কাশীনাথ হালদার
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়চিত্ততা ছিল গগনচুম্বী। কোনােদিন তিনি ঐশ্বর্য অথবা অন্য কারাের ক্ষমতার কাছে মাথা নােয়াননি। তাইতাে কবি সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – "কোথাও তুমি নােয়াওনিকো তােমার উচ্চশির।" আবার বিদ্যার সাগর কিম্বা দয়ার সাগর যিনি, তিনি দীর্ঘদেহী ছিলেন না। ছিলেন বেঁটেখাটো মানুষ। তাঁর বিশালতা বােঝাতেই কবি সত্যেন্দ্রনাথের কলম থেকে বেরিয়েছে – "দয়ায় স্নেহে ক্ষুদ্র দেহে বিশাল পারাবার।" সত্যিই তাই, এই বিশাল মানুষটির জীবন ছিল ঘটনাবহল। সেই ঘটনাগুলাে কেউ কেউ জানেন, আবার কারাে কাছে অজানা। সেই জানা-অজানা কয়েকটা ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে এখানে।
১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন মঙ্গলবার, দুপুর ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বারােটা। ভগবতী দেবীর কোল আলাে করে জন্ম নিলেন এক শিশু। আঁতুড়ঘরেই মায়ের কোলে শিশুটিকে দেখেই শিশুর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ বুঝলেন, শিশুটি ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। সেখানেই
আলতাগােলা-রঙ নিয়ে শিশুটির জিভের তলায় এক মন্ত্র লিখে দিলেন। সেই আঁতুড়ঘরেই শিশুটির নামকরণ করলেন 'ঈশ্বরচন্দ্র'। এরপর ছেলে ঠাকুরদাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "ওরে ঠাকুরদাস, তাড়াতাড়ি আয়। দেখে যা, আমাদের একটা এঁড়েবাছুর হয়েছে।" ঠাকুরদাস ছুটলেন গােয়ালঘরে। কিন্তু সেখানে এঁড়েবাছুর পাওয়া গেল না। অগত্যা রামজয় তর্কভূষণ
বললেন, "ওরে এঁড়ে বাছুর দেখবি যদি আমার সঙ্গে আয়।" বলেই দু' বাপ-ব্যাটায় পা বাড়ালেন আঁতুড়ঘরের দিকে।
ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন ৯ বছর। বাবার সঙ্গে বড়বাজারে বাসায় থাকতেন। ওই বয়সেই তাকে ভর্তি করা হলাে দু' মাইল দূরের সংস্কৃত কলেজে। প্রথম প্রথম বাবা ঠাকুরদাসের সঙ্গে কলেজে যেতেন এবং ফিরতেনও বাবার সঙ্গে। তারপর একা একা যাতায়াত করতেন। ছাতা মাথায় দিয়ে যাতায়াত করার সময় মনে হতাে যেন একটা ছাতা হেঁটে চলেছে, এতটাই বেঁটেখাটো ছিলেন তিনি। আবার দেহের তুলনায় ঈশ্বরচন্দ্রের মাথাটি ছিল বড়াে। সহপাঠীরা তাকে দেখে হাসি মস্করা করে বলতাে, 'যশুরে কৈ' (তখনকার দিনে যশাের থেকে নৌকো করে কৈ মাছ আনা হতাে কোলকাতায়। বেশ কিছুদিন অল্প জলে থাকায় কই মাছগুলাের মাথা একটু বড় হয়ে যেত। এজন্যেই সহপাঠীরা 'যশুরে কৈ' বলে রাগাতাে)। আবার বেশি করে রাগানাের জন্য কেউ কেউ বলতাে 'কসুরে যৈ'। ঈশ্বরচন্দ্র একটু তােতলা ছিলেন। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র তাদের গালাগালি দিতেন। তােতলা কথায় গালাগালি সহপাঠীরা যথেষ্ট উপভােগ করতাে। আর সেই ছােট্ট ঈশ্বরচন্দ্রের রাগ করা ছাড়া আর কোনাে উপায় থাকতাে না।
