গল্প ।। লাল পিঁপড়েদের উপযোগিতা ।। চন্দন মিত্র
আগে ছিল কুল, শিয়াকুল, বঁইচি, সাঁইবাবলা, বুনোজাম, তাল-খেজুর এইসব গাছ। ক্রমশ খালপাড়ের অকর্ষিত বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে আম-জাম-মাদার-লিচু-আঁশফল এমনকি গোলাপজামের চারারাও মাথা তুলে দাঁড়াল। না, মানুষ এসব গাছ লাগায়নি। পাখিরাই ঠোঁটে করে ফল এনে বীজগুলো ফেলেছে। কেবল পাখি নয় খটাশ, ভাম, শেয়াল, বেজি, বুনো খরগোশ এদেরও অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে বনটি। লোকালয় থেকে বেশ কিছুটা দূরবর্তী হওয়ায় খালপাড় লাগোয়া ঝোপঝাড়ে ঢাকা জায়গাটি বহুদিন সাধারণের অগোচরেই ছিল। আমরা কজন বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলে একদা জায়গাটিকে আবিষ্কার করে বসি। যথেষ্ট ফুরসত পেলেই আমরা কজন ওখানে চলে যেতাম। গাছে গাছে মউচাক দেখে আমরা আদর করে জায়গাটির নাম দিয়েছিলাম মধুবন।
একদিন রবিবারের দুপুরে অসীম, নিমাই আর সুজনকে বাড়িতে না-পেয়ে আমি আর নিলয় মধুবনে ঢুকে পড়ি। একটা লিচু গাছে উঠে দুজনে মনের সুখে পাকা লিচু খাচ্ছি, এমন সময় কোথায় একটা ফটাস করে আওয়াজ হল। গাছের উপর থেকে তাকিয়ে দেখি বেশ কিছুটা দূরে বঁইচি ঝোপে ঘেরা যে মাঠটা আছে সেখানে জনাদশেক ছেলে দাঁড়িয়ে। তাদের একজনের হাতে এয়ারগান। তবে কী ওরা পাখি শিকার করতে ঢুকেছে ! আমরা তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে পড়লাম। ওদের কাছে গিয়ে দেখি আমাদের অসীম আর নিমাই ওদের সঙ্গে আছে। বাকিদের ঠিক চিনি না। একজনের হাতে দেখি দুটি রক্তাক্ত ডাহুক ঝুলছে। আর একজন একটি ছটফটকরা শামুকখোলের গলায় পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে পড়ে আছে একটা গলাকাটা খরগোশ, তার পেটটা তখনও ওঠানামা করছে। দলের একজন যে আমাদের থেকে বয়সে কিছুটা বড়ো, সে আমাদের দেখতে পেয়ে বলল, এই তোরা এখানে কী করছিস ? তার হাতে একটা রক্তমাখা নেপালি ছোরা। তার চেহারা দেখে আর গলার আওয়াজ শুনে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, নিলয় তো তখন রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। অসীম সামাল দিল, আরে তোরা কখন এখানে ঢুকলি ? আমরা উত্তর দিলাম না। একটা ছেলে তালগাছের ফোঁকর থেকে খানচারেক টিয়াপাখির বাচ্ছা পেড়ে এনে মাটিতে রাখল। তারপর পকেট থেকে একটি ছোটো ছুরি বের করে বাচ্চাগুলোর অপারেশন শুরু করে দিল। বাচ্ছাগুলো তখনও ডাকতেও শেখেনি। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। একজন দেখি উলুঘাসের ঝোপে আগুন ধরিয়ে দিল। খেয়াল করলাম ওদের দলে আরও চারজন আছে। তারা শিমুল গাছের তলায় গেলাস-বোতল নিয়ে বসেছে। সুজনকে এতক্ষণ দেখতে পাচ্ছিলাম না, এখন দেখলাম সে ওইদলেই আছে। একজায়গায় দেখলাম দশবারোটা খেজুরের কাঁদি জড়ো করা আছে, তখনও সেগুলিতে পাক ধরেনি। একজনের হাতে একব্যাগ কচি আম। আমি ভেবে পেলাম না, এরা কী চায়। আমরা তো এখান থেকে কখনও কাঁচা কিছু পাড়িনি। আমরা জানি এই বনের ফলে পাখিদের অধিকার। তারাই তো এই গাছগুলি লাগিয়েছে। আর পাখিদের ক্ষতি করার কথা আমরা কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি।
