প্রবন্ধ ।। জগন্নাথের স্নানযাত্রা ।। বাণীব্রত গোস্বামী
ছবিঋণ- ইন্টারনেট
জগন্নাথের স্নানযাত্রা তাঁর জ্বর ও তার প্রতিকার
বাণীব্রত গোস্বামী
স্বয়ং জগদ্বীশ্বরের জ্বর ? সাক্ষাৎ ভগবান। তার আবার জ্বর হয় কী করে? জ্বর তো একটা মানবিক ব্যাধি, দেবশরীরে তার প্রকোপ অবিশ্বাস্য। এ আবার পরমাত্মার কেমন লীলা!
সে প্রায় সাড়ে আটশো বছর আগের কথা। জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথি। শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের পুণ্য জন্মদিবস। অবন্তীনগরের সূর্যবংশীয় পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। জগন্নাথ দেবের স্বপ্নাদেশেই মহারাজার হাত ধরেই মহাস্নানযাত্রার মহোৎসবের প্রচলন। প্রত্যুষে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা স্নানবেদীতে অবতরণ (পহন্ডি) করেন। মন্দিরের উত্তর দিকের স্বর্নকূপ থেকে ১০৮ স্বর্ণ-কলসের সুশীতল বারিতে হয় সেই পুন্যস্নান। লেপন করা হয় চন্দন তুলসী মিশ্রিত সুগন্ধ। স্নানমঞ্চ সুসজ্জিত হয় মনিমুক্ত, মালা, চামর ও তোরণ দিয়ে। ভগবানের অঙ্গে শ্বেতশুভ্র পট্টবস্ত্রাদি। অবিরাম পূত বারিধারা নেমে আসছে তার দিব্যতনু বেয়ে। সেবকেরা বীজন করছেন তালপাখা আর চামর দিয়ে। ভগবানের সারা শরীরে সেপটে রয়েছে সিক্ত বসন। ফলস্বরূপ স্নানের পর বিগ্ৰহের শরীরে প্রবল তাপমাত্রা। এখানেই তার মাহাত্ম্য। ভগবৎতত্ত্বে আবার বর্ণিত রাধারানীর প্রেম জলরূপ ধারণ করে ঐ স্বর্নকূপে আবদ্ধ। তাই এই জলের স্পর্শে ভগবানের মনে পড়ে যায় নিকুঞ্জলীলা মাধুরীর মধুময় অমৃত স্মৃতি। সেই স্মৃতিবাহিত পবিত্র প্রেমের বহিঃপ্রকাশেই এই শ্রী অঙ্গের প্রবল উত্তাপ। তাই ভগবৎ ঐশর্য্যতত্ত্বে এর নাম ‘প্রেমময় জ্বর'।
এবার তো তার চিকিৎসার প্রয়োজন। যথারীতি নিয়ে যাওয়া হল চিকিৎসালয় অর্থাৎ 'অনসর পিন্ডিতে'। তিন দেবতার এই সেবা শুশ্রূষা পর্বই হল 'অনঅবসর কার্য'। এই নিরোধন গৃহে তিনি এক পক্ষকাল অবস্থান করেন। সে স্থান হয় বংশাবৃত। প্রধান মন্দিরের যাবতীয় পূজাপাট হয় নিষিদ্ধ। দেবদর্শন-ও সম্পূর্ণ বন্ধ। বিদ্যাপতি ও বিশ্বাবসু বংশের সেবকরাই এইসব কার্য করেন। ক্রমে ছয়দিন পর্যন্ত্য দারুমূর্তির লেপনাদি কার্য চলে। সপ্তম দিবসে তিলতেল মর্দন করা হয়। অষ্টম দিবসে রমনীয় পট্টবস্ত্রের সূত্র দ্বারা মূর্তির সর্বাঙ্গ জড়িয়ে শুষ্ক সর্জবৃক্ষের রস সুবাসিত তিল তেলে মিশিয়ে সর্বাঙ্গে মর্দন