কদিনের বৃষ্টিটা যেন সবাইকে একদম পচিয়ে মারছিল। ঘরে বেশিক্ষন সময় শুয়ে বসে গল্পের বই পড়ে আর কাঁহাতক থাকা যায়। মাঝে এক আধদিন বেরিয়ে সৌম্য আর বিশ্বরূপের সাথে দেখা হয়েছিল বড় রাস্তার মোড়ে বাবলার। তাও আবার টিপটিপে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় করে। আডডাটা একদম জমেনি। হঠাৎ করে মুষল ধারায় বৃষ্টি নামাতে বাড়ী ফিরতে হয়েছিল। ভাল্লাগে না আর। আকাশটা যেন একদম ফুটো হয়ে গেছে। সৌম্য ও বিশ্বরূপ আবার খুব পড়ার তাড়া। কিসের এত পড়ার নেশা কে জানে। এই তো সবে বি কম ফাইনাল দিলি। কবে রেজাল্ট বেরোবে তার নেই ঠিক। এই সময়টায় কোথায় একটু ঘুরে বে্রিয়ে আডডা মেরে বেড়াবি তা নয়। মনে হয় সারাদিন মুষল ধারায় বৃষ্টি হলে খুব আনন্দ হয় ওদের , তাহলে সারাদিন পড়াশোনা করতে পা্রবে। যত্ত সব। বাবলা যেন নিজেকেই ধিক্কার দিল। মনে মনে ভাবে এইতো আমি হায়ার সেকেন্ডারিতে একবার ফেল করে তারপর আবার বি কম ফাইনাল টাও দুবার দিলাম, তবে?
কৈ আমি তো পড়ার জন্য তোদের মত হ্যঙলামি করি না।
আজকে দুপুরে হঠাৎ আকাশ পরিস্কার হয়ে রোদ উঠেছে ভারি সুন্দর। বাবলা দুপুরে একটা ছোট্ট ভাত ঘুম দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে একটু এদিক ওদিক পায়চারি করে মায়ের হাতের গরম গরম লুচি আর বেগুন ভাজা তার সাথে এক কাপ চা খেয়ে বেশ একটা মেজাজ এলো।
তারপর সেজেগুজে বেরিয়ে পড়লো। বড় রাস্তার মোড়ে এসে খানিক দাঁড়ালো। তারপর সাবধানে রাস্তাটা পেরিয়ে একেবারে পার্কের ভিতরে ঢুকলো।
বিকেলের পার্ক তার ওপরে সুন্দর আবহাওয়া। ছোট বড় বাচ্চারা হৈ হৈ করে পার্কটাকে মাতিয়ে রেখেছে। কেউ ঢেকুচ কুচ্, কেউ দোলনা, কেউ কেউ আবার স্লিপে চড়ে উঠছে আর নামছে। কেউ কেউ আবার বল নিয়ে ছুটোছুটি করে খেলছে। অনেকদিন পড়ে একটা আনন্দের ঢেউ মেখে নিয়েছে যেন পার্কটি। কয়েকদিনের মলিনতা ঝেড়ে ফেলে বহুজন এসে সামিল হয়েছে এই পার্কটিতে। বাবলা এইসব দেখেও দেখলো না। পার্কের ভিতরে গোল করে পিচের রাস্তা। ও এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বাঁ দিকের কোনের বেঞচটার কাছে এসে দেখে বিশ্বরূপ ও সৌম্য মাঝখানে একটা বাদামের ঠোঙা থেকে মন দিয়ে বাদাম চিবোচ্ছে। বাবলাকে দেখে সৌম্য বলে ওঠে, 'আরে এসো বাবলাদা তুমিও বসে পড়।' বাবলা বলে, 'কোথায় বলবি এসো বাবলাদা,এই নাও চাউমিন বা বিরিয়ানি খাও তা না বাদাম। নে সরে বস একটু বসতে দে'। সৌম্য বলে, 'দেখ বাবলা দা এইখানে এসে তোমাকে চাউমিন বিরিয়ানি কে এনে দেবে? এইখান দিয়ে একটা বাদাম ওয়ালা যাচ্ছিল তাই ডেকে কিনলাম'। এবার বিশ্বরূপ বললো, ' জান বাবলা দা পার্কে বসে বাদাম ভেঙে খাওয়া একটা চিরকালিন মজা আছে, তুমি তার কি বুঝবে'?
