত্রিকোণ প্রেমের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছিলেন ।
প্রাথমিক তদন্তের পর শরোমাকে গ্রেফতার করে আনে থানায় । শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। কিছুতেই স্বীকার করে না । আবার তাকে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন জজ সাহেব।
সুভাষীনীর বিবরণ অনুযায়ী শুভঙ্কর কে বন্দি করে নিয়ে আসে থানায়।
খাবির সাহেব অমায়িক ব্যাবহার করে। শিক্ষিত ছেলের প্রতি মা বাবা যেমন ব্যাবহার করে তেমনি । কোনো উচ্চবাচ্য নেই।বন্ধুর মতো কাছে ডেকে এনে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে । শুভঙ্কর বড়ো বাবুর ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেনি।
বলে শরোমার সাথে তোমার সম্পর্ক কতোদিনের?
তুমি তো সেদিন অফিসের কোয়ার্টারে ছিলে? সুভাষীনী দেবীকে ধাক্কা মেরে তুমিই তো পালিয়েছিলে?
ওসি সাহেবের সুন্দর ব্যাবহারে তার সব চৈতন্য তার হারিয়ে যায়। কোনো রকম মিথ্যের আশ্রয় নিতে পারেনি সে। হুবহু তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্ত ছক ওসি সাহেব কে বলে দেয়।
অন্যদিকে শুভঙ্কর যে তার প্রাক্তন প্রেমিক তা কিছুতেই স্বীকার করে নি শরোমা।
পরবর্তী শুনানির দিন ওয়ালী মন্ডলের জেরার মুখে মুখ থুবড়ে পড়ে তার মিথ্যে ভান করার গল্প। গড় গড় করে বলে ফ্যালে তাদের পুরাতন সম্পর্কের কথা । বাবা তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে দেয় এখানে। অন্যদিকে আমি ও প্রতিজ্ঞা করে বসি শুভ কে আমি আমার স্বামী বলে জেনেছি।অন্য কেউ আমার স্বামী হতে পারে না।শুভ কে ছাড়া বাঁচা আমার বৃথা। যেকোনো মূল্যে আমাকে শুভকে পেতে হবে।
ছলনা করি স্বামীর সাথে। মিথ্যে অভিনয় দিয়ে স্বামীকে ভুলিয়ে রাখি। অসাবধানতাবশত মেয়ে চলে আসে পেটে। তবুও হাল ছাড়িনি। ভিতরে ভিতরে স্বামী মারা গেলে কেমন করে লাভবান হবো এই আশায় বুক বেঁধেছি। মিথ্যে অভিনয় দিয়ে সাজিয়েছি সংসার।
চায়ের সাথে প্রথমে মেশায় জোড়লাভের ট্যাবলেট। রাত থেকে শুরু হয়ে যায় পাতলা পায়খানা। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আমাকে ডায়ারিয়া রোগীদের সাথেই থাকতে হয়।গা বমি গা বমি করে। একেই তো তার সাথে আমার ঘর করার ইচ্ছে নেই। মনের ভেতর টা তোলপাড় করে ওঠে। ভাবি এটাই একটা সুযোগ। এমনিতেই দুর্বল শরীর।গলা কাট হয়ে যাচ্ছে ওর।জল মুখে দিতেই নেতিয়ে পড়ছে। সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম।সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন বালিশ টা মুখের উপরে দিয়ে চেপে ধরি। সামান্য একটু নড়াচড়া করেই নিথর হয়ে যায় । আমার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়।
এমন কান্না করি যে হাসপাতাল চত্বরের সব লোকের অনুকম্পার পাত্রী হই। কেউ আমাকে অবিশ্বাস করার সুযোগ পাইনি যে আমিই আমার স্বামীর ঘাতক । একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে হালকা হই।
শুভঙ্করের সাথে ঘর বাঁধতে আমার আর কোন বাধা থাকলো না । আমার চাকরি টাও হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি ।গ্র্যচুইটির টাকা ও পেয়ে যায়। শ্বাশুড়ি কে অর্ধেক টাকা ভাগ দিই। মেয়ের জন্য কিছু টাকা রাখতে বলে। শ্বাশুড়ি আমার খুব ভালো মানুষ । দেবীর মতো মানুষ কে ঠকানো আমার ঠিক হয়নি। আবেগের বশে গড় গড় করে বলে ফেলে তার সব অপকর্মের কথা।
জজ সাহেব শুভঙ্কর কে পরামর্শ এবং শরোমা কে মার্ডার করার জন্য যাবৎ জীবন কারাদণ্ড ভোগের বিধান দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়েন ।।
=======================