করা হয়। নবম দিবসে চিকন আর্দ্র বস্ত্রের দ্বারা পূর্বের লেপন বারবার মুছে ফেলা হয়। দশম দিবসে অতি চিকন বস্ত্র দ্বারা দারুমূর্তি আচ্ছাদন করে রক্তচন্দন, সারচন্দন, কস্তুরী, কুঙ্কুম, কর্পূর প্রভৃতি সুবাসিত দ্রব্য একত্রিত করে লেপন করা হয়। একাদশ দিবসে সায়ংকালীন পূজা শেষে নানারকম বাদ্যধ্বনির মধ্যে পূর্বোক্ত চন্দনাদি দ্রব্য পুনরায় লেপন করা হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, এই বারবার লেপনের মাধ্যমে দারুমূর্তিতে রক্ত, মাংসের সৃষ্টি হয়। দ্বদশ দিবসে বস্ত্র আচ্ছাদন করে লেপন করা হয়। এই লেপনে নাকি ত্বকের সৃষ্টি হয়। ঐদিন লেপন ও পূজা কর্মাদি দেড় প্রহর অবধি চলে। তারপর নানা মঙ্গলবাদ্য সহযোগে সুদৃঢ় বস্ত্র ও লেপন দ্বারা পদদ্বয় নির্মান করা হয়। ত্বকের উপর রোম কল্পনার্থে কর্পূর প্রলেপিত হয়। সর্বান্তে পক্ষান্তের দিন নেত্রোৎসবের মাধ্যমে নেত্র চিহ্নিত করা হয়। তারপর হয় অঙ্গরাগ। নানা বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে নবমূর্তিতে প্রকটিত হয়ে জগন্নাথদেব দর্শন দান করেন। এই উৎসবের নামই হল 'নবযৌবন'। আসলে জগন্নাথ দেবের মূল বিগ্ৰহ হল নারায়ন শীলা। যার সংকোচন, প্রসারণ আছে। তিনিই একমাত্র ভক্তের জীবন্ত ভগবান।
আর এক অবতার শ্রীরাম, যিনি গরুড়কে বিশ্বরূপ দেখালেন তার ডানার আড়ালে। তিনিই তো স্বয়ং ভগবান। তিনিই আবার সীতাহরণের পর ভূমিতে লুটিয়ে ক্রন্দনরত। কখনও বা সীতার পাতালপ্রবেশের পর সলিল-সমাধিতে আত্মহত্যা। আর দেবাদিদেব মহাদেব,যিনি 'সীমার মাঝে অসীম' মানুষ তো দূরের কথা দেবতাদের কাছেই তিনি কুলকিনারা- হীন। ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে তিনিই ভবঘুরে ভ্রমণরত ত্রিভুবনময়। ভক্তের দুয়ারে দুয়ারে।
তাহলে জগদ্বীশ্বরের জ্বর হবে না কেন? জ্বর তো একটা অসুখের প্রতীক। মানবতার প্রতীক। আসলে তাকে তো ‘মানুষ’ হতে হবে। ঠিক যেমন মানুষের অসুখ হয়। তবে জ্বরের প্রতিকার তো ওষুধ আর পথ্যে। তাই তিনিও 'পাঁচন' খেলেন। সে কথায় পরে আসছি। তাই এই জ্বর শুধুমাত্র অসুখ নয়, এই জ্বরলীলার মধ্যে দিয়েই জগদ্বীশ্বরের নরলীলা—তার মাধুর্য্যবিস্তার ও বহিঃপ্রকাশ।