ঈশ্বরচন্দ্র কতোটা পিতৃভক্ত ছিলেন তা একটা ঘটনা থেকে জানা যায়। সে সময় সংস্কৃত কলেজের নিয়ম অনুযায়ী অলংকারের পাঠ শেষ হলে ক্রমান্বয়ে পড়তে হতাে ন্যায়, বেদান্ত এবং স্মৃতিশাস্ত্র। স্মৃতিশাস্ত্রে পাশ করলেই তবে কেউ জজপণ্ডিত পদে আবেদন করার সুযােগ পেতো। ঈশ্বরচন্দ্র তখন অলংকার শ্রেণীতে পড়ছেন। জজপণ্ডিত হবার ইচ্ছায় কলেজের অধ্যক্ষের কাছে অলংকারের সঙ্গে স্মৃতিশাস্ত্র পড়ার অনুমতি চাইলেন। পেয়েও গেলেন অনুমতি। দু-তিন বছর একসঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করলে তবেই স্মৃতিশাস্ত্রে পাশ করা সম্ভব। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র ছ'মাস পড়েই ল-কমিটির পরীক্ষায় পাশ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। মাত্র সতেরাে বছর, এত অল্প বয়সে কেউ ল-কমিটির পরীক্ষায় পাশ করতে পারে, তা কেউ বিশ্বাসের মধ্যে আনতে পারছে না। ত্রিপুরায় একটা জজ পণ্ডিতের পদ খালি হলে, ঈশ্বরচন্দ্র সেখানে ঐ পদের জন্য আবেদন করলেন। যথাসময়ে নিয়ােগপত্রও এসে গেল। কিন্তু অত দূরে গিয়ে ছেলে চাকরি করবে, সেটা বাবা ঠাকুরদাসের পছন্দ নয়। বাবার পছন্দ - অপছন্দটাকে গুরুত্ব দিতে গিয়েই আর ত্রিপুরায় চাকরি করা হলাে না ঈশ্বরচন্দ্রের।
এবার আসা যাক, ঈশ্বরচন্দ্রের 'বিদ্যাসাগর'-এ উপনীত হওয়ার ঘটনা। সংস্কৃত কলেজে যে যে বিষয়ে পড়ানাে হয়, সব বিষয়েই উত্তীর্ণ হয়েছেন বিদ্যাসাগর। কলেজের কর্তৃপক্ষগণ অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ, ঈশ্বরচন্দ্রের অগাধ পাণ্ডিত্যে। তাঁরা সবাই মিলে ঈশ্বরচন্দ্রকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি এবং এক মহামূল্যবান শংসাপত্র দিলেন। সেই শংসাপত্রে সই করলেন তখনকার দিকপাল পণ্ডিতেরা। ব্যাকরণে সই করলেন গঙ্গাধর তর্কবাগীশ, সাহিত্যে সই করলেন জয়গােপাল তর্কালংকার। এছাড়া সই করলেন অলংকারে প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ, বেদান্তে-শঙ্ভুচন্দ্র বাচস্পতি, ন্যায়শাস্ত্রে-জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, জ্যোতিষে যােগধ্যান শর্মা, দর্শনে জয়নারায়ণ তর্কভূষণ এবং অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে - শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি প্রমুখ মহামনীষীগণ। এই শংসাপত্রে তাঁরা আরাে