বাবলা, 'কি আমি বুঝিনা ভাবছিস খুব বুঝি। একবার তো কাশ্মীরে এই বাদামের জন্য ভাল্লুকের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম বুঝলি'। সৌম্য বলে, 'তুমি আবার কবে কাশ্মীর গিয়েছিলে কৈ আগে তো কখনও বলোনি। স্বপ্নে নয় তো'? বাবলা, "গিয়েছিলামরে গিয়েছিলাম, তোরা কি জানিস। আমিতো তোদের মত অতো ভাল ছেলে নয় যে কলেজ আর পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু বুঝিনা"। এবার
দুজনেই একসাথে বলে ওঠে, "তাহলে শুনি তোমার কাশ্মীরের গল্প আর কি ভাবেই বা তুমি ভাল্লুকের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলে"? বাবলা, 'এমনি এমনি হয়না তার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয় আর তার জন্য লাগে আরো বাদাম, দেখছিস্ না এটা শেষ হয়ে গেছে। যা নিয়ে আয়। বাদাময়ালা গেটের বাইরে আছে আমি দেখেছি'।
বিশ্বরূপ উঠে পড়লো, 'ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি' বলেই চট্ করে বেরিয়ে গেল আর মিনিট সাতেক পরে ফিরে এসে বড় একটা বাদাম ভর্তি ঠোঙা বাবলার হাতে দিয়ে বলল, 'এই নাও বাদাম আর শোনাও তোমার কাশ্মীরের গল্প'। বাবলা, 'বলছি বলছি দাঁড়া আর শোন এটা কোন গল্প নয় সত্যি ঘটনা। বিশ্বাস না করলে আমার মাসতুতো দাদা সমরদাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখিস
সে আবার মাউন্টেয়ারিঙ ইনস্টিটিউটের সদস্য। প্রতি বছর কিছু লোক নিয়ে ট্রেক করে হিমালয়ে।' মাঝখানে সৌম্য বলে ওঠে, 'আরে এতো দারুন ব্যপার। তারপর'?
বাবলা, 'একদিন সমরদা আমাদের বাড়ীতে এসে গল্প করতে করতে, মানে ট্রেকিং-এর গল্প আরকি, হঠাৎ আমাকে বলে কিরে বাবলা এবার আমি একাই কাশ্মীর যাচ্ছি , যাবি নাকি আমার সাথে ট্রেকিংটা শিখিয়ে দেবো'। আমরা সবাই অবাক হয়ে দাদার গল্প শুনছিলাম তার মধ্যে হঠাৎ এই কথা বলাতে আরও সবাই অবাক হয়ে গেলাম। বাবা বললো, 'সেকি সমর এইতো মাস ছয়েক হলো সানদাকপু ফালুট ঘুরে এলে এর মধ্যেই আবার কাশ্মীর?' সমরদা বলে,'তাতে কি, বাবলাটাকে এইবার ট্রেকিং শেখাব, কিরে
বাবলা পারবি না?' আমি বললাম, 'অবশ্য'। কিন্তু মা বললো, 'দেখ সমর, ওকি পারবে?' তাই শুনে সমরদা
বললো, 'কিচছু চিন্তা করোনা দিদি, ওকে আমি সহজ পথে নিয়ে যাবো।' একদমে কথাগুলো বলে বাবলা এবার একটু থামলো।
পার্কে সন্ধ্যা নেমেছে। ছোটরা ঘরে ফিরে গেছে। নেইকোলাহল। শান্ত পরিবেশ। বাবলা বাদাম চিবোতে চিবোতে পার্কের চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে পুরো আকাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর একটুঅন্যমনস্ক ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বললো 'তারপর একদিন আমি আর সমরদা দুজনে দুটো কাঁধে ব্যগ ঝুলিয়ে সকালে জমবু-তাওয়াই এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। সিটে বসে সমরদা বললো, 'রিটারন টিকিট কিন্তু কাটিনি, যেদিন ইচ্ছে হয় সেদিন ফিরবো। পিছুটান আমার পছন্দ না বুঝলি। কথাটা বাড়ীতে জানিয়ে দিস।
