প্রবন্ধ ।।সাহিত্যের আঙ্গিক নিয়ে কিছু কথা ।। রণেশ রায়
আমি ব্যাকরণ মেনে সাহিত্য চর্চার রীতি জানি না। সেদিক থেকে সাহিত্যিক নই। আমার ভাবনা আমার সীমিত বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে সাহিত্যের প্রাঙ্গণ নিয়ে সীমিত পরিসরে কিছু আলোচনার প্রয়াস এখানে আমার। বলতে পারেন দুঃসাহস। সেটাই এখানে দেখাচ্ছি।
দেখি যে সাহিত্যের প্রাঙ্গণ যেন সমুদ্রের মোহনা বা ফুলের বাগান বা খেলার মাঠ । একটা সমগ্র যার মধ্যে তার বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করে। প্রত্যেকটি অঙ্গকে নির্দিষ্ট সাজে সাজিয়ে তোলা হয়। সুর ছন্দ লয়ে তার অলংকরণ করা হয়। তার থেকে সৃষ্টি হয় একটা ধরন একটা কাঠামো যাকে সাহিত্যের আঙ্গিক বলা যেতে পারে। এই আঙ্গিককে আনুষ্ঠানিক ভাবে একটা ব্যাকরণ মেনে চলার রীতি চালু করার প্রয়াস দেখা যায় সাহিত্য জগতে। সাহিত্যিকের মননকে একটা কাঠামোয় বাঁধার কথা বলা হয় যে কাঠামোকে সাহিত্যের আঙ্গিক বলার একটা রীতি আছে। তবে সাহিত্যিকরা কোন নির্দিষ্ট কাঠামোয় তাকে বেঁধে রাখেন না। প্রত্যেকের নিজের মনন অনুযায়ী শব্দ চয়ন তাকে ছন্দবন্ধ ভাবে তুলে ধরার একটা নিজস্ব ভঙ্গি থাকে।সেভাবে তিনি তাঁর নিজের সৃষ্টি করা আঙ্গিকে নিজের সাহিত্য শিল্পকে ফুটিয়ে তোলেন। ইচ্ছে করলেও নির্দিষ্ট করে দেওয়া ব্যাকরণে নির্দিষ্ট কাঠামোয় নিজেকে বেঁধে রাখতে পারেন না। তবে এটাও সত্যি যে অনুশীলন চর্চা কাউকে অনুসরণের মাধ্যমে এক একটা ধরন এক একটা আঙ্গিকে ধরা পরে। সেটা অস্বীকার করা যায় না। সেই অনুযায়ী লেখক রবীন্দ্র আঙ্গিকে বা জীবনানন্দের আঙ্গিকে নিজের সাহিত্য সৃষ্টি করেন নিজের ভাবনাকে তার সঙ্গে মিলিয়ে। তার মধ্যে তাঁর নিজস্বতা ধরা পড়ে।সাহিত্যের আঙ্গিকে সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গের প্রস্ফুটন। গল্প কবিতা প্রবন্ধ ছড়া হল বিভিন্ন অঙ্গ। এই প্রতিটি বিষয় নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয় তাকে আমরা সাহিত্য প্রাঙ্গণ বলতে পারি। প্রতিটি বিষয় তথা অঙ্গ যার যার নিজস্ব ছন্দ সুর লয়ে খেলা করে, প্রতিটি স্রোতস্বিনী নদী এসে মোহনায় মেলে, বিভিন্ন বর্ণের গন্ধের ফুলের এ যেন বর্ণাঢ্য একটা বাগান। একটা সমগ্র । ঠিক যেমন হাত পা মাথা মুখ এসব নিয়ে একটা সমগ্র মানুষ যার দেহে আশ্রয় করে বিভিন্ন অঙ্গগুলো কাজ করে। একই আঙ্গিকে বিভিন্ন বিষয়কে প্রত্যেকের নিজস্বতা অনুযায়ী জায়গা করে দেওয়া হয় সাহিত্যে।। সব কটার মধ্যে কেন্দ্রীয় ভাবনাটা যদি একতারায় বেজে উঠতে পারে সুর ছন্দ লয়ে তবেই সাহিত্য পূর্ণতা পায়।
মনুষ্য জগতে সাহিত্য সৃষ্টি হয় কারণ সমাজ জীবন ও বহির্বিশ্ব তার অন্তরলোকে তার চেতনায় যে ভাবের সঞ্চার করে তাই সাহিত্যের উৎস। লিপি আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই কার্যত মানব জন্মের সূত্রপাত থেকেই সাহিত্যের সৃষ্টি তার মনোজগত ধরে। লিপিবদ্ধ না হওয়ার আগে থেকেই সাহিত্য সৃষ্টির এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার আঙ্গিকের পরিবর্তন হয়েছে। লিপিবদ্ধ হয়েছে পরিশীলিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সমাজ ও সমাজ জীবনের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য ধারায় পরিবর্তন এসেছে। সাহিত্যিক সময়টাকে ধরতে চেষ্টা করেন যুগের পরিবর্তনের ধরনের সঙ্গে তাল রেখে। সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি সমাজের মূল্য বোধকে তুলে ধরে তাঁর সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি নির্বিকার থাকতে পারেন না। তাই সাহিত্য বিমূর্ত একান্তভাবে সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত চর্চা হতে পারে না যদিও অনেকে সাহিত্যকে সেভাবে দেখার পক্ষে। আমরা মনে করি এভাবে সাহিত্যকে দেখাও সমাজে কোন একটা মূল্যবোধকে সমর্থন করা। আরও একটা বিষয়ের আমরা উল্লেখ করছি এখানে। সাহিত্যিক সমকালীন সময়টাকে যেমন ধরার চেষ্টা করেন তেমনি অতীতের অবগাহন করেন, তাঁর সাহিত্যে ভবিষ্যতের ছবি আঁকেন। অর্থাৎ অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের মধ্যে মেল বন্ধন ঘটান। সেই দিক থেকে সাহিত্যকে অধুনিক সাবেকি ভাগে নিখুঁতভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সাহিত্যিকের পরিচয় আধুনিক সাহিত্যিক আর সাবেকি সাহিত্যিক হিসেবে নয়। কোন সাহিত্যিক আধুনিক আঙ্গিকে এমন কিছু লিখতে পারেন যা ভাবনা মননের দিক থেকে সাবেকি। যেমন তাঁর সাহিত্যে সামন্ত সমাজের মনন প্রতিফলিত হতে পারে পুরুষতন্ত্রের রেশ দেখা যেতে পারে। তাই আঙ্গিক বিচার করে তাকে আধুনিক বলা যায় না। আবার কেউ সাবেকি আঙ্গিকে আজকের প্রগতির ভাবনা প্রকাশ করতে পারেন ভবিষ্যতের এক সুন্দর প্রগতির ছবি আঁকতে পারেন। আঙ্গিকের বিচারে তাকে সাবেকি বলে তাচ্ছিল্য করা চলে না। আমরা এও বলেছি যে বাস্তব বর্জিত বিমূর্ত কল্পনা প্রসূত সাহিত্য রচনা যা সমাজ ও মানুষের সেবা করতে পারে না তাতে আমরা বিশ্বাসী নই। শিল্পের জন্যই শিল্প এই ভাবনার সঙ্গে আমরা একমত নই। মানুষের মনোজগতে কল্পরাজ্য সাহিত্যের কর্ষণভূমি তাই সেখানে বস্তু ও সমাজজীবনের গুরুত্ব তেমন নয় এই ভাবনা সমাজের আর্থসামাজিক দুর্যোগকে যারা আড়ালে রাখতে চান তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করে। সেক্ষেত্রে সাহিত্যিকরা সচেতন ভাবে হোক অচেতনভাবে এই স্বার্থের সাহায্য করেন। সাহিত্য তার সামাজিক ভূমিকা পালন করতে পারে না বলে আমাদের মনে হয়। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার সাহিত্যিক একজন রাধুনী। তাঁকে গল্প কবিতা ছড়া উপন্যাস পাঠককে সাজিয়ে দিতে হয় পাঠকের রুচিমত যে রুচি সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক। পাঠক যদি নিজের রুচিতে সে স্বাদ না পায় তা যদি সমাজের সেবায় না লাগে তবে তা সার্থক সাহিত্য হতে পারে না। তার মানে এই নয় যে লেখকের কল্পনার রঙের ছোঁয়া তাতে থাকবে না তাঁর ভাবনায় তার সমৃদ্ধি ঘটবে না। রাধুনী তাঁর ভাবনা কাজে লাগিয়ে তাঁর কল্পনায় তাকে রাঙিয়ে সুস্বাদু খাদ্য পরিবেশন করেন তবে সেটা যাকে দিচ্ছেন তাঁর রুচি বুঝে। কিন্তু লেখক নিজেকে আড়ালে রাখলেন। আর পাঠকের মননে পাঠক বুঝে নিক এই সুযোগ থাকলে যে বিকৃতির উদ্ভব ঘটতে পারে লেখকের লেখার বিকৃত ব্যাখ্যা হতে পারে তা আমরা একটা প্রশ্ন তুলে ধরে আমাদের এই লেখার ইতি টানছি। ধরা যাক কোন লেখক তাঁর গল্প বা কবিতায় তাঁর সৌন্দর্য বোধ দিয়ে নারীর দেহ সৈষ্ঠভ বর্ণনা করলেন আর পাঠক বা পাঠিকা কবির মনন না বুঝে প্রেক্ষাপট বিচার না করে সেটাকে তার যৌণ ভাবনা দিয়ে ব্যাখ্যা করলেন সেটা কি কাম্য? সেটা কি সাহিত্যের প্রতি সুবিচার? যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন ধরে কাদম্বরীর তথা আমাদের সমাজে এক মহিলার জীবনের বিয়োগান্ত পরিণতি নিয়ে ভেবে গেছেন লিখে গেছেন। সেটাকে তাঁদের অবৈধ প্রেম বলে অনেকে চালাচ্ছেন, সাহিত্যের জগতে তাকে নিয়ে ব্যবসা করছেন কবি নারী স্বাধীনতার যে দাবি তুলেছেন সেটাকে অগ্রাহ্য করে। এটা এক বিকৃত সাহিত্য বোধ বলে আমি মনে করি।