অনেকদিন ধরে ভাবছি গল্প লিখব। মানুষের জীবনে নানা ঘটনা ঘটে। সেগুলো শব্দের জালে জুড়ে গেঁথে ঠিক একটা গল্প হয়ে যাবে। মাথার মধ্যে অনেক তথ্য জড়ো করে খাতা আর খাগের কলম নিয়ে বসলুম।
শব্দগুলো মাথার মধ্যে এত কিলবিল করছে যে কোনটা আগে লিখি আর কোনটা পরে লিখি - ধন্দে পড়ে গেলুম। শেষে সিদ্ধান্ত নিলুম অনুগল্প দিয়ে শুরু করি। লিখতে লিখতে অনুগল্পের শব্দ সংখ্যার সীমা ছাড়িয়ে গেল। অল্প কথায় কোনোকিছু গুছিয়ে লেখা বেশ কঠিন। শব্দ সংখ্যা বাড়ছে বাড়ুক। এটাকে ছোটো গল্প বানিয়ে দেব। কিন্তু ঘটনা এ গলি সে গলি ঘুরে নালার ভিতর দিয়ে খালে গিয়ে পড়ছে। কিছুতে তাকে চৌরাস্তার মোড়ে এনে তুলতে পারছি না। বাধ্য হয়ে কাটছাঁট করতে লাগলুম।
আট-দশটি পাতা ছিঁড়ে মুড়ে গোল বলের মতো করে পাশে রাখলুম। আমার স্ত্রী ওগুলো দেখে বলল,"কাগজ ছিড়ে নষ্ট করছ কেন?" তখন গল্পের নায়ককে কদম গাছের তলায় দাঁড় করাতে চাইছিলুম। স্ত্রীর কথা কানে আসতে ঘটনাক্রম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। গল্পের নায়ক বাদাম গাছের তলা থেকে লোকলজ্জার ভয়ে সাইকেল নিয়ে পালাল। নায়িকা গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ড্রেনের মধ্যে। এবার আমার সংজ্ঞা ফিরল। সুন্দরী নায়িকাকে এভাবে জল-কাদায় ফেলে চোবানো ঠিক হলো না। বৌয়ের উপর রাগ হলো। খাতার পাতাটাকে ছিঁড়ে কুচি কুচি করে দিলুম।
আমার স্ত্রী এসে আবার বলল,"তোমার আজ কি হয়েছে? শুধু খাতার পাতা ছিঁড়ছ কেন?"
আমি বললুম,"অনু---"
আমার কথা শেষ হবার আগে সে বলল,"তুমি ছেলের পড়া খাতায় লিখছ?"
আমি কথা বাড়ালাম না। আমার ছেলে ভৌত বিজ্ঞানের অনু -পরমাণুর অধ্যায় পড়ছে। তাকে একবার বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়েছিলুম। "অনু" কথাটি শুনে আমার স্ত্রী ভেবেছে আমি তার জন্য নোট তৈরি করতে বসেছি।
এমন সময় তপন খুড়ো হাজির। এসে বসল আমার পাশে। খুড়ো বলল,"খাতায় অঙ্ক করছিস, বাবা? যতই বয়স হোক অঙ্ক চালু রাখা ভালো। অনিল এই বুড়ো বয়সেও জমি ও চৌবাচ্চার কালি নিখুঁতভাবে করে। খুব মাথা ওর।"
অনিল খুড়োর মাথার কথা ভাবতে ভাবতে আমার মাথা থেকে অনুগল্পের কাহিনী উড়ে গেল। ওনাকে তো বকাবকি করা যায় না। তাকে বললুম,"খুড়ো, গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি। একটু চুপ করো।"
খুড়ো বলল,"অঙ্ক খুব কঠিন জিনিস। আনকান হলে চলে না।"
আমি নতুন করে খাতায় ধ্যান দিলুম। তপন খুড়ো চেঁচিয়ে আমার স্ত্রীকে বলল,"বৌমা, আমাদের দু-কাপ চা দিয়ো। ছেলেটা কঠিন কঠিন অঙ্ক কষছে। এককাপ গরম দুধ-চা খেলে বুদ্ধিটা খুলে যাবে।"
তপন খুড়ো চা খাওয়ার প্রয়োজন হলে বাড়িতে এসে নানা বাহানা করে। বয়স্ক মানুষ। আমার স্ত্রী তার উপর কখনও রাগ করে না। সে খুড়োকে বলল,"তোমাকে দেখে চা বানাচ্ছি, কাকা। বসো, নিয়ে যাচ্ছি।"
-"দুটো বিস্কুট আর এক গ্লাস জল দিস, মা। ডাক্তার বলে, খালি পেটে চা খেতে নেই।"
-"সেসব নিয়ে যাচ্ছি।"
-"ছেলের জন্য জল-বিস্কুট আনিস, মা।"
-"আনছি।"