হঠাৎ কোত্থেকে তিন চারটে কুকুর এসে আমাদের সামনে এসে মারামারি কামড়াকামড়ি করে চিৎকার জুড়ে দিল। পার্কের শান্তি হঠাৎ মাথায় উঠলো। বিরক্ত হয়ে বাবলা বললো, ' যাচচোলে, এরা দেখি একেবারে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু করে দিল। সবে ভাবটা এসেছিল দিল সব মাটি করে। এগুলোকে এখুনি এখান থেকে তাড়া'।
বিশ্বরূপ একটা আধলা ইট হাতের সামনে পেয়ে দিল একটার দিকে ছুঁড়ে। কেউ কেউ করে ওরা রণেভঙ্গ দিল। শান্তি ফিরে এলো পার্কে।
'তারপর কিহলো বাবলাদা?' সৌম্য জিগ্গেস করে। 'কি যেন বলছিলাম, হ্যা, শ্রীনগর পৌঁছে আমরা ঝিলমের ওপর একটা হাউস বোটে উঠলাম। সমরদা বললো, ঝিলমের হাউসবোটে উঠলাম কেন জানিস? কারন এখানকার চকবাজার থেকেই সবদিকে যাবার বাস ছাড়ে
আর ফেরে। এখানকার আপেল, আখরোট খুব সস্তা।সা্রাদিন আমাদের এই ফলের ওপরেই ভরসা করে থাকতে হবে। এছাড়া এখানকার হোটেলে খাবার খরচ, হাউসবোটের ভাড়াও ডাল লেকের তুলনায় কম'।
হাউসবোটের মালিক আব্দুল আর তার ছেলে ইরফান খুব যত্ন করে আমাদের হাউসবোটে এনে তুললো। দুজনেই বেশ লম্বা ফর্সা অত্যননত সুপুরুষ।
ব্যবহা্রেও খুব বিনয়ী। সেই সময় পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত ছিল। এই বোটে আমরা কটা দিন ছিলাম। বাপ ছেলের ব্যবহার আমাদের খুব মুগ্ধ করেছিল। ওদের জন্য আমাদের কোন অসুবিধায় পড়তে হয়নি। আমরা মাঝে সাতদিন ছিলাম না, ভা্রি মালপত্রগুলো ওদের জিম্মায় রেখে গিয়েছিলাম। পরে শ্রীনগরে ফিরে ওদের হাউসবোটে আবার তিনদিন ছিলাম। মালপত্রগুলো একদম ঠিক ঠাকই ছিল।
যাই হোক বেশ ছিলাম কদিন। সকাল সাতটার আগেই হাউসবোট থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে দোকানের গরম গরম নানা রকমের পরটা দিয়ে মুখরোচক চাট সহযোগে গলধ:করন করে নিতাম। সে
খাবার এতো সুস্বাদু যে তোদের কি বলবো। তারপর রাস্তার উল্টো দিকে থরে থরে সাজানো হরেক কিসিমের আপেল আর আখরোট ব্যাগে ভরে নিতাম। ওখানে আপেল খুব সস্তা। কত রকমের তাদের নাম যেমন আমরি, আমেরিকান, রাজা ইত্যাদি। সব চেয়ে সুস্বাদু আমরি বা আমিরি। আকারে ছোট কিন্তু ভারী সুস্বাদু , দামো বেশি। আমরা প্রতিদিন এক কিলো ঐ আপেল আর হাফ কিলো আখরোট কিনে নিয়ে বাসে উঠতাম।
সারাদিন সেই খেয়ে আর যেখানেই চা পেতাম একটু বেশী করে খেয়ে নিতাম। সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে বাস ছেড়ে দিত। ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আটটা কি নটা।
চকের কোন হোটেলে রাতের ডিনার সেরে ফিরতাম হাউসবোটে। খুব ভোরে মসজিদের আজান শুনে ঘুম ভাঙতো। এমনি করে আমরা গুলমারগ, খিলেনমারগ,শোন মার্গ, উলার লেক বেশ ভাল করে দেখে নিলাম। অবশেষে আমাদের যুশমারগ ভ্রমণ।