লিখলেন, "আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে প্রশংসাপত্র দিতেছি। এই কলিকাতায় শ্রীযুক্ত কোম্পানি-সংস্থাপিত বিদ্যামন্দিরে ১২ বৎসর ৫ মাসকাল অধ্যয়ন করিয়া তিনি উল্লিখিত শাস্ত্রগুলি পাঠ করিয়াছেন এবং ঐ সকল শাস্ত্রে তাহার বিশিষ্ট ব্যুৎপত্তি জন্মিয়াছে। এই প্রশংসাপত্র দেওয়া হইল, ১৭৬৩ শকাব্দে সৌর অগ্রহায়ণ মাসের কুড়ি তারিখে।"
বিদ্যাসাগরের মহত্ত্বের পরিচয় ছড়িয়ে আছে বহু ঘটনায়। তার মধ্যে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি-
এলাহাবাদের লালা বংশীধরের বাড়িতে যাবেন বিদ্যাসাগর। যে ট্রেনে যাওয়ার কথা, তার আগের ট্রেনে ১ ঘণ্টা আগে এলাহাবাদ স্টেশনে নেমেছেন। লালা বংশীধরের লােকজন কেউ তখনও আসেননি। পায়চারি করছেন বিদ্যাসাগর। পাঁচ-সাত মিনিট পরে একটা লােকাল ট্রেন এসে দাঁড়ালাে। একটা কামরা থেকে একজন বাবু নামলেন। হাতে একটা সেরখানেক ওজনের হ্যান্ডব্যাগ। নেমেই কুলি ডাকতে লাগলেন। কাছেই ছিলেন বিদ্যাসাগর – গায়ে সাধারণ একটা মােটা চাদর, পায়ে সাধারণ একটা চটিজুতো। বাবুটির অবস্থা দেখে বিদ্যাসাগর তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, কাঁহা জানে হােগা, বাবু! বাবুটি জানালেন, গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত। বিদ্যাসাগর ব্যাগটি নিয়ে বাবুর সঙ্গে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত এলেন। সেদিন কোনাে কারণে স্টেশন চত্বরে কোনাে গাড়ি, টাঙ্গা, একটা কিছুই ছিল না। বাবুটি বললেন, আমার বাড়ি খুব কাছেই, সাগঞ্জে―আধ মাইল পথ হবে। বিদ্যাসাগর আবার হিন্দিতে বললেন, চলিয়ে বাবু। বলেই হ্যান্ডব্যাগটি নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন বাবুর সঙ্গে।
যথাসময়ে সাগঞ্জে পৌঁছলেন। বাবুর হাতে ব্যাগটা দিলেন 'কুলি-বিদ্যাসাগর'। বাবুটি মানিব্যাগ থেকে একটা দু'আনি বের করে কুলি-বিদ্যাসাগরকে দিতে গেলে, পরিষ্কার বাংলায় তিনি বাবুটিকে বললেন, "এ পয়সা আমি নিতে পারবাে না বাবু। কোনাে গরীব-দুঃখীকে এই পয়সাটা দান করে দেবেন।"
বাবু : তােমার বাড়ি কোথায় ?
বিদ্যাসাগর : মেদিনীপুর জেলায়।
বাবু : তুমি বাঙালি হয়ে কুলির কাজ করাে কেন?
বিদ্যাসাগর : না-না, কুলির কাজ করি না।
আমার অন্য অনেক কাজ আছে। দেখলাম, আপনি ওই একসের ওজনের ব্যাগটার জন্য কুলি খুঁজছেন। তাই আপনার কষ্ট থেকে রেহাই দিতে আমি সাহায্য করলাম মাত্র। আর একটা কথা বাবু, নিজের কাজ যতটা পারেন নিজে করবেন তাতে লজ্জার কিছু নেই।
বিদ্যাসাগর হনহন করে হাঁটতে লাগলেন, গলির মধ্যে। কাছাকাছি একটা একতলা বাড়ির বাইরে একজন যুবক একটা বই নিয়ে পড়ছিলেন। বিদ্যাসাগরকে আসতে দেখে, ছুটে এসে যুবকটি তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। বিদ্যাসাগর ছেলেটিকে চিনতে পেরে বললেন, শঙ্কর না। কী করছো এখানে?