সেদিন প্রায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি। কাউকে কিছু বলেও লাভ নেই। বাড়িতে জানাজানি হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, বকুনি খাওয়াই সার হবে। ভোরের দিকে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। একদল লোক মউবনের গাছগুলি কেটে ফেলছে। পাখির বাসা মাটিতে লুটোচ্ছে। বাচ্ছাগুলি চিঁ চিঁ করছে মাটিতে পড়ে। অগণিত পাখি আকাশে ডানা ঝাপটাচ্ছে। তাদের আর্তনাদে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘামে আর চোখের জলে আমার বিছানা বালিশ ভিজে সপসপ করছে। তারপর থেকে ওইদিকে যাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেল। কয়েকদিন পর ঘোরতর বর্ষা শুরু হল। আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। বর্ষায় কেউ মউবনে ঢোকার সাহস করবে না। পুরো এলাকাটা প্রায় জলে ডুবে থাকে। সাপেদের বাড়বাড়ন্ত হওয়ার সম্ভাবনা। বাড়ির চাপে আর কিছুটা নিজের তাগিদে আমিও মাধ্যমিকের প্রস্তুতিতে পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
মাধ্যমিক শেষ হল। কিন্তু পড়াশোনার চক্কর থেকে বেরোতে পারলাম না। কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হলাম। ইলেভেন-টুয়েলভের জন্য টিউটর নিযুক্ত হয়ে গেল। সেই ঘটনার পর থেকে অসীম, নিমাই আর সুজনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। একদিন কম্পিউটার ক্লাস থেকে ফিরছি দেখি মোড়ের চা-দোকানের বেঞ্চে বসে নিমাই সিগারেট টানছে। চোখাচোখি হতে উঠে এসে আমার সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, চ একটু চা খাই। সত্যি বলতে কী আমার রাগ ততদিনে অনেকটাই প্রশমিত হয়ে গেছে। আমি বললাম, না রে তুই খা। সে বলল, তাহলে তুই একটু বোস। কতদিন পরে দেখা। তুই তো আর বাড়ির বাইরে বেরোস না। আমি তাকে থামিয়ে বলি, ভুল বললি অপ্রয়োজনে বেরোই না। যাইহোক ওর সঙ্গে বেঞ্চে বসলাম। নিমাই বলল, জানিস কালকে আমরা মউবনে গেছিলাম। কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারিনি। কিছুটা ঢুকতেই কোথা থেকে অজস্র লাল পিঁপড়ে এসে এমনভাবে ছেঁকে ধরল যে পালাবার পথ পেলাম না। বিলু তো বন্দুক ফেলে পালিয়ে আসছিল। শেষে হাবলু গিয়ে একছুটে নিয়ে আসে। তবে ফিরে এসে সে মাটিতে ঘণ্টা খানেক গড়াগড়ি দিয়ে তবেই নিস্তার পায়। আশ্চর্য এই লালপিঁপড়েগুলো কোথা থেকে এলো বলত? যেখানে ধরবে সেখান থেকে নড়বে না। একেবারে মরণ কামড়, যেন আত্মঘাতী হামলা ! তবে বিলুও ছাড়ার পাত্র নয়। সে বলেছে মিলিটারি বুট আর ইউনিফর্ম জোগাড় করে আবার যাবে। বিলুকে তুই চিনিস না পাখির মাংসের লোভে মিলিটারি পোশাক তো ছার, সে বাঘের দুধও আনতে পারে। নিমাই একা বকে গেল, আমি কথা বাড়ালাম না, শুনে গেলাম কেবল। ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম লাল পিঁপড়েগুলো এলো কোত্থেকে ? পাখিরা কী ঠোঁটে করে তাদের বয়ে এনে মউবনে ছড়িয়ে দিয়েছে ? নাকি পাখিদের দুঃখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে লালপিঁপড়েরা তাদের পাশে দাঁড়াতে এসেছে ? বিলু কী সত্যিই মিলিটারি ইউনিফর্ম জোগাড় করতে পারবে ? যদি পারে তাহলে কী সে লাল পিঁপড়েদের সঙ্গে পেরে উঠবে ?
সপ্তাদুয়েকের ছুটি নিয়ে কাকা ফিরল। কাকা একটা মাইনিং কোম্পানিতে চাকরি করে, ওড়িশায় পোস্টিং । একদিন কাকাকে বিলুর পরিকল্পনার কথা বললাম। কাকা শুনে হাসতে হাসতে আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, যে পোশাকই পরুক না কেন লাল পিঁপড়ের পাল্লায় পড়লে বিলু তার বাপের নাম ভুলে যাবে। লাল পিঁপড়ের ভয়ে আমরাই জঙ্গলে ঢুকতে গেলে দশবার ভাবি। তবে হ্যাঁ ওই লাল পিঁপড়েগুলো ছিল বলেই এখনও আমাদের দেশে অনেক জঙ্গলপাহাড় টিকে আছে, নচেৎ কবেই ব্যবসায়ীয়া জঙ্গল কেটে পাহাড় ফাটিয়ে পরিবেশ শেষ করে দিত।
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।