প্রতিদিনের মত আমরা সকালের নাস্তা খেয়ে আপেল আর আখরোট ঝোলায় পু্রে বাসে গিয়ে উঠলাম। পনেরো মিনিটের মধ্যে বাস ছাড়লো। শ্রীনগর পেরোতেই বাস অন্য রাস্তা ধরলো। ডান বাম দুদিকেই শুধু পাহাড় আর পাইনের জঙ্গল, বাস একবার বাম দিক আর একবার ডান দিক বেয়ে উঠতে লাগলো। একদিকে পাহাড়তো অন্যদিকে গভীর খাদ। চারিদিকে নৈসর্গিক দৃশ্যের কোনো তুলনা হয়না। দুরে পাহাড়ের মাথায় বরফের চূড়াগুলো সূর্যের আলো পড়ে সোনালী রঙ মেখেছে। দেখতে দেখতে চলেছি মনের আনন্দে। হঠাৎ বাসটা বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে ছোট্ট একটা উপত্যকায় উঠে পড়ে ছবির মত একটা বাংলোর কাছে এসে দাঁড়াল।
বাস থেকে নেমে চতুর্দিকের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। উঁচু নিচু হয়ে উপত্যকাটা পাইন, ফার আর চিনার গাছ দিয়ে ঘেরা এক অনিন্দ্য সুন্দর জায়গা। সমরদা বললো, 'চল বাংলোর বাইরে একটা রঙিন ছাতার নিচে বসে কফি খেতে খেতে ভেবে দেখি কোনদিকে যাওয়া যায়। আমাদের আগে আরো একটা বাস এসেছে।
তাদের কেউ কেউ অন্য ছাতাগুলো দখল করে ব্রেকফাস্ট সারছিল। কেউ কেউ বাংলোর ভেতরে খাওয়া দাওয়া করছিল। শান্ত উপত্যকাটা মৃদু কোলাহলে ভরে গেছে।
অদুরে কিছু ঘোড়াওয়ালা তাদের ঘোড়াগুলো নিয়ে খদ্দের ধরার জন্য হাকিহাকি করছে। সমরদা তাদের দিকে হাত নাড়তেই দুজনে ঘোড়া নিয়ে হাজির। ওদের মধ্যে একজন আবার খুব ছোট। বড়জন সমরদাকে জিগ্যেস করলো, 'যাইয়েগা বাবু ঘুমনেকে লিয়ে?' 'কাহা লে যাওগে ঘুমনেকে লিয়ে?' সমরদা জিগ্যেস করলো। সে বলে, 'বাবু পহলে দুধগঙগা বাদমে একদম নজদিগসে পীর পাঞ্জাল রেঞ্জ'। 'কিতনা টাইম লাগেঙগে ?এহি বসমে হাম দোনোক শ্রীনগর ওয়াপস যানা হ্যয়'। 'হা সাব ও হামকো মালুম হ্যয়। দুধগঙগা এহি সামনে লেকিন পীর পাঞজাল থোড়া দুর হ্যয়। তবভি আপ ইয়ে বস ছুটনেকে পহলে পৌঁছা যায়েঙগে'।
ঠিক এই সময় বাংলোর ভেতর থেকে এক উর্দিধারী লোক দু কাপ কফি টেবিলে নামিয়ে দিয়ে গেল। সমরদা বললো, 'আয় বাবলা কফি খেয়ে গাটা গরম করেনি, যা শীত এখানে। এরপর ঘোড়ায় চড়া যাবে'।
কফি খেয়ে আমরা দুজনে দুটো ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। ঘোড়াগুলো চলতে লাগলো লাগামগুলো মালিকদের হাতে, ওরা হেঁটে যাচ্ছে। অচীরাৎ আমরা দুধগঙগায় পৌছে গেলাম। নদীর নাম জানিনা কিন্তু স্রোত আছে। দুধগঙগা স্থানীয় নাম। আমার একটুও মনে হলোনা যে নদীর জল সাদা, ঘোলাটে ভাবটা কম এই যা।
এইবার ঘোড়ার মালিক সমরদাকে বললো, ' বাবু আভি মেরা লেড়কা আপলোগোকো পীরপনজাল দিখানেকে লিয়ে যায়েঙগে। যাইয়ে উনকে সাথ পীর পাঞ্জাল দেখকে আইয়ে আরামসে'। আমরাতো অবাক। নিতান্তই চিন্তিত হয়ে সমররদা বললো, 'কিউ আপ নেহি যায়েঙগে ক্যয়া?'