তপন খুড়ো যতই কথা বলে ততই আমার সবকিছু গুলিয়ে যায়। নায়িকার মা অনেকবার সাবধান করেছিল, এভাবে আজ-কালকার ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ভালো নয়। কখন বাপ-মায়ের কথায় পাল্টি খেয়ে যাবে! খবরের কাগজে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। খুড়োর কথার চাপে আর কিছু মনে করতে পারছি না।
এরপর চা, বিস্কুট ও জল এলো। ভাবলুম চা খেয়ে ঠান্ডা মাথায় লিখব। চা খেতে খেতে তপন খুড়ো গ্রামের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত পর্যন্ত খবর বলতে লাগল। সারাদিন এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে বেড়াত। গ্রামের সমস্ত খবর তার নখদর্পণে। গ্রামের নতুন খবর তার কাছে পাওয়া যায়। তাই তাকে গ্রামের লোক আকাশবাণীর সংবাদদাতা বলতো।
আমি যে চা খেতে খেতে একটু অনুগল্পটা সাজিয়ে নেবার কথা ভাবব, সে সুযোগ দিচ্ছে না খুড়ো। অনর্গল খবর আওড়ে যাচ্ছে। কার ছেলের অসুখ, কার মেয়ের বিয়ে, কে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি -একপ্রস্থ বলে গেলেন। আমি খুড়োকে কিছু বললুম না। খুড়ো বয়স্ক মানুষ।
চা খাওয়া শেষ হতেই খুড়ো চেঁচিয়ে বলল,"এখন আসি বৌমা। আবার কাল আসব।"
আমার স্ত্রী বলল,"আর একটু বসে যাও কাকা। একটু পরে আর একবার চা করে দিচ্ছি।"
খুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে বলল,"না না বৌমা, ছেলের অঙ্ক ভুল হয়ে যাচ্ছে। কাল এসে চা খেয়ে যাব।"
আমি মনে মনে বললুম-যা তো বাপ। বেশি বকিস না। আমার মাথা ধরে গেল।
তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমার স্ত্রী সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে শাঁকে ফুঁ দিল। আমি আমার ইস্ট দেবতার নাম স্মরণ করে একটা প্রণাম ঠুকলুম। তাতেও গল্পের দরজা খুলে গেল না। অগত্যা ছিঁড়ে মুড়ে গোল করা কাগজগুলো খুঁজতে লাগলুম।"কী আশ্চর্য! কাগজগুলো কি ডানা মেলে উড়ে গেল?" আপন মনে বললুম আমি।
আমাকে তৎপর দেখে আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল,"কি খুঁজছ?"
-"এখানে কতকগুলো কাগজ রেখেছিলুম সেগুলো কি হল?"
-"বলের মতো গোল গোল করা? লেখাগুলো কাটাকুটি করা?"
-"কাটাকুটি তাতে কি? কাগজগুলো কোথায়?"
-"ওগুলো পুড়িয়ে আমি চা করেছি।"
-"তোমার কি কোন কাণ্ডজ্ঞান আছে? ওগুলো কত দামি কাগজ তুমি জানো?" মাথায় হাত দিলুম আমি।
-"বারান্দায় আবর্জনা দেখে আমি পুড়িয়ে দিয়েছি। দামি কাগজ হলে তুমি ওগুলো গোল্লা পাকিয়ে ফেলে দিতে?"
-"আমি ওতে গল্প লিখেছি।"
-"গল্প লিখে কেউ ফেলে দেয়?"
-"ওটাই তো ভুল হয়েছে। এখন আর মনে করতে পারছি না?"
-"তুমি কি লেখক যে গল্প লিখবে?"
-"বাজে কথা বোলোনা। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। কত আশা ছিল একটা গল্প লিখে কাগজে পাঠাব। কাগজে ছাপলে তো পাড়ায় বলতে পারতে আমার স্বামী লেখক।"
আমার স্ত্রী বুঝলেন, আমি তেতে গেছি। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাছে এসে বসল। তারপর সে বলল,"এক কাজ করো, তুমি আমাকে নিয়ে, নয়তো তোমাকে নিয়ে একটা গল্প লেখ।"
আমি মাথা চুলকে বললাম,"তুমি মন্দ বলোনি। কিন্তু ঘরের খবর বাইরে বের করা কি ঠিক হবে?"
সে বলল,"তাহলে তপন কাকাকে নিয়ে লেখ।"
আমি বললাম,"বেশ বলেছ। এই না হলে তুমি আমর অর্ধাঙ্গিনী!"
