বাংলা গদ্যের অন্যতম জনক রাজা রামমোহন
দীপঙ্কর সরকার
ভারত পথিক রাজা রামমোহন সমাজ সংস্কারক হিসেবে সম্যক পরিচিত হলেও বাংলা গদ্যের অন্যতম জনক হিসেবে ও খ্যাত তিনি । মিশনারীদের বাংলা চর্চা , বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে নূতন জন্ম দিলেওঅন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতের রহস্যঘন গহ্বর থেকে ভবিষ্যতের গদ্যের সূর্যশিখা রামমোহনের কৃপায় স্বচ্ছহয়ে ওঠে । তিনি অতীত ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন-কারী " Rammohan stands in history as the living bridge . "
দীর্ঘ ষোলো বছর বাংলা গদ্য সাধনা তাঁকে জনমন ও জনজীবনানুগ ভাষা রচনায় সাহায্য করেছে । শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাদ্রী প্রভাব মুক্ত , সর্বপ্রথম পাঠ্য তালিকা বহির্ভূত অর্থাৎ ব্যবহার্য বাংলা গদ্য বই রচনা করে তিনি নূতন যুগের অগ্রদূত হিসেবে পরিগণিত ।
রামমোহন রায় গদ্যে পণ্ডিতি রীতি অনুসরণ করলেও তখনকার পণ্ডিতের মতো তাঁর গদ্যে পাণ্ডিত্যের ঝাঁঝ, কৃত্রিমতা অথবা দুর্বোধ্যতা ছিল না । বহুভাষাবিদ হওয়ায় রামমোহন বাংলা গদ্যকে নূতন দৃষ্টিতে দেখে -ছিলেন বলে তার সৌকর্য সাধন তাঁর পক্ষে ছিল অনায়াসসাধ্য । বাঙালির জড় জীবনে য়ুরোপীয় গতিবাদ সঞ্চার করার জন্য ভাষার ব্যবহারে তিনি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন । তাই গদ্যে নূতন রীতি গ্রহণে কার্পণ্য ছিল না । রামমোহনের বাংলা রচনায় পরিচিত সাহিত্য রস না থাকলে ও তাঁর স্টাইলের সামর্থ অবিসংবাদিত । রামমোহনের গদ্যরীতি তাঁর নিজস্ব । তাঁর ভাষা সহজ , সরল , স্পষ্ট এবং তাঁরপ্রকাশভঙ্গি লক্ষ্যভেদী । কেরী সাহেবের ' কথোপকথন ' ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ' প্রবোধ চন্দ্রিকা ' র রচনাভঙ্গি রামমোহনের রচনা রীতি থেকে অনেক উৎকর্ষ হলেও ভাষার বেগবত্তা ও সরসতার দিক থেকে রামমোহন শীর্ষ স্থানীয় । বিদ্যাসাগরের বাংলা প্রসাদগুণ , প্রাঞ্জলতা লক্ষ্য করে তাঁকে ' রাজাধিরাজ ' বললে রামমোহনকে বাংলা গদ্যের ' রাজা ' উপাধিতে ভূষিত করলে অযৌক্তিক হয় না ।
রামমোহন স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার ও সতীদাহ প্রথা নিবারণের দ্বারা সমাজকে সংস্কারের চেষ্টা করলেও বাংলা ভাষা সংস্কারেও তিনি পশ্চাৎ পদ ছিলেন না । অনুবাদমূলক ও বিশ্লেষণ বিতর্কমূলক গ্রন্থাদি রচনায় তাঁর পটুত্ব এটাই প্রমাণ করে যে , তিনি বাংলা ভাষা সংস্কারক । ' বেদান্ত গ্রন্থ '(১৮১৫) , ' বেদান্ত সার '(১৮১৫) ,' ঈশোপনিষদ '(১৮১৬) ,' কঠোপনিষদ '(১৮১৭) প্রভৃতি গ্রন্থাবলি রামমোহনের রচনা নৈপুণ্য , ক্ষুরধার যুক্তি এবং বাংলাভাষার ওপর তাঁর অদ্ভুত দখলের পরিচায়ক । তিনি সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন যে , বাংলা গদ্য লেখার কৌশল বাঙালিরা আবিষ্কার করে নি বলেই তিনি বাংলাগদ্য লেখার ' নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠা ' করে গিয়ে ছিলেন । তিনি জানতেন প্রত্যেক ভাষার Structure পৃথক । তাই এক ভাষার ব্যাকরণ অন্য ভাষার ওপর প্রয়োগ করা যায় না । তাই তিনি বাংলার যে একটা আলাদা বাক্যগঠন প্রণালী আছে, সেই সত্যটার প্রতি রামমোহনই প্রথম দৃকপাত করেন -- এখানেই তাঁর অনন্যতা । আর এখানেই তাঁর দ্বিসার্ধশত বর্ষে তাঁকে স্মরণ করার যৌক্তিকতা ।
------------------
ঠিকানা
দীপঙ্কর সরকার
কাঁঠাল পুলি
(সিংহের হাটের কাছে)
চাকদহ
নদীয়া
৭৪১২২২
M 6297618158