নেহি বাবু হাম নেহি যা পায়েঙগে, আপলোগোকো ঘুমানেকে লিয়ে মেরে লেড়কা কাফি হ্যয় সাব'। 'ঠিক হ্যয় আপ নেহী যায়েঙগে তো হামলোগভি নেহি যায়েঙগে'।
'নেহি বাবুজি ইয়ে মেরে লেড়কা ট্যুরিসট লোগোক লেকে একেলাহি ঘুমাকে লেয়াতে। আপকো কৈডর নেহি , আপ উনকো সাত যাইয়ে, মেরে লেড়কা দো ঘোড়ে সামহালকে আপলোগোক আরামসে পীরপাঞজাল দিখাকে লে আয়েঙগে। যাইয়ে যাইয়ে।'
অগত্যা আমরা যাত্রা শুরু করলাম। ছেলেটা খুব লাইভলি। দুপাশে দুটো ঘোড়া নিয়ে লাগাম টানতেই ঘোড়া দুটো ছুটতে লাগলো। ছড়ীটা কোমরে গুঁজে চল হ্যট হ্যট করে ঘোড়া দুটোকে তাড়িয়ে নিয়ে চললো। ঘোড়া দুটো কখনো জোরে আবার কখনো আস্তে আস্তে চলতে লাগলো। ছেলেটিও ছুটতে ছুটতে ওদের ভাষায় হৈ হৈ করে গান গাইতে লাগলো। একসময়ে ছূটতে ছুটতেই আমাদের জিগ্যেস করে , ' বাবুজি আপলোগ বঙ্গাল সে আয়ে হ্যয় ক্যয়া'? আমরা হ্য বলাতে উৎসাহিত হয়ে বলে,'বঙগালসে সবসে জ্যদা ট্যু্রিসট লোক।ইধার আতে হ্যায় হরসাল ঘুমনেকে লিয়ে, কলকাততা সেভি বহুত বঙ্গালি আতা হ্যায়।' আব্বাজান বলতে বাঙ্গালীলোক বহৎ আচ্ছে হতে।' সমরদা বলে, ' কাশ্মীর য্যয়সা, বঙ্গাল উসি তরহা এক রাজ্য আর উসিকে অন্দর শ্রীনগরকা মাফিক য্যয়সা শহর, কলকাততা উসিকা তরহা বঙ্গাল কা এক শহর সমঝা'? ও মাথা নেড়ে বলে, ' হা বাবু আবভি সমঝা।'
হঠাৎ আমার ঘোড়াটা ওর হাত ছাড়িয়ে ডানদিকে দৌড়ে গিয়ে খাদের কিনারায় গিয়ে সামনের পাদুটো খাদে নামিয়ে ঘাস খেতে লাগলো। ভয়ে আমার প্রাণ শুকিয়ে যায় আরকি। ওদিকে আমার মাথার উপরকার গাছের বাঁদর গুলো লাফালাফি আর কিচ্ কিচ করে আমাকে ভ্যঙচাতে লাগলো। ছেলেটি দৌড়ে এসে ঘোড়ার লাগাম ধরে এক টানে মুখে অদ্ভুত রকম আওয়াজ করে ওকে
ফিরিয়ে আনলো। ততক্ষণে সমরদার ঘোড়াটা উল্টোদিকে ঘাসের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। ছেলেটি ঐ
একি কায়দায় ঘোড়াটাকে ফিরিয়ে আনলো। তারপর ঘোড়াদুটোকে দুঘা কষিয়ে দিয়ে বললো,'বদমাসি হোতা
হ্যায় ক্য বাবুলোগ ক্যয়া সমঝ্ পায়েঙগে? ঠিকসে চলো'।
হ্যাট হ্যাট করতে করতে আবার ঘোড়া দুটো নিয়ে দৌড়তে
শুরু করলো। সমরদা বললো, 'দেখেছিস বাবলা ঘোড়াগুলোকে কি রকম ট্রেনিং দিয়েছে। এইটুকু ছেলের
কি রকম বাধ্য। কোন ভয় পাসনা'। আমি বলি, 'ভয় পাবনা
কি গো, হঠাৎ আমাদের নিয়ে যদি খাদে নেমে পড়ে তবে কি হবে। ঘোড়াদেরতো জঙ্গলে কোন ভয় নেই নেমে গেলে ই হলো। তার ওপরে তো গাছে গাছে কত বাঁদর দেখেছ কি রকম ভ্যাঙচাচছে সব সময়'। কথা শুনে ছেলেটি বলে,'আপলোগ বন্দর বলতে হামলোগ পনজু বলতে'।
তার পরেই হৈ হৈ করে গান জুড়ে দিল।
অবশেষে আমরা স্পটে পৌছালাম। ওহোহো, কি এক অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য। আগে কোনদিন এরকম দৃশ্য