"ন্যাকামো আর ধরে না।" বলে সে উঠে গেল।
আমি খচ্ খচ্ করে লিখতে শুরু করলাম। তপন কাকার বৃহৎ জীবন। লিখে শেষ করা যায় না। আবার ছয়খানা কাগজ গোল্লা পাকিয়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে শুরু করলাম। কেটে ছেঁটে দুশো শব্দে গল্প বেঁধে ফেলা গেল। কিন্তু দেড়শো শব্দের মধ্যে লিখে ফেলতে হবে।
সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে গল্প লিখন শিখেছি। সূত্র দেওয়া থাকত। একশত শব্দে গল্প লিখতে হতো। সত্তর পেরোলেই আমার অভিধানের সব শব্দ ফুরিয়ে যেত। কিভাবে যে বাংলায় পাশ করেছিলুম, তা একমাত্র মা সরস্বতী জানে।
এমন সময় আমার স্ত্রী এসে বলল,"রাত এগারোটা বাজে। ভাত খাবে চলো।"
আমি হতবাক হয়ে বললুম,"বলো কী! দুশো শব্দ লিখতে রাত এগারোটা।"
-"লেখা যখন শেষ হয়েছে, তখন খেতে চলো।"
-"এখনো শেষ হয়নি। দেড়শো শব্দে লিখতে হবে।"
"তুমি এবার ভাব কি করবে। আমি ছেলে-মেয়ের খেতে দিই।" বলেই সে চলে গেল।
আমি মনে মনে বললুম, আগে যা। নয়তো আমার লেখা শেষ হবে না।
হঠাৎ হাই স্কুলের ব্যাকরণ শিক্ষকের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি কান মলে দিয়ে আমাকে সন্ধি, সমাস ও বাক্য সংকোচন শিখিয়েছিলেন। সেই বিদ্যে কাজে লাগিয়ে কাটাকুটি করে একশত ষাটটি শব্দে গল্পটি শেষ করলুম। এরপর কলম চালালে গল্পের বড় অঙ্গহানি হবে। অতএব থামলুম।
পরদিন গল্পটি ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলুম এক পত্রিকা সাম্পাদকের কাছে।
ঠিক দুমাস পরে পিয়ন এসে একটি লেখকের সৌজন্য সংখ্যা দিয়ে গেল। আমি সাগ্রহে পত্রিকার পাতা উল্টে যাচ্ছি। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না আমার লেখা গল্প। শেষে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লুম। আমর স্ত্রী আমার অবস্থা দেখে সামনে এক গ্লাস জল ধরল। আমি নিমেষে জলটুকূ সাবাড় করে হাঁপাতে লাগলুম । আমর স্ত্রী জিজ্ঞেস করল,"তুমি হাঁপাচ্ছ কেন?"
আমি উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিলুম,"হাঁপাব না! পত্রিকা অফিস সৌজন্য সংখ্যা পাঠিয়েছে। অথচ আমার লেখা গল্প পাচ্ছি না।"
-"সূচিপত্র দেখেছ?"
-"না।"
-"আগে দেখ।"
আমি তাড়াতাড়ি সূচিপত্র খুলে ফেললুম। দুবার চোখ বুলোনোর পর তৃতীয়বারে খুঁজে পেলুম আমার গল্প। পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখে বইয়ের ভিতরে ঢুকলুম। আমার গল্পের পৃষ্ঠা জোড়া। কাটাইয়ে বাদ পড়ে গেছে। উত্তেজনায় চেঁচিয়ে বললুম,"তাড়াতাড়ি ব্লেড নিয়ে এসো।"
আমার চিৎকার শুনে সে ব্লেড নিয়ে এসে বলল,"চেঁচাচ্ছ কেন?"
-"আমার গল্পটা চাপা পড়ে গেছে। তাকে উদ্ধার করতে হবে।"
-"কিভাবে?" সে ব্লেডটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি জোড়া পাতা কেটে দিতেই বেরিয়ে এলো সেটি। আমার স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে সরবে পাঠ করলুম আমার গল্প। শুনে আমার স্ত্রী বলল,"ভালো হয়েছে।"
নিজের বৌয়ের মুখে প্রশংসা শুনলে কোন পুরুষের না ভালো লাগে!
আজ তপন খুড়োকে বিস্কুট-জল-চা খাওয়াতে খুব ইচ্ছে করছে। তার জন্য আজ আমি গল্পকার। খুড়ো সে সুযোগ আমাকে দিল না। বিশ দিন আগে খুড়ো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। তাকে খারাপ কথা বলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলুম।
আমি মনে মনে তপন খুড়ো আর আমার স্ত্রীর নামে গল্পটা উৎসর্গ করে দিলুম।
---------------------------
হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
গ্রাম ও পো- আমতলা,
থানা-ক্যানিং,
জেলা-দক্ষিণ ২৪ পরগনা,
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ,
পিন নং-743337
মোবাইল নং- +91 9733702450
হোয়াটস অ্যাপ নং-+91 9733702450