উড়িষ্যার পুরী হল শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের স্বর্গসাম্রাজ্য। স্বর্গের রন্ধনশালাতেই প্রস্তুত হয় স্নানযাত্রার ভোগ। মন্দিরে নিয়মিত দুধরনের ভোগ হয়। কোঠভোগ আর ছত্রভোগ। কোঠভোগ মন্দিরের অর্থভান্ডার ও রাজভবন থেকে নিবেদিত হয়। আর ছত্রভোগ পুরীর নানা মঠ ও ভক্তদের অর্থানুকুল্যে প্রস্তুত হয়। কোঠভোগ রাজা, মন্দিরের অধ্যক্ষ, আর কিছু পূজারী ও সেবক পেয়ে থাকেন। অবশিষ্ট প্রসাদ ভক্তদের অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করতে হয়। মন্দিরের বড় দেউলে তিন বিগ্ৰহকে ছয় পন্তি ভোগ নিবেদন করা হয়। স্নানযাত্রার দিন স্নানবেদীতে আরও তিন পন্তি ভোগ দেওয়া হয়। কত রকমারি সব পদ! কী বিচিত্র সব উপকরণ ও স্বতন্ত্র বৈজ্ঞানিক তার রন্ধনপদ্ধতি! শত শত বছরের বংশানুক্রমিক শিক্ষায় তা ত্রুটীহীন। দক্ষতা তাঁদের রক্তধারায়। অন্নভোগের মধ্যে থাকে ‘সুবাস পখাল', ও ‘কর্মাবাই’ খিচুড়ি। তারপর ‘পিতা' অর্থাৎ তেঁতো। শুক্তোর নাম 'ফড়িশুকতা'। এরপর ঘি ও নুন দিয়ে সিদ্ধ করা চাপানোটে(নেউটিয়া) শাক। কচুরি বা পুরি হিসাবে দেওয়া হয় ‘সরপুলি’। মালপো হল ‘তিপুরি’। আর থাকে চালের 'খুদপিতা', চালগুঁড়োর 'মধুরুচি'। ‘পাগ-আরিষা’ হল চাপাটি। সঙ্গে মিষ্টি কুমড়োর ‘কখারু-সন্তোরা'। ঘি দিয়ে খৈ ভেজে হয় ‘বল্লভ’। বিশেষ ধরণের দৈ এর নাম 'দহিকড়ি'। মিষ্টান্নর মধ্যে থাকে ‘হংসকেলি' 'হংসঝিলি', ‘খোয়ামন্ডা’, ‘সরপাপড়ি'। কী এলাহি সে কান্ড! মৃন্ময়পাত্রে সেই ভোগ নিবেদন এক বিরল দৃশ্য।
তবে জ্বর আসার পর এসব একেবারে বন্ধ। তখন শুধু রাজ-কবিরাজের ঔষধ আর পথ্য। দুধের সর আর মিছরি দিয়ে তৈরি হয় ‘মোদক’ শরবত। কর্পূর মিশ্রিত ডাবের জল হল পানীয়। পথ্য হল এলাচ দানা দিয়ে দুধসাবু। পাঁচনের নাম ‘বক্কাল’। তাতে থাকে নিমপাতা, আমলকি, হরীতকী, জায়ফল, কালমেঘ পাতা, আদা, মধু, সিদ্ধিপাতা, দারুচিনি, গোলমরিচ ও কর্পূর। গোদুগ্ধ আর গঙ্গাজলে দিয়ে তৈরী করা হয়। সঙ্গে পানীয় ডাবের জল। পনেরদিন বিচ্ছিন্ন থেকে দেবাদিদেব সুস্থ হয়ে ওঠেন। ষোড়শদিনে নব অঙ্গরাগে জগন্নাথদেব নবযৌবনসম্পন্ন। আসে রথযাত্রা উৎসব। সপার্ষদ সুসজ্জিত রথে যাত্রা করেন ‘গুন্ডিচাগৃহে', অর্থাৎ তার মাসীর বাড়ি। ‘নবরস’ আস্বাদন করে ন’দিন পর নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন। ঠাকুরের কাহিনী আর মানুষের গল্প এখানে মিলেমিশে একাকার। তাইতো পুরীর সমূদ্র স্বর্গদ্বার, আর মন্দির শ্রীক্ষেত্র।
(তথ্য সহায়তা স্কন্দপুরাণ)
-------------------------
নাম—বাণীব্রত গোস্বামী
ঠিকানা—৯/৬ ইস্ট মল রোড, দমদম, কোলকাতা—৭০০৮০
মোবাইল-৯৮৩১০৬৮৪৯৩,৬২৯১৪৯৫৮৭৯.