দেখিনি। একেবারে সামনাসামনি গোটা উত্তর দিকে, একদম বাম দিক থেকে একেবারে ডান দিক পর্য্যন্ত বিস্তৃত তুষার শুভ্র পীর পানজাল রেঞ্জ সোজাসুজি দাঁড়িয়ে। দুপু্রের রোদে ঝকঝকে অভ্র রঙ আর কোন কোন জায়গায় হালকা সোনালী রঙ মেখে ধ্যানগমভীরহয়ে আছে। কি প্রচন্ড গৌরবান্বিত তার উপস্থিতি। চোখ আর যেন ফেরেনা আমাদের। আবেগ তাড়িত হয়ে আপন মনে বলে উঠলাম, 'ফিরতে ইচ্ছে করছেনা একদম'। সমরদা বলে, 'কিনতু ফিরতে তো হবেই। দেখছিসনা কি রকম কন কনে ঠান্ডা বাতাস বইছে
রোদ পড়ে গেলে এখানে দাঁড়ান যাবেই না'।
এবার ফেরার পালা। ছেলেটিও তাড়া লাগাচ্ছে। অগত্যা শেষ বারের মতো একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে
ঘোড়ার উপর গিয়ে উঠলাম। ঘোড়াও চলতে লাগল।
সমরদা ছেলেটাকে জিগ্যাস করলো, 'ইধার দেখতা হ্যয়
বহৎসা জঙ্গল, শেরতো নেহি হ্যায় ইধা্র?' কিন্তু ছেলেটা যা বললো শুনে আমার পিলে চমকে গেল। বললো,'নেহি
সাব শের বহৎ পহেলে থা। লেকিন আভি নেহি হ্যায়। লেকিন ভললু হ্যায় ইধার নিকালতে কভিকভি জঙ্গলসে।'
আমারতো ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। আগে জানলে আমি
কখনো এ পথে আসতাম না। রেগে গিয়ে বললাম, 'পহেলে কাহে নেই বাতায়া?' বলনেসেতো আপলোগ নেহি আতে'। রাগে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। মনে হলো নেমে
গিয়ে আচ্ছা করে ওর কান দুটো ডলে দি। সমরদা বললো, 'দেখেছিস বাবলা এইটুক ছেলে কি ধুরন্ধর,। এর
পর ছেলেটিকে জিগ্যাস করলো, 'এই ভললু আকে ক্যয়া
করতা?' 'আপলোগকো কৈ ডর নেহি বাব, ভললু আদমী
লোককো কুছ নেই করতে, লেকিন জেনানা হোনেসে বহুত মুশকিল'। 'কিউ জেনানা হোনেসে ক্যয়া হোতা?'
'উনকো মরজি সাব'। 'কিসকো মর্জি ভললু না জেনানা?'
'ভললু সাব'।' ক্যয়া করতা উনহে?' 'জেনানাকো বার '' দেতা' 'দেখেছিস বাবলা এ ভাঙেতো মচকায় না। মহা
হারামজাদা ছেলে। দেখছিস কোন গান গাইছে না, প্রায়
কোন কথা বলতে চাইছেনা। নে ঝোলা থেকে আখরোট
বার কর যা হবার হবে।'
ঝোলা থেকে আখরোট বার করলাম কতকগুলো
তারপর যেই সমরদাকে দিতে গেছি, মুখ ঘোরাতেই চোখ চড়কগাছে উঠে গেল। সমরদা আমাকে দেখে অবাক হয়ে জিগ্যাস করলো, 'কিরে কি হলো?' আমার
মুখ থেকে খালি বেরলো, ' ভা ভা ভা' । সমরদা আমার
দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখে একটা রোমশ কালো ভাল্লুক
খাদের নিচের জঙ্গল থেকে উঠে এসেছে। তারপর মাথা
দুলাতে দুলাতে আর মাঝে মাঝে হা করে আমাদের দিকে
এগিয়ে আসছে। সমরদা চিৎকার করে উঠলো,'বাবলা
হাতের আখরোটগুলো ছুঁড়ে মারে ভাল্লুকের দিকে'। আমি
তৎক্ষণাৎ ওগুলো ছুঁড়ে দিলাম ভাল্লুকের দিকে। ভাল্লুক হেলতে দুলতে আসতে আসতে সেগুলো কুড়িয়ে মুখে
পু্রতে পুরতে একগাদা থুতু ছিটিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো। আমি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে খুব চোট
পেলাম। মাথাটা ঝন ঝন করে উঠতেই ভয়ে চোখ বন্ধ