শঙ্কর বললাে, এখানকার হাইকোর্টে ওকালতি করি।
বাবুটিও কুলির সঠিক পরিচয় জানবার জন্য পিছন পিছন আসছিলেন। শঙ্করবাবুর সঙ্গে কথাবার্তার সময় বাবুটি জানতে পারেন, কুলিটিই স্বনামধন্য বিদ্যাসাগর মশাই। সঙ্গে সঙ্গে বাবুটি বিদ্যাসাগরের পা'দুটি জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন, গুরুদেব আপনার কথা আমি চিরদিন মনে রাখবাে। নিজের কাজ নিজে করতে কোনাে লজ্জা পাবাে না। বিদ্যাসাগর বললেন – তাই কোরাে বাবা। এই হােলাে দয়ার সাগর বিদ্যাসাগরের মহত্ত্ব।
বিদ্যাসাগরের মহত্ত্বের আর একটা অপূর্ব ঘটনার কথা। বিদ্যাসাগর তখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে চাকরি করতেন। কালনার তারানাথ তর্কবাচস্পতি বিদ্যাসাগরের বন্ধু ছিলেন। ব্যাকরণসহ অন্যান্য শাস্ত্রে ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি। এক সময়ে তিনি একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগরকে অনুরােধ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন,"চেষ্ট করবাে।" একসময় সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের ১ম এবং ২য় শ্রেণীর অধ্যাপকের পদ খালি হলাে। ১ম শ্রেণীর অধ্যাপকের বেতন মাসিক ৯০ টাকা। ময়েট সাহেব বিদ্যাসাগরকে প্রথম শ্রেণীর অধ্যাপকের পদটি দিতে চাইলেন। বিদ্যাসাগর বললেন, তারানাথ তর্কবাচস্পতি ব্যাকরণে মস্ত পণ্ডিত। তাঁকে এই পদটা দেওয়া হােক।
কেন তিনি বেশি বেতনের চাকরি সত্ত্বেও নিলেন না, তা সহজেই অনুমেয়। যাই হােক, যেদিন ময়েট সাহেবের সঙ্গে এই আলােচনা হচ্ছিল, সেদিন ছিল শনিবার। ময়েট সাহেব বললেন, সেটা না হয় হােলাে ; কিন্তু যিনি কাজ করবেন তিনিই তাে এখানে নেই। অথচ সােমবার সকাল ১০টার মধ্যে তার স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র অবশ্যই আসা প্রয়ােজন। বিদ্যাসাগর সাহেবকে বললেন, তাই হবে।
কিন্তু তারকনাথবাবু আছেন কালনায়। কোলকাতা থেকে প্রায় ৬০ মাইল দূরে। সােমবার কীভাবে অত দূর থেকে আবেদনপত্র আসবে। কিছুক্ষণ চিন্তার পর কর্তব্য স্থির করে ফেললেন বিদ্যাসাগর। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে একজন চাকর নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন কালনার উদ্দেশে।
সারারাত হেঁটে পরেরদিন অর্থাৎ রবিবার সকালে কালনায় পৌছলেন। তর্ক বাচস্পতি মশাইয়ের পক্ষে এত পথ হেঁটে আসা সম্ভব নয়। এজন্য তাঁর স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র সঙ্গে নিয়ে বিদ্যাসাগর আবার রওনা দিলেন কোলকাতার দিকে। এবং যথারীতি সারারাত হেঁটে পরদিন অর্থাৎ সােমবার সকাল ১০টার সময় ময়েট সাহেবের হাতে তুলে দিলেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি মশায়ের স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র। যথাসময়ে ৯০ টাকা বেতনে ১ম শ্রেণীর অধ্যাপকদের পদে যােগ দেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি।
এই হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, এই হলো বিদ্যাসাগরের মহত্ত্ব আর বন্ধুপ্রীতি।
-------------------------------------
●
কাশীনাথ হালদার
জেলেরহাট • পোঃ - দোলতলা ঘোলা
থানা - বারুইপুর • জেলা - দক্ষিণ ২৪ পরগনা • পশ্চিমবঙ্গ • ভারত • ডাকসূচক - ৭৪৩৩৭৬।