করলাম। মার মুখটা মনে পড়লো। বাবাগো বলে চোখ
বুজলাম। কলকাতার ছেলের এই অচেনা জায়গায় শেষ
পর্যন্ত ভাল্লুকের হাতে মৃত্যু, ছিঃ ছিঃ। তারপর আর কিছু
মনে নেই।
কতক্ষন জানিনা অনেক দুর থেকে কে যেন আমায়
ডাকছে। 'এই বাবলা উঠে পড় খুব বেঁচে গেছিস তুই , ভাল্লুক চলে গেছে অনেকক্ষণ। আমরা এখন দুধগঙগার
ধারে'। চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ভগবানকে
অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে মনে মনে বললাম তুমি আছ হে ভগবান, তোমার জন্যৈ আবার কলকাতায় ফিরতে পারবো। ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলৃলাম,' জল এলো কেন আমার গায়ে? কোমড়টাও তো বেশ ব্যথা'।
মনে পড়লো, ভাল্লুকটা আমায় ধাক্কা দিয়ে ঘোড়া থেকে
ফেলে দিয়েছিল। 'নে বাবলা এখানে এই গাছটার আড়ালে জামাটা আর প্যনটা পাল্টে এই জামাটা আর
পাজামাটা পড়ে ফ্যল। ভাগ্যিস কাঁধের ব্যগে এইগুলো
ছিল কিন্তু সোয়েটার দিতে পারলাম না। তার বদলে এই
শালটা গায়ে দিয়ে চল বাসে গিয়ে উঠি। বাস ছাড়ার
সময় পার হয়ে গেছে।' কিন্ত সমরদা ভাল্লুকটা আমায় ছেড়ে দিল কেন? আমি তো ভেবেছিলাম ভাল্লুকটা আমায় মেরে ফেলেছে'।
সমরদা বললো, 'আরে ভাল্লুকটা তোকে মারার উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি, আখরোট গুলো খেয়ে ও বুঝতে পেরেছিল যে তোর কাঁধের ব্যগে অনেক আখরোট আছে। হয়তো দেখেছেও তোকে ঐ ব্যগটা থেকে আখরোট বার করতে । তাই তোর কাছে গিয়েছিল ঐ
ব্যাগটা নেবার জন্য। কিন্তু তুই ভয়ে শক্ত হয়ে যাওয়াতে ব্যগটা তোর সঙ্গে কিভাবে আটকে ছিল। একটানে তোর
কাছ থেকে ব্যগটা নিতে গিয়ে ওর ধাক্কা লেগে তুই পড়ে যাস। তুই যদি ওটা ছুঁড়ে দিতিস ভাল্লুকের দিকে তাহলে ও
কিছু করতোনা তোকে। ঐ ব্যগটা পেয়ে ও হেলতে দুলতে
যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই চলে গেল। আর আমরা
তোকে আবার ঘোড়াতে তুলে অসামান্য দক্ষতায় এই
ছেলেটা তোকে দুধগঙগার ধারে নিয়ে এসে তোকে সুস্থ করে তুললো। জানিস আমাদের এই দুর্দশার কথা শুনে
ওর বাবা কিছুতেই আমার কাছ থেকে টাকা নিতে চাইছিলনা। আমি জোর করে ছেলেটার হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়েছি'। আমরা উঠতেই বাসটা ছেড়ে দিল।
একদমে পুরো ঘটনাটা বলে থামলো বাবলা। বললো,
বুঝলি বিশ্ব যখন 'বাদাম খাওয়া চিরকালীন' কথাটা বললো তখনি আমার সেই ঘটনার কথা মনে পড়লো।'
সৌম্য বললো, 'আর এই বাদামের জন্য তোমার মত
একজনকে আমরা আমাদের মধ্যে পেলাম। থ্রি চিয়ার্স
ফর বাবলাদা'। 'নে চল চল দেখেছিস আকাশটা কি রকম লাল হয়ে গেছে এই নামলো বলে'। বাবলা তাড়া দেয়।
চটপট সবাই উঠে পড়লো। পার্কে কেউ নেই আর। ঐ কুকুরগুলো পর্যন্ত ধা্রে কাছে কোথাও নেই। চটপট ওরা পার্কের গেট পেরিয়ে বাড়ীর পথ ধরলো।
----------------------------